ইয়াজিদ বাহিনী কি ‘হাররাহ যুদ্ধে’ গণধর্ষণ করেছিলো?

কালকে একটা পোস্ট খুব করে ভাইরাল হলো না? ইয়াযীদ কতৃক মদীনা আক্রমণের ‘হাররাহ যুদ্ধ’ নিয়ে? এই পোস্টটা কয়েকজন আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখেই বিরক্তিতে মন তেতো হয়ে গিয়েছিলো। শিয়া ন্যারেটিভে লেখা। ভাবলাম ভদ্রলোক শিয়া কী-না, গিয়ে দেখি ওমা সুন্নী পার্সপেক্টিভ বলে চালাচ্ছে। আচ্ছা, দু’কলম লিখি তাহলে।

প্রথমত, বেইজলেস একটা বিষয় নিয়ে বিশাল বড়ো কীর্তন গেঁথেছেন ভাইটি। ‘পোশাক নাকি মানসিকতা’ বিতর্কের সু্যোগই নেই মুসলিম কমিউনিটিতে। যারা তর্ক-বিতর্ক করেন, তারা আমার “ধর্ষণের জন্য পর্দা দায়ী নাকি মানসিকতা?” পোস্টটি পড়বেন। কমেন্টে লিংক দেয়া আছে। এই বিষয়ে আরিফ আজাদ ভাইয়ের একটি পোস্টের লিংকও কমেন্টে দিয়েছি।

এখন আসি ইতিহাস। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী, এই কথাটা কে না জানে? আর সেটাই ঘটেছে এখানে। এই ভদ্দরলোক মুসলমানদের ওপর রেইপের এলেগেশন দেয়ার জন্য এতোই উঠেপড়ে লেগেছিলেন যে, তিনি খুঁজে খুঁজে শিয়া ন্যারেটিভগুলো বাছাই করেছেন সুন্নীদের ইতিহাস বলতে। শুধু তাই না, তিনি উইকিপিডিয়াকেও সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন, খ্যাক! এই ইতিহাসের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে আমার লেখা ‘কারবালা’ নিয়ে পোস্টটি পড়তে পারেন, কমেন্টে লিংক দেয়া আছে।

ইবনে কাসীর রাহি. এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া এর কথা টেনেছেন ভদ্রলোক, ঠিকাছে সেটা নিয়ে আসবো। কিন্তু কী ভাই, উনি কমেন্টে ইবনে কাসীরকে (রাহি) ইবনে কাতির কেন লিখলেন? তাহলে কি উনি আসলেই তাঁর বই পড়েছেন নাকি উইকিপিডিয়া থেকে কপি-পেস্ট করেছেন, যেহেতু সেখানে Ibn Kathir লেখা। উচ্চারণ নিয়ে কথা বলবো না, উনি এভাবে উচ্চারণ করতেই পারেন। আসি উনার জ্ঞানের গন্ডি মাপতে।

কারবালা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, সেখানেই আমি স্পষ্ট করে বলেছি ইবনে কাসীর (রাহি) তাঁর লেখায় বেশিরভাগ কোট করেছেন আবু মিখনাফকে। আবু মিখনাফ একজন মিথ্যাবাদী ও অনির্ভরযোগ্য লেখক হিসেবে খ্যাত। আবু মিখনাফের ‘মাকতাল আল হুসাইন’ আবার শিয়াদের মেইনস্ট্রীম বই। আর সেই বই থেকে অনেকগুলো বর্ণনা গ্রহণ করেছেন আল তাবারী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখ আল তাবারী’তে এবং ইবনে কাসীর তাঁর বই ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে। এজন্য কারবালা বিষয়ে কিংবা উমাইয়াদের বিষয়ে অনেক ‘বাড়াবাড়ি’ বর্ণনা এই দুটো বইয়ে পাওয়া যায়। আর সেই বাড়াবাড়ি বর্ণনাগুলো নিয়েই কিছু ছাগল নাচানাচি করার সুযোগ পায়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই দুজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবু মিখনাফ থেকে তথ্য নিলেন কেন? প্রথমত, আবু মিখনাফ প্রাচীন ঐতিহাসিক ছিলো এবং তার বর্ণনা বেশ গোছানো ছিলো। দ্বিতীয়ত তাবারী এবং ইবনে কাসীর দুজনেই চেয়েছেন প্রায় সকল বর্ণনা, যা যা পাওয়া যায়, সব একসাথে করে রাখতে। পরবর্তীতে গবেষকরা বিশুদ্ধ বর্ণনা গ্রহণ করবেন এবং অবিশুদ্ধ বর্ণনা বাদ দিবেন। এবং সেটাই হয়েছে, বর্তমান ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে এসব অবিশুদ্ধ ও জাল ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু তাবারী এবং ইবনে কাসীর প্রিকোশন দিয়েছেন, সেহেতু তাঁদের দায় থাকেনা আর। কিন্তু ঐযে, একটা বোধশক্তিবিহীন বাচ্চার সামনে যাই রাখবেন, সে যাচাই বাছাই না করে সেটাই মুখে পুরে দিবে। এই ভদ্দরলোকের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। আসলে যে যেই ফিল্ডে এক্সপার্ট না, সে সেই বিষয়ে কথা বলতে গেলে এমনই হবে।

এখন আসি, হাররাহ যুদ্ধ সম্পর্কে। হাররাহ যুদ্ধের বহু আগেই ইয়াযীদের খিলাফত নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা হয়। যে বিদ্রোহে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা)। হুসাইনকে (রা) কারবালা ময়দানে নির্মমভাবে শহীদ করার পরপরই এই হাররাহ যুদ্ধের ঘটনাটি ঘটে। ইয়াযীদের মদীনা অভিযানের এই যুদ্ধে অনেক মানুষ হতাহত হয় ও অনেকেই মারা যান। এই ঘটনাটির জন্য আমরা ইয়াযীদকে দায়ী করি। ইতিহাসে ইয়াযিদ অবশ্যই তার কৃতকর্মের জন্য ঘৃণিত।

কিন্তু গণধর্ষণের ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়। এর ব্যাপারে দুয়েকটি কিতাবে এসেছে। কিন্তু বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়নি কোথাও। যখন আপনি এরকম একটি ভয়াবহ এলেগেশন আনবেন কোনো মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে, হোক সেটা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য শাসক, আপনাকে সনদ আনতে হবে। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ঘটনাটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত এবং সত্য। এর রাবী পরম্পরায় কোনো দুর্বল রাবী বা মিথ্যুক রাবী নেই, এটাও প্রমাণ করতে হবে। উইকিপিডিয়া থেকে একটা লেখা তুলে দিয়ে আপনি এতোবড়ো ফান্ডামেন্টাল ক্লেইম করার সাহস কোথায় পান?

কেন এই গণধর্ষণের কথা সত্যি হতে পারেনা তার কয়েকটা লজিক দেখাইঃ

১. এর কিছু আগেই কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিলো। সেখানেও ইয়াযীদের নিয়োগ দেয়া প্রশাসক কুখ্যাত ইবনে যিয়াদ কারবালা প্রান্তরে হুসাইনকে (রা) তাঁর সঙ্গে আসা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ নির্মমভাবে শহীদ করে। সেই কুখ্যাত ইবনে যিয়াদও সেখানে উপস্থিত নারীদেরকে সসম্মানে মদীনায় ফেরত পাঠিয়েছিলো, তাদের গায়ে একটু আঁচড় পর্যন্ত লাগতে দেয় নি। এবং এই ইয়াযিদও তাদেরকে মদীনায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। এটা বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তারিখ আত তাবারীতেও পাবেন। তারা রাসূলুল্লাহ (স) এর নাতিকে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে ফেললো, অথচ মহিলাদেরকে হাত লাগালো না, সম্মান দেখালো, এমন কেন? তারাও তো যুদ্ধবন্দী ছিলেন, পাওয়ার প্র‍্যাক্টিসের জন্য তাদেরকেও তো রেইপ করা যেতো? আর যেহেতু তারা করেনি, তাহলে এর কিছুদিন পরই কেন ইয়াযীদ একইরকম আরেকটি যুদ্ধ করতে গিয়ে বা তার ভাষ্যে বিদ্রোহ দমাতে গিয়ে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করবে? পরস্পরবিরোধী হলো না? খাপছাড়া লাগছে না?

২. তৎকালীন মুসলিম সমাজ নারীদের ব্যাপারে এতোবেশি সেন্সিটিভ ছিলো। তাদের অধিনস্ত দাসীদেরকেও যদি কেউ কোনোরূপ আঘাত করতো, তবে তারা হত্যা করতে উদ্যত হতো। তাঁরা সেই নবীর সাহাবা, যেই নবী (স) এক মহিলাকে অনাবৃত করার অপরাধে এক ইহুদী গোত্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এছাড়া পরবর্তী মুসলিমদের লেগেসী তো সবারই জানা। খলিফা মু’তাসিম এক নারীর ইজ্জত হরণের প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু বিজয় করেছিলেন ইজ্জত হরণের প্রতিশোধ নিতে। এরা তো বহু পরের মানুষ। আর তাঁরা তো ছিলেন রাসূল (স) এর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পরের মানুষ, তাহলে তাঁরা মুসলিমা নারীদের সম্মানের ব্যাপারে কতোটা সতর্ক ছিলেন ভাবুন! তাঁদের ব্যাপারে এই মিথ্যা এলেগেশন দেয়া কতোবড়ো বে’আদবি এবং স্পর্ধার কাজ!

৩. শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা (রাহি) এর মতামত উল্লেখ করেছেন এই ভদ্দরলোক। তার হয়তো জানা নেই, ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহি) তাঁর মাজমু আল ফাতওয়ায় লিখেছেন, “ইয়াযিদের ব্যাপারে দুটো চরমপন্থী গ্রুপ আছে, একদল তাকে একেবারে ন্যায়পন্থী শাসক বলে মনে করে। অন্যদল তাকে কাফির বলে। আমরা এর মাঝামাঝি অবস্থান করি। আমরা তাকে ভালোবাসিনা, অভিশাপও দেই না।” যদি গণধর্ষণের কথাটি সর্বসম্মত সত্য হতো, ইমাম তাইমিয়া (রাহি) কি এই মত পোষণ করতেন? শুধু ইমাম তাইমিয়্যা (রাহি) না, ইমাম যাহাবী (রাহি), ইমামু আহলু সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রাহি) ও একই রকম মত পোষণ করেছেন ইয়াযিদের ব্যাপারে। যদি গণধর্ষণের কথাটি সত্য হতো, তবে কি ইয়াযিদের ব্যাপারে তারা স্পষ্ট ঘৃণা করার, অভিশাপ দেয়ার মতটি দিতেন না?

এখন আপনারা বলতে পারেন, তাহলে এসব গালগল্প কারা বানালো? কেন বানালো? উত্তর খুব সহজ! এই গল্প বানিয়েছে শিয়ারা। আমরা সুন্নীরা উমাইয়াদের পাপের কথা স্বীকার করি, কিন্তু তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিনা। কিন্তু শিয়ারা উমাইয়াদের পাপ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা গল্প রচনা করে। সেই গল্প শুরু হয়েছে আবু মিখনাফের ‘মাকতাল আল হুসাইন’ দিয়ে। আর সেটা আস্তে আস্তে ছড়িয়েছে। শিয়া প্রভাবিত মুসলিম উম্মাহর কিছু সময়, এই ছড়িয়ে যাওয়ায় সহায়তা করেছে। এরপর সেই ইতিহাসগুলো কিছু কিছু প্রবেশ করেছে সুন্নীদের কিতাবেও। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, এসব ব্যাপারে বড়ো বড়ো ইমামরা আমাদেরকে আগেই ক্লিয়ার করে গেছেন। আমরা শুধু সহীহ সোর্সগুলো খুঁজে পড়তে পারলেই চলবে, ইন-শা-আল্লাহ।

আর আবারো, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিংবা তারিখ আল তাবারীকে আমি বাতিল করছিনা। কিন্তু এই কিতাবগুলো সবার পড়ার উপযোগী বলেও মনে করিনা। এজন্য আমরা শুদ্ধ বর্ণনাগুলো খোঁজার চেষ্টা করবো। সিহাহ সিত্তাহর উপর নির্ভর করবো, আহলু সুন্নাত ওয়াল জামায়াহর ইমামদের মতামতের ওপর নির্ভর করবো।

যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে ধর্ষণ হয়েছিলো তাহলেও এই ভদ্দরলোক ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী না প্রমাণ করতে গিয়ে চেরি পিকিং, এড ইগনোরেন্টিয়াম ফ্যালাসির উপর ভর করে ক্যাটাগরি মিস্টেক করেছে। যুদ্ধের সময় পর্দা ধর্ষণ ঠেকাবে এটা কোথাও বলা নাই। যুদ্ধের বদলে যুদ্ধ হবে। পর্দার বিধান সাধারণ সমাজের জন্য। এই শাহবাগী ছাগু আপেলের সাথে কমলার তুলনা করেছেন।

এছাড়া, ইসলামের যুদ্ধনীতিতে স্পষ্টভাবে ধর্ষণ নিষিদ্ধ। সেটা কুফফারদের সাথে হলেও। তাই মুসলিমরা যদি এমন করেও থাকে সেটা তাদের দোষ, ইসলামের না।

আর প্রিয় ভাইবোনেরা, ফেসবুকে যা পড়বেন তা-ই একেবারে ওহী বলে বিশ্বাস করবেন না। আমি লিখলে আমার লেখাও যাচাই করবেন। অন্য কেউ লিখলে তার লেখাও যাচাই করবেন। ইতিহাস খুব সেন্সিটিভ ইস্যু। আপনি যেমন পাকিস্তানের ন্যারেটিভে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়বেন না, তেমনি শিয়াদের ন্যারেটিভে সুন্নীদের ইতিহাসও পড়বেন না। যা পড়বেন, তা যাচাই করবেন, হুট করে বিশ্বাস করবেন না।

বারাকাল্লাহু ফী’কুম! আরিফ মাহমুদ

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *