ইবনু জাওযি বলেন, “আমাকে এমন কোনো অসুস্থতা, দুঃখ অথবা যন্ত্রণা স্পর্শ করে নি যা আমার কোনো না কোনো কৃতকর্মের ফলাফল হিসেবে আসে নি। এমনকি আমি এটি এতই সূক্ষ্মভাবে অনুভব করতে পারতাম যে, আমি ঠিকঠাক বলে দিতে পারতাম এই বিপদটি আমার অমুক কৃতকর্মের কারণে এসেছে। সুতরাং, আপনার পাপের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করুন, কারণ এ থেকে খুব কম লোকই নিরাপদ।” ইবনু জাওযি প্রায় আট শতাব্দী আগে ইরাকে মারা গিয়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই মাসটি একই সাথে এই ইরাকের মাটিতে আমেরিকান আগ্রাসনের বর্ষপূর্তি। আমেরিকানরা তাদের লাইফস্টাইল রপ্তানি করার প্রচেষ্টায় (পরবর্তীতে ইরানিরাও) ধীরে ধীরে ধ্বংস করলো পুরো একটি দেশ, পঙ্গু করলো একটি প্রজন্ম, হত্যা করলো অসংখ্য জনগণ, তারপর আস্তে করে চলে গেল। এখন পর্যন্ত অনেক লাশ মসুল ও অন্যান্য শহরগুলোর ধ্বংসস্তুপ ও কনক্রিটের ঢিবির নিচে চাপা পড়ে আছে। ভাইরাসের কাজও অনেকটা এরকমই। ভাইরাস নিজে একটি নিষ্ক্রিয় এবং অপ্রজননক্ষম জড়বস্তু ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যখনই এটি একটি জীবন্ত কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, ধীরে ধীরে তার সমস্ত কন্ট্রোল নিয়ে নেয় এবং নিজের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে থাকে। এবং একসময় একটি সংখ্যায় এত বেশি হয় যে, পোষক কোষটি ব্লাস্ট করে ফেলে এবং বন্যার পানির মত বের হয়ে আসে অসংখ্য ভাইরাস। ঠিক যেভাবে আমেরিকা ও ইরানের মত দেশগুলো একেকটি দেশ ধ্বংস করে চলে যায়। দুটির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। ভাইরাস, আপনার জন্য একটি নিদর্শন – وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِّلْمُوقِنِينَ – وَفِي أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ “বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে রয়েছে নিদর্শনাবলী, এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না?” [সূরা যারিয়াত ৫১:২০-২১] ‘আয়াত’ শব্দের অর্থ“নিদর্শন”, “চিহ্ন, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে চেনা যায়”, “উদাহরণ”, অথবা কারো পক্ষ থেকে কোনো “মেসেজ”, অথবা “সতর্কবাণী”। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এসব আয়াতের উদ্দেশ্য মানুষকে সতর্ক করা, ভীতি প্রদর্শন করা। تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ “আগুন তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা তাতে বীভৎস আকার ধারন করবে।” [সুরা মু’মিনুন ২৩:১০৪] আহমাদ এবং তিরমিযীতে বর্ণিত, রাসূল (সা) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আগুন তাদের মুখ এমনভাবে ঝলসে ফেলবে যে তাদের উপরের ঠোঁট পুড়ে সংকুচিত হয়ে মাথার মাঝখানে পৌঁছে যাবে। আর নিচের ঠোঁট এমনভাবে ঝুলে যাবে যে নাভি পর্যন্ত চলে আসবে।” আল্লাহ যখন সূর্য ও চাঁদে গ্রহণ সংঘটিত করেন, তাদেরকে তার কুদরতে নুড়িপাথরের মত যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যান, রাসূল বলেন “আল্লাহ এই নিদর্শন প্রদর্শন করছেন তার বান্দাদেরকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য।” এই নিদর্শনগুলো দেখানোর পিছনে মূল লক্ষ্য হচ্ছে আপনাকে তওবার দিকে ধাবিত করা। কুফায় যখন ভূমিকম্প হয়, ইবনে মাসউদ তার লোকজনকে বলেন, “হে লোকসকল! তোমাদের রব তোমাদেরকে একটি শিক্ষা প্রদান করছেন। এখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করো।” এখন, আপনি এখান থেকে কীরকম শিক্ষা গ্রহণ করবেন, তা আপনার উপর নির্ভরশীল – ১. হয়তো আপনার খুব বেশি নিদর্শন দেখা দরকার হবে না, সামান্য ইশারাতেই আপনি ফিরে আসবেন।“যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর” [সুরা আনফাল ৮:২] ২. অথবা হয়তো নিদর্শনটি আপনার সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করতে হবে, নতুবা আপনি ফিরে আসবেন না। ইউনুস (আ) কে যখন তার কওমের লোকেরা কোনোভাবেই মানছিলো না, তিনি তার কওমের লোকদেরকে হুমকি দেন, আল্লাহর আযাবের ভয় দেখান, পরিশেষে তাদেরকে ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু এরপরও তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে নি। এরপর একদিন তাদেরকে আল্লাহর আযাব দেখানো হলো, আকাশ থেকে তাদের উপর নিকষ কালো আঁধারের ন্যায়। যখন তারা তা দেখলো, সকলে বেরিয়ে এক স্থানে জড় হয়ে খাস দিলে তওবা করতে লাগলো, একটানা চল্লিশ দিন পর্যন্ত। তওবার প্রথম ধাপটি হলো নিজের ভুল বুঝতে পারা, এরপর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ইবনে রজব বলেন, “সকল বিপর্যয়ের সৃষ্টির পিছনেই ভূমিকা রাখে পাপ, কারণ আল্লাহপাক বলেই দিয়েছেন “আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা আপনার নিজের কারণে” [সুরা নিসা ৪:৭৯] এবং “তোমাদের উপর যে বিপর্যয় পতিত হয় তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল” [সুরা শূরা ৪২:৩০] । সুতরাং এসব ছোঁয়াচে রোগের বিস্তারণের পিছনে মানুষের পাপ ছাড়া অন্য কিছু দায়ী নয়।” রাসূল (সা) নিজেও ছোঁয়াচে রোগকে মানুষের কৃতকর্মের সাথেই সম্পর্কিত করেছেন, “যখন লোকজন প্রকাশ্যে অশ্লীলতার চর্চা শুরু করবে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ এবং এমন সব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা তাদের পূর্বসুরীরা কখনো দেখেনি।” [ইবনে মাজাহ. অধ্যায় ২. নং ৩২৪৬] আল্লাহ তা’আলা ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে দিকটি রেখেছেন তা হলো, দৃষ্টিসীমার বাইরে ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও এর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। সাধারণ ভাইরাসসমূহ ব্যাকটেরিয়া থেকেও ২০ থেকে ১০০ গুণ ক্ষুদ্র হয়। তাই ভাইরাসকে বলা হয় অতি আণুবীক্ষণিক, সাধারণ মাইক্রোস্কোপে যা দেখা যায় না। এখানে মজার বিষয়টি হলো, যুগে যুগে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহপাক বড় বড় অহঙ্কারীদের অহঙ্কার ধূলিস্মাৎ করতে ক্ষুদ্র জিনিসই ব্যবহার করেছেন। হাদিস থেকে পাওয়া যায়, যেই প্রচন্ড বাতাসের মাধ্যমে আ’দ জাতির ধ্বংস সাধিত হয়েছিলো তা আসমান থেকে এসেছিলো “একটি রিং এর সমান ছোট গর্তের” মধ্যে দিয়ে হযরত কাতাদাহ হতে বর্ণিত, যেই প্লাবনে সাবা’ জাতি ধ্বংস হয়েছিলো, তা সংঘটিত হয়েছিলো বাঁধের তলদেশ ইঁদুরে কেটে ফেলার মাধ্যমে ইবনে কাছীর লেখেন, যখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাঈদ ইবনে যুবায়ের(রা) কে হত্যা করে ফেলে, হযরত হাসান বসরী দোয়া করেন, “ইয়া আল্লাহ! অত্যাচারীদের নির্মূলকারী! তুমি হাজ্জাজকে ধ্বংস করো।” তিন দিনের মাথায় হাজ্জাজের মুখ থেকে পোকা বের হতে শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়েই সে মারা যায়। শেষ জমানায় যখন ঈসা (আ) ও তার বাহিনী ইয়াজুজ মা’জুজ দ্বারা আক্রান্ত হবেন, রাসূল বলেন, “ঈসা ও তার অনুসারীরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, ফলে আল্লাহ ইয়াজুজ মা’জুজদের ঘাড়ে একপ্রকার পোকা সৃষ্টি করে দিবেন, যার দংশনে তারা মারা যাবে।” ৩. সর্বশেষ, হয়তো আপনি একের পর এক নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করার পরও শিক্ষাগ্রহণ করবেন না, যেমনটি হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়ের (পূর্বোল্লিখিত, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে যিনি মৃত্যুবরণ করেন) বলেন, “মূসা (আ) ফেরাউনের কাছে গিয়ে দাবি করলেন, ‘বনী ইসরাইলকে আমার হাতে ছেড়ে দাও’। ফেরাউন অস্বীকৃতি জানালো। পরিণামে আল্লাহ তাদের উপর নিদর্শন হিসেবে বৃষ্টির আযাব প্রেরণ করলেন। বৃষ্টি অবিরাম বর্ষিত হতেই লাগলো, যতক্ষণ না তারা একে আল্লাহর যাব বলে স্বীকার করে। অবশেষে তারা নতি স্বীকার করলো, এবং মূসা (আ) কে বললো, ‘তোমার রবকে বলো আমাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিতে। আমরা অবশ্যই তোমার উপর ঈমান আনবো এবং বনী ইসরাইলকে তোমার হাতে ছেড়ে দিবো।’ মূসা (আ) আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন আযাব উঠিয়ে নেয়ার জন্য, আল্লাহ আযাব উঠিয়ে নিলেন, কিন্তু তারা ঈমানও আনলো না, বনী ইসরাইলকেও ছেড়ে দিলো না। সেই একই বছর আল্লাহ তা’আলা তাদের জমিতে বিভিন্ন রকম সবজি দান করলেন, যা বিগত বছরগুলোতে কখনো সেখানে হয়নি। তারা বলতে লাগলো, ‘এটা আমাদের অর্জন’, পরিণতিতে আল্লাহপাক তাদের উপর প্রেরণ করলেন পঙ্গপালের আযাব। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল এগিয়ে আসতে লাগলো তাদের জমিগুলোর দিকে। তারা বুঝলো, এবার এই পঙ্গপালের হাত থেকে আমাদের ফসল কোনোভাবেই রক্ষা পাবে না। তাই তারা একই রকম আবেদন নিয়ে মূসা (আ) এর কাছে গেল, ‘তোমার রবকে বলো আমাদেরকে পঙ্গপালের হাত থেকে রক্ষা করতে। আমরা অবশ্যই তোমার উপর ঈমান আনবো এবং বনী ইসরাইলকে তোমার হাতে ছেড়ে দিবো।’ মূসা (আ) পুনরায় আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন, তিনি আযাব উঠিয়ে নিলেন। কিন্তু তারা ঠিক একই রকম আচরণ প্রদর্শন করলো, যেমনটা আগে করেছিলো। এ পর্যায়ে তারা তাদের সব সবজি ফসল আগেভাগেই ঘরে তুলে রাখলো, আর বলতে লাগলো, ‘আমরা আমাদের ফসল রক্ষা করেছি।’ আল্লাহপাক তাদেরকে ছেড়ে দিলেন না। তাদের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ তাদের ফসলে শস্যখেকো পোকা সৃষ্টি করে দিলেন। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পুনরায় তারা মূসা (আ) কে বললো, ‘তোমার রবকে বলো আমাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিতে। আমরা অবশ্যই তোমার উপর ঈমান আনবো এবং বনী ইসরাইলকে তোমার হাতে ছেড়ে দিবো।’ মূসা (আ) আবার আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন, তিনি আযাব উঠিয়ে নিলেন। কিন্তু তাদের স্বভাবচরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসলো না। একদিন মূসা (আ) ফিরাউনের সাথে ছিলেন, এমতাবস্থায় একটি ব্যাঙ ডেকে উঠলো কাছে কোথাও। মূসা(আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে ও তোমার জাতিকে যদি এবার ব্যাঙ দিয়ে আযাব দেয়া হয়?’ ফেরাউন উত্তর দিলো, ‘ব্যাঙ আর এমন কী করবে’। সেদিন রাতের মধ্যেই গোটা এলাকা এত অসংখ্য পরিমাণ ব্যাঙে ছেয়ে গেল যে, কেউ বসে থাকলে তার গাল পর্যন্ত উঁচু হয়ে যাচ্ছিলো ব্যাঙের স্তুপ। আর কথা বলার জন্য মুখ খুললে আর উপায় নেই, একটা না একটা ব্যাঙ সেখানে লাফ দিয়ে ঢুকবেই। আবারও সেই একই ঘটনা, একই অনুরোধ একই প্রতিশ্রুতি, আবারও আল্লাহর কাছে আযাব তুলে নেয়ার জন্য মুসা (আ) এর আবেদন। আল্লাহ তা’আলা আযাব তুলে নিলেন, তারা তাদের মতই থাকলো। প্রতিশ্রুতি পূরণ করলো না। এর পরে আল্লাহপাক তাদের নদী, নালা, কূপ, এমনকি মশকের পানি পর্যন্ত পানি রক্তে পরিণত করলেন। পানীয় কোনোকিছু তাদের জন্য অবশিষ্ট ছিল না। তারা একযোগে ফিরাউনের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করলো। ফিরাউন বললো, ‘মূসা তোমাদেরকে জাদু দেখিয়েছে’। তারা বললো, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা নিজ চোখে দেখেছি, আমাদের মশকের পানিগুলো পর্যন্ত সত্যিকারের রক্তে পরিণত হয়েছে’। সেই একই ঘটনা, একই অনুরোধ একই প্রতিশ্রুতি, আবারও আল্লাহর কাছে আযাব তুলে নেয়ার জন্য মুসা (আ) এর আবেদন। আল্লাহ তা’আলা আযাব তুলে নিলেন, তারা তাদের মতই থাকলো। প্রতিশ্রুতি পূরণ করলো না।” এর পরের ফায়সালা, “সুতরাং আমি তাদের কাছে থেকে বদলা নিয়ে নিলাম, বস্তুতঃ তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে দিলাম। কারণ, তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমার নিদর্শনসমূহকে এবং তৎপ্রতি অনীহা প্রদর্শন করেছিল। [সুরা আরাফ ৭:১৩৬]” তারিক মেহান্না মঙ্গলবার, ২৯ রজব ১৪৪১ (২৪ মার্চ ২০২০) ম্যারিয়ন সিএমইউ