দুআ কেন কবুল হয় না? ও দুআ কবুল হওয়ার তিন ধাপ দুআ কেন কবুল হয় না?

দুআ কেন কবুল হয় না? ও দুআ কবুল হওয়ার তিন ধাপ দুআ কেন কবুল হয় না? অথচ আল্লাহ তাআলা বান্দার দুআ কবুল করার ওয়াদা করেছেন৷ আল্লাহ তাআলার ওয়াদা তো ব্যতিক্রম হতে পারে না৷ তাহলে এত এত দুআ করার পরও কেন দুআ কবুল হয় না? এক ভাই অনুযোগের সুরে বলেছেন, ২ বছরেরও অধিক সময় ধরে টানা প্রতিদিন তাহাজ্জুদ পড়ে দুআ করছেন, কিন্তু তার দুআ কবুল হওয়া তো দূরের কথা; যে সমস্যা সমাধানের জন্য দুআ করছিলেন, সে সমস্যা আরো বেড়েছে৷ আসুন, আগে আমরা দুআ কবুল না হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করি: ১. আল্লাহর হুকুম অমান্য করা৷ এটা বড়ই অযৌক্তিক ব্যাপার যে, আমরা আল্লাহ তাআলার হুকুম লঙ্ঘন করব আবার দুআ কবুলের আশা করে বসে থাকব৷ দুআ কবুল হতে হলে আগে আল্লাহ তাআলার বিধিবিধান মেনে চলতে হবে৷ তাঁকে সন্তুষ্ট করেই দুআ কবুলের আশা পোষণ করতে হবে৷ ২. আল্লাহ তাআলার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ঘাটতি৷ আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে ঠিক, কিন্তু অগাধ বিশ্বাসের ঘাটতি আছে৷ সেই ঘাটতি দূর করতে হবে৷ ইরশাদ হচ্ছে- وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ অর্থ: আর আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, আমি তো রয়েছি সন্নিকটেই। আমি বান্দার প্রার্থনা কবুল করি, যখন সে আমাকে আহ্বান করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মেনে চলে এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। যাতে তারা সঠিক পথের দিশা লাভ করতে পারে। (সুরা বাকারা: ১৮৬) এই আয়াতে দুটি বিষয় লক্ষণীয়: এক- আল্লাহ তাআলা বলেন: “আমি বান্দার প্রার্থনা কবুল করি, যখন সে আমাকে আহ্বান করে।” এই আয়াতে আমরা দুআ কবুলের দুটি শর্ত পেলাম৷ ১ম শর্ত- কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মেনে চলে৷ ২য় শর্ত- আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। ৩. খাবার পবিত্র ও হালাল না হওয়া৷ বলতে গেলে দুআ কবুল না হওয়ার এই কারণটি মৌলিক কারণ৷ খাবার যদি পবিত্র ও হালাল না হয়৷ হারাম ও অপবিত্র খাদ্য থেকে শরীরের রক্ত-মাংস গঠিত হয়, পোশাক-পরিচ্ছদ পরা হয়, তাহলে এমন ব্যক্তির দুআ কবুলের দরোজা বন্ধ৷ কুরআনুল কারিমে আমলের আগে পবিত্র খাবার গ্রহণের নির্দেশ এসেছে৷ তাহলে বোঝা গেলো, আমল কবুলের পূর্বশর্ত খাবার হালাল হওয়া৷ ইরশাদ হচ্ছে- يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا অর্থ: হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী হতে আহার কর, এবং নেক আমল কর। (সুরা মু’মিনুন: ৫১) রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন- أيها الناسُ! إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا [المؤمنون: 51] وَقَالَ: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟ (صحيح مسلم: ١٠١٥) অর্থ: হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মু’মিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসুলগণকে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী হতে আহার কর, এবং নেক আমল কর।’’ আরও বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে রিযিকস্বরূপ দিয়েছি৷” তারপর রাসুল ﷺএমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে: হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে? (সহীহ মুসলিম: ১০১৫) হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে: تُلَيَتْ هَذِهِ الْآيَةُ عِنْدَ النَّبِيِّ ﷺ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلالًا طَيِّباً فَقَامَ سَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مُسْتَجَابَ الدَّعْوَةِ، فَقَالَ يَا سَعْدُ أَطِبْ مَطْعَمَكَ، تَكُنْ مُسْتَجَابَ الدَّعْوَةِ، وَالذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، إِنَّ الرَّجُلَ لَيَقْذِفُ اللُّقْمَةَ الْحَرَامَ فِي جَوْفِهِ مَا يُتَقَبَّلُ مِنْهُ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، وَأَيُّمَا عبد نَبَتَ لَحْمُهُ مِنَ السُّحْتِ وَالرِّبَا فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ. রাসুল ﷺ এর নিকট এ আয়াতটি তিলাওয়াত করা হলো । ‘‘হে মানবমন্ডলী ! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর।’’ তখন সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রা, দাঁড়িয়ে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দু’আ করুন যেন আমি দুআ কবুল হওয়া লোক হতে পারি। রাসূল ﷺ বললেন: হে সা‘দ! তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তুমি দুআ কবুল হওয়া ব্যক্তি হতে পারবে। মনে রেখ, কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক লোকমাও মুখে নেয় তাহলে চল্লিশ দিন যাবত তার দু‘আ কবুল হবে না৷ আর বান্দার শরীরের গোশত হারাম থেকে কিংবা সুদ থেকে গঠিত হয়েছে, সে জাহান্নামের সর্বাধিক উপযুক্ত৷ (তাবারানী: ৬৪৯৫) ৪. গোনাহ ও আল্লাহ তাআলার নাফরমানি দুআ কবুল না হওয়ার বড় কারণ৷ আমরা গোনাহ করে যাবো আবার দুআ কবুলের আশা করব, এমনটা হতে পারে না৷ দুআ কবুল হতে হলে আগে গোনাহ ছাড়তে হবে৷ ৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাও দুআ কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ৷ আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা প্রকারান্তরে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার নামান্তর৷ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ لَيْسَ فِيهَا إِثْمٌ ، وَلَا قَطِيعَةُ رَحِمٍ إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ بِهَا إِحْدَى ثَلَاثٍ: إِمَّا أَنْ تُعَجَّلَ لَهُ دَعْوَتُهُ وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ وَإِمَّا أَنْ يَصْرِفَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا. قَالُوا: إِذًا نُكْثِرُ قَالَ: اللهُ أَكْثَرُ (رواه البخاري في الأدب المفرد 710 وصححه الألباني وأحمد) নবী কারীম ﷺ বলেছেন: যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি দুআ করে, যে দুআতে কোনো পাপ থাকে না ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তাহলে আল্লাহ তাআলা তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দুআ অবশ্যই কবুল করে নেন। যে দুআ সে করেছে হুবহু সেভাবে তা কবুল করেন অথবা তার দুআর প্রতিদান আখেরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন কিংবা এ দুআর মাধ্যমে তার ওপর আগত কোনো বিপদ তিনি দূর করে দেন। এ কথা শুনে সাহাবিগণ বললেন, আমরা তাহলে অধিক পরিমাণে দুআ করতে থাকবো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: তোমরা যত প্রার্থনাই করবে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশি কবুল করতে পারেন। (বুখারি: আল-আদাবুল মুফরাদ ও আহমদ) এই হাদিস থেকে আরো পরিষ্কার বোঝা গেলো, শর্ত পাওয়া গেলে সব দুআই আল্লাহ কবুল করেন৷ কোনো দুআ আল্লাহ ফেরত দেন না৷ কোনো দুআ ব্যর্থ বা বেকার যায় না৷ আল্লাহ তাআলা দুআ কবুল করেন তিনভাবে: এক. সে যা চাইবে, যা কামনা করবে হুবহু সেই প্রার্থিত বিষয় বা জিনিস তাকে দিয়ে দেয়া হবে৷ বান্দা তার দুআ কবুলের আলামত নগদ-নগদ দেখতে পাবে৷ দুই. আল্লাহ তাআলা বান্দার দুআর বিনিময়ে তাকে দুনিয়াতে কিছু না দিয়ে পরকালের জন্য রেখে দেন৷ দুনিয়াতে কবুল না হওয়া দুআগুলি কিয়ামতের দিন বিশাল আকারে বান্দার সামনে প্রকাশ পাবে৷ তখন বান্দা আকাঙ্ক্ষা করবে; হায়! দুনিয়াতে একটা দুআও যদি আমার কবুল না হয়ে আখেরাতের জন্য রেখে দেয়া হতো! তিন. হয়ত তার সামনে কোনো বড় বিপদ-মুসিবত আসন্ন ছিলো৷ আল্লাহ তাআলা জানেন সে যা চেয়ে দুআ করেছে, তার চাইতে আসন্ন বিপদ দূর করা তার জন্য বেশি প্রয়োজন৷ তখন আল্লাহ তাআলা তা-ই করেন৷ সরাসরি প্রার্থিত বস্তু কবুল না করে তার অজ্ঞাতেই তার উপর থেকে বিপদটি দূর করে দেন৷ অথচ বান্দা মনে করে তার দুআ মনে হয় কবুল হয় না৷ পেরেশান হয়ে যায়, অস্থির হয়ে যায়৷ সে বুঝতেই পারে না তার তাহাজ্জুদের সময় বা বিভিন্ন দুআর সময় যে প্রার্থনা করেছে, সেই দুআর বদৌলতে আল্লাহ তাআলা কতো বড় সমস্যা থেকে তাকে উত্তীর্ণ করেছেন৷ তাই দীর্ঘদিন তাহাজ্জুদ পড়ে দুআ করার পর কবুলের আলামত না পেয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ বরং এই আমল করতে পারার জন্য নিজের শরীর এবং মেযাজ ফুরফুরে থাকা উচিত৷ হতাশা শয়তান সৃষ্টি করে দেয়৷ ইবাদত-বন্দেগির প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে৷ — Mufti Ziaur Rahman

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *