মহামারিতে হযরত ওমর রা. এর কর্মকৌশল মূল : ড. আলী মুহাম্মাদের সাল্লাবি। অনুবাদ : কাজী মোহাম্মদ হানিফ বর্তমানে বিশ্ব-মহামারি করোনা ভাইরাস নিয়ে পৃথিবীর সবাই যারপরনাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। এ ভাইরাসটি দিন দিন ব্যাপক আকার ধারণ করছে ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এই মহামারিটি বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু দেশে এ মহামারিটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যেহেতু এই ধরনের মহামারি আল্লাহর ইচ্ছা এবং নিয়তির লিখন, তাই আমরা ইমানদার হিসেবে আল্লাহর উপর নির্ভর করে এবং তার বিচার ও নিয়তিকে মেনে নিয়ে এই বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উপায়- উপকরণ অবলম্বন করতে সচেষ্ট হবো। ওমর বিন খাত্তাব রা. (জন্ম ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দ – মৃত্যু ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) এর জীবনীতে মহামারি বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে এমন কিছু নির্দেশনা রয়েছে যা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। ১৮ হিজরিতে একটি ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে, যা ইতিহাসে আমাওয়াস প্লেগ হিসাবে প্রসিদ্ধ। আমাওয়াস হলো জেরুজালেম এবং রামলার মধ্যবর্তী একটি এলাকা। এখান থেকেই রোগটির উৎপত্তি হয়েছিল। পরে তা শাম তথা বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে একে আমাওয়াসের প্লেগ বলা হয়। আমার জানা মতে এ রোগটি সম্পর্কে যিনি সবচেয়ে ভালো লেখেছেন তিনি হলেন ইবনে হাজার আসকালানি রহ. (জন্ম 1372 খ্রিষ্টাব্দ – মৃত্যু 1448 খ্রিষ্টাব্দ) । তিনি প্লেগের আলোচনা করার পরে বলেছিলেন: ভাষাবিদ, ফকিহ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে যা বলেছেন তার সারাংশ হচ্ছে: ‘প্লেগ হলো, বিশেষ কোনো অঙ্গে রক্তের অতিরিক্ত চাপ বা প্রবাহের কারণে অঙ্গটি ফুলে গিয়ে তাতে বৈকল্য দেখা দেওয়া। এছাড়া বায়ু দুষণের কারণে ছড়িয়ে যাওয়া ব্যাপক রোগ-ব্যাধিকেও প্লেগ বলা হয়। তবে তা রূপক অর্থে। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে কিংবা মৃত্যুর ব্যাপকতা ঘটে।’ মহামারি এবং প্লেগের মধ্যে এই পার্থক্যের উদ্দেশ্য হ’ল: রাসুলুল্লাহ স. এর ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হাদিসের সত্যতা প্রমাণ করা। কেননা হাদিসে আছে, প্লেগ মদিনা শরিফে প্রবেশ করবে না, তবে মহামারি প্রবেশ করতে পারে। বিগত শতাব্দীতে মহামারি মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় মুসলমান ও রোমানদের মধ্যে বিশাল যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক মরদেহ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বায়ু দুষিত হয়ে মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তা ঘটেছিল। হেজাজ ও শামের সীমান্তবর্তী এলাকা সারগ থেকে ওমরের ফিরে যাওয়া ১৭ হিজরিতে ওমর রা. দ্বিতীয়বার শামের উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন। তার সাথে মুহাজির ও আনসারদের একটি দল ছিল। তারা যখন হেজাজ ও শামের সীমান্তে সারগ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন সৈন্যদলের কমাণ্ডারদের সাথে তাঁদের সাক্ষাত হলো। তারা তাকে বললো: ‘হে আমীরুল মুমিনীন, শামে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানের অবস্থা ভালো নয়।’ এ সংবাদ শুনে ওমর রা. উপস্থিত লোকদের সাথে পরামর্শ করলেন। অবশেষে মদিনায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো। শামে আমাওয়াস প্লেগ নামে পরিচিত এ ভয়ংকর মহামারিতে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: শামের গভর্নর আবু উবায়দাতুবনুল জাররাহ, মুয়াজ ইবনে জাবাল, ইয়াযিদ ইবনে আবি সুফিয়ান, হারিস ইবনে হিশাম, (কারো মতে তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।) সুহাইল ইবনে আমর, উতবা ইবনে সুহাইল এবং নেতৃস্থানীয় অনেকেই। আমর ইবনুল আস কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে এ মহামারিটি দূর হয়ে যায়।গভর্নর হওয়ার পর তিনি ভাষণে বলেন: হে লোকসকল! এ মহামারি যখন কোথাও আপতিত হয় তখন তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অতএব তোমরা এ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়ে চলে যাও। এরপর তিনি পাহাড়ে চলে গেলেন। তার সাথে লোকজনও পাহাড়ে গেল। পাহাড়ে গিয়ে তারা আলাদা আলাদা হয়ে অবস্থান করলেন। অবশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ মহামারি উঠিয়ে নিলেন। মহামারিতে আমর ইবনুল আস যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তা ওমর রা. এর কাছে পৌঁছালে তিনি তা অপছন্দ করেননি। প্লেগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা মুসলিম সেনাবাহিনীর বড় বড় কমাণ্ডারদের মৃত্যুর ফলে ওমর রা. খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। প্লেগ শেষ হওয়ার পর শাম থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে অনেক চিঠি আসে । সেখানে এতো লোক মারা যায় যে, অনেক সম্পদের উত্তরাধিকারী পাওয়া যাচ্ছিল না। তাদের সে সম্পদ কী করা হবে? এ জাতীয় অনেক বিষয় ছিল। ওমর রা. পরামর্শ সভা ডাকলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করলেন। এরপর ওমর রা. নিজে আক্রান্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মদিনায় আলী রা. কে তার স্থলাভিষিক্ত নিয়োজিত করে প্রথমে শামে গেলেন। সেখানের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করলেন। তিনি সেখানের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। শূন্যপদসমূহে জনবল নিয়োগ দিলেন। সেনাবাহিনী বিন্যস্ত করলেন। এক নামাজের সময় লোকেরা বললো : হে আমীরুল মুমিনীন, বেলাল কে আযান দিতে বলুন। তিনি বেলালকে (রা.) আযান দিতে বললেন। তিনি আযান দিলেন। তার আযান শুনে সবাই ডুকরে কেঁদে উঠলো।কাঁ দতে কাঁদতে সবার দাড়ি ভিজে গেল। সবচেয়ে বেশি কাঁদলেন ওমর রা.। উক্ত নামাযের আগে তিনি শামের জনগণকে সম্বোধন করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন: হে লোকসকল, ‘আমি তোমাদের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে দিয়েছি। আমার ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা আমি পালন করার চেষ্টা করেছি। আমি তোমাদের মাঝে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছি। তোমাদের বাড়িঘর ঠিক করে দিয়েছি। আমার কাছে যা ছিল সব তোমাদেরকে দিয়েছি। তোমাদের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী নতুনভাবে বিন্যস্ত করে দিয়েছি। তোমাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেছি। তোমাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করে দিয়েছি। এছাড়া আর করার মতো কিছু থাকলে আমাকে বলো, আমি তা ইনশাআল্লাহ করবো। আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোনো ক্ষমতা নেই।’ আমাওয়াসের এ মহামারিটি মুসলমানদের জন্য একটি বিরাট বিপদ ছিল। তাদের মধ্যে বিশ হাজারেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। এরা ছিল শামের জনসংখ্যার অর্ধেক। মুসলমানরা সেদিন ভয় পেয়েছিল এবং রোমানদের ব্যাপারে তারা ভয়ে ভয়ে ছিল। বস্তুত যদি রোমানরা শামের মুসলমানদের এই দুর্বলতা টের পেতো এবং এই দেশটিতে আক্রমণ করত; তাহলে শামের সেনাবাহিনীর জন্য তাদেরকে প্রতিহত করা কঠিন ছিল। তবে রোমানদের অন্তরে হতাশা ঝেকে বসেছিল, তাই তারা মুসলমানদের আক্রমণ করা থেকে বিরত ছিল। বিশেষত যদি জনগণ শাসকদের কর্তৃত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তাদের ন্যায্য কর্তৃত্বের প্রতি সমর্থন দেয় এবং তাদের আচরণে সবাই খুশি থাকে তাহলে শত্রুদের জন্য আক্রমণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো জাতির মধ্যে যদি যুদ্ধের প্রতি অনিহা ও ভোগবিলাসিতার প্রতি অধিক আগ্রহ থাকে তাহলে তারা এমন জাতির বিরুদ্ধে কখনো অগ্রসর হবে না বিজয় যাদের পদচুম্বন করে সর্বক্ষেত্রে এবং যাদের প্রভাব প্রত্যেকের মসন বদ্ধমূল হয়ে গেছে। মহামারিকবলিত স্থানে প্রবেশ এবং অবস্থানের বিধান রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা যদি শোনো যে কোনও এলাকায় মহামারির প্রকোপ দেখা দিয়েছে তাহলে সেখানে যাবে না। আর যদি তোমরা মহামারিকবলিত এলাকায় থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না।” সাহাবাগণ বাইরে বেরোনোর ও প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত মর্ম কী তা নিয়ে মতভেদ করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার বাহ্যিক অর্থ গ্রহন করেছিলেন। আর কেউ কেউ তার ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন। যারা ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন তারা প্লেগকবলিতদেরকে বেরোনোর অনুমতি দিয়েছিলেন। আবু উবাইদাহকে হযরত ওমর রা.ও শাম থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলেন। আর তিনি বের হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিশেষ ওযরের কারণে তিনি পরে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। (এখানে উল্লেখ্য যে, সারগ নামক জায়গায় আবু উবায়দার সাথে ওমরের সাক্ষাতের পরে যখন তারা আব্দুর রহমান ইবনে আওফের কাছ থেকে মহামারি কবলিত এলাকা থেকে বের না হওয়া এবং বাহির থেকে ভেতরে না যাওয়ার হাদিস শুনেছিলেন এরপরে এ ঘটনা ঘটেছিল।) ওমর (রা।) ও এরপর মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, মহামারিটি তখন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। মহামারিকবলিত এলাকা থেকে বের হওয়ার পক্ষে ওমরের বক্তব্য কোনো কোনো সাহাবি থেকে বর্ণিত আছে। যেমন আমর ইবনুল আস ও আবু মুসা আশআরি রা. । তবে এ মতানৈক্য মহামারিকবলিত এলাকা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে, প্রবেশের ব্যাপারে নয়। প্রবেশের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে সবাই একমত। তবে অনিবার্য কারণবশত কিংবা চিকিৎসার জন্য বের হওয়া সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ। আবু উবাইদাহ ওযর পেশ করে ওখানে থেকে যাওয়ার পক্ষে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কারণগুলো যেমন স্বাস্থ্যগত তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক। তিনি নিজেই বলেছেন: ‘আমি মুসলিম বাহিনীর দায়িত্বে আছি। আমি তাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না।’ তাছাড়া ব্যাপকভাবে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলে শক্তিশালীরা বের হয়ে যাবে ফলে দুর্বলরা বিপদে পড়বে। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলবে। জীবিতদের খোঁজ খবর নেওয়ার ও মৃতদের দাফনকাফনের লোক পাওয়া যাবে না। এ কারণে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কারণ এর ফলে অন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। সারকথা, মহামারিকবলিত এলাকায় থাকারও অনুমতি আছে আবার (প্রয়োজনবশত)বের হওয়ারও অনুমতি আছে। তবে যে ওখানে আছে এবং আক্রান্ত হয়ে গেছে তার জন্য বের হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সে বের হলে তার মাধ্যমে সুস্থ মানুষের মধ্যে তা ছড়াবে। তবে যে এখনো আক্রান্ত হয়নি (প্রয়োজনবশত) সে বের হতে পারবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এভাবে যেন সবাই বের না হয়ে যায়। কেননা অসুস্থদের দেখাশোনার মতো পর্যাপ্ত লোক সেখানে থাকতে হবে। উপসংহার : শামের মহামারিতে ওমর রা. এর কর্মকাণ্ড থেকে আমরা কিছু দিকনির্দেশনা পাই। যেমন: ১. পরিপূর্ণরূপে সতর্কতা অবলম্বন করা। (এ কারণেই তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা মহামারিরর প্রাথমিক পর্যায়ে শামে প্রবেশ করেননি। মদীনায় ফিরে এসেছেন।) ২. আক্রান্ত হয়নি এমন লোকদেরকে সেখান থেকে বের হতে উদ্বুদ্ধ করা। ৩. মহামারি দূর হওয়ার পর জনগণের পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা। তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ৪. রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহস যোগানো। ৫. দ্রুত গভর্নর নিযুক্ত করে তার মাধ্যমে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এভাবে ওমর রা. আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে মহামারিতে তার নিপূণ কর্মপদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে একজন যোগ্য রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে তা অনুসরণের তাওফিক দান করুন।