হলুদ রঙের কাপর পড়া কি পুরুষের জন্যে হারাম?
?হলুদ রঙঃ
লাল রঙের ন্যায় হলুদ রঙের বিষয়েও দুই প্রকারের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিছু হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হলুদ রঙের লুঙ্গি, চাদর বা অন্যান্য পােশাক পরিধান করেছেন। অন্য হাদীসে আমরা দেখি যে, তিনি পুরষের জন্য হলুদ রঙ অপছন্দ করেছেন।
?হলুদ রঙের বৈধতা
আব্দুল্লাহ ইবনু জাফর (রা) বলেন,
“আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দুটি হলুদ কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।” এ হাদীসটির অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন:
?
“আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কে যাফরান দ্বারা রঙকৃত দুটি কাপড়: চাদর ও পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।” হাদীসটির সনদ হাসান । (আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ ১২/২০০; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/২১০, তাবারানী, আল-মু’জামুস সাগীর ১/৩৮৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২৯)
আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে একটি হাদীসে দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) হলুদ রঙ ব্যবহার করতেন, কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ রঙ পছন্দ করতেন। এ হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় হলুদ রঙ ব্যবহারের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ সকল বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন:
?“আমি দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আতর (যাফরান মিশ্রিত হলদে আতর) দ্বারা তার মুবারক দাড়ি হলুদ করতেন । এর চেয়ে আর কোনাে রঙই। তাঁর কাছে বেশি প্রিয় ছিল না। তিনি তাঁর সকল পােশাক: তার চাদর, তার কামীস (পিরহান) ও তাঁর পাগড়ি (সবই) যাফরান দিয়ে রঙ করে নিতেন।” বর্ণনাগুলির সনদ হাসান বা গ্রহণযােগ্য। (নাসাঈ, আস-সুনান ৮/১৪০, ১৫০; আস-সুনানুল কুবরা ৫/৪১৭, ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৪৫২; ইবনু আব্দিল বার, আত-তামহীদ ২/১৮০)
অন্য হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন,
?“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পােশাকাদি: জামা, চাদর ও লুঙ্গি তাঁর কোনাে কোনাে স্ত্রীর নিকট প্রেরণ করতেন (পরিস্কার করে রঙ করার জন্য)। তাঁদের। মধ্যে যিনি সেগুলিকে যাফরান মিশিয়ে দিতেন তাকেই তিনি সবচেয়ে পছন্দ করতেন।” হাদীসটির সনদ দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়। (নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৫/৪৭৯)
আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
?“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখেন যে, আব্দুর রাহমান ইবনু আওফ (রা) এর দেহে হলুদের ছাপ রয়েছে। অন্য বর্ণনায়, তার দেহে রয়েছে যাফরার মিশ্রিত ‘খালুক’ আতরের হলুদের প্রভাব । তিনি প্রশ্ন করেন, এ কি? তিনি বলেন, আমি একজন আনসারী মহিলাকে বিবাহ করেছি…।”(বুখারী, আস-সহীহ ২/৭২২, ৩/১৩৭৮, ১৪২৩, ১৪৩২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/১০৪২; আবু দাউদ, আস-সুনান ২/২৩৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৯/২৩৩)
হলুদ রঙ আব্দুর রাহমান ইবনু আওফের (রা.) দেহে না পােশাকে ছিল। তা এ সকল হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে আল্লামা ইবনু আব্দিল বাবুর উল্লেখ করেছেন যে, হলুদ রঙ বা যাফরান তার দেহে নয়, বরং পােশাকেই ছিল । বিবাহ উপলক্ষে তিনি তার পােশাকে হলুদ রঙের আতর ব্যবহার করেছিলেন বা যাফরান দ্বারা রঞ্জিত পােশাক পরিধান করেছিলেন। (ইবনু আব্দিল বার, আত-তামহীদ ২/১৭৯)
এ বিষয়ে সহীহ-যয়ীফ আরাে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের পরেও সাহাবীগণ এবং পরবর্তীকালে তাবিয়ীগণ হলুদ পােশাক ব্যবহার করতেন বলে অনেক বর্ণনা সংকলিত হয়েছে । আমর ইবনু মাইমুন বলেন, উমার (রা) যেদিন আহত হন সেদিন তার পরনে হলুদ কাপড় ছিল। ইমরান ইবনু মুসলিম বলেন, আমি আনাস (রা) কে হলুদ ইযার পরিহিত দেখেছি। আহনাফ ইবনু কাইস বলেন, উসমান (রা) একটি হলুদ চাদর পরিধান করে তা দিয়ে নিজের মাথা আবৃত করে আমাদের নিকট আগমন করেন । আবু যুবিয়ান বলেন আমি আলীকে (রা) একটি হলুদ ইযার ও কামীস পরিহিত দেখেছি। ইমরান ইবনু বিশর বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু বুসরকে (রা.) একটি হলুদ পাগড়ি ও হলুদ চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। মালিক ইবনু মিগওয়াল বলেন, আমি শীতে-গ্রীষ্মে সর্বদা (তাবিয়ী) ইব্রাহীম নাখয়ীকে হলুদ চাদর ও হলুদ লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখতাম। (বিস্তারিত দেখুন: ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৫/১৬০-১৬১; ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৬/৩৩৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২৯-১৩০; বুসীরী, মুখতাসারু ইতহাফ ৩/৩৯৪; মুহাম্মাদ শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ ৭/৩১৪-৩১৫।)
?হলুদ রঙ ব্যবহারে আপত্তি
উপরের হাদীসগুলির বিপরীতে কিছু হাদীসে পুরুষদের জন্য হলুদ রঙ বা হলুদ রঙের আতর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা দেখা যায় । আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন:
?“নবীউল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দশটি বিষয় অপছন্দ করতেন, তার প্রথম হলুদ, অর্থাৎ যাফরান মিশ্রিত হলুত আতর।” হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা থাকলেও হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/৮৯; নাসাঈ, আস-সুনান ৮/১৪১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/২১৬; আবূ ইয়ালা, আল-মুসনাদ ৯/৮, ৮৫)
আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন,
?“কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে আগমন করে। তাদের মধ্যে একব্যক্তির হাতে “খালুক” আতর বা যাফরান মিশ্রিত লালচে-হলুদ আতরের রঙ লেগে ছিল। তিনি অন্য সকলের বাইয়াত গ্রহণ। করতে থাকেন কিন্তু তাকে সরিয়ে দেন। অতঃপর তিনি বলেন: পুরুষদের। আতরের সুগন্ধ প্রকাশ পাবে কিন্তু রঙ প্রকাশ পাবে না। আর মহিলাদের আতরের রঙ প্রকাশ পাবে কিন্তু সুগন্ধ ছড়াবে না।” হাদীসটির সনদ সহীহ।” (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১৫৬)
এভাবে আমরা একাধিক হাদীসে দেখতে পাই যে, কোনাে পুরুষের হাতে বা শরীরে লাল বা হলুদ আতরের চিহ্ন থাকলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে তা ভালভাবে ধুয়ে দাগ তুলে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন । ধুয়ে দাগ না তােলা পর্যন্ত তিনি তার সাথে প্রয়ােজনীয় কথাবার্তা বলেন নি। (আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/৮১; ২৫০, আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/১৩৩; আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ ৭/২৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১৫৫-১৫৭)
?হলুদ রঙ বিষয়ক হাদীসগুলির সমন্বয়
এ সকল হাদীস থেকে আমরা আমরা নিম্নের বিষয়গুলি দেখতে পাই:
(১) দাড়ি ও চুলের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেহেদি, যাফরান, ‘কাতাম’ (মেহেদি বা মেন্দির ন্যায় এক প্রকারের উদ্ভিদ, যা থেকে কালচে রস বের হয়। হাদীসে মেন্দির সাথে কাতাম মিশ্রিত করে কালচে-হলুদ খেযাব দাড়ি ও চুলে ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে) ইত্যাদি দিয়ে হলুদ, লালচে হলুদ, নীলচে হলুদ বা কালচে হলুদ খেযাব (কলপ) দিতে উৎসাহ দিয়েছেন। নিজেও এরূপ করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে ।
(২) পােশাকের ক্ষেত্রে তিনি নিজে এরূপ যাফরান ও হলদে সুগন্ধি দিয়ে। পােশাক রঞ্জিত করেছেন এবং এ রঙ তিনি সবচেয়ে পছন্দ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে। তবে পােশাকের জন্য এ রঙ ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন বলে জানা যায় না।।
(৩) দেহের ক্ষেত্রে হাতে বা দেহের অন্যত্র তিনি যাফরান, মেহেদি বা খালুক’ আতর ব্যবহার করেছেন বলে জানা যাচ্ছে না। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এগুলি ব্যবহারের বিষয়ে তিনি আপত্তি করেছেন ।
যে সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলদে, লালচে হলদে, যাফরানী রঙ ব্যবহার করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি সবই চুল-দাড়ি বা পােশাকের বিষয়ে। দেহে বা হাতে তা ব্যবহারের উল্লেখ নেই। আবার যেগুলিতে তার আপত্তির কথা উল্লেখ সেগুলি বাহ্যত দেহে ব্যবহারের বিষয়ে। এ থেকে সাধারণভাবে বুঝা যায় যে, পােশাক ও চুল-দাড়ির ক্ষেত্রে হলুদ, লালচে হলুদ বা কালচে হলুদ রঙ, খেযাব বা সুগন্ধি ব্যবহার বৈধ। পক্ষান্তরে পুরুষের জন্য হাতে বা দেহে এরূপ রঙ বা খেযাব ব্যবহার আপত্তিকর।
হলুদ পােশাকের বিষয়ে আলিমগণের মতামত লাল পােশাকের মতই। আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আত-তামারতাশী (১০০৪ হি) তার তানবীরুল আবসার গ্রন্থে, আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) তার আদ-দুররুল আখতার গ্রন্থে ও আল্লামা মুহাম্মদ আমীন ইবনু আবেদীন (১২৫৬ হি) তাঁর হাশিয়াতু বাদ্দিল মুহতার গ্রন্থে এ বিষয়ে হানাফী ইমাম ও ফকীহগণের মতামত আলােচনা করেছেন। তাঁদের আলােচনার সার সংক্ষেপ এ যে, পুরুষদের জন্য ‘আসফার’ ও যাফরান মিশ্রিত লাল বা হলুদ রঙের পােশাক পরিধান বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকগুলি । মতের মধ্যে রয়েছে: (১) মুসতাহাব, (২) জায়েয, (৩), জায়েয তবে অনুত্তম বা মাকরূহ তানযীহী পর্যায়ের, (৪) কারাে মতে মাকরূহ তাহরীমী পর্যায়ের । এগুলির মধ্য থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মত ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।” (ইবনু আবেদীন, মুহাম্মদ আমীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ৬/৩৫৮)
অধিকাংশ ইমাম ও আলিম দ্বিতীয় মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের মতে হজ্জ ছাড়া অন্য সময়ে যাফরান মিশ্রিত বা হলুদ পােশাক পরিধান জায়েয । ইবনু হাজার আসকালানী ও অন্যান্য আলিম এ মতকেই সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। (ইবনু আব্দিল বারর, আত-তামহীদ ২/১৭৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৩/৪০১-৪০৪, ১০/৩০৫; শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৮৭-৯৩। )