কুরাইশ গোত্র মোট চৌদ্দটি উপগোত্রে বিভক্ত ছিল। বনু জুমাহ যার অন্যতম।

কুরাইশ গোত্র মোট চৌদ্দটি উপগোত্রে বিভক্ত ছিল। বনু জুমাহ যার অন্যতম। উসমান ইবনে মাজউন রা. এই উপগোত্রেই জন্মেছিলেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনামতে, তিনি মাত্র ১৩ জনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণকারী ১৪ তম ব্যক্তি। ব্যক্তিগতভাবে আমার করা ক্রমানুসারে তিনি ইসলাম গ্রহণকারী ১৫ তম ব্যক্তি। তাঁর ভাই কুদামা ইবনে মাজউন রা. তাঁর ভাই অপর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে মাজউন রা. তাঁর বোন জয়নাব বিনতে মাজউন রা. তাঁর পুত্র সায়িব ইবনে উসমান রা. তাঁর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকিম রা. তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ‘আস সাবিকুন আল আওয়ালুন’ অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণে অগ্রবর্তীদের অন্যতম। উমার রা. ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. ছিলেন ভগ্নিপুত্র এবং উম্মাহাতুল মুমিনিন হাফসা রা. ছিলেন তাঁর ভাগ্নি। মক্কা থেকে ইথিওপিয়ায় হিজরতকারী প্রথম দলটির নেতৃত্বে তিনি ছিলেন। সেই দলে উসমান বিন আফফান রা. ও তাঁর স্ত্রী, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা রুকাইয়া রা. সহ চৌদ্দ জন সাহাবি শরিক ছিলেন। মক্কার কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণ করেছে এমন একটি ভুল সংবাদে বিভ্রান্ত হয়ে তাঁরা পুনরায় মক্কা ফিরে আসেন। এ অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ তাঁদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অনিরাপদ। সেকালে আরবে যেহেতু কোনও রাষ্ট্র কাঠামো ছিল না। ফলত শাসন বলতে যা কিছু আছে সব নির্ভর করত গোত্র প্রধানের উপর। সুরক্ষার একমাত্র পথ ছিল গোত্র। যখন কেউ গোত্রত্যাগ করে অন্য কোনও অঞ্চলে বসতি গড়ে তখন সে গোত্রের সুরক্ষার (Safety chain) সম্পূর্ণ বাইরে চলে যায়। ফলে তাকে হত্যা করলে রক্তপণ দেবার দায়টুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। এই অবস্থায় প্রত্যেকের নিজ নিজ উপায়ে কোনও না কোনও নিরাপত্তাদাতার সন্ধান করে মক্কায় প্রবেশ ব্যতীত উপায় ছিল না। সেসময় উসমান ইবনে মাজউন রা. ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করেন। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা কা’বার সামনে তাঁর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের পক্ষ থেকে তাঁর নিরাপত্তার ঘোষণা দেন। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা ছিলেন বনু মাখযুমের গোত্রপতি। আবু জাহেল ছিল তারই গোত্রের। ফলত কারো পক্ষেই উসমান ইবনে মাজউন রা. এঁর ব্যাপারে তখন বক্রদৃষ্টিতে তাকাবারও সাহস ছিল না। কিন্তু তাঁর চোখের সামনেই অন্য সব অসহায় সাহাবারা নির্যাতিত হচ্ছিলেন। বিশেষত তাঁর স্বীয়গোত্র বনু জুমাহর গোত্রপতি উমাইয়া ইবনে খালফের কৃতদাস ছিলেন বিলাল রা.। উমাইয়া ইবনে খালফ মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় শীর্ষে ছিল। তিনি নিজে শান্তিতে আছেন অথচ অপরাপর মুসলমান অবর্ণনীয় নির্যাতনের মধ্য দিনাতিপাত করছে এটা খুব প্রবলভাবে নাড়া দেয় তাঁকে। তিনি আল ওয়ালিদ ইবনে মুগিরাকে অনুরোধ করেন যেন কা’বার সামনে গিয়ে ঘোষণা দিয়ে তাঁর দেওয়া নিরাপত্তা তিনি ফিরিয়ে নেন। সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করে ওয়ালিদ তা চাইছিলেন না। উসমান বিন মাজউন রা. তাকে বললেন, ‘আল্লাহর নিরাপত্তাই আমার জন্য যথেষ্ট।‘ তাঁর পুনঃ পুনঃ অনুরোধে ওয়ালিদ নিরাপত্তা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথেই তিনি শারীরিক হেনস্থার শিকার হন। তাঁর একটা চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওয়ালিদ বিন মুগিরা এ খবর জানতে পেরে তাঁকে দেখতে আসেন। আবারও নিরাপত্তা প্রদানের প্রস্তাব দেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর চে’ উত্তম নিরাপত্তা আর কেইবা দিতে পারে! বরং আমার সুস্থ চোখ তো আহত চোখকে ঈর্ষা করছে।‘ ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা তাঁর প্রতি স্নেহ পরবশ ছিলেম। আদতে উসমান ইবনে মাজউন রা. কুরাইশদের মধ্যে ইসলাম পূর্ব যুগ থেকেই উত্তম গুণের জন্য আদৃত ছিলেন। যেমন মদপান, পরনারী সঙ্গ, জুয়া থেকে নিজেকে তিনি সবসময় বিরত রেখেছেন। তিনি মদিনাতেও স্বপরিবারে হিজরত করেন। তিনি ছিলেন বদরি সাহাবি। মুহাজিরদের মধ্যে মদিনায় তিনিই প্রথম স্বাভাবিক মৃত্যু (Natarul death)বরণ করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তাঁকেই জান্মাতুল বাকীতে সমাধিস্থ করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁরই কবরের পাশে নিজ সন্তান ইব্রাহিম, জয়নাব, রুকাইয়াকে দাফন করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওঁরা ওঁদেরই পূর্ববর্তী উত্তমকর্মপরায়ণ উসমান বিন মাজউনের কাতারে শামিল হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যুর পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কপালে চুমু দিয়েছেন। তাঁর কান্নায় উসমানের কপোল সিক্ত হয়েছে। উসমান ইবনে মাজউন রা. এঁর মক্কার উদ্দিষ্ট ঘটনাটির দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, তিনি ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার না করালেও পারতেন। আর তা-ই ছিল যুক্তিযুক্ত। এটা নাজায়েজ কিছু ছিল না। স্বয়ং রাসুল্লাল্লাহ সা. আবু তালিব, মুতিম ইবনে আদি এমনকি আবু লাহাব প্রদেয় নিরাপত্তা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু উসমান ইবনে মাজউন রা. ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার দেওয়া সেই নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। অথচ নিরাপত্তা গ্রহণ করাটাই ছিল সতর্কতার পরিচয়। আদতে একেকজনের অন্তর একেকরকম হয়। তাঁর ইখলাসের দরুণ তিনি তা করেন নি। আলী রা. তাঁর এই বীরত্বের প্রশংসা কবিতা রচনা করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর বিরুদ্ধে কিছুই বলেন নি। এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়, বস্তুবাদী দুনিয়ার রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ, অর্থ, সম্পদ, সম্মান ও নিরাপত্তা যেমন নানাক্ষেত্রেই আমাদের কাছে বিবেচ্য তেমনি একজন মুমিনের ক্ষেত্রে ইখলাসের ব্যাপারটাও বিবেচ্য। আজকে স্বাস্থ্য সচেতনতার দরুণ মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহু আলেমের সম্মতিতেই ঠিক আছে। আমি, আপনি, আমরা যারা এর পক্ষে তারা তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু কোনও আলেম কিম্বা কোনও আবেদ যদি রব্বের ভয়ে যদি তাঁর ইখলাসের দরুণ মসজিদগুলো খুলে দিতে বলে। আপনি, আমি তা না-ই মানতে পারি। সে মত প্রত্যাখ্যান করতেই পারি। বিরোধিতাও করতে পারি। তবে এর জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, আমরা আমাদের জায়গায় নিজের মতকে ব্যক্ত করব। কিন্তু সেসব ব্যক্তিদের অপমানিত করার অধিকার কারোর নাই। ওয়াল্লাহি, ঐ রব্বের কসম, মসজিদে আমরা যাঁর গোলামির জন্য উপস্থিত হই। নিশ্চয় আপনার আমার এই গালির জন্য, এই বাড়াবাড়ির জন্য রব্বের কাছে জবাব দিতে হবে। আমাদের দ্বিমতের ক্ষেত্রে এই যে বিনয়ের বদলে ঔদ্ধত্য তার জন্য কি জবাব দেব আমরা? তাঁদের ইখলাস, তাঁদের আল্লাহ্‌ভীতির জন্য গালি দিয়েছি আমরা তাদের? ইমাম কুশাইরি রহ. লিখেন, একবার ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ একত্রে বসা ছিলেন। এইসময় শায়খ শাইবান আর-রায়ী রহ. সেদিকে আসলেন। শায়বান রহ. ছিলেন দরবেশ গোছের লোক। ফিকহি ইলম ছিল না। কিন্তু প্রচুর ইবাদাত করতেন। ইমাম আহমাদ রহ. তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘যদি কেউ কোনও এক ওয়াক্ত নামাজ পড়তে ভুলে যায়। আর পরে স্মরণ করতে না পারে যে, কোন ওয়াক্ত সে কাযা করেছে। এই ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কি বলবেন। তার কি করা উচিত?’ শাইবান রহ. বললেন, ‘এই অন্তর আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন। তার এমন সংশোধন দরকার যেন সে আর কখনওই নিজ রব্বের ব্যাপারে উদাসীন না হয়।‘ ইমাম আহমাদ রহ. এই জন্য প্রশ্ন করেছিলেন যে, শাইবান এই মাসআলার সমাধান দিতে পারবে না। ফলে সে ফিকহ অধ্যয়নের দিকে ধাবিত হবে। কিন্তু তিনি এমন এক উত্তর দিয়েছেন যে, ইমাম আহমাদ রহ. আল্লাহ্‌র সাথে তাঁর হৃদয়ের এই সম্পর্ক উপলব্ধি করে লজ্জায় বেঁহুশ হয়ে পড়েন। তাই মুমিনের ব্যাপারে মন্তব্যের আগে তাঁর ইখলাসের দিকে তাকান। ফেসবুকে মসজিদ প্রসঙ্গে অত্যন্ত বাড়বাড়ন্ত কথাবার্তা চলছে। বাস্তবতা হলো, যতখানি ইখলাস তারচে’ ঔদ্ধত্যপূর্ণ পোস্ট বেশি ছিল। কি মনে করি আমরা! ইসলামে বিধানকে নিজের মত সাজানোটা এত সআমর আল্লাহ্‌র জাত আর ইজ্জতের কসম, ইসলামে ইতিহাসের প্রথম যে নির্মিত মসজিদ, সে মসজিদে কুবা স্থাপিত হওয়ার পর থেকে- নামাজের বিধান নাজিল হওয়ার পর থেকে- গত সোয়া চৌদ্দ শত বছরের মধ্যে এই প্রথম প্রায় সমগ্র দুনিয়ায় মসজিদসমূহ বন্ধ। এইরকম ঘটনা উম্মতের ইতিহাসে অশ্রুতপূর্ব, অভূতপূর্ব। ফলে এটা নিয়ে ইখতিলাফ হবে না তো কি নিয়ে হবে? আমার মত দূর্বল ঈমানের লোককে হয়ত এ ঘটনা স্পর্শ করে নাই। কিন্তু বহু আল্লাহ্‌র গোলামের অন্তরে যন্ত্রণার আগুন জ্বালিয়েছে। তাঁদের প্রসঙ্গে মন্তব্যের ব্যাপারে সাবধান হউন। নামাজ বাড়িতেই আদায় করুন। মসজিদে জামায়েত সীমিতই থাকুক। বাড়াবাড়ি বন্ধ হোক। উম্মতের এই বেদনার কালকে অনুভব করুন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর দয়াই প্রকৃতপক্ষে একমাত্র পথ। বিজ্ঞানের আবিষ্কার কি কেবলই মানুষের সক্ষমতা? কখনোই না। বরং আল্লাহ্‌রই দয়া। জায়নামজের দোয়াই ল্যাবরেটরিতে মানুষকে বিজয় এনে দেবে। আসমানি রহমই সেখানে পথ দেখাবে। বস্তুবাদীতা আমাদের যেন অন্ধ না করে। #আরজু আহমেদ

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *