কেমন ছিলেন রাসূল ﷺ তাঁকে কি এতটাই তুচ্ছ মনে হয় তােমার? জানাে না তাঁর সৌন্দর্যের কথা? মনে নেই তাঁর সুমহান চরিত্রের কথা? তাঁর মহানুভবতা, উদারতা, বদান্যতা, বীরত্বের কথা? ভুলে গেছ কি সবই? কখনও কি তাঁর সম্পর্কে জানতেও ইচ্ছে হয় না? ইচ্ছে না হলেও আজ বলব। বলেই ছাড়ব। বড়াে ভাই হিসেবে এটুকু জোর তাে করতেই পারি। তবে বলি শুনাে—অসাধারণ সুন্দর ছিলেন তিনি। খুব বেঁটেও ছিলেন না, আবার অস্বাভাবিক লম্বাও ছিলেন না। একেবারে পার্ফেক্ট ছিল তাঁর উচ্চতা৷ তাঁর চুল খুব বেশি কোঁকড়ানাে না, আবার একেবারে খাড়াও ছিল না। গােলাপি আর গৌর বর্ণের মাঝামাঝি গায়ের রঙ ছিল তাঁর। সুন্দর গঠন ছিল, যা সটান সােজাও নয়, আবার ঝুঁকে পড়াও নয়। সুরমারাঙা চোখ ছিল তাঁর। ভুরু ছিল তলােয়ারের মতাে। কপাল অত্যধিক মাংসলও ছিল না, আবার শুকনােও ছিল না। দুই কাঁধের মধ্যিখানে ছিল নবুওতের মােহর। বুক ছিল প্রশস্ত। হালকা চুলের রেখা ছিল বুকের ওপর থেকে নাভি পর্যন্ত। লােমশূন্য ছিল দেহের অন্যান্য অংশ। হাত পা ছিল মাংসল। পেশি ছিল চওড়া। ঘামলে তাঁর চেহারা আরও সুন্দর মনে হতাে। ঘাম থেকে খুশবু বের হতাে। আয়িশা (রাঃ) তাঁর ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে কবিতা আবৃতি করতেন— তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম। চমকানাে মেঘ যেন চমকায় অবিরাম। তাঁর হাতের তালুর চেয়ে অন্য কারও তালু বেশি নরম ছিল না। রেশমের চাইতে বেশি কোমল ছিল তাঁর হাত। পায়ের গােড়ালি ছিল সরু। চলার সময় স্পন্দিত ভঙ্গিতে পা তুলতেন তিনি। হাঁটলে মনে হতাে যেন যমীন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে তাঁর জন্যে। কোনাে জিনিস তাঁর মতাে সুন্দর ছিল না। সূর্য জ্বলজ্বল করত চেহারায়। দূর থেকে দেখলে তাঁকে আরও উজ্জ্বল দেখাত। কাছ থেকে তাঁর মিষ্টি-মধুর ব্যক্তিত্ব অনুভব করা যেত। হঠাৎ কেউ তাঁকে দেখলে তাকিয়ে থাকত অবাক নয়নে। তিনি উঠতে বসতে আল্লাহর স্মরণ করতেন। ইস্তিগফার করতেন। অপছন্দ করতেন সমাবেশে তাঁর জন্যে স্পেশাল জায়গা রাখাটা। মজলিসের যেখানেই জায়গা পেতেন, সেখানেই বসে যেতেন। উপস্থিত সবাইকে দেখতেন সমান চোখে। সবাই ভাবত তিনি তাকেই বেশি মহববত করেন। অনর্থক কোনাে কথা আলােচিত হতাে না তা মজলিসে। সে মজলিস হতে ইলম ও আমানতদারিতার মজলিস। সেখানে উচ্চস্বরে কথা বলতাে না কেউ। মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হতাে না কারও। স্থান পেত না অশালীন কোনাে আলােচনা। কাউকে হুমকি-ধমকি দিয়েও কথা বলা হতাে না। মজলিসে কারও প্রয়ােজন দেখা দিলে তা পুরাে করা হতাে। ছােটো-বড়াে সবাই মতামত পেশ করার সুযােগ পেত। সুস্পষ্ট প্রকাশভঙ্গি ছিল তাঁর। কথা খুব সংক্ষিপ্তও ছিল না, আবার দীর্ঘও ছিল না। তিনি যখন কথা বলতেন, দেখে মনে হতাে যেন আলােকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে দাঁতের ফাঁক দিয়ে। কথা বলতেন তিনি প্রাঞ্জল ভাষায়। অলঙ্কৃত ভাষা ছিল তাঁর। অল্প কথায় গভীর ভাব প্রকাশ করতে পারতেন। আরবের সব গােত্রের ভাষারীতি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন তিনি। প্রত্যেক গােত্রের সাথে কথা বলতেন তাদের বাগরীতিতে৷ বেদুইনদের মতাে দৃঢ়তাব্যঞ্জক বাচনভঙ্গি আবার শহুরে নাগরিকদের বিশুদ্ধ ভাষা, সবই ছিল তাঁর আয়ত্তাধীন। তাঁর কথা ছিল সুস্পষ্ট। উপস্থিত লােকেরা সে কথার মর্ম বুঝতে পারত। অনর্থক এদিক-সেদিকের আলােচনা করতেন না কখনও। বাহুল্যবর্জন করতেন কথায়। তার মুখ দিয়ে শুধু এমন কথাই বের হতাে, যা কল্যাণকর। তিনি বলা শুরু করলে, সাথিরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন; দেখে মনে হতাে যেন চড়ই বসে আছে তাঁদের মাথায়। টু শব্দটিও করতেন না কেউ। সাথিদের কেউ কথা বললে তিনি পূর্ণ মনােযােগ দিতেন তাঁর দিকে। নীরব থাকতেন কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অতিমাত্রায় প্রশংসা করতেন না কারও। কারও প্রতি রুষ্ট হলেও ধমক দিতেন না। যে কথা শুনে তাঁর সাথিরা অবাক হতাে, সে কথায় তিনিও অবাক হতেন। যে কথায় সাথিরা হাসত, সে কথায় তিনিও হাসতেন। তবে কেউ জোরে হাসত না তার সামনে। তিনি নিজেও জোরে হাসেননি কখনও। মুচকি হাসিই ছিল তাঁর চিরচেনা বৈশিষ্ট্য। কেউ লম্বা করে কথা বললে তিনি বিরক্ত হতেন না। অপরিচিত কেউ অসংযমী হলে ধৈর্য হারাতেন না তিনি। কোনাে প্রয়ােজনে তাঁর কাছে এলে, তিনি উঠে যেতেন না প্রয়ােজন পুরাে না হওয়া পর্যন্তু। কেউ কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না খালি হাতে। কিছু না থাকলে বলতেন, পরে এসাে। সর্বাধিক লাজুক ছিলেন তিনি। কারও চেহারার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন না। তাঁর লজ্জাশীলতা এত বেশি ছিল যে, সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না মুখের ওপর। কারও দোষ-ত্রুটি দেখলে তাকে অপমান করতেন না মানুষের সামনে। কবি বলেন, লজ্জাশীল তিনি তাই দৃষ্টি নত তাঁর, তাঁকে দেখে চোখের নজর, নত যে সবার। তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয় তখন, অধরে তাঁর মৃদু হাসি ফোটে যখন। রেষারেষি থেকে তিনি ছিলেন সর্বদাই দূরে। তাঁর ক্ষমার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদেরও তিনি ক্ষমা করেছেন৷ রক্তাক্ত করার পরেও ক্ষমা করেছেন রক্তাক্তকারীদের। নিজের স্বার্থের জন্যে প্রতিশােধ নেননি কারও কাছ থেকে। তবে কেউ আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করলে তিনি তাকে শাস্তি দিতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক, বিনম্র, অতুলনীয় সৌজন্যবােধের অধিকারী ও উদার স্বভাবের মানুষ। অনিচ্ছাকৃতভাবেও অশালীন কথা বলেননি তিনি। অশ্লীল কাজ করেননি কখনও। তাঁকে দুটি কাজের একটিকে বেছে নিতে বলা হলে—যদি সেটা গােনাহের কাজ না হতাে—তবে তিনি সহজটিই বেছে নিতেন। ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। ছিলেন সত্যবাদী ও বিশিষ্ট আমানতদার। তাঁর শত্রু-মিত্র সকলেই এ ব্যাপারে একমত। উপাধি ছিল তাঁর ‘আল-আমীন’। চিরশত্রু আবু জাহল পর্যন্ত তাঁর সত্যবাদিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিত। আত্মীয়তার সম্পর্ক পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন তিনি। আত্মীয়দের সাথে হৃদ্যতা ও বদান্যতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সব সময় আত্মীয়দের খোঁজখবর রাখতেন। ভালাে খাবার পেলে পৌঁছে দিতেন তাদের বাড়িতে। তান মন্দের বদলা মন্দ দিয়ে দিতেন না। মন্দের বিপরীতে অবলম্বন করতেন ক্ষমার নীতি। কেউ তাঁর হাত ধরলে তিনি ছাড়িয়ে নিতেন না। যে-কেউ তাঁকে দাঁড় করিয়ে কথা বলতে পারত। ছােটো ছােটো বাচ্চারা তাঁর হাত ধরে অনেকদূর নিয়ে যেত। দাস-দাসীদের প্রতি কখনোও খারাপ আচরণ করেনি তিনি। গালি দেননি কোনাে দাসকে। এমনকি কথাও বলেননি, কেন তুমি এটা করলে না?’ কিংবা এও বলেননি, কেন তুমি এটা করলে?’ তাঁর পােশাক-পরিচ্ছদ দাসদের থেকে উন্নত ছিল না। গরিব-মিসদের তিনি ভালােবাসতেন। ওঠাবসা করতেন গরিবদের সাথে। খোঁজখবর নিতেন । নিজেই ইমামতি করতেন গরিবদের জানাযায়। কিয়ামতের দিন গরিবদের সাথে উঠার দোয়া করতেন। তিনি সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবিশ্যি সে চিন্তা আরাম আয়েশের জন্যে নয়, ক্ষমতার জন্যেও নয়। চিন্তা করতেন উম্মাহর কল্যাণের জন্যে। পানাহার দ্রব্যের সমালােচনা করতেন না তিনি। স্বল্প-দামি হাদীয়া এলেও তা গ্রহণ করতে সংকোচ বােধ করতেন না। ইশারা করতে তিনি হাতের পুরাে তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত উল্টোতেন। দৃষ্টি নিচু করতেন খুশি হলে। রাগান্বিত হলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। সব সময় ঐক্যবদ্ধ রাখতেন সাথিদের। সাথিদের খোঁজখবর নিতেন। কুশলাদি বিনিময় করতেন তাঁদের সাথে। সম্মান করতেন সকল গােত্রের নেতৃস্থানীয় লােকদের। সম্মানিত লােকদেরই নেতা মনােনীত করতেন। সাবধান থাকতেন মানুষের অনিষ্ট থেকে। মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন সব বিষয়ে। তাঁর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি ছিল তাকওয়া। যে-কোনাে পরিস্থিতির জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতেন তিনি। সত্য ও ন্যায় থেকে দূরে থাকাকে অপছন্দ করতেন। সর্বদা দূরে থাকতেন অন্যায় থেকে। কিন্তু কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করতেন। তিনি ছিলেন নিরহংকার, অতি বিনয়ী। কেউ তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি তা অপছন্দ করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও মাথায় মুকুট পরেননি কোনােদিন। মণিমুক্তো জমিয়ে রাখেননি ঘরে। যা হাদিয়া পেয়েছেন, সবই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছেন। কখনও ব্যাকুল হননি দামি পােশাকের জন্যে। তালি-দেওয়া জামা গায়ে দিয়েছেন। মাসের-পর-মাস আগুন জ্বলেনি তাঁর উনুনে। পুরাে মাস পার করেছেন সাধারণ মানের খেজুর ও পানি খেয়ে। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। শত্রুরা যখন তীব্র আক্রমণ শুরু করত, তখন সাথিরা তাঁর আড়াল গ্রহণ করতেন। শত্রুর ভয় তাঁকে ভীত করেনি কভু। ময়দান থেকে কখনও পালিয়ে যাননি তিনি। কখনও বিচলিত হননি সংখ্যাধিক্যের ভয়ে। বড়ো বড়াে বাহাদুররা যখন পিছপা হতাে, তখনও তিনি দঢ়চিত্তে সামনে এগিয়ে যেতেন। হুনাইনের যুদ্ধে তাঁর সাথিরা যখন সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে ছটোছুটি শুরু করছিলো, সেদিনও তিনি ময়দানে দাঁড়িয়ে নির্ভীকের মতাে বলছিলেন— আমি সত্য নবি মিথ্যা নবি নই। আর আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান। ইনিই হলেন মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ। ইনিই সেই ব্যক্তি, যাঁকে বাছাই করা হয়েছে তােমার আদর্শ হিসেবে। তমি এমন কোন আদর্শ চাও, যা তাঁর মধ্যে নেই? তুমি যদি একজন আল্লাহভীরু বান্দাহকে দেখতে চাও, তবে সালাতের-পর-সালাত পড়ে নিজের পদযুগল ফুলিয়ে ফেলা মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন অত্যাচারিত-উৎপীড়িত অসহায়কে দেখতে চাও, তবে তায়েফের ময়দানে পাথরের আঘাতে জর্জরিত মুহাম্মাদ ﷺ – এর দিকে তাকাও। তুমি যদি একজন সত্যনিষ্ঠ মনিষীকে দেখতে চাও, তবে মক্কার পূত-পবিত্র আল-আমীনের দিকে তাকাও। যদি অসত্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কাউকে দেখতে চাও, তবে জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে চির-বিদ্রোহী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন আদর্শ যােদ্ধাকে দেখতে চাও, তবে বদরের সফল যােদ্ধা মুহাম্মাদ ﷺ – এর দিকে তাকাও। যদি একজন নির্ভিক সেনানায়ককে দেখতে চাও, তবে হুনাইনের একনিষ্ঠ বীর সেনানী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন রক্তাক্ত নির্ভিক কমান্ডারকে দেখতে চাও, তবে ওহুদের যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত মুহাম্মাদ ﷺ – এর দিকে তাকাও। যদি একজন আদর্শ স্বামীকে দেখতে চাও, তবে খাদিজা (রাঃ) কিংবা আয়িশা (রাঃ)- এর প্রেমময় নিষ্কলুষ স্বামী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন আদর্শ পিতাকে দেখতে চাও, তবে ফাতিমার (রাঃ) স্নেহময় পিতা মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন আদর্শ নানাকে দেখতে চাও, তবে হাসান (রাঃ) কিংবা হুসাইনকে (রাঃ) মাথায় করে সালাতে দাঁড়ানাে মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন আদর্শ ব্যবসায়ীকে দেখতে চাও, তবে সিরিয়া ও বসরার বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। যদি একজন শ্রেষ্ঠ দানবীরকে দেখতে চাও, তবে স্বর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে মাটির বিছানায় শয়নকারী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দিকে তাকাও। বাকি অংশ কমেন্টে…