তাওহিদের গুরুত্ব

কিয়ামতের দিন মানুষের মুক্তি দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
MPHS_02
১. ইমান,
২. নেক আমল।

ইমান দ্বারা উদ্দেশ্য—আল্লাহ তাআলার সত্তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা; রিসালত এবং আখিরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা; ফেরেশতা এবং অবতীর্ণ কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা; ভালাে এবং মন্দ ভাগ্যলিপির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। রাসুল সা. বলেছেন,

ইমানের রয়েছে সত্তরের অধিক শাখা। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ শাখা “লা ইলাহা ইলাল্লাহ”র সাক্ষ্য দেওয়া। সর্বনিম্ন হলাে পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা ইমানের বিশেষ অঙ্গ।’ (সহিহ মুসলিমঃ ৫৮) অর্থাৎ,ইমানের ভিত্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।

নেক আমল দ্বারা উদ্দেশ্য সেসব আমল, যা রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ অনুসারে পালিত হবে। নিঃসন্দেহে পারলৌকিক মুক্তির জন্য সৎকর্ম সবিশেষ গুরুত্ব রাখে। তবে তাওহিদের আকিদা এবং নেক আমলের মধ্যে তাওহিদের আকিদার গুরুত্ব বেশি।

তাওহিদের আকিদা বিশুদ্ধ থাকলে কিয়ামতের দিন আমলের ত্রুটি ও কমতি ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু আকিদার মধ্যে যদি ত্রুটি থাকে— যেমনঃ শিরকি আকিদা বা শিরক মিশ্রিত আকিদা, তাহলে আকাশ ও ভূমির প্রশস্ততা-পরিমাণ নেক আমলও অনর্থক এবং নিস্ফল বলে প্রতীয়মান হবে। সুরা আলে ইমরানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কাফিররা যদি পূর্ণ পৃথিবীর সমপরিমাণ স্বর্ণও সদকা করে, তবুও ইমান আনয়ন ব্যতিরেকে আল্লাহ তাআলার কাছে তাদের এই বিপুল পরিমাণ আমল গৃহীত হবে না। বর্ণিত আছে—

যারা কুফর অবলম্বন করেছে ও কাফির অবস্থায়ই মারা গেছে, তাদের কারও থেকে পৃথিবী ভরতি স্বর্ণও গৃহীত হবে না, যদিও তারা নিজেদের প্রাণরক্ষার্থে তা দিতে চায়। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং তাদের জন্য নেই কোনাে সাহায্যকারী। (সুরা আলে ইমরানঃ ৯১)

শুধু এতটুকুই নয়, তাদের নেক আমলগুলাে নিষ্ফল করে দেওয়া হবে; বরং কুফরি আকিদার কারণে তাদের কষ্টদায়ক শাস্তিও দেওয়া হবে। কেউই তাদের জন্য সাহায্য বা সুপারিশ করতে পারবে না। সুরা আনআমে নবিগণের পবিত্র জামাআত- ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, নুহ, দাউদ, মুসা, হারুন, জাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ইসমাইল, ইয়াসা, ইউনুস এবং লুত আ. -এর কথা উল্লেখের পর আল্লাহ তা’আলা বলেন,

আর যদি তারাও শিরক করত, তাহলে তাদের নেক আমলগুলাে
ধ্বংস হয়ে যেত। [সুরা আনআম : ৮৮]।

শিরকের নিন্দায় কুরআন মাজিদে আরও এসেছে
,

অবশ্যই আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যারা গত হয়েছে, তাদের প্রতি এই মর্মে ওহি অবতীর্ণ করা হয়েছে যে, যদি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেন, তাহলে আপনার কর্ম নিচ্ছল হয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। [সুরা জুমারঃ ৬৫]

আপনি আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনাে ইলাহাকে ডাকবেন না। নতুবা আপনি শাস্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। [সুরা শুআরাঃ ২১৩]

উপরিউক্ত আয়াত দুটিতে আল্লাহ তাআলা সূদৃঢ় এবং দ্ব্যর্থহীন সম্বােধনে প্রিয় রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ -কে বলছেন, ‘আপনিও যদি শিরক করেন, তাহলে আপনার সব নেক আমল ধ্বংস হয়ে যাবে; তদুপরি অন্য মুশরিকদের সাথে আপনাকেও জাহান্নামের শাস্তি ভােগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন; আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। [সুরা মায়িদা : ৭২]

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সঙ্গে শিরক করে। এ ছাড়া যেসব গুনাহ রয়েছে; যার জন্য ইচ্ছা করেন, সেগুলাে ক্ষমা করেন। [সুরা নিসা : ১১৬]

উপরিউক্ত আয়াত দুটির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রতিভাত হলাে যে, আল্লাহ তাআলার কাছে শিরক অমার্জনীয় অপরাধ। শিরক ছাড়া কোনাে গুনাহ এমন নেই, যাকে আল্লাহ তা’আলা অমার্জনীয় বলে অভিহিত করেছেন বা যাতে লিপ্ত হলে জান্নাত হারাম করার ঘােষণা দিয়েছেন। শিরকের ওপর যাদের মৃত্যু হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করাকেও নিষিদ্ধ করেছেন।

নবি এবং মুমিনদের জন্য এটা সংগত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে; যদিও তারা আত্মীয় হয় এ কথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে, তারা জাহান্নামি। [সুরা তাওবা :১১৩] ।

শিরকের নিন্দায় অসংখ্য-অগণিত হাদিস বর্ণিত আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কয়েকটি উল্লেখ করছিঃ

  1. রাসুল সাঃ মুআজ রাঃ কে ১০র্টি উপদেশ দিয়েছিলেন। যার মধ্যে শীর্ষ উপদেশ ছিল–

আল্লাহর সঙ্গে কোনােকিছুকে শরিক করবে না; যদিও তােমাকে হত্যা করা হয় এবং অগ্নিদগ্ধ করা হয়। ( মুসনাদে আহমাদঃ ২২০৭৫)

  1. রাসুল সাঃ বলেন,

তােমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু থেকে বেঁচে থেকো। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলাে কী? তিনি বললেন,
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা;
২. জাদু করা;
৩. অন্যায়ভাবে হত্যা করা;
৪. এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা;
৫. সুদ খাওয়া;
৬. যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং
৭. সাদাসিধে ইমানদার নারীদের ওপর অপবাদ আরােপ করা। (বুখারিঃ ২৭৬৬; মুসলিমঃ ১৪৫)

  1. রাসুল সাঃ বলেন,
    আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার গুনাহ ক্ষমা করেন, যতক্ষণ-না পর্দা পড়ে যায়। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, পর্দা পড়ে যাওয়ার কী অর্থ হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, এর অর্থ হলাে, কোনাে প্রাণ মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।’ (মুসনাদে আহমাদঃ ২১৫২৩; সহিহ ইবনে হিব্বানঃ ৬২৬)

এসব আয়াত এবং হাদিস দ্বারা এ কথা অনুমান করা দুষ্কর হয় না যে, শিরকই হলাে এমন পাপ, যার পরিণতিতে মানুষের ধ্বংস এবং বরবাদি নিশ্চিত। কয়েকটি দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যেতে পারে :

  1. এক ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবে। তার অবস্থা
    এই হবে যে, তার ৯৯টি খাতা থাকবে গুনাহ দ্বারা পরিপূর্ণ। গুনাহের পরিমাণ দেখে সে হতাশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ তাআলা তাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, “আজ কারও ওপর অবিচার করা হবে না। আমার কাছে তােমার একটা নেকি রয়ে গেছে। এ জন্য যাও, মিজানের কাছে যাও।”
    রাসুল সাঃ বলেন, তখন তার সব গুনাহ এক পাল্লায় রাখা হবে এবং সেই একটা নেকি অপর পাল্লায় রাখা হবে। সেই এক নেকির পাল্লা গুনাহের পাল্লার ওপর ভারী হয়ে যাবে। নেকিটি হলাে, “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। (সুনানুত তিরমিজি)
  2. এক বৃদ্ধ ব্যক্তি রাসুল সাঃ-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসুল, সারাটা জীবন গুনাহের মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। এমন কোনাে গুনাহ নেই যা আমি করিনি। পৃথিবীর সৃষ্টিজীবের মধ্যে যদি আমার গুনাহ বন্টন করে দেওয়া হয় তাহলে তা সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এ অবস্থায় আমার কি তাওবার কোনাে সুযােগ রয়েছে?’ রাসুল সাঃ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?’ সে বলল,”‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনাে ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহ তাআলার বান্দা এবং রাসুল।” রাসুল বললেন, “যাও, আল্লাহ তাআলা পাপরাশি মােচনকারী এবং তিনি পাপকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তনকারী।” সে বলল, আমার সব গুনাহ এবং অপরাধ কি ক্ষমা করে দেওয়া হবে?’ রাসুল সাঃ বললেন, “হ্যাঁ, তােমার সব গুনাহ এবং অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (তাফসিরে ইবনে কাসির)

একদিকে রাসুল সাঃ -এর আপন চাচা, যিনি দীনের ব্যাপারে জীবনভর তাঁর আপ্রাণ সহযোগিতা করেছেন; কিন্তু তাওহিদের আকিদীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন না করায় জাহান্নামের উপযুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে একজন অপরিচিত ব্যক্তি, যার সঙ্গে রাসুল সাঃ -এর রক্তের সম্পর্ক নেই, আবার সে নিজের অগণিত গুনাহের কথা স্বীকারও করছে; কিন্তু তাওহিদের আকিদার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের কারণে জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে গেছে।

এই নাতিদীর্ঘ আলােচনার সারকথা হলাে, কিয়ামতের দিন মুক্তির একমাত্র ভিত্তি হবে মানুষের আকিদা-বিশ্বাস। আকিদা-বিশ্বাস যদি কিতাব এবং সুন্নাহর আলােকে নির্ভেজাল তাওহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে নেক আমলসমূহ সওয়াব এবং প্রতিদানপ্রাপ্ত হওয়ার উপযােগী হবে। পক্ষান্তরে আকিদা যদি তাওহিদের পরিবর্তে শিরকের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে পৃথিবীসমতুল্য নেক আমলও নিষ্ফল এবং অগ্রাহ্য হবে।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *