দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার দুঃখ – কষ্টগুলােও ক্ষণস্থায়ী। এগুলাে একদিন ঠিকই ফুরােবে। কিন্তু আখিরাতের দুঃখকষ্ট গুলাে ফুরােবে না কখনও। একথা সে মাথায় রাখে সব সময়। ফলে দুনিয়ার ক্ষতিটাকে পরীক্ষা আর আখিরাতের ক্ষতিটাকে সর্বনাশা ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করে।
“অতঃপর আল্লাহ খারাপ লােকদের একজনকে আরেকজনের ওপর রেখে সকলকে স্তুপীকৃত করবেন, এরপর এদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (প্রকৃতপক্ষে ) এই লােকগুলােই চরম ক্ষতিগ্রস্ত।”[সূরা আল-আনফাল, ৩৭]
সে দুনিয়ার ব্যথা-বেদনাগুলাের ওপর সর্বদা সবর করে। এগুলােকে আল্লাহর থেকে আসা পরীক্ষা মনে করে ধৈর্য ধরে। সে যা পায়নি, তা নিয়ে কখনও আফসোস করে না। কারণ সে বিশ্বাস করে—না পাওয়া বস্তুটা তারই ছিল না। আর যে জিনিশ তার নয়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটা একধরনের বােকামাে মনে হয় তার কাছে সে
দুনিয়াকে একটা পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। এবং বিশ্বাস করে—দুনিয়ায় তাঁকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা হবে। কখনও ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে, কখনও ব্যবসার
লসের মাধ্যমে, কখনও-বা প্রিয় জিনিস তুলে নেওয়ার মাধ্যমে।
“আমি তােমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি কিছু একটা দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আর তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যধারণকারীদের।”[সূরা বাকারা, ১৫৫]
তাই পরীক্ষায় ভালাে মার্কস পাওয়ার জন্যে সব সময় প্রস্তুত রাখে নিজেকে। সে যদি ভালাে কিছু পায়, তাে রবের শুকরিয়া আদায় করে। আর যদি কিছু হারায়, তবে ধৈর্যধারণ করে। কারণ সে জানে, এই ধৈর্যই তাঁকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে।
“তাদেরকে তাদের ধৈর্যধারণের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত দেওয়া হবে। সেখানে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানাে হবে সংবর্ধনা ও সালাম সহকারে। তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। অবস্থান ও আবাসস্থল হিসেবে তা কতই-না উত্তম!”[সূরা ফুরকান, ৭৫-৭৬]
যদি দীর্ঘদিন কষ্ট করার পরও ভালাে জব না পায়, কিংবা ব্যবসায় মােটা অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়, অথবা কোনাে প্রিয় জিনিস যদি হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে, তখনও মনমরা হয়ে পড়ে থাকে না। কারণ, তার রবের ওয়াদা মমতার পরশে শুনিয়ে দেয়ঃ
“আমি যখন আমার মুমিন বান্দার কোনাে প্রিয়তম কিছু দুনিয়া থেকে তুলে নিই আর সে ধৈর্যধারণ করে, তার জন্যে জান্নাত ব্যতীত অন্য কোনাে প্রতিদান নেই
আমার কাছে।” [বুখারি, ৫৯৮১]
কেউই যখন তাকে বুঝতে চায় না, তার সমস্যাগুলাে শুনতে চায় না, কিংবা প্রিয় কেউ ভুল বুঝে দূরে চলে যায়, তখনও সে একাকীত্ব অনুভব করে না। বরং খুশিমনে বলতে থাকেঃ
“আমি তাে আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি।”[সূরা ইউসুফ, ৮৬]
আল্লাহর ভালােবাসা পাওয়ার জন্যে হারামের সাথে সম্পর্ক আছে এমন চাকুরি ছেড়ে দিয়ে সে যখন সামান্য মাইনেতে ছােটোখাটো কোনাে জব করতে থাকে আর তাই দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরা হাসি-তামাশা করে, তখনও সে বিচলিত হয় না। কারণ, সে জানেঃ
“আল্লাহ যখন কোনাে বান্দাকে ভালােবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুককে ভালােবাসেন। অতএব তুমিও তাকে ভালােবাসে।
(এ কথা শােনার পর) জিবরীলও তাকে ভালােবাসতে শুরু করেন। এরপর সে (জিবরীল) আকাশবাসীদের মধ্যে ঘােষণা করে দেন—“আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালােবাসেন। কাজেই তােমরাও তাকে ভালােবাসাে। তখন আকাশবাসীরাও ওই বান্দাকে ভালােবাসতে শুরু করে। অতঃপর পৃথিবীতে তাকে সম্মানিত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।”[বুখারি, ৩২০৯]
শত্রুভাবাপন্ন লােকদের হাজারও ঠাট্টা-মশকারা তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যত করতে পারে না। নিন্দুকেরা যখন তাকে নিয়ে কানাঘুষাে করে, তখন এই আয়াত স্মরণ করে তার অন্তর প্রফুল্ল হয়ে ওঠেঃ
“সম্মান তাে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের জন্যই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।” [সূরা মুনাফিকুন, ৮]
যখন কোনাে দুঃখ-দুর্দশা-কষ্ট এসে কড়া নাড়ে তার দরজায়, তখন আল্লাহর বাণী তাকে সান্ত্বনা প্রদান করেঃ
“নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।” [সূরা আশ-শারহ, ৫]
রাত জেগে মাসের-পর-মাস পড়শােনা করার পরও ভালাে জবটা যদি তার হাতছাড়া হয়ে যায়, কিংবা রক্ত পানি করে উপার্জিত টাকাগুলাে যদি ছিনতাই হয়ে যায়, এমনকি দুর্ঘটনায় যদি তার অঙ্গহানিও হয়ে যায়, তবুও হাল ছাড়ে না সে। এমনকি এটুকুও বলে না “ইশ! আমি যদি আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করতাম, তবে তাে এমনটা হতাে না। কারণ, তার রাসুল , তাকে শিখিয়েছেনঃ
“…আর যদি তােমাদের ওপর কোনাে (বিপর্যয়) আসে, তা হলে এমন কথা বলবে না যে, “ইশ, যদি আমি এমনটি না করতাম, তা হলে আমার আজ এমন পরিণাম ভুগতে হতাে না। বরং বলবে, আল্লাহ (তাকদীরে) যা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, তা-ই হয়েছে। যদি কথাটা শয়তানের দরজা খুলে দেয়।”[মুসলিম, ৬৪৪১]
কখনও যদি সে অর্থসঙ্কটে পড়ে যায়, কিংবা একের-পর-এক যাতনা, বিপদ, অসুস্থতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা কিংবা ক্ষতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতে থাকে, তবুও সাহস হারায় না। মনােবল ভেঙে পড়ে না তার। কারণ, তার পিঠে হাত বুলিয়ে নবি না বলতে থাকেনঃ
“সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন নবিরা, অতঃপর তাঁদের নিকটবর্তীরা, এরপর এদের নিকটবর্তীরা। মানুষকে তার ঈমান অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। যদি তার ঈমান শক্তিশালী হয়, তা হলে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়। আর যদি তার ঈমান দুর্বল হয়, তা হলে তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে হালকা হয়। বিপদ বান্দার পিছু ছাড়ে না, পরিশেষে তার অবস্থা এমন হয় যে, সে পাপমুক্ত হয়ে যমীনে চলাফেরা করে।” [তিরমিযি, ২৪০১, সহিহ]
সে আরও হিম্মত পায় যখন শুনে রাসূল ও তাকে লক্ষ করে বলছেনঃ
“মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে-সকল যাতনা, রােগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এসবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।”[বুখারি, ২১৩৭]
ওর পাশেই যখন কেউ পর্ন-মিউজিক-নারী-অ্যালকোহলের মাধ্যমে মাস্তি করতে থাকে, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এগুলাে থেকে। শক্ত করে যমীন কামড়ে ধরে অশ্লীলতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। কখনও ঝরে যায় না। হারিয়ে যায় না অমবস্যার নিকষকালাে আঁধারে। কারণ সে জানে—জান্নাতের অনাবিল সুখ-শান্তির কাছে এসব তাে কিছুই না।
“তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ তাদের জন্যে যেসব চোখজুড়ানাে বস্তু লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তা কেউই জানে না।”[সূরা সাজদা, ১৭]
যুবক বয়সেই দ্বীনের ওপর চলার কারণে যখন কেউ ঠাট্টা-মশকারা করে তাকে নিয়ে, তাকে ব্রেইন ওয়াশড বলে গালি দেয়, তখন সে কুরআনের এই আয়াত স্মরণ করেঃ
“অপরাধীরা মুমিনদের উপহাস করত এবং তারা যখন মুমিনদের পাশ দিয়ে গমন করত, তখন পরস্পর চোখ টিপে ইশারা করত। যখন তারা পরিবার পরিজনের কাছে ফিরত, তখন (মুমিনদের ঠাট্টা করে আসার জন্যে) তারা ফিরত উৎফুল্ল হয়ে। আর যখন মুমিনদেরকে দেখত, তখন বলত—এরা তাে অবশ্যই বিভ্রান্ত।”[সূরা মুতাফফিফীন, ২৯-৩২]
সে এই আয়াত বারবার স্মরণ করে, আর বিস্মিত হয়। আল্লাহ সাড়ে চৌদ্দ শ বছর। আগেই ওসব লােকদের কথা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা আজ তাকে ব্রেইন ওয়াশড বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। সে মােটেও মন খারাপ করে না ওদের কথা শুনে। সে জানে—একদিন তারও সুযােগ আসবে। সে সিংহাসনে বসে ওদের উপহাস ওদেরকেই ফিরিয়ে দেবে।
“আজ মুমিনগণ অবিশ্বাসীদের উপহাস করছে। সিংহাসনে বসে তাদের (অবিশ্বাসীদের) অবস্থা দেখছে। (আর বলছে,) অবিশ্বাসীরা তাদের কৃতকর্মের ফল পেলাে তাে?”[সূরা মুরাফফিফীন, ৩৮-৩৬]
মুমিন যদি সুখের মধ্যে থাকে, সেটাও তার জন্যে কল্যাণকর। আবার যদি কষ্টের ভেতরে থাকে, সেটাও তার জন্যে কল্যাণকর। মুমিনের কোনাে লস প্রজেক্ট নেই। সবটাই তার লাভ।
“মুমিনের বিষয়টি বড়ােই বিস্ময়কর! তার সবকিছুই কল্যাণকর; মুমিন ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে সেটি প্রজোয্য নয়। তার জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি এলে সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে ফলে তা হয় তার জন্য কল্যাণকর। আর দুঃখ-দুর্দশার মুখােমুখি হলে সে ধৈর্যধারণ কর। ফলে তাও হয় তার জন্য কল্যাণকর।” [মুসলিম, ২৯৯৯]
এভাবেই একজন সত্যিকারের মুমিন সব সময় আত্মিক তৃপ্তির মধ্যে থাকে। সর্বদা প্রশান্ত থাকে তার হৃদয়। জান্নাতীসুখ অনুভব করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
“যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার পুরুষ হােক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব।”[সূরা নাহল, ৯৭]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা -এর কিছু কথা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, ওটা শুনিয়েই ইতি টানছিঃ
“সুতরাং মহান প্রতিপালকের ইবাদাত, ভালােবাসা এবং তার প্রতি অভিমুখী হওয়া ছাড়া কোনাে বান্দার অন্তর সংশােধিত হবে না, সফলতা লাভ করবে না, কোনােপ্রকার স্বাদ গ্রহণ করবে না, আনন্দিত হতে পারবে না, তৃপ্তি পাবে না, স্বস্তি লাভ করবে না এবং কিছুতেই প্রশান্ত হতে পারবে না। যেসব বিষয়ের দ্বারা সৃষ্টিজীব স্বাদ লাভ করে, এমন সবকিছুও যদি সে অর্জন করে ফেলে, তবুও তার অন্তর প্রশান্ত হবে না, স্বস্তি লাভ করবে না। কারণ তার অন্তর সত্তাগতভাবেই নিজ প্রতিপালকের মুখাপেক্ষী। তিনিই তার পালনকর্তা, প্রেমাস্পদ এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। তাই স্রষ্টাকে পেলেই কেবল প্রফুল্লতা, আনন্দ, স্বাদ, নিয়ামাত, স্বস্তি এবং প্রশান্তি অর্জিত হতে পারে।” [আল-উবুদিয়্যাহ, পৃষ্টা, ১২০]