পহেলা বৈশাখ : সূচনাকাল, ইতিহাস ও শরয়ি বিধান
আমাদের এ বঙ্গদেশে প্রতি বাংলা নববর্ষে ঘটা করে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। হিন্দু-মুসলিম, দল-মত নির্বিশেষে সবাই-ই এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে। অনেকে বলে এটা বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, কারও মতে এটা দেশীয় সংস্কৃতি, আর কারও নিকট এটা নিছক রং-তামাশা ও আনন্দ-উৎসব। একধাপ এগিয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবি এটাকে ইসলামের দৃষ্টিতেও বৈধ বানানোর অপচেষ্টা করেছে। মোটকথা, প্রত্যেকেই এটাকে স্বীকৃত ও বৈধ উৎসব প্রমাণ করার জন্য যুক্তি পেশ করছে। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে এক্ষেত্রে ইসলামের দিক-নির্দেশনা কী, সে কথা ভেবে দেখার লোক নিতান্তই কম। এ বিষয়ে উদাসীনতা আজ আমাদের মুসলিম সমাজের স্বকীয়তার জন্য মারাত্মক এক অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আজ আমরা এ প্রসঙ্গে এর সূচনাকাল, ইতিহাস ও এর শরয়ি বিধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
পহেলা বৈশাখের সূচনা ও ইতিহাস :
আমাদের দেশে ১৪ই এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়ে থাকে। বর্তমানের প্রচলিত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন মূলত আরবি হিজরি সনেরই একটি পরিবর্তিত রূপ। মোঘল শাসনামালে ভারতে হিজরি পঞ্জিকানুসারেই জনগণ থেকে খাজনা-ট্যাক্স উসুল ও অন্যান্য কাজকর্ম পরিচালনা করা হতো। কিন্তু কিছুদিন এভাবে চলার পর খাজনা-কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিল। কেননা, হিজরি সন চান্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল, যা সৌর বৎসরের চেয়ে ১০/১১ দিন কম হয়। আর চাষাবাদ ও এ জাতীয় মৌসুমি অনেক কাজ সৌর বৎসরের সাথে সম্পৃক্ত। এতে করে সৌর বৎসরের হিসাবের সাথে চান্দ্র বৎসরের হিসাবের গড়মিল হওয়ায় যথাসময়ে প্রজাদের ফসলের কর-খাজনা আদায় করা দুষ্কর হয়ে পড়ছিল। তখন ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের সিদ্ধান্তে প্রচলিত হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সম্রাট আকবর তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহুল্লাহ সিরাজিকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন, যা এখন বাংলা সন নামে পরিচিত। তবে সম্রাট এ থেকে ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসনে আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকার হিসাব শুরু করার নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ সালের গণনা শুরু হয়। ইতিপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত বর্ষপঞ্চীর প্রথম মাস ছিল শকাব্দ বা শক তথা চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মুহাররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস; এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের প্রথম দিন ধরা হয়। তাই বাংলা সন মূলত হিজরি বা খ্রিষ্টাব্দ সনের বিপরীত স্বয়ংসম্পূর্ণ তৃতীয় কেনো সন নয়; বরং এটা হিজরি সনেরই পরিবর্তিত রূপ। হিজরি পঞ্জিকার মতো এ পঞ্জিকার হিসাবও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের সময় থেকেই শুরু। সুতরাং ১৪২৬ বঙ্গাব্দ অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের বয়স ১৪২৬ বৎসর। তবে এ ১৪২৬ বৎসরের সবই এক শ্রেণির বৎসর নয়; বরং এর মধ্যে ৯৬২ বছর পর্যন্ত হলো চান্দ্র বৎসর আর পরবর্তী ৪৬৪ বছর সৌর বৎসর। সৌর বৎসর চান্দ্র বৎসরের চেয়ে ১০/১১ দিন বেশি হওয়ায় প্রতি ৩৫/৩৬ বৎসরে চান্দ্র পঞ্জিকাবর্ষে এক বৎসর বেড়ে যায়। এজন্য ১৪৪০ হিজরি সাল মোতাবেক বঙ্গাব্দ ১৪৪০ সাল না হয়ে ১৪২৬ সাল হয়েছে।
মোঘল আমলে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করত এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে কিছু আনন্দ উৎসব করত। এছাড়াও বাংলার সব শ্রেণির ব্যবসায়ী ও দোকানদারগণ পহেলা বৈশাখে হালখাতা করত। প্রথম প্রথম পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে এতে বিভিন্ন বিষয় সংযোজন হতে হতে আজকের এ জাকজমকপূর্ণ স্বতন্ত্র উৎসবের রূপ নিয়েছে।
ইসলামে পহেলা বৈশাখ পালনের বিধান :
অনেক কারণেই উলামায়ে কিরাম পহেলা বৈশাখ পালনকে হারাম ও নাজায়িজ বলেছেন। ইসলামে দিবস পালনের বিষয়ে কয়েকটি মূলনীতি জানলেই পহেলা বৈশাখ পালনের অবৈধতা উপলব্ধি করা সহজ হবে। আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে মূলনীতিগুলো উল্লেখ করছি; এতে পহেলা বৈশাখ পালনের অসারতা ও অবৈধতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে।
১ নং মূলনীতি : ইসলামে জাতিগতভাবে উৎসব পালনের জন্য শুধুমাত্র দুটি দিন নির্ধারণ রয়েছে। এক হলো ইদুল ফিতর আর দ্বিতীয়টি হলো ইদুল আজহা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا هُمْ نَاسِكُوهُ فَلَا يُنَازِعُنَّكَ فِي الْأَمْرِ
‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই আমি নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছি, যা তারা পালন করে। সুতরাং তারা যেন এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে বিতর্ক না করে।’ (সুরা আল-হাজ : ৬৭)
আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا، فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا: كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ
‘রাসুলুল্লাহ সা. যখন মদিনায় আসলেন তখন তাদের দুটি উৎসবের দিন ছিল। তিনি বললেন, এ দুটি দিনের তাৎপর্য কী? তারা বলল, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটি দিনে উৎসব পালন করতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ দিনগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন⸻কুরবানির ইদ ও রোজার ইদ।’ (সুনানু আবি দাউদ : ১/২৯৫, হা. নং ১১৩৪, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)
আল্লামা আবু আব্দুর রহমান আজিমাবাদি রহ. এ হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন :
وَهُمَا يَوْمُ النَّيْرُوزِ وَيَوْمُ الْمِهْرَجَانِ كَذَا قَالَهُ الشُّرَّاحُ. وَفِي الْقَامُوسِ النَّيْرُوزُ أَوَّلُ يَوْمِ السَّنَةِ مُعَرَّبُ نَوْرُوزٍ وَالنَّوْرُوزُ مَشْهُورٌ وَهُوَ أَوَّلُ يَوْمٍ تَتَحَوَّلُ الشَّمْسُ فِيهِ إِلَى بُرْجِ الْحَمَلِ وَهُوَ أَوَّلُ السَّنَةِ الشَّمْسِيَّةِ
‘সে দুটি দিবস হলো, নাইরুজ ও মেহেরজান দিবস। হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ এমনই বলেছেন। কামুস অভিধানগ্রন্থে এসেছে, নাইরুজ হলো বছরের প্রথম দিন। শব্দটি ফার্সি ‘নওরোজ’ এর আরবি প্রতিবর্ণায়ন। আর নওরোজ তো প্রসিদ্ধ দিবস, অর্থাৎ যেদিন সূর্য মেষরাশির কক্ষপথে আবর্তিত হয়, তার প্রথম দিন। আর সেটা হলো সৌরবর্ষের প্রথম দিবস।’ (আওনুল মাবুদ : ৩/৩৪১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে জাতীয়ভাবে দুটি উৎসবই নির্ধারিত। আর কুরআনের ভাষ্যমতে মুসলিমদের জন্য নিজ ধর্মের অনুমোদিত উৎসবই শুধু বৈধ, এর বাইরে অন্য কোনো উৎসব-পার্বন পালনের অনুমতি নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে প্রথমেই যেসব কুসংস্কৃতি বন্ধ করেন, তন্মধ্য হতে অন্যতম ছিল নববর্ষ পালন উৎসব। ইসলামপূর্ব সময়ে মদিনাতেও নববর্ষ পালনের প্রথা চালু ছিল। কিন্তু ইসলাম এসে তা বন্ধ করে তাদের উৎসবের জন্য নতুন দুটি দিবস দান করে। অতএব, বিধর্মীদের উদযাপিত নববর্ষের পরিবর্তে ইসলাম-প্রদত্ত দুটি দিবস পেয়েও যারা সন্তুষ্ট নয়, এখনও যারা নববর্ষ পালন করতে আগ্রহ দেখায় বা পালন করে, তারা মূলত ইসলামের পূর্ণতাকে অস্বীকার করে পূর্বের সে জাহিলিয়াতের দিকেই ফিরে যেতে চায়! এমনটা করা একজন মুসলিমের পক্ষে কী করে সম্ভব, যে দিবসের পরিবর্তে আল্লাহ তাকে উত্তম দিবস দান করলেন, তথাপিও নিষিদ্ধ সে দিবস পালন করার জন্যই সে উদগ্রীব হয়ে থাকে!?
২ নং মূলনীতি : ইসলামে বিধর্মী ও বদদ্বীন লোকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
হুজাইফা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সঙ্গে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (মুসনাদুল বাজ্জার : ৭/৩৬৮, হা. নং ২৯৬৬, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল উলুম ওয়াল হিকাম, মদিনা)
এ হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, বিজাতীয় ও বদদ্বীন লোকদের অনুষ্ঠান বা মেলায় শরিক হওয়া, এতে সমর্থন দেওয়া নাজায়িজ ও হারাম। অতএব, যারা এসব বিজাতীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে, তারাও এ ক্ষেত্রে তাদের শ্রেণিভুক্ত হয়ে যাবে।
৩ নং মূলনীতি : অশ্লীলতাপূর্ণ উৎসব পরিত্যাগ করা মুসলিমদের জন্য একান্ত আবশ্যক। নিজে অশ্লীল কাজ করা বা এর প্রচার কামনা করা জঘন্যতম অপরাধ ও হারাম।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা নূর: ১৯)
আমাদের কারও অজানা নয় যে, দিনদিন পহেলা বৈশাখে অশ্লীলতা কী পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে! অতএব, পহেলা বৈশাখসহ অশ্লীলতাপূর্ণ সকল কর্মকাণ্ড মুসলিমদের জন্য হারাম। তাতে শরিক হওয়া কিংবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করা সবই নাজায়িজ।
৪ নং মূলনীতি : অপচয় ও অনর্থক কাজ থেকে মুসলমানদের বেঁচে থাকা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন :
{وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
‘আর তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আল-আরাফ : ৩১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
{ إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা হলো শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ
‘ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৩৬, হা. নং ২৩১৭, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
পহেলা বৈশাখে কী পরিমাণ অপচয় হয়, তা শুধু এ থেকেই ধারণা পাওয়া যায় যে, সামান্য এক প্লেট পান্তা আর ছোট্ট এক টুকরো ইলিশের দাম রাখা হয় একশ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত! বাকি অন্যান্য অপচয়, অশ্লীলতা ও অনর্থক কাজের হিসাব তো আছেই!
৫ নং মূলনীতি : সংশয়পূর্ণ বিষয় পরিত্যাগ করে সংশয়মুক্ত বিষয় গ্রহণ করার নির্দেশ রয়েছে।
হাসান বিন আলি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيبُكَ
‘যা তোমাকে সন্দেহে নিপতিত করবে তা পরিত্যাগ করো, আর যাতে কোনো সন্দেহ নেই সেটাই করো।’ (সুনানুন নাসায়ি : ৮/৩২৭, হা. নং ৫৭১১, প্রকাশনী : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যা, হালব)
সুতরাং কোনো বিষয়ে মতানৈক্য বা মতবিরোধ থাকলে তা যদি আবশ্যকীয় জাতীয় কাজ না হয়ে থাকে তাহলে একজন মুমিনের কর্তব্য হলো তা পরিত্যাগ করা। কেননা, কাজটি বৈধ হলেও তা না করার কারণে তার কোনো গুনাহ হবে না, কিন্তু তা অবৈধ হয়ে থাকলে এতে জড়িত হওয়ার দরুন সে গুনাহগার হয়ে পড়বে, যা কখনো একজন সাচ্চা মুমিনের কামনা হতে পারে না। তাই শরিয়তের অপব্যাখ্যা করে কেউ পহেলা বৈশাখ পালন জায়িজ হওয়ার কথা বললেও এ পঞ্চম মূলনীতির আলোকে তার কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না।
সারকথা:
এ পাঁচটি মূলনীতিকে সামনে রেখে বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে বুঝে আসে যে, বর্তমানের প্রচলিত পহেলা বৈশাখ পালন করা, এতে শরিক হওয়া ও এর সমর্থন করা হারাম ও নাজায়িজ। কেননা, আমাদের মুসলিমদের জন্য কুরআন-সুন্নাহর বাইরে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই। আর কুরআন-সুন্নাহ আমাদের উৎসবের জন্য নির্ধারিত দুটি দিন রেখে অন্য সব জাতীয় উৎসবকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, পহেলা বৈশাখের সূচনার সাথে বিধর্মীয় কোনো উৎসব জড়িত না থাকলেও কালের পরিক্রমায় তা এখন সম্পূর্ণরূপে বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচারের মৃগোয়া ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাস্তবতাকে আজ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আর যদি এটাকে বিজাতীয় উৎসব নাও মানা হয় তথাপি এটা যে বদদ্বীন ও ফাসিকদের আনন্দ-উৎসব, এতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সর্বাবস্থায়ই এতে বিজাতীয় ও বদদ্বীন লোকদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন হয়, যা হাদিসের ভাষ্যনুসারে নিন্দনীয় ও নাজায়িজ। তৃতীয়ত, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইদানীং যে পরিমাণ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা দেখা যাচ্ছে, তা শুধু ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়; বরং সুস্থ রুচিশীল ও বিবেকসম্পন্ন যে কোনো লোকের জন্যই তা চরম বিব্রতকর এক পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অশ্লীলতাপূর্ণ একটি উৎসবকে সামান্য ইসলামের জ্ঞান রাখে, এমন কেউ-ই বৈধ বলার মতো দুঃসাহস দেখাবে না। চতুর্থত, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পান্তা-ইলিশ, নবান্ন উৎসব, রং-বেরঙয়ের সাজ, নাচগান, হৈ-হুল্লোড়⸺এসবই অপচয় ও চরম অনর্থক পর্যায়ের কাজ, যা নাজায়িজ হওয়ার পাশাপাশি একজন মুসলিম হিসেবে মারাত্মক লজ্জাজনক একটি বিষয়ও বটে। পঞ্চমত, যদি কারও ভুল ব্যাখ্যায় এটাকে বৈধ মনে করার সামান্য অবকাশ আছে বলেও কারও মনে হয় তথাপিও হাদিসের ভাষ্যনুসারে তার জন্য এতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নেই। কেননা, সংশয়পূর্ণ কাজে জড়িত হওয়া কোনো মুমিনের পক্ষে কখনো শোভা পায় না। এটা বরং সুযোগসন্ধানীদের বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
এছাড়াও এর সাথে আরও অনেক শিরক ও ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস জড়িত রয়েছে, যা একজন মুমিনের ইমানকে মুহুর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারে। যেমন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা, নববর্ষের প্রথম প্রহরে সূর্যকে স্বাগত জানানো, রবি ঠাকুর-রচিত শিরকমিশ্রিত বৈশাখী গান গাওয়া, এদিনের বিশেষ কাজকে মঙ্গলজনক বা অমঙ্গলজনক মনে করা⸺এ জাতীয় অসংখ্য ইমানবিধ্বংসী আকিদা-বিশ্বাস এ পহেলা বৈশাখের সাথে জড়িত। তাই সার্বিক বিবেচনায় এতে অংশগ্রহণ করা, সমর্থন করা ও প্রচার করা পরিষ্কার হারাম ও নাজায়িজ এবং ক্ষেত্র বিশেষে আকিদাগত কারণে তা শিরকের পর্যায়েও চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মুসলিমদের জন্য বিজাতীয় এ উৎসবকে সর্বাত্মকভাবে বর্জন করে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে রাসুলুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর নির্দেশিত পথে চলে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন।
ইদানিং কিছু মানুষ পহেলা বৈশাখ পালনের বৈধতা নিয়ে কথা বলছে। কেউ কেউ এটাকে সাধারণ উৎসব পালন হিসেবে আর কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে ইসলামের দৃষ্টিতেই এটাকে বৈধ প্রমাণের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। উভয় চিন্তাই নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত। জগতের প্রতিটি কাজের ব্যাপারেই ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। কোনো কাজই এমন নেই, যে ব্যাপারে ইসলামের কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি ইসলামের নামে শরিয়তের অপব্যাখ্যারও বর্তমানে অভাব দেখা যায় না। অধিকাংশ সাধারণ লোক ওই সব চতুর লোকদের চতুরতা উপলব্ধি করতে না পেরে প্রতারিত হয় এবং ইসলামের নামে অনৈসলামিক কাজে লিপ্ত হয়। বস্তুত মানুষ যখন কুরআন-সুন্নাহ থেকে সরে গিয়ে যুক্তি-তর্ক ও নিজেদের মতামত-ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তাদের থেকে হিদায়াতের রাস্তা সরিয়ে দেন। তারা মনে করে, ইসলাম নিয়েই তাদের যতসব গবেষণা, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণেই ব্যস্ত! এজন্যই বারবার বলছি, ইলম শিখুৃন, ইলম শিখুন, ইলম শিখুন। পুরোপুরি না পারলেও কমপক্ষে বেসিক ইলমটা শিখুন; তাহলে অনেক সত্য-অসত্য অনুধাবন করা সহজ হবে। হককে বাতিল থেকে আলাদা করা সম্ভব হবে। নয়তো আজীবন এ মরুপ্রান্তরে চিৎকার করে কান্নাকাটি করলেও আলোর দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহ আমাদের সঠিক ইলম অর্জন ও সে অনুসারে আমল করার তাওফিক দান করুন।
- মুফতি তারেকুজ্জামান