পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম দানশীল ব্যক্তিদের একজন ছিলেন হাতিম। আরবের তাঈ গোত্রের মানুষ; সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছেন হাতিম তাঈ নামে। আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে দানশীল, পরোপকারী নগণ্য কয়েকজনের নাম বলা হলেই হাতিম তাঈর নাম ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন। যুগে যুগে তাকে ঘিরে নানা গল্প, কাহিনী এমনকি ‘দাতা হাতেম তাঈ’ ধরনের বাগধারা-প্রবচন ইত্যাদিরও উদ্ভব হয়েছে।
.
কিন্তু…
.
কিন্তু হাতিম তাঈ ইসলামের যুগ পাননি। আর সেসময় যে গুটিকয়েক বান্দারা প্রকৃত ইবরাহিমীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন, হাতিম তাঈ তাদের অন্তর্ভুক্তও ছিলেন না। অবশ্য তার ছেলে আদি ইবনু হাতিম তাঈ ইসলামের যুগ পেয়েছেন এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠতম প্রজন্ম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। রদিআল্লাহু আনহুম।
.
মজার কিন্তু গুরুত্ববহ ব্যাপার হলো, আদি ইবনু হাতিম (রদিয়াল্লাহু আনহু) নিজের বাবার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাও আবার নির্দিষ্টভাবে তাঁর বাবার বদান্যতা, দানশীলতার ব্যাপারেই – যে কারণে তার এত প্রসিদ্ধি, এত নামডাক। তো সেসময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কী বলেছিলেন?
.
আদি ইবনু হাতিম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাবা আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতেন, আরও এই এই (দান-সাদাকাহ) কাজ করতেন… তিনি কি এইজন্য (আল্লাহর নিকট) পুরস্কার পাবেন?”
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “তোমার পিতা যা চেয়েছিলেন (প্রসিদ্ধি), তা তিনি পেয়ে গেছেন।” [১]
.
আরেকটি হাদিসেও প্রায় একই বক্তব্য এসেছে যা মুহাদ্দিসগণ সহিহ সাব্যস্ত করেছেন। [২] তাছাড়া হুবহু প্রায় একই বক্তব্য একাধিক দুর্বল সনদেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও সহিহ বর্ণনার অনুরূপ। যাই হোক, মূল বক্তব্য আশা করি স্পষ্ট।
.
হাতিম তাঈ তার সময়ের সত্যান্বেষীদের মতো ঈমানদার ছিলেন না। আর তিনি নিজের দানশীলতার বদৌলতে প্রসিদ্ধি, যশ, খ্যাতি এসব দুনিয়াবি বিষয়ই চেয়েছিলেন। হোক তা সজ্ঞানে, কিংবা নিজের অজান্তেই। তাই আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়াতেই সেই আকাঙ্ক্ষিত প্রতিদান দিয়ে দিয়েছেন। আজও তাকে মানুষ দাতা হাতিম বলে চেনে। কিন্তু আখিরাতে তার কোনো অংশ নেই। আর তিনি আখিরাতে পুরস্কার পাবেনই বা কীভাবে? দুনিয়া ও আখিরাতে যিনি দেওয়ার একচ্ছত্র মালিক, সেই একক সত্ত্বার প্রতিই তো তার সঠিকভাবে ঈমান আনা হয়নি।
.
মানুষের জীবনের যতো দানশীলতা, যতো পরোপকারিতা তথা যতো ভাল কাজ – এগুলোর পেছনে নানারকম মোটিভেশন কাজ করে। কেউ হয়তো মনে কিছু শান্তি পাবার জন্য এমনটা করে, কেউ হয়তো অন্য মানুষদের কাছে বাহবা, প্রসিদ্ধি ইত্যাদির জন্য করে। দয়াময় আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের কাজ পুরো পন্ড করেন না, বরং দুনিয়াতেই তাদের নিয়্যাত অনুযায়ী প্রতিদান দিয়ে দেন। কিন্তু সেসবের সবটুকুই আখিরাতের সমীকরণে মূল্যহীন হয়ে যায়, যখন সর্বোত্তম প্রতিদানের মালিক আল্লাহর ওপরই বান্দাদের ঈমান থাকে না।
.
এই হলো ঈমানের মর্যাদা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর মর্যাদা। দুনিয়াতে থাকতেই সর্বোত্তম প্রতিদানের মালিকের প্রতি সঠিকরূপে ঈমান আনার পুরস্কার।
.
আসলে কেবলই যশ, খ্যাতি বা মনগড়া মানবতার নিয়্যাত নয়, যুগে যুগে হাতিম তাঈ আর তার উত্তরসূরিদের ত্রুটি থেকেছে ঈমানের এই মূল জায়গাতেই। কেননা, অজস্র হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কাফির ব্যক্তি মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করলে আখিরাতে সে আল্লাহর ইচ্ছায় নিজ জাহিলিয়াতের সময় করা ভালো কাজগুলোরও প্রতিদান পেয়ে যায়। ওহে মুসলিম ভাই ও বোনেরা, এই হলো ঈমানের মর্যাদা – সমস্ত নেককাজ কবুলিয়্যাতের পূর্বশর্ত, অনন্ত অসীমের জীবনে প্রতিদান পাবার পূর্বশর্ত।
.
ইমাম ইবনু কাসির (রহিমাহুল্লাহ) লিখেন, “জাহিলিয়্যাতের যুগে যেসব বিখ্যাত মানুষদের মৃত্যু হয়েছিল, তাদের প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা হাতিম তাঈর জীবনী উল্লেখ করেছি। মানুষের প্রতি তার বদান্যতা আর দানশীলতার কথাও উল্লেখ করেছি। কিন্তু সেসব যদি আখিরাতে বান্দার উপকারে আসতে হয়, তাহলে তার ভিত্তি হতে হবে ঈমান। অথচ তিনি (হাতিম) কখনোই বলেননি, ‘হে রব্ব, বিচার দিবসে আমার গুনাহখাতা ক্ষমা করে দিন।’ “(অর্থাৎ ঈমান আনে নি) [৩]
.
.
এভাবেই সহস্রাব্দ পর আজ যখন ঈমানহীন লোকদের দ্বারা সমাজের কোনো ব্যাপক কল্যাণময় কাজ হতে দেখি, তখন আমাদের হাতিম তাঈর উদাহরণ মনে পড়ুক। মনে পড়ে যাক ‘জাহান্নামী’দের দিয়েও আমাদের রব্বের কাজ করিয়ে নেওয়ার অবাক করা কৌশল। ওদের জন্য আফসোস… ওদের যে ঈমান নসিব হয়নি!
.
.
রেফারেন্সঃ
.
[১] আহমাদ ৩২/১২৯, শাইখ শুয়াইব আল-আরনাউত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন
[২] আহমাদ ৩০/২০০, ইবনু হিব্বান ১/৪১
[৩] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/৬৭