নবি ﷺ ও আবু বাকর (রাঃ) খুব দ্রুত হাঁটছেন। পেছনে আসছে শত্রুবাহিনী। শত্রুরা তাঁদেরকে পেলেই হত্যা করবে। ইতােমধ্যেই ওয়ারেন্ট জারি হয়ে গেছে তাঁদের নামে। নবিজি ﷺ ও আবু বাকরকে (রাঃ) চিহ্নিত করা হয়েছে ‘টপ মােস্ট টেরােরিস্ট’ হিসেবে। নবিজির মাথার দামও ঘােষণা করা হয়েছে। প্রেস ব্রিফিং-এর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—‘মুহাম্মাদকে ﷺ জীবিত বা মৃত যে হাজির করতে পারবে, তাকে এক শ উট পুরস্কার দেওয়া হবে।
পুরস্কারের আশায় লােকজন তাঁদের খুঁজতে লেগে গেছে। ওই সময় কাউকে ট্রেস করার পদ্ধতি ছিল ‘পায়ের ছাপ। ওরা পায়ের ছাপ ধরেই তাঁদের খোঁজাখুঁজি করছে। পায়ের ছাপ যাতে না পড়ে, সেজন্যে নবিজি ﷺ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে হাঁটছেন। তাঁর ﷺ পা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবুও সামনে এগােচ্ছেন খুব দ্রুততার সাথে আবূ বাকর (রাঃ)
কিছুক্ষণ নবিজির ﷺ সামনে হাঁটছেন, কিছুক্ষণ পেছনে এভাবে পথ চলতে দেখে নবি ﷺ ‘আবু বাকর, তােমার কী হলাে? তুমি কিছুক্ষণ আমার সামনে হাঁটছ, আবার কিছুক্ষণ পেছনে। (ব্যাপার কী?)’
তিনি জবাব দিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে ধরার জন্যে কেউ পেছন থেকে আসছে কি না, এ কথা মনে হলে পেছনে চলে যাই। আবার (সামনে থেকে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে) কেউ ওত পেতে আছে কি না, এ কথা মনে হলে সামনে চলে যাই। নবিজি ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, আবূ বাকর! এমন কোনাে বিষয় আছে কি, যা তুমি চাও আমাকে নয় বরং তােমাকে স্পর্শ করুক?
তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন। ছােটোখাটো এমন কোনাে ক্ষতি নেই, যার ব্যাপারে আমি মনে করি না যে, তা আপনাকে নয় বরং আমাকেই স্পর্শ করুক।'[ইবনু কায়্যিম, যাদুল মাআদ ২/১৭১-১৭২]
আমি এখানে একটু থামব। আবু বাকর (রাঃ) -এর অবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলব। চরম পরিস্থিতিতে নবিজি ﷺ ও আবু বাকর (রাঃ) পথ চলছেন। শত্রুরা দুজনকেই খুঁজছে। ধরতে পারলে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড। আবু বাকর (রাঃ) এ কথাগুলাে জানেন। জানার পরও তিনি নিজেকে নিয়ে মােটেই চিন্তিত নন। চিন্তা করছেন নবিজিকে ﷺ নিয়ে। তাই একবার সামনে হাঁটছেন, আরেকবার পেছনে। তিনি চাচ্ছেন, নবিজির ﷺ ওপর যেন আঘাত না আসে। যতক্ষণ তিনি জীবিত আছেন, ততক্ষণ কেউ যেন তাঁকে হামলা না করে। ছােটো-বড়াে ক্ষতি যা-ই হােক না কেন, তাঁর হােক। নবিজি ﷺ নিরাপদ থাকুক। প্রয়ােজন হলে জীবন যায়, যাক; আপত্তি নেই।
এই হলাে ভালােবাসা। সত্যিকার ভালােবাসা। যে ভালােবাসার দাবি পূরণের জন্যে আবু বাকর (রাঃ) নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করছেন।
তাঁরা একটি গুহার কাছে পৌঁছলেন। অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে দুজনেই ক্লান্ত। সিদ্ধান্ত নিলেন সামনের গুহায় একটু জিরিয়ে নেবেন। নবিজি গুহায় প্রবেশ করতে যাবেন এমন সময় আবু বাকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ ! আপনি আপনার জায়গায় থাকুন। আমি আপনার জন্যে গুহাটিকে পরিষ্কার ও নিরাপদ করে দিচ্ছি (এরপর আপনি প্রবেশ করুন)।
নবিজি ﷺ গুহার বাইরে দাঁড়ালেন আর তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন। গুহাটি পরিষ্কার করে ওপরে উঠে এলেন। ওপরে উঠেই তাঁর মনে হলাে, একটি গর্ত পরিষ্কার করা হয়নি। দ্রুত গুহায় ঢুকলেন। গর্তটি বন্ধ করে এরপর বেরােলেন। বেরিয়ে বললেন “হে আল্লাহর রাসূল ﷺ ! এবার নামুন।
নবিজি গুহায় নামলেন। ক্লান্ত দেহে তিনি আবু বকর (রাঃ) -এর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আবু বকর (রাঃ) দেখলেন গুহায় দুটো গর্ত রয়েছে। এর আগে এগুলাে তাঁর নজরে পড়েনি। গর্তে হয়তাে কোনাে কীট-পতঙ্গ লুকিয়ে থাকতে পারে, তাই তিনি নিজের পা-কে একটু সামনে নিয়ে গর্ত দুটো বন্ধ করে রাখলেন। ইতােমধ্যেই তাকে কীসে যেন কামড়ে দিল। নবিজির ঘুম ভেঙে যাবে দেখে তিনি নড়াচড়া করলেন না। বরং নবিজির ﷺ মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। তাঁর ভালােবাসার মানুষটি ঘুমােচ্ছেন, তিনি সেটা প্রাণ ভরে দেখছেন। কিন্তু বিষের ব্যথা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ব্যথায় তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। চোখের জল নবি ﷺ -এর গায়ে পড়তেই তিনি জেগে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, (আবু বাকর! কাঁদছ কেন?) তােমার কী হয়েছে?
আবু বাকর (রাঃ) বললেন, আমার মা বাবা আপনার ওপর কোরবান হােক। কীসে যেন আমায় কামড়েছে। (এর ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ক্লান্ত দেহে আপনি ঘুমােচ্ছেন বলে নড়াচড়া করে বিরক্ত করতে চাইনি।)
নবিজি ﷺ তার দিকে তাকালেন। তিনি এমন সাথিকে দেখছিলেন, যিনি তাঁর জীবনের চেয়েও তাঁকে বেশি ভালােবাসেন। যিনি যে-কোনাে বিপদ মাথায় নিতে প্রস্তুত রয়েছেন তাঁর জন্যে। তাঁর সেইফটির সামনে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করছেন যিনি। নবি ﷺ এই সন্তুষ্ট হলেন আবুবাকর (রাঃ) -এর ওপর। নিজের থুতু লাগিয়ে দিলেন তাঁর পায়ে।[শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ১৮৮]
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এ দিনটির কথা স্মরণ করে কাঁদতেন। মনে মনে বলতেন, ‘ইশ, যদি আমি আবূ বাকরের জায়গায় হতাম। উমারের শাসনামলে কিছু লােক তাঁকে আবু বাকরের (রাঃ) ওপর প্রাধান্য দিতে লাগল। তখন উমার (রাঃ) এই দিনের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আবুবাকরের একটি দিন উমারের পরিবারের চেয়েও অধিক উত্তম।
আবু বাকরের (রাঃ) কথা যখন এসেছে, তখন তাঁর আরেকটি ঘটনার কথা বলি। সময়টা নবম হিজরির। প্রচণ্ড গরম ছিল সে সময়। কিছু মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। এরই মধ্যে তাবুক যুদ্ধের ঘােষণা এল। নবিজি ও তাঁর সাহাবিরা প্রস্তুতি নিলেন। সাহাবিরা যুদ্ধের জন্যে দান-সদকা করতে লাগলেন সর্বোচ্চ পরিমাণে। উসমান (রাঃ) নয়শ উট, এক শ ঘােড়া। আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) দিলেন সাড়ে উনত্রিশ কিলো সোনা। উমার (রাঃ) মনে মনে ভাবতে থাকেন—এই সুযােগ। আবূ বাকর-এর ঘরে তেমন সম্পদ নেই। এবার আবু বাকর-কে ঠিক পেছনে ফেলে দেবাে। (রাঃ) তাে যে কথা সেই কাজ। অর্ধেক সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন উমার (রাঃ)। নবি ﷺ ও উমারের (রাঃ) দান দেখে সন্তুষ্ট হলেন। এবার উমার (রাঃ) অপেক্ষা করছেন আবু বাকর (রাঃ) কী আনেন, সেটা দেখার জন্যে। কিছুক্ষণ পর আবূ বাকর (রাঃ) এলেন। পুরােনাে কাপড়ে বাঁধা পুঁটলিটা মাথা থেকে নামালেন। উমার (রাঃ)-এর দৃষ্টি পুটলির দিকে। আবূ বাকর (রাঃ) সেটা খুললেন। তাঁর যত সম্পদ ছিল, সবই ওই কাপড়ে বেঁধে এনেছেন। নবি ﷺ ও তাঁর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, বাসার সবই কি নিয়ে এসেছ?
আর বাকর (রাঃ) মাথা নেড়ে বললেন, ‘সবই নিয়ে এসেছি, কিন্তু ঘর খালি করে আসিনি।
উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে? এখানে তাে আপনার সব জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে।
আবু বাকর (রাঃ) মুচকি হেসে বললেন, ‘ঘরে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।”[শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৬৭]
সাহাবিরা যারপরনাই বিস্মিত হলেন তাঁর কথা শুনে। নবিজিকে ﷺ ভালােবেসে যে যার সাধ্যমতাে দান করেছেন, কিন্তু সম্পদের সবটা দান করেননি কেউই। একমাত্র তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনিই সে ব্যক্তি, যিনি নবিজির ﷺ ভালােবাসায় সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। নবিজির ﷺ ভালােবাসার সামনে তুচ্ছ মনে করেছেন সমস্ত ধন-সম্পদকে। তাই তাে নবিও ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ দিয়ে, সাহচর্য দিয়ে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি ইহসান করেছে, সে ব্যক্তি হলাে আবু বাকর।[বুখারি, আস-সহীহ, অধ্যায় : আম্বিয়া কিরাম, হাদীস : ৩৩৯২]
তুমি আবু বাকর (রাঃ) -এর মতাে নবিজিকে ﷺ ভালােবাসাে কি না, কখনও টেস্ট করেছিলে?