মাস’আলা-মাসাঈল জানার জন্য সরাসরি হাদিসের কিতাব নাকি ফিকহি কিতাব পড়বেন ? কোনটি বেশী নিরাপদ ?
ইসলামি বিধানে চলার পথে প্রতিটা পদে পদে মাস’আলা-মাসাঈল জেনে চলতে হয়৷ তাই তো আমরা কেহ সরাসরি কোর’আন-হাদিস পড়ি ; আবার কেহ ফিকহী কিতাব অধ্যায়ন করি।
প্রসঙ্গ আলোচনা হচ্ছে – একজন সাধারণ মুসলিমের জন্য মাসালা-মাসাইল জানতে কোনটি বেশী নিরাপদ ? সরাসরি কোর’আন-হাদিস নাকি ফিকহী কিতাব ?
[ আমি আগেই বলে রাখি, কোর’আন-হাদিস সাধারণ অধ্যায়নে সওয়াব বা প্রয়োজনীয়তার বিকল্প নাই। আমি এখানে জাস্ট,মাসালা-মাসাইল বুঝার জন্য কোনটি বেশী নিরাপদ , তা নিয়ে আলোচনা করছি ]
বিষয়টি নিয়ে খোলাসা করার পূর্বে হাদিস ও ফিকহী কিতাবের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরা জরুরি মনে করছি –
হাদীস গ্রন্থঃ –
যেখানে সকল ধরণের আহাদিস সন্নিবেশিত করা হয়। সহীহ, জঈফ, রাসূলের জন্য খাস,নাসেখ-মানসুখ সহ যাবতীয় হাদীস সংগ্রহ করা হয়৷ কোনটা আমলের প্রযোজ্য, কোনটি প্রযোজ্য নয় , এমন কিছুর বিবরণ হাদিস গ্রন্থাবলীতে সাধারণত পাওয়া যায় না৷
ফিকহী গ্রন্থঃ –
জীবনে চলার পথে প্রতিটা পদে পদে প্রয়োজনীয় সকল মাসালা-মাসাইল দলীল-প্রমাণ সহ উপস্থাপিত থাকে৷ ইবাদাত, মো’আমালাত, হুদুদ ইত্যাদি পার্ট পার্ট সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো থাকে৷
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হাদীসটির দলীল দিয়ে মাসালা-মাসাইল সাজানো হয়ে থাকে৷
উভয়টির সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় –
হাদিসের কিতাব পড়লে একজন সাধারণ মুসলিম জানতে পারে না, কোন হাদিসটি আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর কোন হাদিসটি প্রযোজ্য নয়।
তবে, ফিকহি কিতাব পড়লে একজন সাধারণ মুসলিম সহজেই বুঝতে পারবে যে, আমলের ক্ষেত্রে কোন হাদিসটি প্রযোজ্য । কেননা, ফোকাহায়ে কেরাম বিপুল পর্যালোচনার পরে নাসেখ-মানসুখ তফাৎ করে আমলের ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রযোজ্য হাদিস’টি মাস’আলায় বর্ণনা করে থাকেন।
তাহলে, আমাদের সামনে পরিসস্কার হয়ে গেলো যে, যারা লক্ষ লক্ষ হাদিসের নাসেখ-মানসুখ ইত্যাদি নিয়ে ধারণা রাখেন, তারা কেবল সরাসরি হাদিস পাঠ করে মাসালা-মাসাইল জেনে তার উপর আমল করতে পারেন। আর যারা সাধারণ মুসলিম ; তাদের জন্য ফিকহী কিতাবাদী পড়া আবশ্যকীয় ।
কেননা একজন সাধারণ মুসলিম জানে না –
→ কোনটা হাদিস আর কোনটা সুন্নাহ!
→ কোন’টার হুকুম রহিত হয়ে গেছে বা বাকি আছে।
→ কোনটা নাসিখ আর কোনটা মানসুখ।
→ হাদিসের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয় জানে না।
এছাড়াও, অনেক বিষয় আছে হাদীসে ; যা একজন সাধারণ মুসলিম কস্মিনকালেও জানতে পারে না। সুতরাং, কেবল মাসলা-মাসাইল জানার জন্য একজন সাধারণ মুসলিমের জন্য ফিকহী কিতাবাদী পড়া অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও নিরাপদ বটে৷
এবার আপনাদের সামনে হাদীসের নাসেখ-মানসুখ নিয়ে যৎসামান্য আলোকপাত করি –
মানসুখ → যে হাদিসের হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে
নাসেখ → যে হাদীস হুকুম রহিত করে নতুন কোন হুকুম নিয়ে এসেছে
প্রশ্ন হতে পারে –
রাসূল সাঃ এর হাদিসে কি এভাবে নাসেখ-মানসুখ আছে ? জ্বী, হ্যাঁ ! এরকম অসংখ্য হাদীস আছে ; যার হুকুম পরবর্তীতে রহিত হয়ে যায়। যা মোহাদ্দিসীনে কেরাম আবিস্কার করেছেন বা কিছুটা রাসূল সাঃ বলেছেন বা বিপরীত আমল করে বুঝিয়েছেন।
হাদিসের নাসেখ-মানসুখ বুঝার কিছু মূলনীতি –
→ রাসূল সাঃ জীবনের প্রথম দিকে একভাবে আমল করেছেন, পরবর্তীতে অন্য ভাবে করেছেন৷
→ রাসূল সাঃ প্রথমে একভাবে বলেছেন, পরে অন্যটি বলেছেন৷
→ রাসূলঃ একভাবে বলেছেন, তবে আমল ভিন্নভাবে করেছেন।
→ রাসূল সাঃ একভাবে বলেছেন, সাহাবাগণ অন্যভাবে আমল করেছেন৷
এছাড়াও, আরো অনেক মূলনীতি আছে, যার আলোকে পরিস্কার হয় – হাদিসের নাসেখ-মানসুখ ।
রাসূল সাঃ এর হাদিসের নাসেখ-মানসুখ নিয়ে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন ইমাম হাফীজ ইবনু শাহীন ( ৩৮৫ হিঃ) রাহিমাহুল্লাহ ! বইটিতে তিনি ৬৬৬ হাদিস সন্নিবেশিত করেছেন, যে’সব হাদীস আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে, তবে হুকুম বাকি নেই। অর্থাৎ, উম্মাহ এর উপর আমল করতে পারবে না৷
সর্বশেষ, আপনাদেরকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেই যে, একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য কখনো সরাসরি হাদিস পড়ে মাসালা-মাসাইল জানা সম্ভব না ; যদি না সে পাশাপাশি ফিকহি কিতাব পড়ে।
হাদিসের কিতাবে আছে –
ما رواه أبو داود والترمذي من حديث معاوية: من شرب الخمر فاجلدوه، فإن عاد في الرابعة فاقتلوه.
সহীহ সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেনঃ ” যে ব্যক্তি মদ পান করবে, তাকে বেত্রাঘাত করো। যদি যে পূণরায় মদ করে এমনকি চারবার করে ফেলে, তাহলে তাকে হত্যা করো। “
ফিকহী কিতাবে আছে –
কোন ব্যক্তি যদি মদ পান করে, তাহলে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে৷ একই কাজ বারবার করলে, তাকে পুণরায় বেত্রাঘাত করা হবে৷ কখনো হত্যা করা যাবে না৷
আপনি যদি একজন সাধারণ মুসলিম হোন এবং উপরে বর্ণিত হাদিস’টি পড়েন তাহলে বলবেন, বারবার মদ পানের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ! কিন্তু, যদি দেখেন কোন মুফতী ফতোয়া দিচ্ছেন যে, বারবার মদ্যপানে মৃত্যদন্ড শাস্তি দেওয়া যাবে না, তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে ?
নিশ্চিত বলবেন, এই মুফতি হাদীস জানেন না৷ জানলেও মানেন না। এই মুফতী সাহেব অন্ধ তাকলীদ করেন। এই মুফতী সাহেব মাজহাব পুজারী। এই মুফতী সাব,,,আরো কতো কিছু হয়তো বলবেন !!
বস্তুত, আপনি একজন সাধারণ মুসলিম মোটেও জানেন না যে, এই হাদিস’টা মানসুখ তথা এই হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে। এটার উপর আর আমল চলবে না৷
ইমাম নাবাবী রাঃ মুসলিম শারীফের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট উল্লেখ করে বলেন –
” এই হাদীসটা মানসুখ হয়ে গিয়েছে। একজন মদ পানকারীকে কখনো মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবে না। বরং, যত বার মদ পান করবে, ততো বার তাকে বেত্রাঘাত করা হবে “
প্রিয় ভাই আমার,
মাজহাব নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি এই জায়গা থেকেই শুরু হয়। আমরা অনেকেই জানি না, হাদিসের নাসেখ-মানসুখ। অথচ, ডিরেক্ট পড়ে ফেলি বিশাল বিশাল হাদিসের গ্রন্থ!
আর যৎসামান্য ফিকহার কিছু হাদিসের বিপরীত হলেই সহসা বলে ফেলি –
→ আবু হানফী রাঃ তো হাদীস বিরোধী ছিলেন
→ আবু হানীফা রাঃ এর কাছে তো হাদিস পৌঁছেই নাই
→ আবু হানীফা দাঃ কিয়াসকে হাদিসের উপর প্রাধান্য দিতেন।
আরো কতো কথা,,,,,
আল-ইয়াজুবিল্লাহ !
আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে জাহালত থেকে দূরে রাখেন এবং কোর’আন-হাদিসের প্রকৃত বুঝ দান করেন৷
আব্দুল কারীম আল-মাদানী
ইসলামীক আইন ও বিচার বিভাগ,
মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব৷