“তাকবীরে তাহরিমা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রেও দু’হাত উত্তোলন সংক্রান্ত হাদিস”


একাধিক সহীহ মারফু তথা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস ও অধিকাংশ মাওকুফ হাদীস তথা সাহাবা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুম ও তাবেয়ীন রহ. এর আমল ও ফতােয়া প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমা বলার সময়ই হাত উঠানাে সুন্নাত, অন্যান্য সময় নয়। সাহাবাযুগে মদীনা ও কূফা নগরীতেই অধিকাংশ সাহাবীর অবস্থান ছিলাে। কুফা নগরীতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পাঁচশ সাহাবাসহ মােট পনেরশ সাহাবী থাকতেন। এদের মধ্য থেকে আমীরুল মুমিনীন আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু, অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ও মুজতাহিদ সাহাবী আবু মূসা আশআরী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ছিলেন উল্লেখযােগ্য।
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন নসর রহ. বলেন
অর্থাৎ আমরা কুফার অধিবাসী ছাড়া এমন কোনাে শহর সম্পর্কে জানি না, যার অধিবাসীরা সকলে সময় হাত তােলা ছেড়ে দিয়েছেন। [আত-তা’লীকুল মুমাজ্জাদ আলা মুআত্তা মুহাম্মাদ, পৃ. নং ৯১ হাদীস নং ১০৪ সংক্রান্ত আলােচনা (আল মাকতাবাতুল আশরাফিয়া , দেওবন্দ)]
এ থেকে বুঝা যায়, অন্যান্য শহরে তাকবীরে তাহরিমার সময় ছাড়া অন্য সময়ে হাত তােলা ও না তোলা উভয় মতের লােক ছিলাে। একমাত্র কুফাই এমন নগরী, যার অধিবাসীদের সবাই রাফউল ইয়াদাইন তথা তাকবীরে তাহরিমা ব্যতীত অন্যান্য সময়ে হাত তােলা ছেড়ে দিয়েছেন।
এখানে এ বিষয়টিও পাঠকের জানা থাকা দরকার যে, কূফা নগরী অন্যান্য শহরের মতাে শুধু সাধারণ একটি শহরই ছিলাে না; বরং তা ছিলাে হাদীস ও ফিকহ চর্চার অন্যতম একটি প্রাণকেন্দ্র ও ইলমী শহর, যার অধিবাসীদের আমল অনেকাংশে দলীল ও প্রমাণােপযােগী।
ইমাম বুখারী রহ. এর একটি মন্তব্য থেকে কূফা নগরীর মর্যাদা ও ইলমী অবস্থান পরিস্কার হয়। তিনি তার ইলম অন্বেষণের সফর সম্বন্ধে বলেনঃ
অর্থাৎ আমি (ইলম অন্বেষণে) সিরিয়া ও মিসরে প্রবেশ করেছি দু’বার , বসরায় চারবার, হিজাযে অবস্থান করেছি ছয় বছর আর মুহাদ্দিসদের সাথে কুফা ও বাগদাদ নগরীতে কতােবার যে প্রবেশ করেছি তার কোনাে ইয়াত্তা নেই! [হাদইয়ুস সারী : ১/৪৭৮ (দারুল মা’রিফা, বৈরূত)]
আরেক ইলমি শহর মদীনা শরীফেও তাকবীরে তাহরিমা ছাড়া অন্য সময়ে হাত উঠানাের তেমন একটা প্রচলন ছিলাে না।
মদিনার বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম মালেক রহ. যিনি মদীনাবাসীদের চলন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে দলিল হিসেবেও পেশ করতেন- রাফউল ইয়াদাইন সম্পর্কে বলেনঃ
অর্থাৎ নামাযের সূচনালগ্ন তথা তাকবীরে তাহরিমার সময় হালকাভাবে দু’হাত উঠানাে ছাড়া অন্য কোনাে তাকবীর বলার সময় -না ঝোকার সময় আর না উঠার সময়- দু’হাত উঠানাের নিয়মের কথা আমি জানি না। [আল মুদাওওয়ানাতুল কুবরাঃ ১/১৬৫ রুকু ও ইহরামে রাফউল ইয়াদাইন অধ্যায় ( দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা , বৈরূত)]
এতে বুঝা যায়, সাহাবা ও তাবেয়ীযুগে মদীনা শরীফে তাকবীরে তাহরিমা ছাড়া অন্যান্য সময় তথা রুকূতে যাওয়ার সময়, রুকূ থেকে উঠার সময় বা নামাযের অন্যান্য সময় দু’হাত উঠানাের তেমন কোনাে প্রচলন ছিলাে না। যদি তা প্রচলনই থাকতাে তাহলে মদীনার ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম মালেক রহঃ এ ক্ষেত্রে এ (অর্থাৎ আমি জানি না) বলতেন না।
যাই হােক আমরা এখন মৌলিক আলােচনা তথা দলীল ও প্রমাণাদি নিয়ে কথা বলবাে।
এ পর্যায়ে আমরা এখন দুটি বিষয় নিয়ে আলােচনা করবাে। এক: প্রত্যেক রাকআতে রাফউল ইয়াদাইন করা যে ফরয ও আবশ্যক নয়, তা তাদেরই কতিপয় ইমাম ও মান্যবর ব্যক্তিত্বের বাণী ও উক্তি দ্বারা প্রমাণ করা। দুই: সহীহ প্রমাণযােগ্য হাদীস ও আসারে সাহাবা থেকে এ প্রমাণ পেশ করা যে, তাকবীরে তাহরিমা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দু’হাত তােলা সুন্নাত নয়; শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমার সময়ই দু’হাত উঠানাে সুন্নাত। লা-মাযহাবীদের আস্থাভাজন বড় একজন ইমাম আল্লামা ইবনে হযম রহঃ রাফউল ইয়াদাইন করা ও না করা উভয় প্রকারের হাদীস সহীহ মেনে নিয়ে বলেনঃ
অথাৎ যখন বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম তাকবীরে তাহরিমার পর প্রত্যেক উঠাবসায় দু’হাত উঠিয়েছেন এবং (এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, দু’হাত আর) উঠাননি তখন উভয় পদ্ধতিই বৈধ, (কোনােটিই) ফরয বা আবশ্যক নয়। আর আমাদের এ অবকাশ যে, আমরা অনুরূপ (দু’পদ্ধতিতেই) নামায পড়বাে। সুতরাং যদি (তাকবীরে তাহরিমা পরবর্তী) দু’হাত উঠাই তাহলে আমরা তেমনই নামায পড়লাম যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়েছেন। আর যদি আমরা (তাকবীরে তাহরিমা পরবর্তী) রাফউল ইয়াদাইন না করি তাহলে আমরা তেমনই নামায পড়লাম যেমনটি পড়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়া সাল্লাম। [আল মুহাল্লা, ইবনে হযমঃ ৩/২৩৫; মাসআলা নং ৩৫৮ (ইদারাতুত তাবাআতিল মুনীরিয়্যা, মিসর)]
লা-মাযহাবীদের আরেক বড় ইমাম অন্যতম আস্থাভাজন আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ রহ. রাফউল ইয়াদাইনের মতভেদ সম্পর্কে বলেনঃ
অর্থাৎ উচ্চস্বরে ইমামের আমীন বলাও এ জাতীয় মতভেদের অন্তর্ভুক্ত। আর এটা এমনই বৈধ এক মতানৈক্য, যাতে আমলকারী ও বর্জনকারী কাউকেই ভৎসনা করা যাবে না। এটা তেমনই যেমন রাফউল ইয়াদাইন করা ও না করার মতভেদ। [যাদুল মাআদঃ ১/২৭৫ (মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরূত)]
লা-মাযহাবীদের সবচে আস্থাভাজন ইমাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. এ জাতীয় ইবাদাতের প্রকারভেদের মতভেদ সম্পর্কে বলেনঃ
অর্থাৎ এ বিষয়ে আমাদের সবচে বিশুদ্ধ নীতিমালা হলো- উক্তিমূলক হোক বা কার্যমূলক ইবাদাতের বর্ণিত হবে তখন এ পদ্ধতি বর্ণনায় বর্ণিত হবে তখন এ পদ্ধতিগুলোর কোনটিই অপছন্দনীয় হবে না; বরং সবগুলোই শরীয়াহসম্মত হবে। যেমনটি আমরা বলেছি, সালাতুল খাওফের পদ্ধতিগুলোর ব্যাপারে, আযানের দত্যি প্রকার তারজী’ করা ও তা বর্জন করার ব্যাপারে, ইকামাতের দু’টি পদ্ধতি জোড়সংখ্যার ইকামাত ও বিজোড় সংখ্যার ইকামাতের ব্যাপারে এবং যেরকমভাবে আমরা বলেছি তাশাহহুদ, সানা, আউযু, কিরাত, ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর , জানাযার নামায, সিজদায়ে সাহু, রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়া, রাব্বানালাকাল হামদ’ বাক্যে (ওয়া) শব্দটি রেখে ও না রেখে পড়া এবং আরাে ইত্যাদির প্রকারগুলাের ব্যাপারে। হ্যাঁ, কখনাে এ বর্ণিত পদ্ধতিগুলাের কোনােটি মুস্তাহাব ও (বেশীর চেয়ে বেশী) অন্য পদ্ধতি থেকে উত্তম হতে পারে যখন তা উত্তম হওয়ার উপযােগী প্রমাণযােগ্য কোনাে দলীল থাকবে, কিন্তু অপরটি অপছন্দনীয় হবে না। [মাজমূআতুল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়াঃ ২৪/১৩২ সালাতুল ঈদাইন অধ্যায়- তাহকীকঃ আল আযযার ও আনওয়ার আল বায (দারুল অফা, কায়রাে) মূল নুসখার পৃষ্ঠা নং ২৪/২৪২-২৪৩]
এটাই মূলত ইনসাফভিত্তিক কথা। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সনদে বিভিন্ন ইবাদাতের ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। তাই একটাকে সুন্নাহর স্বীকৃতি দিয়ে অপর পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা বা বিদআত ও পরিত্যাজ্য বলা প্রকারান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও সহীহ হাদীসকেই অবজ্ঞা করার শামিল, যা সঠিক অনুসারী কোনাে মুসলিম থেকে কল্পনাও করা যায় না। আমাদের পূর্ববর্তী আসলাফ এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ সতর্ক ছিলেন। এমনকি বর্তমান লা-মাযহাবী সম্প্রদায়ের অন্যতম আস্থাভাজন বড় তিন ইমাম আল্লামা ইবনে হযম রহ., আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ, আল্লামা ইবনে কাইয়িম জাওযী রহ. পর্যন্ত এ বাস্তবতার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এখন আমরা ঐসকল বিশুদ্ধ হাদীস ও আসারে সাহাবা উল্লেখ করবো, যেগুলাে থেকে এ প্রমাণ মিলে যে, নামাযে তাকবীরে তাহরিমা ছাড়া অন্যান্য স্থানে দু’হাত উঠানাে সুন্নাত নয়। পূর্বে নামাযের বিভিন্ন স্থানে হাত নিয়ম থাকলেও পরে তা রহিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আলােচনা ইনশাআল্লাহ হাদীস ও আসারে সাহাবা উল্লেখ করে।
১ নং হাদীসঃ
অর্থাৎ জাবের বিন সামুরা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একদিন) আমাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেন, আমার কী হলাে যে আমি তােমাদেরকে নামাযে বেয়াড়া ঘােড়ার মত হাত উত্তোলনরত দেখি? নামাযে তােমরা স্থিরতা অবলম্বন করাে। [সহীহ মুসলিমঃ ১/১৮১; হাদীস নং ৪৩০ (আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যা, ঢাকা]
সহীহ মুসলিমের এ হাদীস থেকে রাফউল ইয়াদাইন নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি দু’ভাবে প্রমাণিত হয়। এক: নামাযে রাফউল ইয়াদাইন করা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাগান্বিত হওয়া হাদীসের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়। দুই: নামাযে স্থির থাকার নির্দেশ প্রদান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নামাযে রাফউল ইয়াদাইন করাটা নামাযের স্থিরতা পরিপন্থী। কুরআনেও নামাযের মধ্যে স্থিরতা অবলম্বনের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা নামাযীদের লক্ষ্য করে বলেনঃ
অর্থাৎ “আর আল্লাহর সামনে একান্ত আনুগত্য ও আদরে দণ্ডায়মান হও।”
[সূরা বাকারাঃ আয়াত নং ২৩৮]
বিবেকবান লােকদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, মহান কোনাে ব্যক্তিত্ব ও সত্ত্বার সামনে খুব বেশী নড়াচড়া না করে স্থির ও চুপ থাকাটাই তাঁর প্রতি আনুগত্য ও আদবের বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া নামাযে বারবার রাফউল ইয়াদাইন করাটা অন্যান্য সাধারণ নড়াচড়ার চেয়ে একটু বেশীই আদব পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়। মােটকথা মুসলিম শরীফের উক্ত হাদীসের স্পষ্টপ্রায় ভাষ্য এবং পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতের সারমর্ম থেকে এটাই প্রমাণিত হলাে যে, নামাযে বারবার রাফউল ইয়াদাইন করাটা স্থিরতা পরিপন্থি হওয়ার পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরও পছন্দ ছিলাে না। রাফউল ইয়াদাইন একবার শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমা বলার সময় করা সুন্নাত, এর বেশী নয়। নামাযে আল্লাহর সামনে খুবই আদব ও আনুগত্যের সহিত দাঁড়াবে এবং যথাসম্ভব ধীরস্থির থাকবে।
[বি. দ্র.: এখানে একটি সংশয়ের নিরসন ও বিষয়টির অবতারণা না করলেই নয়। বিষয়টি হলাে, মুসলিম শরীফের উপরােক্ত হাদীসের পরে আরাে একটি হাদীসের উল্লেখ আছে। বাহ্যিকভাবে চিন্তা করলে দ্বিতীয় হাদীসটি প্রথম হাদীসের ব্যাখ্যা বলে ভ্রম হয় এবং রাফউল ইয়াদাইন না করার ব্যাপারে প্রথম হাদীসটির প্রামাণ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ ও সংশয়ের আবর্তে নিপতিত হয়। তাই এর নিরসন অত্যাবশ্যকীয়।]
প্রথমত আমরা উক্ত দ্বিতীয় হাদীসটি উল্লেখ করছিঃ
অর্থাৎ জাবের বিন সামুরা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহিত নামায পড়তাম তখন (সালাম ফিরানাের সময়) বলতাম আসসালামু আলাইকুম, আসসালামু আলাইকুম এবং তিনি ( অর্থাৎ জাবের তাআলা আনহু) স্বীয় হাত দ্বারা (ডান-বাম) দু’দিকে ইঙ্গিত করে কােন এরপর (একদিন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হাতের ইশারায় সালাম ফিরানাের বিষয়টি বুঝতে পেরে) বললেন, তােমরা স্বীয় হাত দ্বারা কিসের প্রতি ইঙ্গিত করাে? যেনাে তা অবাধ্য ঘােড়ার লেজ! তােমাদের শুধুমাত্র এটাই যথেষ্ঠ যে, স্বীয় হাত নিজ রানের উপর রাখবে এরপর নিজের ডানদিকের ও বামদিকের (মুসলিম) ভাইদের দিকে লক্ষ্য করে সালাম ফিরাবে। [সহীহ মুসলিমঃ ১/১৮১ হাদীস নং ৪৩১ (আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যা, ঢাকা)]
এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে কারাে কারাে ধারণা, এটা প্রথম হাদীসের জন্য তাফসীর ও ব্যাখ্যাস্বরূপ। কেননা, উভয় হাদীসে হাত উঠানােকে অবাধ্য ঘােড়ার লেজের সহিত তুলনা করা হয়েছে। তবে প্রথম হাদীসে হাত কোন সময় উঠানাে হতাে তার কোনাে উল্লেখ নেই আর দ্বিতীয় হাদীসে তা সালাম ফিরানাের সময় করা হতাে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এটা প্রথমটার জন্য ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদীস। উভয় হাদীসের সমষ্টিতে বুঝা যায়, নামাযে শুধুমাত্র সালামের সময় রাফউল ইয়াদাইন নিষিদ্ধ, অন্যান্য সময় করার ব্যাপারে হাদীসটি নিরব।
আমরা বলি, এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল ও ভ্রান্ত। কারণ, উপরােক্ত হাদীস দুটির সনদ তথা বর্ণনাসূত্র ভিন্ন হওয়া ছাড়াও আরাে অনেকগুলাে কারণে আলাদা আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ দুটি হাদীসের মর্যাদা রাখে। যার একটি আপরটির ব্যাখ্যা কিছুতেই হতে পারে না। কারণগুলাে আমরা নিম্নে তুলে ধরছিঃ
এক: প্রথম হাদীসে রাসুললাহ সালালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজীদেরকে রাফউল ইয়াদাইন করা দেখে প্রচ্ছন্নভাবে রাগ প্রকাশ করে নির্দেশ দিলেন, ‘তােমরা নামাযে স্থির থাকো’। দ্বিতীয় হাদীসে যেহেতু সালাম ফিরানোর সময় হাত দিয়ে ইশারা করা নিষেধ করা হয়েছে তাই স্থির থাকার নির্দেশটি দ্বিতীয় হাদিসের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কেননা, কেউ সালাম ফিরানোর সময়য় হাত উঠালে তাকে ‘নামাযে স্থির থাকো’ বলে নির্দেশ দেয়া হয় না। যেহেতু সে তো সালামের মাধ্যমে নামায থেকে ফারেগই হয়ে যাবে, তাকে আবার নামাযে স্থির থাকার নির্দেশ দেয়া হয় কিভাবে? হ্যাঁ, এ নির্দেশ তার জন্যই প্রযােজ্য হয় , যে নামাযের ভিতরে যথা রুকূতে যাওয়ার পূর্বে ও পরে কিংবা সিজদায় যাওয়ার পরে রাফউল ইয়াদাইন করে। তাকে এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত যে, ‘নামাযে স্থির থাকো’। কিন্তু যে ব্যক্তি সালামের সময় হাত উঠায় তাকে একথা বলা কিছতেই যুক্তসঙ্গত হতে পারে না। তাকে বরং এরকম করা থেকে নিষেধ করে সঠিক পদ্ধতিতে সালাম ফিরানাের নিয়মাবলী শিক্ষা দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটাই করেছিলেন। এজন্য নির্দ্বিধায়ই বলা যায় যে, এ হাদীসটি পূর্বের হাদীস থেকে ভিন্ন এবং প্রত্যেকটি ঘটনা আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে সংঘঠিত হয়েছে।
দুই: প্রথম হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে এসে তার কতিপয় সাহাবীকে নামাযে রাফউল ইয়াদাইন করতে দেখেছিলেন। এতে বুঝা যায় তিনি তাদের সাথে নামাযে শরীক ছিলেন না। সম্ভবত তারা একাকী নফল বা সুন্নাত নামায পড়ছিলেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় হাদীসে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে জামাতে নামায পড়ছিলেন। অর্থাৎ এ হাদীসের বর্ণনানুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমাম ছিলেন আর সাহাবায়ে কিরাম তার পিছনে ইক্তিদা করছিলেন এবং তাঁরা সালাম ফিরানাের সময় হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন। তাহলে দুটি হাদীস এক হয় কী করে?
তিন: প্রথম হাদীসের ভাষ্য থেকে বঝা যায় বিশেষ একটি ঘটনায় কতিপয় সাহাবীই শুধু নামাযে রাফউল ইয়াদাইন করেছিলেন। অর্থাৎ ঐসকল সাহাবী, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নফল বা সুন্নাত পড়ছিলেন। আর দ্বিতীয় হাদীসের ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালামের সময় রাফউল ইয়াদাইন করাটা সবার কাজ ছিলাে। যেহেতু তখন সবাই জামাতে শরীক ছিলেন।
চার: দ্বিতীয় হাদীসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, এখানে তাদের হাতের ইশারটা সালামের সময় মুসাফাহা তথা করমর্দনকারীর হাত উঠানাের মতাে | আর এটা প্রথম হাদীসের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কেননা, প্রথম হাদীসে সবাই নামায একাকী পড়ছিলাে বিধায় এখানে একজন অপরজনের প্রতি হাত দিয়ে ইশারা করার অবকাশই নেই।
পাঁচ: প্রথম হাদীসে রাফউল ইয়াদাইন তথা নামাযে দু’হাত উত্তোলনের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এরপর তা আম(ব্যাপক অর্থবোধক) একটি শব্দ তথা ‘নামাযে স্থির থাকো’ বলে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় হাদীসে রাফউল ইয়াদাইনের কথা বলাই হয়নি; বরং তথায় হাত কথা বলা হয়েছে এবং এরপর তা নিষেধ করে এমন এক পদ্ধতি শিখানো হয়েছে, যা শুধু সালাম ফিরানাের সময়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট [নাসবুর রায়া (তা’লীক): ১/৩৯৩-৩৯৪ শাইখ আওয়ামা কর্তৃক তাহকীককৃত (মুআসসাসাতুর রাইয়ান, বৈরূত)]
সুতরাং এতােগুলাে সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকার পরও যদি দুটি হাদীসকে এক ভেবে দ্বিতীয় হাদীসকে প্রথম হাদীসের ব্যাখ্যা দাবি করা হয় তাহলে এই হঠকারিতা এবং বে-ইনসাফী আর কী হতে পারে? মােটকথা, এখানে ঘটনা দু’টি আলাদা এবং ভিন্ন সময়ের। উভয় ঘটনার সাক্ষী হযরত জাবের বিন সামুরা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু একজন হলেও এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, তিনি দুই ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী। [নাসবুর রায়া (তা’লীক): ১/৩৯৩-৩৯৪ শাইখ আওয়ামা কর্তৃক তাহকীককৃত (মুআসসাসাতুর রাইয়ান, বৈরূত)] তাই উভয় ঘটনা তার থেকে বর্ণিত হওয়ায় তা একই ঘটনা বলে ভ্রম হওয়ার সংশয়টা সম্পূর্ণই অমূলক। এতে মূলত আশ্চর্যের কিছু নেই।
এছাড়াও আমরা যদি এ কথা মেনেও নেই যে, প্রথম হাদীসে সালাম ফিরানাের সময়ই হাতের মাধ্যমে ইশারা বা হাত উঠানােকে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে (তথা দালালাতুন নস হিসেবে) আমাদের দাবিটি আরাে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। তা এভাবে যে, সালাম হলাে নামাযের শেষাংশ, যার মাধ্যমে মানুষ নামায থেকে বের হয়ে যায়। এক কথায় সালাম হলাে একটি দরজা, যার এ পিঠ নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট আর অপর পিঠ নামাযের বাহিরের সাথে সম্পকিত। শরীয়ত যখন সালামের মতাে একটি দু’মূখী বিধান পালনকালে হাত দিয়ে কোনাে প্রকারের ইশারা ইঙ্গিত করতে নিষিদ্ধ করেছে তখন নামাযের ভিতরের বিধান (যা দুমূখী নয়, বরং সম্পূর্ণই নামাযের সংশ্লিষ্ট) যথা রুকু, সিজদা ইত্যাদি পালনকালে হাত দ্বারা কোনাে ধরনের ইশারা, ইঙ্গিত বা বারবার তা উত্তোলন করাকে অবশ্যই আরাে কঠোরভাবে নিষেধ করবে। এজন্যই হাদীসের শেষাংশে ‘নামাযে স্থির থাকো’ বলে এদিকে প্রায় স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নামাযের মধ্যে স্থির থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নামাযে একাধিকবার রাফউল ইয়াদাইন করাটা এ নির্দেশের সরাসরি পরিপন্থী। তবে তাকবীরে তাহরিমার সময় রাফউল ইয়াদাইন করাটা এ নির্দেশের আওতাভুক্ত নয় বিধায় এতে উক্ত হাদীসের বিরােধিতা হবে না। কেননা, হাদীসে নামাযের ভিতরে স্থির থাকার কথা বলা হয়েছে অথচ তাকবীরে তাহরিমা নামাযের আভ্যন্তরীন কোনাে বিধান নয়, বিশেষত হানাফীদের নিকটে। তাই এখানে রাফউল ইয়াদাইন করলে উক্ত হাদীসে স্থিরতা থাকা নির্দেশের পরিপন্থী কিছু হবে না। তথাপি তাকবীরে তাহরিমার সময় রাফউল ইয়াদাইন করা মতানৈক্য ছাড়া ঐক্যমত সমর্থিত একটি বিষয়। সুতরাং সবধরনের নিষেধের বিধান থেকে এটা মুক্ত ও উর্দ্ধে। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৫৬-৫৭ হা. নং ৮১২ সংশ্লিষ্ট আলােচনা (ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলুমিল ইসলামিয়্যা, করাচী)]
মােটকথা, যেভাবেই বলা হােক না কেনাে, সহীহ মুসলিমের উক্ত হাদীসটি রাফউল ইয়াদাইন না করার ব্যাপারে একটু চতুর্মুখী স্পষ্ট প্রমাণ এবং সব দৃষ্টিকোণ থেকেই তা কার্যকর।
২ নং হাদীসঃ
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আমি কি তােমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়ে দেখাবাে না? রাবী (আলকামা রহ.) বলেন, এরপর তিনি নামায পড়লেন এবং (তাকবীরে তাহরিমার সময়) একবার ছাড়া আর দু’হাত উঠালেন না। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/২০৩; হাদীস নং ৩৬৮১ (মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরূত)]
নির্ভরযােগ্য ইমামরা সবাই এ হাদীসটিকে সহীহ ও প্রমাণযােগ্য বলেছেন। ইমাম ইবনে হযম রহ. বলেনঃ
নিশ্চয়ই এ হাদীসটি সহীহ।
[আল মুহাল্লাঃ ৪/৮৮; মাসআলা নং ৪৪২ (ইদারাতুত তাবাআতিল মুনীরিয়্যা, কায়রো]
ইমাম দারা কুতনী রহ. বলেনঃ
এর সনদ বিশুদ্ধ।
[ ইলালু দারা কুতনীঃ ৫/১৭২; প্রশ্ন নং ৮০৪ (দারু তাইবা, রিয়াদ)]
আল্লামা নিমবী রহ. বলেনঃ
এটা সহীহ হাদীস।
[আসারুস সুনানঃ পৃ. নং ১৫২; হাদীস নং ৪০২ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী]
শাইখ শুয়াইব আরনাউত রহ. বলেনঃ
এর রাবীগণ সিকা তথা নির্ভরযােগ্য। সবাই বুখারী, মুসলিমের বর্ণনাকারী শুধুমাত্র আসেম বিন কুলাইব ছাড়া। তিনি হলেন সহীহ মুসলিমের বর্ণনাকারী (বুখারীর নয়)।
[মুসনাদে আহমাদঃ ৬/২০৩; হাদীস নং ৩৬৮১ (মুআসসাসাতুর রিসালা,বৈরুত ]
ইমাম ইবনুল কাত্তান রহ. বলেনঃ
এটা আমার নিকটে সহীহ হাদীস।
[আদ্দিরায়াঃ ১/১৫০; হাদীস নং ১৮১ সংশ্লিষ্ট (দারুল মা’রিফা, বৈরূত) ]
মােটকথা এ হাদীসের বিশুদ্ধতায় সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। অনেকে অবশ্য এখানে ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. এর একটি উক্তি দ্বারা বিভ্রাতি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালান।
তিনি বলেনঃ
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর হাদীস “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নামাযে) প্রথমবার ছাড়া আর দু’হাত উঠাননি” এটা (মুহাদ্দিসীন কিরামের নিকট বিশুদ্ধ সূত্রে) প্রমাণিত নয়।
মূলত এখানে বিভ্রান্তির কিছু নেই। কেননা, ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে রাফউল ইয়াদাইনের ব্যাপারে দু’ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক: ফেলী (কর্মসূচক) হাদীস, অর্থাৎ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু নিজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মতাে করে মায পড়ে দেখান। দুই: কওলী (উক্তিমূলক) হাদীস, অর্থাৎ তিনি নিজে নামায পড়ে দেখাননি; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে নামায পড়তেন তা মৌখিকভাবে বর্ণনা করেছেন। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ, এ দ্বিতীয় হাদীসটিকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয় বলেছেন, প্রথম হাদীসটিকে নয়। তার উক্তিটি দেখলেই তা পরিস্কার হয়ে যায়।
এজন্যই ইমাম তিরমিযী রহ. প্রথমে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. এর উক্তিটি উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি (“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে প্রথমবার ছাড়া আর দু’হাত উঠাননি” -সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসমূহের অধ্যায়) বলে আলাদা একটি শিরােনাম এনেছেন এবং এখানে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর ফে’লী হাদীস (যাতে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাযের স্বরূপ নিজে পড়ে দেখান) উল্লেখ করেছেন। এবং হাদীসটিকে হাসান (উত্তম সনদে বর্ণিত) বলে অভিহিত করেছেন।
এতে এ বিষয়টি আরাে সস্পষ্ট হয়ে গেলাে যে, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর ফে’লী হাদীসের ব্যাপারে কোনাে মন্তব্য করেননি, যাকে ইমাম তিরমিযী রহ. হাসান ও অন্যান্যরা সহীহ বলেছেন।
স্মর্তব্য যে, উপরােল্লিখিত ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর হাদিসটি বাহ্যতঃ মাওকুফ (সাহাবীর হাদীস) মনে হলেও বাস্তবে তা মারফূ (রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস)। কেননা, তিনি স্বীয় নামাযকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাযের দিকে সম্বােধিত করেছেন।
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. ইলাউস সুনানে এ বিষয়ের উপর আলােকপাত করতে গিয়ে বলেনঃ
এটা অস্পষ্ট নয় যে, হাদীসটি প্রথম দৃষ্টিকোণ (অর্থাৎ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর ফে’লী হাদীসটির দৃষ্টিকোণ) থেকেও মারফু । যদিও তা হুকমীভাবে তথা কার্যভাবেই হােক না কেনাে। কেননা, সাহাবীর উক্তি ‘আমি কি তােমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়ে দেখাবাে না?’ কথাটি মারফু হাদীসের অন্তর্ভূক্ত- যেমনটি হাদীসের মূলনীতি অনুসারে প্রমাণিত। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৫৮; হাদীস নং ৮১৩ (ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলুমিল ইসলামিয়্যা, করাচী)]
৩ নং হাদীসঃ
সালেম বাররাদ রহ. বলেন, (একবার) আমরা আবু মাসউদ আনসারী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর নিকট প্রবেশ করলাম। এরপর আমরা তাকে নামায সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে নামায পড়ে দেখাবাে না, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায পড়তেন? রাবী বলেন, এরপর তিনি দাঁড়িয়ে তাকবীর বললেন এবং স্বীয় দু’হাত উঠালেন। এরপর রুকু করলেন এবং হাতের দু’তালুকে স্বীয় দুই হাঁটুর উপর রাখলেন এবং বগলদ্বয়ের মাঝে ফাঁক রাখলেন। রাবী বলেন, অতঃপর তিনি (রুকূ থেকে উঠে) দাঁড়ালেন; এমনকি তার সবকিছু স্থির হলাে। এরপর সিজদা করলেন এবং স্বীয় দু’হাতের তালু (মাটিতে) রাখলেন এবং বগলদ্বয়ের মাঝে ফাঁক রাখলেন। এরপর (সিজদা থেকে ) স্বীয় মাথা উঠালেন; এমনকি তার সবকিছু স্থির হয়ে গেলাে। এরপর এভাবেই চার রাকআত নামায পড়লেন। [ মুসনাদে আহমাদঃ ৩৭/৪৩; হাদীস নং ২২৩৫৯ (মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরূত)]
এ হাদীসটির সনদ হাসান তথা প্রমাণযােগ্য।
শাইখ শুয়াইব আরনাউত রহ. মুসনাদে আহমাদের তা’লীকে বলেনঃ
আতা বিন সায়েব (নামক রাবী) থাকায় এর সনদ হাসান। এছাড়া সনদের বাকী রাবীগণ নির্ভরযােগ্য ও বুখারী মুসলিমের রাবী।
এ হাদীসটিতে বিখ্যাত সাহাবী আবু মাসউদ আনসারী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায বর্ণনা করে দেখান। এতে দেখা গেলাে, তিনি শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমার সময়ই রাফউল ইয়াদাইন তথা দু’হাত উত্তোলন করেছেন। এরপর আর তিনি রাফউল ইয়াদাইন করেননি। বুঝা গেলাে, এটাই ছিলাে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায, যাতে শুধু একবারই রাফউল ইয়াদাইন করা হয়।
৪ নং হাদীসঃ
আলকামা সূত্রে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি কি তােমাদেরকে রাসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায সম্বন্ধে খবর দিবাে না? রাবী বলেন, এরপর তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। অতঃপর প্রথমবার (অর্থাৎ তাকবীরে তাহরিমা বলার সময়) দু’হাত উঠালেন। এরপর আর তার পুনরাবৃত্তি করলেন না। [সুনানে নাসায়ীঃ পৃ. নং ১২৫; হাদীস নং ১০২৬ (বাইতুল আফকার , রিয়াদ)]
ইমাম নাসায়ী রহ. হাদীসটি স্বীয় সুনানে বর্ণনা করে কোনাে ধরনের মন্তব্য করেননি। এতে বুঝা যায়, তার নিকট এ হাদীসটিতে সনদগত কোনাে সমস্যা নেই।
আল্লামা নিমবী রহ. স্বীয় আত তা’লীকুল হাসানে বলেনঃ
এটি একটি সহিদ সনদ।
[আর তা’লীকুল হাসান মাআ আসারিস সুন্নাহঃ পৃ নং ১৫৩ হা. নং ৪০২ সংশ্লিষ্ট (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. বলেনঃ
এর সব রাবী বুখারী, মুসলিমের রাবীদের অন্তর্ভুক্ত শুধুমাত্র সুইয়াইদ (নামক রাবী) ছাড়া। অবশ্য তিনিও সিকা (নির্ভরযােগ্য) রাবী। আর আসেম (নামক রাবীটি) শুধু মুসলিমের রাবী (বুখারীর নয়)। তিনিও নির্ভরযােগ্য।
শাইখ আলবানী রহ.ও এ হাদীসটির ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীস বলে অভিমত পেশ করেছেন। [সহীহু নাসায়ী(আলবানী): ১/৩৩৪; হাদিস নং ১০২৫ (মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ)]
৫ নং হাদীসঃ
অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু সূত্রে রাসূলুল্লাহ সালালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম শুধু প্রথম তাকবীরে স্বীয় দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর তার পুনরাবৃত্তি করতেন না।
এ হাদীসটির সবগুলাে রাবীই নির্ভরযােগ্য।
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. বলেনঃ
ইবনে আবী দাউদ সিকা তথা নির্ভরযােগ্য রাবী, যার হাদীসকে ইমাম তাহাবী রহ. সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। ……আর নুআঈম বিন হাম্মাদ হলেন বুখারী, মুসলিমের রাবী। ……সনদের বাকী রাবীগুলাে সহীহ বুখারীর রাবীদের অন্তর্ভুক্ত শুধু আসেম ব্যতীত। তিনি হলেন সহীহ মুসলিমের রাবী। [শরহু মাআনিল আসার , তাহাবীঃ ১/২২৪ হাদিস নং ১৩৪৯ (আলামুল কুতুব, বৈরুত)]
এছাড়া তিনি হাদীসটি সহীহ বলেও আখ্যায়িত করেছেন এবং এ হাদীসের উপর ইবনে মুবারক রহ. কর্তৃক অভিযােগ খণ্ডণ করতঃ বলেছেনঃ
আর তুমি এ কথা জেনেছাে যে, (ইবনে মাসউদ রাজিআল্লাহু তাআলা আনহু এর কওলী ও ফে’লী হাদীসদ্বয় থেকে) প্রথমটি অর্থাৎ কওলী মারফু হাদীসটিও সহীহ। কেননা, এর সব রাবীই সিকা। সুতরাং ইবনে মুবারক রহ. এর নিকট তা প্রমাণিত না হওয়ায় এটার প্রামাণ্যতা একেবারেই না হওয়া আবশ্যক নয়। এ ব্যাপারে আমরা অধ্যায়টির শুরুতে আলােচনা শেষ করে এসেছি। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৭১-৭২; হাদিস নং ৮২২ (ইদারাতুল কুরআন, করাচী)]
৬নং হাদীসঃ
বারা বিন আযেব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আমি নামায শুরু করার সময় (অর্থাৎ তাকবীরে তাহরিমা বলার সময়) দু’হাত উঠাতে দেখেছি। এরপর আর তিনি নামায শেষ করা পর্যন্ত দু’হাত উঠাননি। [শুনানে আবু দাউদঃ পৃ. নং ১০২; হাদিস নং ৭৫২ (বাইতুল আফফার, রিয়াদ)]
উল্লেখ্য যে, ইমাম আবু দাউদ রহ. এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃ
এ হাদীসটি সহীহ নয়। [শুনানে আবু দাউদঃ পৃ. নং ১০২; হাদিস নং ৭৫২ (বাইতুল আফফার, রিয়াদ)]
আমরাও বলি, এটি সহীহ নয়, তবে অবশ্যই তা হাসান (উত্তম সনদে বর্ণিত) তথা প্রমাণযােগ্য হাদীস হবে। কেননা, হাদীসের স্তরসমূহের মধ্য থেকে প্রথম অবস্থান সহীহ হাদীসের। এরপর হাসান হাদীসের। এরপর জয়ীফ হাদীসের । আহকাম তথা বিধি-বিধানের জন্য প্রথম দু’প্রকার হাদীস ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনের কিরামের নিকট গ্রহণযােগ্য ও প্রমাণযােগ্য। আর তৃতীয় প্রকাশ ফযীলত সংক্রান্ত ও উৎসাহমূলক আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণীয়।
এ আলােচনা থেকে বুঝা গেল, কোনাে হাদীস সহীহ না হলেই তা বাতিল, পরিত্যাজ্য হয় না; বরং তা হাসান বলে প্রমাণিত হলে তা দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে। | সতরাং আমরা বলবাে যে, মূলত এ হাদীসটিকে সহীহ না বলার পিছনে কারণ হলাে এর সনদে মুহাম্মাদ বিন আ. রহমান বিন আবী লায়লা নামক একজন রাবী আছে, যে বিতর্কিত রাবী। তবে সে কিছুটা বিতর্কিত হলেও মুসলিম শরীফের রাবী ইয়াযিদ বিন আবী যিয়াদ থেকে নিম্নস্তরের নয়; বরং তার সমমানের। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৮৬; হা. নং ৮২৮ সংশ্লিষ্ট (ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূমিল ইসিলামিয়্যা, করাচী)] অনেক ইমাম তার প্রশংসা করেছেন।
ইমাম ইজলী রহ. বলেনঃ
তিনি একাধারে ফকীহ, সুন্নাহর অনুসারী, সত্যবাদী ও হাদীস বর্ণনার উপযােগী ছিলেন। [তাহযীবুত তাহজিবঃ ৩/৬২৮; জীবনী নং ৭১৩৩ (মুআসসাসাতুত রিসালা, বৈরুত)]
ইমাম ইয়াকুব বিন সুফইয়ান রহ. বলেনঃ
তিনি নির্ভরযােগ্য বিশ্বস্ত রাবী। অবশ্য তার হাদীসে কিছুটা বির্তক আছে। [তাহযীবুত তাহজিবঃ ৩/৬২৮; জীবনী নং ৭১৩৩ (মুআসসাসাতুত রিসালা, বৈরুত)]
ইমাম আবু হাতেম রহ. বলেনঃ
তাঁর অবস্থান সততা ও সত্যবাদিতার। তবে সে কিছুটা দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলাে। [তাহযীবুত তাহজিবঃ ৩/৬২৮; জীবনী নং ৭১৩৩ (মুআসসাসাতুত রিসালা, বৈরুত)]
ইমাম ইবনে খুযাইমা রহ. বলেনঃ
তিনি হাফেযে হাদীস না হলেও ফকীহ ও আলেম ছিলেন। [তাহযীবুত তাহজিবঃ ৩/৬২৮; জীবনী নং ৭১৩৩ (মুআসসাসাতুত রিসালা, বৈরুত)]
এসব বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তার স্মৃতিশক্তি কিছুটা দুর্বল ছিলাে বটে কিন্তু সে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী ছিলাে। আর হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে বিশ্বস্ত রাবীর স্মরণশক্তি একটু কম হলে তার বর্ণিত হাদীসটি হাসান বলে বিবেচিত হয়, যা প্রমাণযােগ্য ও আমলযােগ্য। দেখুন: নুযহাতুন্নযর ফী তাওযীহি নুখবাতিল ফিকারঃ পৃ. নং ৬৫; তাহকীক- নূরুদ্দীন ইতর, হালব ও দামেশক।
এছাড়াও ইমাম তিরমিযী রহ. স্বীয় সুনানে তিরমিযীতে মুহাম্মাদ বিন আ. রহমান বিন আবী লায়লা কর্তৃক বর্ণিত একাধিক হাদীসকে হাসান বলে অভিমত পেশ করেছেন। এজন্যই আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এ হাদীসটির ব্যাপারে ইমাম আবু দাউদ রহ. এর মন্তব্য (হাদীসটি সহীহ নয় কথাটি) বর্ণনা করে বলেনঃ
অর্থাৎ আমি বলি হ্যাঁ (হাদীসটি সহীহ নয় ঠিক আছে) কিন্তু তা হাসান হবে। যা কিছুক্ষণ পরেই আমরা হাশিয়াতে (বিস্তারিতভাবে) উল্লেখ করছি।
এখানে আরাে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলােচনা ও পয়েন্ট রয়েছে, যা কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় উল্লেখ করছি না। বিস্তারিত দেখতে চাইলে দেখুন- ইলাউস সুনানঃ ৩/৮৫ হা. নং ৮২৮ সংশ্লিষ্ট হাশিয়া (ইদারাতুল কুরআন কর্তৃক প্রকাশিত)।
৭ নং হাদীসঃ
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু, ও উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর পিছনে আমায় পড়েছি। তাঁরা সবাই শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমা বলার সময়ই দু’হাত উঠাতেন (অন্য সময়ে নয়)। [সুনানে কুবরা, বাইহাকীঃ ২/১১৩-১১৪; হাদিস নং ২৬৩৪(দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যা, বৈরুত)]
এ হাদীসটির সনদ প্রমাণযােগ্য।
আল্লামা ইবনে তুরকুমানী রহ. বলেনঃ
(অন্য হাদীস শক্তিশালী করতে) এটা একটি উত্তম ও ভালাে সনদের প্রামাণিক হাদীস। [আল জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকাঃ ২/৭৮ (মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফিন্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ.ও স্বীয় ইলাউস সুনানে (৩/৬৮ , হা. নং ৮২১) আল্লামা ইবনে তুরকুমানী রহ. এর উক্ত মন্তব্য সমর্থন করে এর সনদকে ভালাে সনদ বলে অভিমত পেশ করেছেন। সুতরাং এ হাদীসটি হাসান বলে পরিগণিত হবে, যা মুহাদ্দিসীন ও উলামায়ে কিরামের নিকট প্রমাণযােগ্য একটি দলিল।
এতােক্ষণ পর্যন্ত আমরা একাধিক সাহাবী থেকে সহীহ ও প্রমাণযােগ্য সনদে এ বিষয়টি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমার সময় একবারই দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর রাফউল ইয়াদাইন (দু’হাত উত্তোলন করতেন না।
আগামী পর্বে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বড় বড় বিখ্যাত কতিপয় সাহাবা ও তাবেয়ীনের আমল ও ফাতওয়া উল্লেখ করবাে, যারা নামাযে তাকবীরে তাহরিমার সময় শুধু একবারই রাফউল ইয়াদাইনের প্রবক্তা ছিলেন। পরিভাষাগতভাবে এদের আমল ও ফতােয়াকে মাওকুফ/মাকতু হাদীস বা আসর বলে, যার দ্বারা মূলত মারফু হাদীসের প্রামাণ্যতা আরাে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়।

“তাকবীরে তাহরিমা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রেও দু’হাত উত্তোলন সংক্রান্ত হাদিস: পর্ব ২”
১ নং আসর:
আসওয়াদ রহ. বলেন, আমি উমার বিন খাত্তাব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-কে দেখেছি যে, তিনি শুধু প্রথম তাকবীরে দু’হাত উঠাতেন এরপর আর তার পুনরাবৃত্তি করতেন না। রাবী (যুবাইর বিন আদী) বলেন, এছাড়া আমি ইবরাহীম নাখয়ী রহ. ও শাবী রহ.-কেও অনুরূপ করতে দেখেছি। (শরহু মাআনিল আসার, তাহাবীঃ ১/২২৭, হাদিস নং ১৩৬৪ [আলামুল কুতুব, বৈরুত])
এ মাওকুফ হাদীসটি সহীহ। ইমাম তাহাবী রহ. এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর মন্তব্য করেন:
অর্থাৎ এটা সহীহ হাদীস।
আল্লামা তুরকুমানী রহ. ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ. থেকে এ আসরটি উপরােক্ত সনদে উল্লেখ করে বলেন:
অর্থাৎ এ সনদটিও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। [আল জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকী : ২/৭৫ (মাজলিস দায়িরাতিল মাআরিফান্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. স্বীয় আদ দিরায়াতে ইমাম তাহাবীর উদ্ধৃতিতে উক্ত আসরটি উল্লেখ করে বলেন:
অর্থাৎ এর সবগুলাে রাবীই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য। [আদ্দিরায়া: ১/১৫২ হাদীস নং ১৮২ সংশ্লিষ্ট (দারুল মা’রিফা, বৈরুত)]
আলামা নিমবী রহ. আসারুস সুনানে ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ. ও তাহাবী রহ. এর উদ্ধৃতি দিয়ে আসরটি উল্লেখ করে বলেন:
অর্থাৎ এটা বিশুদ্ধ একটি আসর। [আসারুস সুনান: পৃ. নং ১৫৫ হাদীস নং ৪০৩ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
২ নং আসর:
অর্থাৎ আসেম বিন কুলাইব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু যখন নামায শুরু করতেন (শুধুমাত্র) তখন দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর তার পুনরাবৃত্তি করতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৪১৬ হাদীস নং ২৪৫৭ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
হাফেয যাইলায়ী রহ. বলেন:
অর্থাৎ এটা বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত একটি আসর। [নাসবুর বায়া: ১/৪০৬ হাদীস নং ১৭২৭ শাইখ আওয়ামা কর্তৃক তাহকীককৃত (মুআসসাসাতুর রাইয়ান, বৈরূত)]
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন:
অর্থাৎ এর সব রাবী সিকা তথা নির্ভরযােগ্য এবং এটা মাওকুফ হাদীস। [আদ্দিরায়া: ১/১৫২ হাদীস নং ১৮১ সংশ্লিষ্ট (দারুল মা’রিফা, বৈরূত)]
হাফেয বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন:
অর্থাৎ আসেম বিন কুলাইবের হাদীসটির সনদ ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্তানুযায়ী সহীহ। [উমদাতুল কারী: ৫/৪০০ হাদীস নং ৭৩৫/১২৩ সংশ্লিষ্ট (দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরূত)]
আল্লামা নিমবী রহ. বলেন:
অর্থাৎ এর সনদ বিশুদ্ধ । [আসারুস সুনান: পৃ. নং ১৫৬ হাদীস নং ৪০৪ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
৩ নং আসর:
মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুমা এর পিছনে নামায পড়লাম। তখন তিনি নামাযের প্রথম তাকবীর ছাড়া আর কোথাও দু’হাত উঠালেন না। [শরহু মাআনিল আসার, তাহাবী: ১/২২৫ হাদীস নং ১৩৫৭ (আলামুল কুতুব, বৈরুত)]
হাফেয আইনী রহ. উমদাতুল কারীতে বলেন: ইমাম তাহাবী রহ. সহীহ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। [উমদাতুল কারী: ৫/৩৯৯ হাদীস নং ৭৩৫/১২৩ সংশ্লিষ্ট (দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যা, বৈরূত)]
আল্লামা নিমবী রহ. বলেন: এর সনদ সহীহ। [আসারুস সুনান: পৃ. নং ১৫৭ হাদীস নং ৪০৫ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. ও ইলাউস সুনানে এর সমর্থন করে বলেন: এর সনদ বিশুদ্ধ। [ইলাউস সুনান: ৩/৬৪ হাদীস নং ৮১৮ (ইদারাতুল কুরআন, করাচা)]
আল্লামা ইবনে তুরকুমানী রহ. বলেন: এটা একটি সহীহ সনদ। [আল জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকী: ২/৭৪ (মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফিন্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
৪ নং আসর:
ইবরাহীম নাখয়ী রহ. থেকে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর ব্যাপারে বর্ণিত যে, তিনি (শুধু) প্রথম তাকবীর অর্থাৎ তাকবীরে তাহরিমার সময় দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর উঠাতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৪১৬ হাদীস নং ২৪৫৬ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
হাফেয ইবনে তুরকুমানী রহ. বলেন: এটা একটি বিশুদ্ধ সনদ। [জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকী : ২/৭৯ (মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফিন্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
আল্লামা নিমবী রহ. বলেন: এর সনদটি ভালাে একটি মুরসাল। [আসারুস সুনান: পৃ. নং ১৫৮ হাদীস নং ৪০৬ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
উল্লেখ্য যে, মুরসাল হাদীস অধিকাংশ মুহাক্কিক উলামা ও মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকট দলীল ও প্রমাণযােগ্য হাদীস বলে বিবেচিত হলেও একটি দলের নিকট তা দলীলের উপযুক্ত নয়। তবে ইবরাহীম নাখয়ী রহ. এর বর্ণিত মুরসাল যদি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর হাদীস সংক্রান্ত হয় তাহলে তা বিশুদ্ধ ও প্রমাণযােগ্য হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই।
এ ব্যাপারটি স্পষ্ট করতে গিয়ে ইমাম তাহাবী রহ. বলেন:
যদি আমাদের বিরােধী পক্ষ অভিযােগ করে যে, তােমরা ইবরাহীম নাখয়ী রহ. সূত্রে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে যে হাদীস উল্লেখ করেছাে তা সূত্রবিচ্ছিন্ন। (কেননা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে ইবরাহীম নাখয়ী রহ. এর সরাসরি কোনাে হাদীস বর্ণনা নেই এবং তাদের মাঝে পারস্পারিক সাক্ষাতও হয়নি।) তখন তাদেরকে উত্তর দেয়া হবে যে, ইবরাহীম নাখয়ী রহ. আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে যখন মুরসাল হিসেবে হাদীস বর্ণনা করেন তখন (বুঝতে হবে) তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে উক্ত বর্ণনা তার নিকটে পারস্পারিক সনদে সুদৃঢ় ও বিশুদ্ধ হওয়ার পরই মুরসাল হিসেবে তা বর্ণনা করেছেন। (ঘটনা হলাে- একবার) ইমাম আমাশ রহ. তাকে বললেন, যখন আপনি আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করবেন তখন তার সনদ উল্লেখ করবেন। তখন তিনি বললেন, আমি যখন তােমাকে বলবাে আব্দুল্লাহ বলেছেন তখন (বুঝবে) আমি ততােক্ষণ পর্যন্ত তা বলি না যতােক্ষণ তা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে আমার নিকট বড় একটি (মুহাদ্দিসীন ও ইমামদের) দল বর্ণনা করে। আর যখন আমি বলবাে, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে আমার অমুক বর্ণনা করেছে তখন শুধু সে ব্যক্তিই আমার নিকট তা বণনা কম (অন্যরা নয়)। এরপর ইমাম তাহাবী রহ. উপরােক্ত ঘটনাটির সনদ করেছেন , যা ইমাম আমাশ রহ. পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। [শরহু মাআনিল আসার, তাহাবী: ১/২২৬-২২৭ হাদীস নং ১৩৬২ সংশ্লিষ্ট (আলামুল কুতুব, বৈরূত)]
৫ নং আসর:
আসওয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর সাথে নামায পড়লাম। তখন (দেখলাম) তিনি একমাত্র নামাযের শুরু সময় ছাড়া অন্য কোনাে সময় দু’হাত তুললেন না। রাবী আ. মালেক বলেন, আমি (বিখ্যাত তিন তাবেয়ী) ইমাম শাবী রহ., ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী রহ. ও ইমাম আবু ইসহাক রহ.-কে দেখেছি যে, তারা নামাযের শুরুসময় তথা তাকবীরে তাহরিমা বলার সময় ছাড়া অন্য কোনাে সময় দুহাত তুলতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৪১৭-৪১৮ হাদীস নং ২৪৬৯ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
আল্লামা ইবনে তুরকমানী রহ. বলেন: এ সনদটিও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। [আল জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকী: ২/৭৫ (মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফিন্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
ইমাম তাহাবী রহ. বলেন: এটা সহীহ একটি হাদীস। [শরহু মাআনিল আসার, তাহাবীঃ ১/২২৭; হাদিস নং ১৩৬৪ (আলামুত কুতুব, বৈরুত)]
অবশ্য তাহাবী শরীফে ইমাম আবু ইসহাকের কথা উল্লেখ নেই।
৬ নং আসর:
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সাতটি স্থানে হাত উঠাতে হয়। এক: যখন নামাযে দাড়াবে অর্থাৎ তাকবীরে তাহরিমার সময়। দুই: যখন বাইতুল্লাহ শরীফ দেখবে। তিন: সাফা পাহাড়ের উপর। চার: মারওয়া পাহাড়ের উপর অর্থাৎ সায়ীকালীন সময়ে। পাঁচঃ আরাফার ময়দানে। ছয়: মুযদালিফায়। সাত: কংকর নিক্ষেপের সময়। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ১/৪১৭; হাদীস নং ২৪৬৫ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
এ বর্ণনাটির সবগুলাে রাবীই সিকা। সুতরাং এ আসরটির সনদ সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই। হ্যা, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস হওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর বাণী তথা মাওকুফ হাদীস হওয়ার ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই।
আর এ কারণেই এটা মারফু তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস না হওয়ার প্রমাণ দিতে গিয়ে আল্লামা ইবনে দাকীক আল ঈদ রহ. বলেন: (এটা মারফু হাদীস না হওয়ার) দ্বিতীয় প্রমাণ হলাে, ইমাম অকী রহ. এর উক্ত হাদীসটি ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর মাওকুফ হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা। [নাসবুর রায়া: ১/৩৯১, হাদীস নং ১৬৮৮ শাইখ আওয়ামা কর্তৃক তাহকীককৃত (মুআসসাসাতুর রাইয়ান, বৈরূত)]
অর্থাৎ সহীহ সূত্রে যেহেতু প্রমাণিত হয়েছে যে, উক্ত কথাগুলাে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নয়; বরং ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর বাণী বিধায় তা মারফু হাদীস বলে দাবি করাটা ভুল। সুতরাং বুঝা গেলাে যে, উপরােক্ত হাদীসটি মারফু হওয়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মাওকুফ হওয়া নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই।
ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর এ আসর থেকে প্রমাণ মেলে যে, নামাযে শুধু একবারই দু’হাত উঠানাের নিয়ম রয়েছে। আর তা হলো নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরিমা বলার সময়। তাই নামাযে অন্যান্য – দুহাত উঠানাে সুন্নাত বলে বিবেচিত হবে না।
৭ নং আসর:
আবু ইসহাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ। রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ও আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর সঙ্গীসাথী ও শাগরিদগণ নামাযের সূচনালগ্ন ছাড়া অন্য কোনাে সময় দু’হাত উঠাতেন না। ইমাম অকী রহ. (এ বাক্যটি অতিরিক্ত) বলেন, এরপর আর তার পুনারাবৃত্তি করতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৪১৬; হাদীস নং ২৪৬১ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
আল্লামা ইবনে তুরকুমানী রহ. বলেন: এটা একটি সুস্পষ্ট সহীহ সনদ। সুতরাং তাদের দু’জনের শাগরিদদের এ ব্যাপারে ঐক্যমত পােষণ করা এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, মহান এ দু’সাহাবীর মাযহাব ও মত এরূপই ছিলাে। [আল জাওহারুন্নাকী মাআল বাইহাকি: ২/৭৯ (মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফিন্নিযামিয়্যা, হায়দারাবাদ)]
আল্লামা নিমবী রহ. স্বীয় আসারুস সুনানে বলেন: এর সনদ বিশুদ্ধ। [আসারুস সুনান: পৃ. নং ১৫৮; হাদীস নং ৪০৭ (আল মাকতাবাতুল বুশরা, করাচা)]
৮ নং আসর:
ইমাম আবু বকর বিন আইয়াশ রহ. বলেন, আমি কখনো কোনো ফকীহকে এমন করতে দেখিনি যে, প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য সমস্ত উঠিয়েছেন। [শরহু মাআনিল আসার, তাহাবীঃ ১/২২৮; হাদিস নং ১৩৬৭ (আলামুল কুতুব, বৈরুত)]
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. বলেন: এর সব রাবী বুখারীর রাবী শুধু ইবনে আবী দাউদ ব্যতীত। আর তিনিও সিকা তথা নির্ভরযােগ্য রাবী, যা পূর্বে গত হয়েছে। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৭৬; হাদিস নং ৮২৭ (ইদারাতুল কুরআন, করাচী)]
৯ নং আসর:
হুসাইন বিন আ. রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং আমর বিন মুররা রহ. (একবার) ইবরাহীম নাখয়ী রহ. এর দরবারে প্রবেশ করলাম। (তখন) আমর রহ. বললেন যে, আলকামা বিন ওয়ায়েল রহ. তাঁর পিতা থেকে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে নামায পড়তে গিয়ে দেখেছেন যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি স্বীয় দুহাত উঠিয়েছেন যখন তাকবীরে তাহরিমা বলেছেন এবং যখন রুক করেছেন এবং যখন রুক থেকে মাথা উঠিয়েছেন। ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বললেন, আমি বুঝি না তিনি সম্ভবত শুধু ঐ একদিনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়া দেখে তা ইয়াদ ও আয়ত্ব করে নিলেন। অথচ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সফর-হযর সর্বাবস্থার সঙ্গী ও প্রথম যামানার শীর্ষস্থানীয় সাহাবী) ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা তা ইয়াদ রাখতে পারলেন না? এরকম কথা আমি তাদের কারো থেকে শুনিনি। তাঁরা (সাহাবা ও তাবেয়ীন) নামাযের শুরুতে শুধুমাত্র কবীরে তাহরিমা বলার সময়ই দু’হাত উঠাতেন। [মুয়াত্তা মুহাম্মাদঃ ১/১৩৬-১৪০; হাদিস নং ১০৭ (আল-মাকতাবাতুল বুশরা, করাচী)]
এ বর্ণনাটি বিশুদ্ধ। এর সব রাবীই নির্ভরযােগ্য। আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. ইলাউস সুনানে বলেন: এর রাবীগণ সবাই সিকা (নির্ভরযােগ্য)। [ইলাউস সুনানঃ ৩/৭৩ হাদিস নং ৮২৫ (ইদারাতুল কুরআন, করাচী)]
১০ নং আসর:
ইসমাঈল রহ. থেকে বর্ণিত যে, কাইস রহ. নামায শুরু করার প্রারম্ভেই শুধু দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর তা উঠাতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাঃ ২/৪১৭; হাদিস নং ২৪৬৪ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
১১ নং আসর:
জাবের রহ. থেকে বর্ণিত যে, বিখ্যাত তাবেয়ীদ্বয় আসওয়াদ রহ. এবং আলকামা রহ. যখন নামায শুরু করতেন তখন দু’হাত উঠাতেন। এরপর আর তার পুনরাবৃত্তি করতেন না। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাঃ ২/৪১৭; হাদিস নং ২৪৬৮ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
১২ নং আসর:
তালহা রহ. থেকে ইমাম খাইসামা রহ. ও ইবরাহীম নাখয়ী রহ. এর ব্যাপারে বর্ণিত যে, তিনি (তালহা রহ.) বলেন, তারা শুধুমাত্র নামাযের শুরুতেই (তাকবীরে তাহরিমার সময়) দু’হাত উঠাতেন। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাঃ ২/৪১৬; হাদিস নং ২৪৬৩ (দারুল কিবলা, জেদ্দা)]
উপরােক্ত ১০, ১১ ও ১২ তিনটি আসরের সনদই হাসান প্রমাণযােগ্য।
আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. ইলাউস সুনানে বলেন:
নিশ্চয়ই সাহাবীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, যারা শুধু প্রথম তাকবীর তথা তাকবীরে তাহরিমার সময় হাত উঠানাের উপরই ক্ষান্ত করতেন, যেমনটি পূর্বে গত হয়েছে। আর তাবেয়ীদের মধ্য থেকে বড় একটি দল এরূপই (মতপােষণ করতেন)। তাদের মধ্যে থেকে অন্যতম হলেন- আসওয়াদ রহ., আলকামা রহ., ইবরাহীম নাখয়ী রহ., খাইসামা রহ., কাইস বিন আবী হাযেম রহ., শাবী রহ., আবু ইসহাক রহ. এবং আরাে অনেকে। এসবগুলাে বর্ণনা ইমাম ইবনে আবী শাইরা রহ. তার মুসান্নাফে উত্তম ও ভালাে সনদে উল্লেখ করেছেন। [ইলাউস সুনান: ৩/৮৮ হাদীস নং ৮২৯ সংশ্লিষ্ট (ইদারাতুল কুরআন, করাচী)]
মূলত এ ব্যাপারে সাহাবা ও তাবেয়ীদের আরাে অনেক আসার আছে, যা কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় উল্লেখ করলাম না। তবে যে বারােটি আসার উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে শীর্ষস্থানীয় কতিপয় সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল ও বর্ণনা পাওয়া যায় যে, তারা শুধুমাত্র প্রথম তাকবীরের সময়ই দু’হাত উঠানোর প্রবক্তা ছিলেন। আর প্রামাণ্য হওয়ার জন্য এতােটুকুই যথেষ্ঠ মনে করি। কেননা, পূর্বের হাদীস ও আসারগুলাে থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত হয়েছে যে, যেরকমভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় নামাযে তাকবীরে তাহরিমার সময় একবারের বেশী আর হাত তুলতেন না তেমনি তার শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের মধ্য থেকে আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু, উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু, আব্দুল্লাহ বিন উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুমা, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুমা-সহ প্রমূখ সাহাবীগণও তদানুযায়ী আমল বা ফতােয়া প্রদান করেছেন। তদ্রুপ তাবেয়ীদের মধ্য থেকেও অসংখ্য তাবেয়ী -যাদের মধ্যে আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর শাগরিদগণ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য- এ মতের উপরই আমল করেছেন।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাযের এ বিশুদ্ধ বর্ণনা ও শীর্ষস্থানীয় সাহাবা ও তাবেয়ীদের আমল ও ফতােয়া দেখেও যার মন ভরে না এবং প্রমাণ হিসেবে এগুলাে যার জন্য যথেষ্ঠ বলে মনে হয় না তাদের জন্য আমাদের আর কিছু বলার নেই। মূলত এ ধরনের লােকদের দুনিয়ার তাবৎ দলীল এনে দিলেও নিজের মনমতাে না হলে তা উপেক্ষা করে ফেলে দেয়। আল্লাহ সবাইকে হিদায়াত দান করুন।

পিডিএফ ডাউনলোড লিংকঃ https://drive.google.com/file/d/1y7WTjfnMn3HgtuaezvB99smw9OEyzgOn/view?usp=sharing

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *