আত্মমর্যাদাবোধকে আরবিতে ‘গায়রত’ বলে।

অহংকার এবং আত্মমর্যাদাবোধ আলাদা বিষয়। আত্মমর্যাদাবোধকে আরবিতে ‘গায়রত’ বলে। গায়রত থাকা মুমিনের বৈশিষ্ট্য, অহংকার থাকা কাফিরের বৈশিষ্ট্য। গায়রতের উৎস হলো দীন, অহংকারের উৎস হলো নফস। ইমানি গায়রত ও ইলমি গায়রতও দীনি গায়রতের অংশ। ইমানি গায়রতের অর্থ হলো, ইমানের কারণে ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ জেগে ওঠা। কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসুল বা সাহাবিদের নিয়ে গালি দিলে ভেতরে যদি আত্মমর্যাদাবোধ না জাগে, তবে সেই ব্যক্তি ইমানি গায়রতহীন। একজন ব্যক্তির সামনে দীনের অপব্যাখ্যা হওয়া সত্ত্বেও সে যদি মুখে কুলুপ এঁটে রাখে, তবে সে ইলমি গায়রতহীন।

আল্লাহ তাআলারও গায়রত রয়েছে; বরং সর্বাধিক গায়রত তাঁরই। বান্দা যখন আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ে লিপ্ত হয়, তখন তাঁর গায়রত জাগে। আর এ কারণেই তিনি যেমন দয়ার সাগর, একইভাবে তিনি সুকঠিন শাস্তিদাতাও। যে নারী তার সৌন্দর্যের প্রতি অন্যদের লোলুপ দৃষ্টি পড়তে দেয়, যে পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে অন্য পুরুষকে বন্ধুত্ব করতে দেয় বা একইসঙ্গে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে, এরা সবই গায়রতহীন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তিন শ্রেণির লোক জান্নাতে যাবে না। তন্মধ্যে দাইয়ুস অন্যতম। দাইয়ুসের পরিচয়ও তিনি তুলে ধরেছেন :

الذي لا يبالي من دخل على أهله
এমন ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর কাছে কে প্রবেশ করল, এর পরোয়া করে না।

কখনো গায়রত শিরোনামে অহংকারেরও চর্চা হয়। আমরা পূর্বেই বলেছি, গায়রতের উৎস হলো দীন। এখন কারও আত্মমর্যাদাবোধের উৎস দীন না হয়ে যদি অন্য কিছু হয়; যেমন নফস, তাহলে তা-ই অহংকার ও জাহিলিয়্যাত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন :

من الغيرة ما يحب الله، ومنها ما يبغضه الله
কিছু গায়রত এমন, যা আল্লাহ ভালোবাসেন। আর কিছু গায়রত এমন, যা আল্লাহ ঘৃণা করেন।

আপনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করবেন অথবা আপনার বিধবা মা নতুন স্বামীর সঙ্গে সংসার করবেন কিংবা আপনার স্বামী দীনি প্রয়োজনে চারিত্রিক পরিশুদ্ধি রক্ষার্থে দ্বিতীয়াকে ঘরে আনবেন, কিন্তু এতে আপনি ইগোর অজুহাত দিয়ে বাঁধ সাধলেন, তবে এটা নিষিদ্ধ গায়রত। কারণ, আল্লাহ যা বৈধ করেছেন, সে ব্যাপারে আপনার নেতিবাচক মানসিকতা লালন করার কোনোই অধিকার নেই। শরিয়াহর কোনো বিধানের ব্যাপারে অন্তরে সামান্য অপছন্দনীয়তা থাকলেও ব্যক্তির ইমান নেই।

আজকাল সমাজের পুরুষদের থেকে গায়রত হারিয়ে গেছে, তাই নারীদের থেকেও পবিত্রতা বিলুপ্ত হয়েছে। বাবা, ভাই ও স্বামী দাইয়ুস হয়ে গেছে, তাই নারীদের সম্ভ্রমও পানির মতো সস্তা হয়ে পড়েছে। কথিত আছে :

كلُّ أمة وضعت الغَيْرة في رجالها وضعت العفة في نسائها
যে জাতির পুরুষদের ভেতরে গায়রত থাকে, সে জাতির নারীদের ভেতরে পবিত্রতা থাকে।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন :

إن أصل الدين الغَيْرة، ومن لا غيرة له لا دين له، فالغَيْرة تحمي القلب فتحمي له الجوارح، فتدفع السوء والفواحش، وعدم الغَيْرة تميت القلب، فتموت له الجوارح
দীনের মূল হলো গায়রত। যার গায়রত নেই, তার দীনও নেই। গায়রত অন্তরকে সুরক্ষিত রাখে, ফলে অঙ্গগুলোও সুরক্ষিত থাকে। আর তা অশ্লীলতা ও নোংরামি দূরে রাখে। গায়রতহীনতা অন্তর মেরে ফেলে। ফলে অঙ্গগুলোও মৃত্যুবরণ করে।

আজ উম্মাহর পুরুষদের গায়রত নেই বলেই তো উম্মাহর নারীরা কুফফারের হাতে ধর্ষিতা হয়। কুফফারের জিন্দানখানায় সতীত্ব খোয়ায় আর নির্যাতন সইতে না পেরে মৃত্যুর জন্য ডুকরে কাঁদে। আজ উম্মাহর গায়রত নেই বলেই তারা গোটা দুনিয়াব্যাপী কুফরের শাসন ও নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, কুফরের মধ্যেই শান্তি খুঁজে পেয়েছে। আজ উম্মাহর গায়রত নেই বলেই উলামায়ে সু চারিদিকে দুর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, দুই পয়সার দুনিয়ালোভী তাগুতি কুকুররা হকপন্থীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বসেছে। হায়, গায়রতের অভাবেই তো উম্মাহর দিন কাটে অশ্লীলতা ও নেশার ঘোরে, রাত কাটে টিভি বা পিসির পর্দায় খেলা ও ফিল্মের মাঝে।

যেদিন উম্মাহর গায়রত জেগে উঠবে, সেদিন পৃথিবীটা আর এমন থাকবে না। সেদিনের সূর্যটা হবে অনেক সুন্দর। প্রকৃতি ফিরে পাবে প্রাণ। হবে সব অন্যায় ও জুলুমের অবসান। পৃথিবীর দিগন্তে উদ্ভাসিত হবে নতুন আলো, ইসলামি শাসনের আলো, ন্যায় ও ইনসাফের আলো। কিন্তু গায়রতহীন জাতির গায়রত কে জাগাবে! লক্ষ্যহীন জাতিকে লক্ষ্যের পানে কে ছোটাবে! তবে আশার বাণী হলো, অন্ধকার যখন গভীর হয়, সুবহে সাদিকও তখন নিকটে আসে। আরেকবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাদের। আর এ যুগটাই এর সবচে উপযুক্ত সময়। (আলী হাসান উসামা)

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *