আবু হানিফা রাঃ – এর হাদিসগুলা কি আসলেই জঈফ বা দূর্বল ??? (( পর্বঃ এক))
[[ সবার জন্য বিষয়টি জানা থাকা জরুরী ]]
============================
→ ভূমিকা –
অধুনা সময়ে এসে উম্মাহ একটা বিশাল ঝামেলায় আপতিত। চার মাজহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম, আবু হানিফা রাঃ মাসালা-মাসাইলে যে হাদিসগুলা রেফার করেছেন, সেগুলোর অধিকাংশ নাকি জঈফ বা দূর্বল _ এমন একটা বিশাল অজ্ঞতাপূর্ণ তুহমত দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যারা ছড়াচ্ছেন, তারা নিঃসন্দেহে সত্য জানা সত্যেও কেবল হিংসার বশবর্তী হয়ে মিথ্যা – অপবাদ ছড়াচ্ছেন৷ আল্লাহ সবাইকে হেদায়ত দান করুক _ আমীন!
যাইহোক, আজকের লেখায় হাদিসে সনদ নিয়ে আলোচনা করব। যদিও বিষয়টি আহলে ইলমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ; তথাপি আশাকরি সবাই সহজপাঠ্য হিসেবে লেখাটি পাবেন৷
→ মূল কথা –
আমরা জানি, হাদিসের দূর্বলতা দু’দিক থেকে হয়। এক, রাবী বা বর্ণনাকারীর দিক থেকে। দুই, মতন বা মূল হাদিসের দিক থেকে। আমার পর্যালোচনা সনদের দিক থেকে।
আমরা তাও জানি, ইমাম বুখারী রাঃ এর জন্মের প্রায় শতাধিক বছর আগে ইমামে আজম আবু হানীফা রাঃ দুনিয়ায় আগমন করেছেন। এবং তাও জানি যে, ইমাম আবু হানীফা অধিকাংশ মুহাদ্দিসিনদের মতে একজন তাবেয়ী। কারো মতে চারজন, আবার কারো মতে সাতজন সাহাবীর সান্নিধ্য সহ শিক্ষা নিয়েছেন৷
ধরুন,
ইমাম আবু হানীফা একজন তাবেয়ী। তাহলে বলা যায়, তিনি কারো থেকে হাদিস গ্রহণ করলে রাবী এবং রাসূল সাঃ পর্যন্ত সর্বোচ্চ দুই স্তর থাকে। তাবেয়ী → সাহাবী → রাসূল সাঃ৷
ধরুন,
ইমাম বুখারী রাঃ একজন তাবেয়ে তাবেয়ী। তাহলে বলা যায়, তিনি কোন হাদিস গ্রহণ করলে রাবী এবং রাসূল পর্যন্ত অন্তত চার স্তর থাকে। রাবী → তাবেয়ে তাবী → তাবী → সাহাবী → রাসূল সাঃ।
এবার একটা চার্ট পর্যালোচনা দেখুন,
আচ্ছা,মনে করুন একটা হাদিস বর্ণিত হচ্ছে এভাবে পর্যায়ক্রমে –
রাসূল সাঃ
↓
উমর ইবনু খাত্তাব রাঃ
↓
আলক্বামা বিন ওয়াক্ক্বাস
↓
ইয়াহয়া বিন সাঈদ
↓
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা
↓
মু’আম্মাল ইবনে ইসমাইল
↓
ইমাম বুখারী রাঃ
আশাকরি, চার্ট দেখে বুঝতে পারছেন যে, একটা হাদিস রাসূল সাঃ থেকে ইমাম বুখারী পর্যন্ত পৌঁছেছে৷
এবারে ইমাম আবু হানীফা ও বুখারীর নিকট এই হাদিসের মান নিয়ে আলোচনা করি –
সংক্ষেপে বলি,
হাদিসটি ইমাম আবু হানীফা রাঃ এর নিকট সহীহ এবং বুখারী রাঃ এর নিকট জঈফ। এবং উভয়ের তাহকীম সহীহ বা বিশুদ্ধ।
বলবেন কিভাবে?
জ্বী, তাহলে এবার গভীর মনযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করুন।
✅ ইমাম আবু হানীফা রাঃ এর নিকট হাদিসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ –
কারণ, তিনি হাদিসটি গ্রহণ করেছেন – আলকামা রাঃ থেকে । কেননা, আবু হানীফা রাঃ উনাকে উনার জীবদ্দশায় পেয়েছেন এবং শিক্ষাদীক্ষা নিয়েছেন। আর সর্বসম্মতিক্রমে, আলক্বামা রাঃ একজন সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবি। তাই আবু হানীফার হাদিস গ্রহণ সহীহ বা বিশুদ্ধ৷ কারণ, উনার পর্যন্ত হাদিসের সনদে বা রাবীদের মাঝে কোন সমস্যা নাই।
❌ ইমাম বুখারীর নিকট হাদিসটি জঈফ বা দূর্বল –
কারণ, তিনি হাদিসটি গ্রহণ করেছেন মু’আম্মাল ইবনে ইসমাইল থেকে। আর, মু’আম্মাল যেহেতু স্মৃতি শক্তির ব্যাপারে সমালোচিত, তাই ইমাম বুখারী রাঃ উনার বর্ণিত হাদিসটা ” সহীহুল বুখারীতে ” স্থান দেন নাই। ” উমার ইবনে খাত্তাব ” থেকে নিয়ে ” সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা ” পর্যন্ত সকল রাবী সিকাহ হওয়া সত্ত্বেও কেবল ” মু’আম্মাল ইবনে ইসমাইল ” এর কারণে ইমাম বুখারী রাঃ হাদিসটি ” সহীহুল বুখারীতে ” স্থান দেন নি।
→ এবার গভীরভাবে চিন্তা করে বলুন,
ইমাম আবু হানীফার হাদিস গ্রহণ কি অশুদ্ধ? মোটেও না! কারণ, ইমাম বুখারী রাঃ যে রাবীর কারণে হাদিসটি জঈফ বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা তো উনাকে তথা মু’আম্মালকে পানই নাই৷ মু’আম্মাল এর জন্মের বহু আগে আবু হানীফা রাঃ মৃত্যু বরণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তো একজন সীকাহ রাবী তথা আলক্বামা থেকে হাদিসটা গ্রহণ করেছেন। তাই নিশ্চিন্তে, আবু হানীফার হাদিস গ্রহণ সহীহ৷
তাই সারাংশে উক্ত হাদিসের পর্যালোচনায় বলা যায় –
এই হাদিসটি ইমাম আবু হানীফার গ্রহণ বিশুদ্ধ। কারণ, তিনি একজন সিকাহ রাবী তথা আলক্বামা থেকে হাদিসটি গ্রহণ করেছেন৷
আবার একই হাদিস ইমাম বুখারীর গ্রহণ অশুদ্ধ৷ কারণ, তিনি হাদিসটি একজন জঈফ রাবী তথা মু’আম্মাল থেকে শুনেছেন।
শেষ কথা,
নতুন দ্বীনে আসা প্রেক্টিসিং মুসলিম ভাইদের অনুরোধ করে বলব, কোন হাদিসের ব্যাপারে জঈফ শব্দ শুনলেই নাক ছিটকাবেন না। জঈফ মানেই পরিত্যাজ্য বা নাক ছিটকানো না। জঈফ হাদিস এর প্রকার মোট -৪৯ টা রয়েছে। সব ক’টি জঈফ হাদিস পরিত্যক্ত বা আমলের অনুপযুক্ত _ ব্যাপারটা এমন না। তন্মধ্যে কিছু হাদিস আছে, যা আমলের যোগ্য এবং অনেক মুহাদ্দিসীনে কেরাম থেকে উক্ত জঈফ হাদিসের উপর আমলের বর্ণনা রয়েছে।
যেমন, ইমাম তিরমিজী রাঃ উনার ” জামিউল কাবীর ” গ্রন্থে বলেন –
আমি উক্ত হাদিসের কিতাবে সহীহ, হাসান, জঈফ ইত্যাদি হাদিস উল্লেখ করেছি। তবে যে হাদিসগুলা এনেছি, তার উপর কোন না কোন মুহাদ্দিসের আমল দেখেছি / শুনেছি, তারপর আমার কিতাবে স্থান দিয়েছি৷
ইমাম তিরমিজী রাঃ এর উক্তি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, তখনকার সময়ে মুহাদ্দিসীনদের মাঝে সঙ্গত কারণে কিছু কিছু জঈফ হাদিসের উপর ও আমল ছিল।
তাই আমি আমার দ্বীনি ভাইদের বলব, জঈফ হাদিস শুনলেই আঁতকে উঠবেন না। হাদিসটির ব্যাপারে উলামায়ে কেরামদের তাহকীম জানবেন। তারপর, সিদ্ধান্ত নিবেন ইনশা আল্লাহ ! আল্লাহ আপনাদের প্রচেষ্টাতে বারাকাত দান করুক _ আমীন!
আব্দুল কারীম চৌধুরী,
ইসলামিক আইন ও বিচার বিভাগ,
মদীনা ইসলামীক বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।