• উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল নামগুলোর একটা হচ্ছে মাহমুদ গজনভী। তুর্কিশ বংশোদ্ভূত এক দাস পিতার সন্তান ছিলেন তিনি।
পেশায় ছিলেন পিতার উত্তরসূরি, সামানিদ সাম্রাজ্যের সৈনিক। সামানিদরা ইরান কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতর এক ন্যায়পয়ারণ শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
মাহমুদের পিতা সামানিদদের হয়েই গজনীর গভর্নর ছিলেন। সেকালে সামানিদ সম্রাজ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। পিতার মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই তিনি গজনীর শাসন ক্ষমতায় আসেন।
এমনকি নিজ কূটনৈতিক দক্ষতার দরুণ আব্বাসীয় খেলাফতের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেন এবং ‘সুলতান’ হিসেবে স্বাধীনভাবে শাসনক্ষমতা পরিচালনার অনুমতি প্রাপ্ত হন।
সুলতান মাহমুদ কাস্পিয়ান সাগর থেকে যমুনার তীর পর্যন্ত বিস্তৃত এক ভূমিতে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এমন বহু অঞ্চল ছিল- ইতিহাসে যা তার মাধ্যমেই প্রথমবারের মত মুসলমানদের হাতে এসেছে।
একবার সুলতান মাহমুদের কাছে এসে এক লোক অভিযোগ জানালো- সুলতানের ভাতিজা তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে জবরদস্তিমূলক রাত কাটায়।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানালেও সুলতানের ভাতিজা বলে তারা কোনও ব্যবস্থা নেয় নি। সুলতান তাকে বললেন, ‘আরেকবার যখনই সে আসবে আমাকে জানাবেন।’
এরপর প্রহরীকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, দিনে বা রাতে যে কোনও সময় এই লোক এলে যেন সরাসরি সুলতানের কাছে নিয়ে আসা হয়।
দুদিন পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে এলেন, তখন মধ্যরাত। সুলতান ঘুমোচ্ছিলেন। অবগত হওয়ামাত্র নিজের তলোয়ারটা হাতে নিয়ে একা একা সেই লোকের বাড়িতে গেলেন।
ঘরে আলো জ্বলছিল। আলোটা নিভিয়ে তরবারির এক আঘাতে নিজের ভাতুষ্পুত্রের শিরোচ্ছেদ করলেন। এরপর সেই লোকের কাছ থেকে পান করার জন্য পানি চাইলেন।
অভিযোগকারী অত্যন্ত অবাক হয়ে সুলতানের কাছে জিজ্ঞেস করলেন- তিনি কেনইবা আলো নেভালেন। কেন পানি পান করতে চাইলেন!
সুলতান বললেন, ‘নিজের প্রিয়জনের মুখ যেন ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকে ব্যহত না করে সেই জন্য তিনি আলো নিভিয়েছেন।’
আর পানি চাইবার করবার কারণ হচ্ছে- তিনি কসম করেছিলেন। যতক্ষণ না এর বিহিত করেন ততক্ষণ এক ফোটা পানিও তিনি পান করবেন না। ফলত গত দুইদিন ধরেই তিনি পিপাসার্ত।
• সুলতান মাহমুদকে ইবনে কাসীর ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অভহিত করেছিলেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে লেখাজোঁকায় প্রচুর অপবাদ ও কলঙ্ক আরোপ করা হয়েছে। মিথ্যাচার করা হয়েছে।
বলা হয় তিনি সোমনাথ মন্দিরে গণহত্যা চালিয়েছিলেন। অথচ সোমনাথ মন্দিরে তাঁর অভিযান ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক কারণে। আর তা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। এর সাথে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের সম্পর্ক নেই।
মন্দিরে পরিচালিত অভিযানে বিশেষ কোনও ক্ষয়ক্ষতিই হয় নি এবং তা এতখানিই অনুল্লেখযোগ্য যে সেই মন্দিরে সমসাময়িক সময়ের তীর্থ যাত্রীদের নথি আবিষ্কৃত হবার পর দেখা গেছে- এতে কোনও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির উল্লেখ ছিল না।
এই প্রসঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই যে সমস্ত মিথ প্রচলিত আছে তা ইতিহাসের বিচারে শেষাবধি টিকে না।
সুলতান মাহমুদের শাসনামলে সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। বায়হাক্বী রহ. সুলতানের সেনাবাহিনীতে বহু হিন্দু কর্মচারী এবং তিলক নামে প্রভাবশালী এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার কথা বলেছেন। যার কমান্ডে বিশাল একটি ইউনিট ছিল।
• সুলতান মাহমুদ বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৮ বছর। অথচ এইটুকুন সময়ের মধ্যে যেন বহু অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কবিতা ও সাহিত্যে আগ্রহ ছিল। মহাকবি ফিরদউসি তাঁর রাজ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন।
আল বিরুনি তাঁরই নির্দেশে ‘ভারততত্ত্ব’ রচনা করেছিলেন। তাঁর সময়ে মাদ্রাসাগুলোতে গণিত, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান এবং মহাকাশ বিদ্যার পাঠ দান করা হত।
১৭ বার তিনি ভারত অভিযান পরিচালনা করেছেন। নিজে আইনজ্ঞ ছিলেন। ইসলামী আইনশাস্ত্রের উপর দক্ষতা ছিল তাঁর। তিনি কাশ্মীরকেও তাঁর শাসনাধীন করেছিলেন।
• সুলতান মাহমুদ তাঁর নিজের ভাতিজাকে ধর্ষণের অভিযোগে নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন- তাও এমন ভাইয়ের সন্তানকে- যে ভাই তাঁকে বিদ্রোহে সহযোগী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল।
শাসক হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন তা বুঝবার জন্য এ ঘটনাটিই যথেষ্ট। একজন সাধারণ নাগরিকের মর্যাদার মূল্য দিতে তিনি হত্যা করেছিলেন নিজের স্বজন এবং ক্ষমতার সহযোগীকে।
অথচ সেই সুলতান মাহমুদের চরিত্রে যারা কলঙ্ক লেপন করেছে এবং এখনো সে প্রজেক্ট চলমান রেখেছে। তাদেরই কথিত সেই ‘ভিলেন’ সুলতান মাহমুদ এটুকুন ইনসাফ দিতে পারলেও-
আজও অবধি তারা কি তা পেরেছে? ফেব্রুআরি ১৯৯১, ২৩ তারিখ উত্তর কাশ্মীরের কুনান, পুশপরা গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪ রাজপুত রাইফেলস যে গণধর্ষণ চালায় তাতে এক রাতে গণধর্ষিত হয়েছিল ২৩ থেকে ৪০ জন নারী।
জাতিসংঘের স্টেট ডিপার্টমেন্ট গণধর্ষণের প্রমাণ আছে বলে বিবৃতি দেওয়া স্বত্ত্বেও আজও পর্যন্ত কোনও একটি নিরপেক্ষ তদন্ত অথবা আদালতে একটা মামলারও বিচার কাজ শেষ হয় নি। সবকিছুই নিরেট অস্বীকার করা হয়েছে।
এই প্রজন্মের সেই গালি দেওয়া ‘মধ্যযুগ’ আর মেকি গৌরবের ‘আধুনিক সভ্যতা’র মধ্যকার এ ফারাকটুকুন বোঝা দরকার। আর তা আত্মস্থ করাটাও প্রয়োজনীয়। ©আরজু আহমেদ