কিছু মুসলিম চিন্তাবিদদের বড় একটি চিন্তাবিভ্রাট হল

কিছু মুসলিম চিন্তাবিদদের বড় একটি চিন্তাবিভ্রাট হল, ইসলামি শিক্ষা ও নির্দেশনাকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিশ্লেষণ করা। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের একটি ত্রুটি হচ্ছে, হুকুকুল ইবাদকে হিউম্যান রাইটস এর দৃষ্টিতে বুঝা কিংবা হিউম্যান রাইটসকে হুকুকুল ইবাদ দিয়ে প্রমাণ করা। কেউ কেউ তো হিউম্যান রাইটস এর অর্থ ভুলভাবে হুকুকুল ইবাদ করা পর্যন্তই ক্ষান্ত থাকে না। বরং আগ বেড়ে তারা দুটোকেই এক মনে করে। এমনকি তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, পৃথিবীকে ইসলামই সর্বপ্রথম হিউম্যান রাইটস দীক্ষা দিয়েছে। বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিউম্যান রাইটস এর শিক্ষা দিয়েছেন। (নাঊযুবিল্লাহ)

উভয়টার পার্থক্য সহজভাবে বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক একটা লিবারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দুজন নারীপুরুষ লীভ টু গেদার করতে চায়। এখন প্রশ্ন হল, এমনটা করার অধিকার তাদের আছে কি না? যদি এই প্রশ্নের উত্তর কোন দ্বীনি ব্যক্তিত্বের কাছে জানতে চাওয়া হয় তাহলে তিনি খোদাপ্রদত্ত কল্যানের ধারণা তথা কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে উত্তর দিবেন। একজন মুসলিম আলেম বলবেন, যেহেতু কুরআন- সুন্নাহতে এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এজন্য কারোরই লীভ টু গেদারের অধিকার নেই। পক্ষান্তরে যেই ব্যক্তি হিউম্যান রাইটসকে সর্বোচ্চ সত্য ও আইন হিসেবে মেনে নেয় তাকে প্রশ্ন করা হলে সে এই কাজকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিবে। সে বলবে, প্রত্যেক মানুষের এই অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে যে, নিজেদের চাহিদা এবং খাহেশাত যেভাবে ইচ্ছা পূরণ করবে। এখন যদি তারা দুজন লীভ টু গেদার করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে চায়, তবে তাদের পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে এমনটি করার। এই দলিলের ভিত্তিতেই পাশ্চাত্যসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সমকামিতা, যিনা, পরকীয়া সহ নানান অশ্লিলতা এবং পাপাচারকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে। একটি লিবারেল রাষ্ট্রে প্রত্যেকেরই অধিকারই আছে, সে খোদায়ী প্রত্যাদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হিউম্যান রাইটস এর আড়ালে এসব জঘন্যতম কাজগুলোর সাংবিধানিক অনুমোদন পাওয়া।

“হুকুকুল ইবাদ” মহান আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। একজন মানুষের (গোলামের) কোন কাজের অনুমোদন কিংবা নিষেধাজ্ঞা কিতাব- সুন্নাহর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বিপরীতে হিউম্যান রাইটস এর বৈধতা একজন স্বেচ্ছাচারী ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবিদার মানব সত্ত্বা দ্বারা হয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তির অধিকার এমন কোন বিষয় নয় যার বৈধতা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ফিতরী কানুনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। বরং ‘অধিকার’ এর একমাত্র উৎস হতে হবে কুরআন এবং সুন্নাহ। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি তার নিজ জীবনের মালিক নয়। এই জীবন তার রবের দান করা বস্তু। এজন্য বান্দা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিচালনা করার অধিকার রাখেনা। ফলে আমরা মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন মনে করতে পারি না। বরং সে গোলাম এবং বান্দা। সাথে সাথে আমরা তার এমন কোন অধিকারের দাবিকেও মেনে নিতে পারি না, যেটার অনুমোদন খোদায়ী নির্দেশনার বাহির থেকে গৃহীত হয়েছে। বান্দার অধিকার ততটুকুই যতটুকু আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীর মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর বাইরে বান্দার সমস্ত কার্যক্রমই জুলুম এবং অবাধ্যতা হিসেবে গণ্য হবে। আর সেটাকে মিটিয়ে দেয়াই মূল ইনসাফ ও আদল। মানুষের এমন কোন সত্ত্বাগত অধিকার নেই যেটার বৈধতার প্রমাণ স্বয়ং সে নিজেই এবং সেই অধিকারকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ থাকবে না। হিউম্যান রাইটস এর অর্থ হল, মানবিধারকে কল্যানের উপর প্রাধান্য দেয়া এবং এই কথার স্বীকৃতি দেয়া মানুষ নিজেই তার মালিক। এমনকি ভাল মন্দের মাপকাঠিও খোদায়ী প্রত্যাদেশ নয়,বরং মানুষের খাহেশাত।

অধিকার ও কর্তব্যের সব ধরণের ব্যাখ্যা কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য ও কল্যানের ধারণা পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে অধিকার ও কর্তব্যের ব্যাখ্যায়ও পরিবর্তন আসে। (যেমন)শরীয়াহ প্রবর্তকের পক্ষ থেকে বান্দাকে অধিকার প্রদান করার পিছনে শরীয়াহর উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব করার এজেন্ডা থাকে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস বান্দাকে যেসব অধিকার প্রদান করে সেগুলো তার খোদায়িত্বকে পরিপূর্ণ করার সুযোগ তৈরি করতে থাকে। যেহেতু হিউম্যান রাইটস শরীয়ার এজেন্ডা অর্জন এবং আবদিয়্যাতকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হিসেবে মেনে নেয় না, এজন্য তা শরীয়তের বয়ান করা অধিকারের ব্যাখ্যা ও সীমাকে অস্বীকার করে। বিপরীতে হিউম্যান রাইটস অধিকারের সেই ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা সমাধিকারের ভিত্তিতে এমন সামাজিক কাঠামো তৈরি করে যেখানে প্রত্যেকে ব্যক্তি নিজ নিজ খাহেশাত বেশি বেশি পূরণ করতে পারে। যেই রাষ্ট্র হিউম্যান রাইটস এর অনুসারী হবে সেই রাষ্ট্র কখনো শরীয়ার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ করতে পারে না।

“হিউম্যান” এটা কোন শাব্দিক ব্যাপার নয় যে, শব্দটির অর্থ মানুষ তুলে যেভাবে ইচ্ছা চালিয়ে দেয়া যাবে।বরং তা ধর্মের বিরোধী নির্দিষ্ট এক বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস থেকে বের হয়ে আসা পরিভাষা। humanity মূলত এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনের রহস্যজনক ধারণা। এর অর্থ “মানবতা” নেয়া মারাত্মক ভ্রান্তি ও ধোঁকা।মানবতার সঠিক ইংরেজি হল Mankind। মানবতাকে বুঝানোর জন্য ১৮ শ শতাব্দি পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় এই শব্দটিরই প্রচলন ছিল। humanity এর ধারণা ইসলামে মানবসত্তার ধারণাকে পরিপূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ human being “আবদিয়ত”কে অস্বীকার করে। কান্টের মতে হিউম্যান বিয়িংয়ের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং আসল অবস্থান হল, autonomy তথা খোদায়িত্ব ও স্বেচ্ছাধিকারিত্ব।

মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার অনুসারী এবং অনুগামী হয়।আর হিউম্যান বিয়িং নিজেই রব বনে যায়।এজন্য হিউম্যানের সঠিক অর্থ মানুষ নয়,বরং শয়তান( human is actually demon)। কারণ সে শয়তানের মতই আপন রবের বিদ্রোহী। সুতরাং হিউম্যান রাইটস এর অর্থও তাহলে মানবাধিকার নয়, হবে শয়তানের অধিকার। বিংশ শতাব্দির প্রসিদ্ধ দার্শনিক ফুকো ঠিকই বলেছে যে, হিউম্যানের আবিষ্কারই হয়েছে ১৭/১৮ শতাব্দির দিকে।[১১) what is Enlightenment)এর পূর্বে হিউম্যানের অস্তিত্ব ছিল না।কারণ সমস্ত ধর্মেই ‘ইনসান’ “আবদ” এর অবস্থানে ছিল।তবে আবদিয়তের ধরণ নিয়ে ধর্মগুলোর মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। যখন হিউম্যানের ধারণা ইসলামে মানুষের মৌলিক অবস্থানের (আবদ) সাথেই সাংঘর্ষিক,তখন “ইসলামী হিউম্যান রাইটস” পরিভাষা আবিষ্কার করা অনেকটা ইসলামী কুফরের মতই। যেভাবে ইসলামী খ্রিষ্টবাদ নামে কোন কিছু হতে পারে না,তেমনি ইসলামী হিউম্যান রাইটস নামেও কিছু হতে পারে না। হিউম্যান রাইটস এর বিপরীতে ইসলামে “হুকুকুল ইবাদ” এর ধারণা আছে। কিন্তু হুকুকুল ইবাদ হিউম্যান রাইটস নয়। বরং তা গোলামের অধিকার। কোন বিদ্রোহীর অধিকার না। ইসলামে হিউম্যানের কোন অধিকার নেই।কারণ সে খোদাদ্রোহী।

পরিতাপের বিষয় হল, ইসলামে হুকুকুল ইবাদের মত ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনগুলো ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কেন হিউম্যান রাইটস এর প্রয়োজন পড়ল? ইসলামী দলগুলোর মূল দাওয়াতই তো হবে হিউম্যান রাইটসকে প্রত্যাখ্যান করা, সেটার ইসলামী পোষাক নির্মাণ নয়। কারণ মানুষের উলূহিয়্যাতের উপর ঈমান রাখা কুফুর এবং শিরকের নিকৃষ্ট এক অবস্থান। পাশ্চাত্য ব্যক্তিসত্ত্বা ( হিউম্যান বিয়িং), সামাজিক ব্যবস্থা ( সোল সোসাইটি), অর্থব্যবস্থা ( পুঁজিবাদ), রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (গণতন্ত্র) পরস্পর সংযুক্ত মনে না করে বিক্ষিপ্ত অংশ মনে করা মারাত্মক ভুল ও আদর্শিক বিচ্যুতি। যাইহোক, হিউম্যান রাইটস ফ্রেমওয়ার্ক ইসলামী ইতিহাস ও শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসা কোন বিষয় নয়। যখন আমরা হিউম্যান রাইটস এবং ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্ককে এবস্যুলেট হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে ইসলামকে এর প্রেক্ষিতে জাস্টিফাই করতে যাব, তখন একদিকে আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতাকেই শক্তিশালী করব। অপরদিকে আমরা নিজেরাও আদর্শিক ও নৈতিক সংকটের মুখে পড়ব। ফলশ্রুতিতে ডিফেন্সিভ পজিশন থেকে আমরা হয়ত নিজেদের ইতিহাসের বর্ণনাকে বিকৃত করব নতুবা লাগামহীনভাবে নব্য সব ব্যাখ্যার আশ্রয় নিব, যা সালফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত নয়।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *