জাল হাদীস কেন্দ্রিক একটি প্রান্তিক ফিতনা।

প্রসঙ্গ:জাল হাদীস কেন্দ্রিক একটি প্রান্তিক ফিতনা।

(পূর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, জাল টাকা যেমন টাকা নয় ঠিক তেমনি জাল হাদীসও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নয়।)

জাল বর্ণনাকে হাদীস মনে করা গুনাহ এবং এগুলো প্রচার করা বড় ধরনের ফেতনা।

আবার সহীহ বা মকবুল হাদীসকে বাতিল বা ভিত্তিহীন বলে দেওয়াও একটি বড় ধরনের ফেতনা। জাল বর্ণনাকে রাসুলের হাদীস বলে দেয়ার ফেতনার চেয়ে হাদীস হিসেবে প্রমাণিত রেওয়ায়াতকে ভিত্তিহীন বলে দেয়ার ফেতনা কোন অংশেই কম ভয়াবহ নয়।

প্রাচ্যবিদ, হাদিস অস্বীকারকারী, যুক্তি পূজারী আধুনিকতাবাদী, উগ্রপন্থী বেদাতি ও প্রবৃত্তি পূজারীদের সব সময়ের নীতি হল, কোন হাদীসের বক্তব্য তাদের বক্র বুদ্ধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হলেই আর তারা তা মানতে প্রস্তুত হয় না, শাস্ত্রীয় বিচারে সে হাদিস যত উচ্চপর্যায়ের সহীহ হোক না কেন।

আবার তারা এটাও চায় না যে, তাদের বিরুদ্ধে হাদীস অস্বীকার এর অভিযোগ উঠুক। তাই হাদীস অস্বীকার এর এই বিরুদ্ধপ্রয়াসকে ঢাকার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। সহীহ হাদীসকে “মুনকার”বাতেল” মওযু” বা অন্য কোন নাম দিয়ে অস্বীকার করে।

ফিকহ ও হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণ এ ধরনের লোকদের বক্তব্য জোরালো ভাষায় খন্ডন করে আসছেন। ইমাম ইবনে কুতাইবা রহ রচিত”তাবিলু মুখতালিফিল হাদীস” এর একটি উজ্জ্বল নমুনা।

আমাদের ওস্তাদ মুফতি ওলী হাসান টুংকি রহ.তাঁর ভাষণ সংকলন “ফিতনায়ে ইনকারে হাদিস:এক আজিম ফেতনা”তে হাদীস অস্বীকারের উপরিউক্ত দিকগুলো সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
যাইহোক এই ফিতনা তো সৃষ্টি হয়েছিল মুলহিদ মানসিকতার কারণে।

কিন্তু এখন অন্য একটি ফেতনা-যা সম্ভবত নেক নিয়ত থেকেই করা হচ্ছে- আমাদের দেশে প্রসার লাভ করছে।সেটা হলো কোনো রেওয়ায়েত মওজু বলে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতার পরিচয় না দেওয়া, এক্ষেত্রে সীমালংঘন ও প্রান্তিকতার শিকার হওয়া।

এই ফিতনা সৃষ্টির কারণ তাফাক্কুহ ফিদ্দীন এর অভাব, উলূমুল হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সম্পর্কে দূরদৃষ্টি ও গভীর জ্ঞানের কমতি। এবং নিজ দল ও মতের প্রতি অবচেতন মনে অন্যায় পক্ষপাত।

এই ফেতনার কিছু দিক নিম্নরূপ।
১.
মুখতালাফ ফীহ (যে হাদীস সহীহ না যয়ীফ এ ব্যাপারে শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে দলীলের আলোকে মতভেদ রয়েছে)এমন সহীহ হাদীসের সঙ্গে জয়ীফ হাদিস এর মত কর্মপন্থা অবলম্বন।
২.
মুতালাক্কা বিল কবুল যয়ীফ (যে বর্ণনার সনদ যয়ীফ কিন্তু তার মর্ম স্বীকৃত ও অনুসৃত) এবং যয়ীফে মুনজাবির (তথা যে বর্ণনার সনদে কিছুটা দুর্বলতা আছে কিন্তু তার শব্দগত বা অর্থগত সমর্থক বর্ণনা পাওয়া যায়।) এই দুই ধরনের হাদীস এর সঙ্গে সাধারণ জয়ীফ হাদিস এর মত কর্মপন্থা অবলম্বন।
৩.
যয়ীফ বর্ণনা ও মওযু বর্ণনাকে এক কাতারে নিয়ে যাওয়া।যেখানে যয়ীফ বর্ণনা বিভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে গ্রহণ করা যেতে পারে সেখানেও যয়ীফ কে রদ বা বাতিল করে দেওয়া।
৪.
নির্দিষ্ট রেওয়ায়েত যয়ীফ হওয়ার কারণে রেওয়ায়াতে উল্লিখিত পুরো বিষয়বস্তু বা বিধানকে রদ করে দেওয়া অথচ বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভিন্ন দলিল বিদ্যমান।
৫.
যথাযথ অনুসন্ধান না করে কিংবা অসম্পূর্ণ অধ্যয়নের ভিত্তিতে কোন বিষয়কে ভিত্তিহীন বলে দেওয়া।
৬.
যে বর্ণনার ব্যাপারে খোদ মুহাদ্দিসীনে কেরামের মধ্যে মতভেদ আছে যে বর্ণনাটি হাসান পর্যায়ের না জয়ীফ? যয়ীফ হলে বেশি দুর্বল না চলার মতো?

কিংবা বর্ণনাটি জয়ীফ না মওযু?-এ ধরনের বর্ণনার ক্ষেত্রে (যেখানে একাধিক মত রয়েছে)একটি মত অবলম্বন করে ভিন্ন মতাবলম্বী কে জাহেল বা গুমরাহ সাব্যস্ত করে দেওয়া।

অথচ ভিন্নমতটি প্রথমমতের মতোই শক্তিশালী কিংবা ভিন্নমত মারজুহ(প্রাধান্য প্রাপ্ত নয় এমন) হলেও একটি “মুজতাহাদ ফীহ” রায়ের মর্যাদা রাখে, সেটিকে এমন ভুলের কাতারে ফেলা যায় না যাকে”যাল্লাত”(নিশ্চিত ভুল)বলা চলে।

(তবে হ্যাঁ ভিন্নমতটি যদি যাল্লাতের পর্যায়ে পড়ে তাহলে তা গ্রহণ করার সুযোগ নেই।কোন আলেমের ব্যাপারে যদি জানা যায় যে তিনি হঠকারিতা করে নয়, বরং নেক নিয়তে ভুলক্রমে সেই মত অবলম্বন করেছেন তাহলে আদবের সঙ্গে তার ভুল চিহ্নিত করা করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এ কারণে তাকে “জাহেল” বা “গোমরাহ” বলা যাবেনা।)
৭.
(প্রথমে)কোন জয়ীফ বা কোনো ঘটনা বা কাহিনীতে শিরকী কথা আছে বলে অমূলক দাবি উত্থাপন করা এরপর এই অজুহাতে রেওয়ায়াতটি মওযু বা ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করা এবং এই ঘটনা যে কিতাবে আছে সেই কিতাবকে শিরক ও মওযু রেওয়ায়াতের কিতাব সাব্যস্ত করা।

( শিরকী হবার দাবীটাই এখনো প্রমানিত নয়,অথচ তার উপর ভিত্তি করে বর্ণনাকে মওজু বলা এবং এর উপর ভিত্তি করে কিতাবটিকে শিরকী রেওয়ায়াতের কিতাব সাব্যস্ত করা)

শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.এর ফাযায়েলের কিতাবগুলোর উপর কিছু কট্টরপন্থী লোক যে আপত্তিগুলো উত্থাপন করে থাকে তার অধিকাংশের মূলেই আছে শেষের দুটি বিষয়।

আপত্তি উত্থাপন কারীরা যদি এই বাড়াবাড়ি ছাড়তে পারতেন তাহলে এই আপত্তিগুলোর অধিকাংশ তারা নিজেরাই ফিরিয়ে নিতেন এবং আপত্তি উত্থাপন ও গালমন্দের পথ ছেড়ে আলোচনা ও কল্যাণকামিতার পথ অবলম্বন করতেন।

(হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ রচিত “এসব হাদীস নয়”,২/২০-২২)

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *