বাঙলার মুসলমান এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক বিচারে সবচে’ বেশি সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের শিকার।

বাঙলার মুসলমান এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক বিচারে সবচে’ বেশি সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের শিকার। হিন্দু জমিদারদের সময়ে আজকে থেকে ৭০/৮০ বছর আগেও এই অঞ্চলের মুসলমানের কুরবানি করার অধিকার ছিল না। জেল, জুলুম, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।(i)

মুসলমান দাড়ির রাখলে সে কালেই আড়াই টাকা হারে কর দিতে হত। অধিকন্তু কোনও মুসলমান গোঁফ খাঁটো করলে জন্যে পাঁচ সিকা হারে কর দতে হত।

যেকনো প্রকারের মসজিদ নির্মাণের আগে মসজিদের আকারের বিচারে নূন্যতম পাঁচ শত থেকে এক হাজার টাকা হার করে হিন্দু জমিদারের কাছে দিতে হত।

সে আমলে এই টাকা এত উচ্চ হারে ছিল যে, মসজিদ নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মুসলমানি নাম রাখলে নামের জন্য পঞ্চাশ টাকা কর দিতে হত।

পাকিস্তান কায়েমের প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেলেও হিন্দু প্রভাবশালীদের দাপট প্রসঙ্গে তদানীং নাটোরের এসডিও লিখছেন,

“মুসলমান বাড়ী বাচ্চা পয়দা হলে ছ’দিন পার হবার পর বাচ্চাটাকে নিয়ে বাবুদের বাড়ীর দরজার সামনে হাত জোড় করে ছেলে বা মেয়ের বাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে, বাবু কখন বেরুবেন।

বাবু দরজা দিয়ে বের হলে জোড়া হাত কপালে ছুঁইয়ে মাথা নত করে বলে, বাবু একটা নাম রেখে দিন। বাবু অত্যন্ত করুণা স্বরে বলেন,

‘তোর পোলা হয়েছে বুঝি? তা বেশ। কি নাম রাখবি- পচু বলেই ডাকিস। আর দেখিস কখনও গো-মাংস খাবি না, আর ওকেও খাওয়াবি না। কথা না শুনলে কিন্তু ছেলে অক্কারাম। একেবারে প্রাণে মারা পড়বে।”(ii)

শুধু কি রাজনৈতিকভাবে এ নিপীড়ন চলেছে? বরং ভাষা ও সাহিত্যেও তা হয়েছে। এককালে অভিজাত হিন্দুর কাছে বাঙলা ছিল অচ্ছুৎ ভাষা। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে বলা হয়েছিল,-

“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ/ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌবং নরকং ব্রজেৎ”।

অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত ইত্যাদি মানব ভাষায় (বাংলা) চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে। (iii)

ফলে বাঙলা চর্চায় হিন্দুরা শাস্ত্রীয় বাঁধার জন্যই নিরুৎসাহিত ছিল। প্রথমবারের মত সুলতানি আমলেই মালাধর বসু ভাগবতের বঙ্গানুবাদ করেন ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামে। দীর্ঘ সাত বছর সময় নিয়ে। (iv)

সুলতান তাঁকে হিন্দু শাস্ত্র বাংলায় অনুবাদের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘কবি গুণরাজ’ নামক রাজকীয় উপাধি প্রদান করেন।

আদতে বাঙলা ভাষার যে বিস্তার এবং পূর্ণতা তার সবই বাঙালি মুসলমানের হাত ধরে। প্রভাতকুমার বন্দোপাধ্যায় বলেন, “ভারতে ইসলামের আগমনের পর ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের ছোঁয়ায় মূলত বাংলা একটি ভাষার রূপ লাভ করে।” (v)

বাঙলা ভাষার বিকাশে মুসলিম শাসনের তাৎপর্য বর্ণনায় দীনেশ সেন লিখেন-

‘মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলা ভাষার বাস ছিল বাঙলার গ্রামাঞ্চলে কৃষকের কুঁড়েঘরে, ঘোমটা পরা দরিদ্র নারীদের সাথে। ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা বাংলাকে নিম্নশ্রেনীর মানুষের ভাষা মনে করতেন এবং তাদের জীবনে সেটিকে স্থান দিতেন না। ‘ভদ্রলোকদের’ কাছেও এটি গ্রহণযোগ্য ছিল না। বরং, বাংলা ছিল তাদের কাছে ঘৃণা, অশ্রদ্ধা এবং উদাসীনতা প্রকাশের বস্তু।’

অধিকন্তু তিনি এও বলেন, ‘এই দেশে বাংলা ভাষা বহু আগে থেকেই ছিল, এমনকি বুদ্ধ’র সময়েও ছিল। কিন্তু এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলা সাহিত্য এক দিক থেকে মুসলমানদের সৃষ্টি।(vi)

কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজ সরকারের মুসলিমদের প্রতি দমননীতি, অপরদিকে হিন্দুদের শাসনযন্ত্রের অংশ হিসেবে আবির্ভাব পুনরায় বাঙলায় ‘মুসলিম অচ্ছুৎ’ নীতি নিয়ে হাজির হয়।

ফলে কোলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বাঙলা ভাষায় শুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে। বাঙলা ভাষার সংস্কৃত্যায়ন করা হয়। আর বাঙালিয়ানা মাত্রই বর্ণহিন্দুর সম্পদ এই বিষয় কায়েম করে। উল্টো বাঙলা ভাষার অধিকার থেকে মুসলমানদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো।

আবুল মনসুর আহমদ নয়া পড়া, নামে শিশু পাঠ্য বই লেখেন। তাকে টেক্সটবুক কমিটি থেকে জানানো বইয়ের কিছু জায়গায় সংস্কার করতে হবে।

” ‘আল্লা’ ‘খোদা’ ‘পানি’ ইত্যাদি শব্দ প্রাইমারি পাঠ্যপুস্তকে থাকিলে হিন্দু ছাত্রদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিবে।

আমি জানাইলাম, একশ বছরের বেশি বাংলার মুসলমান ছাত্ররা পাঠ্য-পুস্তকে ‘ঈশ্বর’ ‘ভগবান’, ‘জল’ পড়াতেও যদি তাদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিয়া না থাকে, তবে এখন হইতে ‘আল্লা’ ‘খোদা’ পড়িয়া হিন্দুদেরও ধর্মভাবে আঘাত লাগা উচিৎ নয়।
… আমাকে জানাইয়া দিলেন, অত্র অবস্থায় আমার বই বাতিল করিয়া দিতে তাঁরা বাধ্য হইলেন বলিয়া দুঃখিত।

…হক সাহেব যথারীতি হৈ চৈ করিলেন। (তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী) টেক্সট বুক কমিটি ভাঙিয়া গড়িবেন, কর্মচারীদের ডিসমিস করিবেন বলিয়া হুংকার দিলেন। তাঁদের কৈফিয়ত তলব করিলেন।

বহুদিন অপেক্ষা করিবার পর আবার কলিকাতা গেলাম। এইবার হক সাহেব আমাকে জানাইলেন যে ‘হিন্দু বদমায়েশ অফিসার’দের জ্বালায় তিনি কিছু করিতে পারিলেন না।

বাঙালি মুসলমানদের মুখের ভাষা বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি পাইবার প্রয়াসে ইহাকে আমার আরেকটা স্যাক্রিফাইস বলিয়া অবশেষে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলাম।” (vii)

ভাষা সাহিত্যের এই আলাপ এখনো কি উঠে না? পাঠ্যবইয়ে ‘ওড়না’ বিতর্কের কথা তো মাত্র কয়েকবছর।

কেবল রাজনৈতিক কিম্বা ভাষাসাহিত্যে নয়, বরং বাঙালি মুসলমানের মুসলমানিত্বকেই আমৃত্যু তার বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা হয়। এটা বাস্তবতা। কাজী নজরুল বিষয়টা স্ব-অভিজ্ঞতা থেকে এভাবে লিখেছেন,

‘সম্ভ্রান্ত হিন্দু-বংশের অনেকেই পায়জামা-শেরওয়ানি-টুপি ব্যবহার করেন, এমনকি লুঙ্গিও বাদ যায় না। তাতে তাঁদের কেউ বিদ্রূপ করে না, তাঁদের ড্রেসের নাম হয়ে যায় তখন ‘ওরিয়েন্টাল’। কিন্তু ওইগুলোই মুসলমানেরা পরলে তারা হয়ে যায় ‘মিয়া সাহেব’।

আমি ত টুপি-পায়জামা-শেরওয়ানি-দাড়িকে বর্জন করে চলেছি শুধু ঐ ‘মিয়া সাহেব’ বিদ্রূপের ভয়েই—তবুও নিস্তার নেই।“(viii)

নজরুল তাঁর আত্মস্বীকারোক্তিতে দাড়ি, টুপি বর্জনের কথা বলছেন, বিদ্রুপের ভয়ে। নজরুলের চেয়ে অসাম্প্রদায়িক তো কারো হওয়া সম্ভব না। তবুও তাঁর মত লোক বিদ্রুপের নিস্তার পায় নাই। কেন? কেবল মুসলমান হওয়ার কারণে। মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়ার দরুণ।

আমরা, কি করে তা পারব? বাঙালি মুসলমান যতদিন এপোলজিটিক থাকবে। ততদিন এই ভূত তার পিছু ছাড়বে না। যে ভাষা বাঙালি মুসলমানের হাতে গড়ে উঠেছে। সেই ভাষার সাথেও তাকে মুখোমুখি শত্রুবৎ দাঁড় করানো হয়েছে।

প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রোপাগান্ডা দাঁড় করিয়ে বাঙালি মুসলমানকে তার আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

বাঙালি মুসলমানকে ‘বিদ্রূপ’ করাটা এলিটিজমের অংশ। নজরুল আত্মস্বীকারোক্তিই এর সবচে পোক্ত প্রমাণ। আমরা প্রত্যেকেই ইতিহাসের সন্তান। এ অঞ্চলে আজও সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা মুছে যায় নাই।

গত একদিনে আমরা দেখলাম, বাঙালি মুসলমানকে কী পরিমাণ গালাগালিই না করা হলো! সাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা করা হলো। আমি অবাক হই নাই। কারণ এটা নতুন কিছু নয়। অথচ ব্যাপারটা দেখুন।

প্রথমে কিছু গুটি কয়েক ফেইক আইডি থেকে স্পেকুলেশন ছড়ানো হলো। ফেসবুকে কত কথা হয়। অথচ সেটাকে প্রতিষ্ঠানের ইমেজ আর এর প্রতি গণমানুষের সিম্প্যাথিকে ব্যবহার করে ইস্যুতে রূপান্তরিত করা হলো।

এরপর বাঙালি মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের সুযোগ তৈরি করা হলো। জনপ্রিয় কতগুলো আইডি থেকে বাঙালি মুসলমানের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হলো।

পর্যাপ্ত সময় দিয়ে প্রায় একদিন পর বিবৃতি দেওয়া হলো, যা নিয়ে এত ঘটনা, সেই প্রসঙ্গে বলা হলো, ‘আমার সিদ্ধান্তে পাগলামি ও আবেগের প্রভাব যুক্তির চেয়ে বেশি থাকে।’

আদতেই এটা কী পাগলামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? আমরা তো দেখলাম এটাকে কেন্দ্র করে এই সময়ের মধ্যে ইসলাম এবং বাঙালি মুসলমানকে ‘ম্যানুফ্যাক্টচারড অপনেন্ট’ তথা কৃত্রিমভাবে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে ঘৃণা ছড়ানো হলো।

মানুষের আবেগকে পুঁজি করে এটা কি সাম্প্রদায়িকতার প্রসার নয়? বরং বাস্তবতা হচ্ছে, এই পাগলামোর নাম দিয়ে যে নোংরা প্রয়াসকে লেজিটিমেসি দেওয়া হলো- সমসাময়িক সময়ে বাঙালি মুসলমানের উপর ঘৃণা বিস্তারের প্রচেষ্টার এটাই সবচে’ বড়ো ঘটনা।

তথ্যসূত্রঃ

i.) মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশের উৎসব, বাংলা একাডেমী।

ii.) স্মৃতির পাতা থেকে, পি এ নাজির। (পিয়ার আলী নাজির, সাবেক সিএসপি)

iii.) শ্রীশ্যামাচরণ কবিরত্ন সম্পাদিত, সাহিত্য-সংহিতা (নব পর্য্যায়, পঞ্চম খন্ড)

iv) বঙ্গভাষা ও সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন

v.) প্রভাতকুমার বন্দোপাধ্যায়, রামমোহন ও তৎকালীণ সমাজ ও সাহিত্য

vi.) দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব।

vii.) আবুল মনসুর আহমদ, আত্মকথা; ‘আহমদ পাবলিশিং হাউজ’ কতৃক তৃতীয় মুদ্রণ, ২০১৪

viii.) বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ২৫ মে ১৯৯৩

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *