এদেশে শাহজালালকে (রাহিমাহুল্লাহ) শুধুমাত্র একজন পীর-দরবেশ হিশেবে উপস্থাপন করা হয়। হ্যাঁ, এটা সত্য যে তিনি ছিলেন একজন পীর; কিন্তু তারচেয়ে বড় সত্য হলো তিনি ছিলেন একজন বীর। তাঁর পীরত্বের পরিচয়কে বড়ো করে দেখাতে গিয়ে হারিয়ে যায় তাঁর বীরত্বের পরিচয়।
‘এদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য শাহজালাল (রাহিঃ) এসেছিলেন’ কথাটি যতোটা সত্য, তারচেয়ে বড়ো সত্য হলো এক জালিমের জুলুম থেকে একজন মজলুমকে সুরক্ষার জন্য এদেশে শাহজালালের (রাহিঃ) আগমন ঘটেছিলো।
সিলেটের টুলিটিকরে বোরহান উদ্দীন নামে একজন বাস করতেন। ছেলের আকীকার জন্য তিনি একটা গরু জবাই করে আশেপাশের মুসলিম বাসিন্দাদের খাবার ব্যবস্থা করেন। একটা কাক/চিল ছোঁ মেরে এক টুকরো মাংস নিয়ে ফেলে দেয় গৌড়ের রাজা গোবিন্দের রাজপ্রসাদের আঙ্গিনায়।
রাজ্যে একটা গরু জবাই হয়েছে শুনে গোবিন্দ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। সৈন্যদেরকে আদেশ দেওয়া হয় বোরহান উদ্দীনকে বন্দী করে নিয়ে আসার। গরু জবাইর ‘অপরাধ’ –এ বোরহান উদ্দীনের একটা হাত কেটে দেওয়া হয়। তাঁর নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করা হয়।
দিল্লীর সিংহাসনে বসা ছিলেন তখন সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী। নিজাম উদ্দীন আউলিয়াও (রাহিমাহুল্লাহ) তখন দিল্লীতে ছিলেন। সেই সময় ইয়েমেন থেকে এক যুবক বারোজন সঙ্গী নিয়ে দিল্লীতে আসেন ইসলাম প্রচারে। তাঁর নাম শায়খ জালাল। নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার (রাহিঃ) সাথে শায়খ জালালের পরিচয় হলো। নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রাহিঃ) খুশী হয়ে তাঁকে এক জোড়া নীল রঙের কবুতর দেন। শায়খ জালাল খুব যত্ন করে কবুতর জোড়া সঙ্গে রাখেন।
দিল্লীতে থাকাবস্থায় শায়খ জালালের সাথে পরিচয় হয় সন্তানহারা এক বাবার। তিনি দিল্লীতে এসেছেন তাঁর সন্তান হত্যার বিচার চাইতে। বোরহান উদ্দীনের কথা শুনে শায়খ জালাল দারুণ ব্যথিত হোন।
ইতোপূর্বে সুলতান ফিরোজ শাহ বোরহান উদ্দীনের পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে তাঁর ভাগ্নে সিকান্দার শাহকে গৌড় অভিযানে পাঠান। দুই বারের অভিযানে সিকান্দার শাহ ব্যর্থ হলেন।
এবার শাহজালালকে (রাহিঃ) সঙ্গে নিয়ে বোরহান উদ্দীন নতুন করে গৌড় রাজা গোবিন্দকে আক্রমণ করতে যান। সাথে নতুন সেনাপতি সৈয়দ নাসির উদ্দীন। রাজা গোবিন্দ জুলুমের প্রতিশোধ নিতে আসা মুসলিম সৈন্যদের আগমন বন্ধ করার জন্য নদী পারাপার বন্ধ করে দেয়। শাহজালাল (রহঃ) সৈন্যবাহিনী এবং তাঁর সাথের তিনশো ষাটজন শিষ্য নিয়ে বাঁশ কেটে ভাসমান ভেলা তৈরি করেন। একে একে সবগুলো নদী পার হলেন।
যথাযথ প্ল্যান এবং আল্লাহর সাহায্যে মুসলিম বাহিনী পদানত করে জালিম গোবিন্দের সেনাবাহিনীকে। বরাক নদী, সুরমা নদী পার হয়ে শাহজালাল (রাহিঃ) প্রবেশ করেন গৌড়ের রাজধানী সিলেটে। তাঁর সাথে ছিলেন ইয়ামেনের বাদশাহর পুত্র শেখ আলী। যে ঘাট দিয়ে তারা সুরমা নদী অতিক্রম করেন, সেই ঘাটকে ইসলাম প্রচার করতে আসা ইয়ামেনের বাদশাহর পুত্রের নামানুসারে আজঅবধি ‘শেখঘাট’ নামে ডাকা হয়।
শাহজালালের (রাহিঃ) মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের নিশান উড়ে। গৌড় রাজ্য জয়ের পর শাহজালাল (রাহিঃ) সেনাপতি সিকান্দার গাজীকে সিলেটের শাসনকর্তা হিশেবে নিযুক্ত করেন। তাঁকে ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনার আদেশ দেন। সিকান্দার গাজীর পরবর্তী শাসনকর্তা ছিলেন নুরুল হুদা; যিনি ‘হায়দর গাজী’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। দুজনের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ইসলামি শাসন প্রবর্তিত হয়।
…
শাহজালাল (রাহিঃ) কার্পেট বিছানো পথে এদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেননি। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সেই ইয়ামেন থেকে দিল্লী হয়ে এসেছিলেন এক মজলুমের আর্তনাদ শুনে।
“মুমিনের উদাহরণ একটা দেহের মতো। দেহের একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে যেমন সমস্ত দেহে তাপ ও অনিদ্রা চলে আসে।” [সহীহ মুসলিমঃ ৬৪৮০]
এই ‘সহীহ’ হাদীসটি শাহজালাল (রাহিঃ) জানতেন কি-না আমি জানি না। তবে এই সহীহ হাদীসটি কিভাবে মানতে হয় সেটা তিনি দেখিয়ে গেছেন।
…
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মক্কায় ছিলেন। আকাবার প্রথম বাইয়াতে মদীনা থেকে বারোজন প্রতিনিধি আসে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীনের দাওয়াত দেবার জন্য তাঁদের সাথে প্রেরণ করেন মুস’আব ইবনে উমাইরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। পরবর্তী বছর আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতে উপস্থিত হোন মদীনার ৭৩ জন সাহাবী। একবছরের মধ্যে ছয়গুণ বেড়ে যায়। কিভাবে বাড়ে? মুস’আব ইবনে উমাইরের (রাঃ) নিরলস দাওয়াতের ফলে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন ইহুদিরা বাদে মদীনার প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। মদীনাবাসী রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাগত জানিয়েছিলো- ত্বলা’আল বাদরু আলাইনা… গেয়ে।
এই দুই-তিন বছরের মধ্যে মদীনার প্রায় সবাই যে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেটা ছিলো মুস’আব ইবনে উমাইরের (রাঃ) দাওয়াতের ফসল। ঐসব সাহাবীরা জীবনে যতো আমল করেছেন, তাঁদের মাধ্যমে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, করে যাচ্ছেন, সবার সওয়াবের একটা ‘পার্সেন্টিজ’ মুস’আব ইবনে উমাইরের (রাঃ) আমলনামায় যোগ হবে (ইন শা আল্লাহ)।
…
এদেশে ইসলাম এসেছে পীর-দরবেশদের মাধ্যমে। নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে তারা ছুটে এসেছিলেন পথহীন মানুষকে পথের সন্ধান দিতে। তাঁদের কুরবানি-ত্যাগের ফল হলো বর্তমান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনপদ। তাঁদের হাত ধরে ইসলাম গ্রহণের যে সিলসিলা শুরু হয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত সেই সিলসিলায় যারা ইসলাম গ্রহণ করবেন, সবার সওয়াব ইন শা আল্লাহ তাঁদের আমলনামায় পৌঁছবে। আল্লাহ যেন তাঁদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দেন, আমরা সেই দু’আ করি।
…
এদেশে যেসব পীর-দরবেশগণ ইসলামের বাণী নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তাঁদের ব্যাপারে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে আপনি ইসলাম ‘প্রচার’ করতে চাচ্ছেন?
তাহলে জেনে রাখুন এদেশের মাটিতে তাঁদের শুধু ঘাম ঝরেনি, এদেশের জমিনে তাঁদের রক্তও লেগে আছে। এক ফোঁটা ‘নোংরা’ পানি থেকে আমাদের জন্ম। আমরা আমাদের জন্মকে স্বীকার করি। তাহলে জমিনে লেগে থাকা ঘাম আর রক্তকে আমি কিভাবে অস্বীকার করবো?
…
অন্যদিকে পীর-দরবেশদের নামে মাজারে-মাজারে যে রমরমা ব্যবসা চলছে, সেটা তাঁদের লিগ্যাসী না। তাঁদের নাম ভাঙ্গিয়ে এইসব ইন্সটিটিউশনে শিরক-বিদ’আতের প্রচার এবং প্রসার চলছে। তাঁদের নামে কোনো ‘আমল’ যদি শত বছর ধরে চলে আসে, আর কুর’আন-হাদীসের আলোকে যদি জানা যায় এটা শিরক-বিদ’আত, তাহলে আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো- যাচাই-বাছাই করে শিরক-বিদ’আত কনফার্ম হলে সেগুলো বর্জন করা। পীর-দরবেশদের নামে জেদ ধরে এগুলো আঁকড়ে থাকা কোনোভাবে তাঁদের লিগ্যাসী বহন করে না।
শাহজালাল রাহিমাহুল্লাহঃ পীর ও বীর
আরিফুল ইসলাম
১৯ এপ্রিল ২০২০