সত্যের ব্যাপারে সত্য

⁂ সত্য কী?
⁂ “যেটা যেরকম, সেটাকে ঠিক সেভাবেই বলা” অথবা “যা কোনােকিছুর প্রকৃত অবস্থাকে বর্ণনা করে” সেটাই সত্য।

⁂ আমাদের সমাজে ইদানীং সত্যকে আপেক্ষিক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়, অথচ যা সত্য, তা সবসময়েই সত্য। সত্য কারাে মতামতের উপরে নির্ভরশীল নয়। কোনাে বিষয়ে একজন জ্ঞানী মানুষের মতামত মিথ্যে হতে পারে, আবার একজন অজ্ঞের মতামতও সত্য হয়ে যেতে পারে। মতামত আর চলতি বিশ্বাস যাই হােক না কেনাে, সত্য সত্যই থাকে। বিশ্বাস পরিবর্তনশীল হতে পারে, মতামত আর দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যেতে পারে, কিন্তু সত্য অপরিবর্তনশীল।

⁂ উদাহরণ দেয়া যাক। মানুষ একসময় বিশ্বাস করতাে পৃথিবী একটা বিছানাে সমতল ভুমি। সত্যটা প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা গেলাে মানুষের বিশ্বাসে ভুল ছিলাে। ঐ সময়ের মানুষের বিশ্বাস, মতামত আর বিশ্লেষণের ক্যানভাসে পৃথিবীর ছবি চারকোণা সমতল হলেও, আসলেই কি পৃথিবী চারকোণা সমতল ছিলাে? মোটেও না। পৃথিবী গােলাকারই ছিলাে সবসময়। দৃঢ়বিশ্বাস আর ব্যক্তিগত মতামত সত্যের উপরে কোনাে প্রভাবই ফেলে না, তা যতাে লক্ষ বছরের বিশ্বাস আর প্রতিষ্ঠিত মতামতই হােক না কেনাে।

⁂ সত্যের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা সবসময়ের জন্যেই সত্য। সত্য আপেক্ষিক না। সত্য সবসময়েই পরম (absolute)। আর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সত্যের উল্টোটা সবসময়েই মিথ্যা। ঠান্ডা মাথা নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক তাহলে। ধরা যাক, “সূর্য গােল” এই কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর উল্টো কথা হচ্ছে “সূর্য গােল না”। প্রথম কথাটা সত্যি হলে, সেটা সবসময়ের জন্যেই সত্যি, এবং সেইক্ষেত্রে দ্বিতীয় কথাটা সবসময়েই মিথ্যা। এটাই ফ্যাক্ট। সব সত্যের উল্টো কথাই মিথ্যা। এটা ধর্মীয় সত্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। আশা করি বুঝা গেছে। তাও গােলমেলে মনে হচ্ছে? তাহলে পড়তে থাকুন। একটু পরে একদমই ফকফকা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ঠিক আছে?

⁂ অনেকক্ষণ ভারী ভারী কথা হলাে। এখন একটা হালকা গল্প কল্পনা করি। অনল আর হামজা। দুই ত্যাঁদড় টাইপের বন্ধু গলা ফুলিয়ে তর্ক করছে। চায়ের কাপে সুনামি চলছে। আড্ডার অন্যান্য বন্ধুরা হা করে চুপচাপ এই দুই ট্যালেন্টের তর্ক শুনছে গালে হাত দিয়ে। কারাে মুখে কোনাে কথা নেই। এক পর্যায়ে অনল দাঁড়িয়ে শ্রোতা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলােঃ

⁂ “তােরা দ্যাখ, এই মুসলিমগুলা কত্তো সংকীর্ণমনা! আমি হামজার সব কথা শুনলাম। তােরা জানিস হামজা কী বিশ্বাস করে? ও বিশ্বাস করে যে ইসলামই সত্য আর যেটা ইসলামের উল্টা কিংবা সাংঘর্ষিক সেটা মিথ্যা। এই মুসলিমগুলা সব আসলেই সংকীর্ণমনা!”

⁂ হামজা মিটিমিটি হাসছিলাে অনলের কথা শুনে। অনলের কথা শেষ হবার পর সে। উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস একটা মুখ বানিয়ে বললােঃ

⁂ “তােরা দ্যাখ, এই এথিইস্টরা (atheists) কত্তো সংকীর্ণমনা! আমি অনলের সব কথা শুনলাম। তােরা জানিস অনল কী বিশ্বাস করে? ও বিশ্বাস করে যে এথিইজমই (atheism) সত্য আর যেটা এথিইজমের উল্টা কিংবা সাংঘর্ষিক সেটা মিথ্যা। এই এথিইস্টগুলা সব আসলেই সংকীর্ণমনা!”

⁂ আড্ডার বন্ধুরা একটু চমকে উঠলাে প্রথমে, তারপরেই বুঝতে পেরে ঠাঠা করে হাসতে শুরু করলাে। আসলেইতাে। এথিইস্টদের সত্যের দাবীটাওতাে মুসলিমদের সত্যের দাবীর মতােই সংকীর্ণ! যদি মুসলিমদের কথা সত্য হয়, তাহলে উল্টো হবার কারণে এথিইস্টদের দাবী মিথ্যে। একইভাবে, এথিইস্টদের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে মুসলিমদের দাবীটা মিথ্যে হতে হবে।

⁂ সত্যের ব্যাপারে আরাে কিছু সত্য এখানে দেয়া হলােঃ

১. কেউ জানুক বা না জানুক, বুঝুক বা না বুঝুক, সত্য সত্য হিসেবেই অস্তিত্বে থাকে। সত্যকে খুঁজে বের করতে হয়, সত্যকে তৈরী করা যায় না। যেমনঃ নিউটন সাহেবের আগেও মহাকর্ষ ছিলাে।

২. সত্য টাইম-স্পেস বা সময়-কালের উপরে নির্ভর করে না। যা সত্য, তা সকল সময়ের সকল স্থানের জন্যেই সত্য। যেমনঃ ২ আর ৩ এ যােগ করলে ৫ হয়, এটা সকল সময়ের সব জায়গার সব মানুষের জন্যেই সত্য।

৩. সত্যের ব্যাপারে আমাদের “বিশ্বাস” বদলাতে পারে, “বিশ্বাসে” ভুল থাকতে পারে, কিন্তু সত্য সবসময়েই অপরিবর্তনশীল। সত্য বদলায় না। যেমনঃ মানুষ বিশ্বাস করতাে পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে সূর্য ঘুরছে। এতে কিন্তু সত্যটা বদলে যায়নি, বরং সত্যটা বুঝতে পারার পর মানুষের বিশ্বাস বদলেছে।

৪. বিশ্বাস কখনাে সত্যকে বদলে দিতে পারে না, সেটা যতােই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা হােক না কেনো! একজন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে। তার এই মনেপ্রাণে বিশ্বাসের কারণে সত্যটা বদলে যাবে না।

৫. কারাে চরিত্র বা আচার-আচরণের কারণেও সত্য বদলে যায় না। আচার-আচরণে ভালাে একজন মানুষ যেমন ভুল করতে পারেন, আবার একজন অহংকারী মানুষের কথাও সত্যি হতে পারে। সত্য কারাে ব্যক্তিগত চরিত্রের উপরে নির্ভরশীল নয়।

৬. সকল সত্যই পরম(absolute) সত্য। এমনকি যেগুলােকে আপেক্ষিক সত্য বলে ভ্রম হয়, সেগুলােও আসলে সত্য। উদাহরণ স্বরুপ, “আমি, মোঃ আবিরুজ্জামান মোল্লা, আজ ১৯ই মে, ২০২০ তে বড় মন খারাপ অনুভব করছি” কথাটাকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই আপেক্ষিক অর্থাৎ শুধু আমার জন্যেই সত্য বলে মনে হলেও, এটা আসলে সব জায়গার সব সময়ের সব মানুষের জন্যেই পরম সত্য যে, মোঃ আবিরুজ্জামানের ঐ নির্দিষ্ট দিনে আসলেই মন খারাপ ছিলাে।

⁂ সারকথা হলাে, ভুল বিশ্বাস থাকা সম্ভব, কিন্তু ভুল বা আপেক্ষিক সত্য থাকা সম্ভব না। আমরা বিশ্বাস করতেই পারি যে আমাদের চোখের আকৃতি কাঁঠালের মতাে, কিন্তু আমাদের সেই বিশ্বাস চোখের সত্যিকার আকৃতিকে কখনােই বদলে দেবে না। চোখের আকৃতির ব্যাপারে সত্যটা সত্যই থেকে যাবে।

⁂ এতক্ষণে ফকফকা ক্লিয়ার হয়েছে, তাই না? কিন্তু আধুনিক সেকুলার, লিবারেলিস্ট, এগনস্টিক আর এথিইস্টরা “সত্য বলে কিছু নাই” বলে যখন দাবী করে তখন আমরা কী করবাে? জানতে হলে পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকুন ইনশা আল্লাহ।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *