হাদসে নববী পাঠ ও গ্রহ্ণের উসূল

الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفر.. .

আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকর। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে খালেছ ইলমী ও দ্বীনী বিষয়ে আলোচনা ও মুযাকারা করার জন্য বসার তাওফীক দিয়েছেন। তালিবে ইলম হাদীসের দরস কীভাবে গ্রহণ করবে, কী কী উসূল ও আদাবের رعايت করবে, কী কী উসূলের رعايت করা উচিত- এ বিষয়ে আজকের এ মজলিস। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়টা কিছুটা হলেও বিস্তৃত, এক মজলিসে সবদিক আলোচনা সম্ভব নয়। তারপরও হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেব দা.বা. বিষয়ের আহাম আহাম দিকগুলোর সুন্দর একটা খোলাসা আমাদের সামনে পেশ করেছেন। একটা বুনিয়াদী রাহনুমায়ী এ হেদায়াতগুলোর মধ্যে, এ খোলাসার মধ্যে আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইস্তিফাদার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আমার ইচ্ছা ছিল তাঁর আলোচনা আরো দীর্ঘ হোক, আর এ বিষয়ে আলোচনার তিনিই বেশি হকদার, কেননা তাঁর উসূলী معلومات -এর সাথে আমলী তাজরেবাও আছে, দীর্ঘদিন যাবৎ হাদীসের দরস দিয়েছেন এবং ফন্নী আন্দাযেই দরস দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তিরমিযী শরীফের দরস অনেক দিন যাবৎ দিয়েছেন। তাই তার আলোচনাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যা বলেছেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমি ইনশা আল্লাহ দুটি বিষয়ে কথা আরয করব। বিষয়টির দুটি দিক : এক. উসূল দুই. আদাব। হুযুরের আলোচনায় উসূলের দিকটা বেশি এসেছে এজন্য আমি শুরু করছি আদব দিয়ে।

বড় আদব হল, إخلاص ও تصحيح النية। আর এটা তো সব কাজেই দরকার। হাদীসের দরস আমি গ্রহণ করব সেক্ষেত্রে إخلاص ও تصحيح النية লাগবে সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে আমি বলছি না, বরং আমার আসাতিযায়ে কেরামের কথা تكرار করছি আমার জন্য এবং সব সাথীদের জন্য। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নোমানী রাহ. বলতেন تجديد النية -এর কথা। দৈনিক সকালে তুমি তোমার নিয়তের নবায়ন কর, নিয়তের تجديد কর- হে আল্লাহ এ দিনটা আমি তোমার রেযামন্দিতে কাটাতে চাই। তোমার রেযামন্দির জন্য তোমার ওহীর ইলমের জন্য আমি এ দিনটা কাটাতে চাই, তুমি আমাকে তাওফীক দান কর। এটা ইজমালী হলো। আরো তাফসীলের সাথে কারো যেহেনে আসলে আরো ভাল। আমি দেখেছি যেদিন হুযুরের এ কথার উপর আমল করা হয় সে দিনটা অন্য দিনগুলো থেকে ভাল কাটে। দিনটা গাফলতের সাথে শুরু হওয়া উচিত নয়। গাফলত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন أذكار শিখিয়েছেন। যেমন سيد الاستغفار । অনুরূপ শোকর আদায় করার জন্য-

اللَّهُمَّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشُّكْرُ.

অনুরূপ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَقَالَنَا يَوْمَنَا هَذَا، وَلَمْ يُهْلِكْنَا بِذُنُوبِنَا.

এগুলো তো এ জন্যই যাতে আমার দিনটা نشاط -এর সাথে, تيقظ -এর সাথে এবং استحضار -এর সাথে, আল্লাহর নিআমতের استحضار -এর সাথে এবং আল্লাহর রহমতের আশা নিয়ে শুরু হয় এবং এর আছর সারা দিনের কাজের উপর পড়ে। আমরা تجديد النية -এর চেষ্টা করি- হে আল্লাহ তোমার ওহীর ইলমের জন্য আমি আমাকে ওয়াকফ করে দিয়েছি আমার এ দিনকেও ওয়াকফ করে দিয়েছি, আর তোমার রেযামন্দি মোতাবেক আমার এ দিনটা কাটাতে চাচ্ছি, তুমি আমাকে তাওফীক দান কর। বিশেষ করে এতদিন যা পড়েছি সেগুলো ছিল بالواسطة ইলমে ওহী আর মিশকাত ও দাওরার মধ্যে যা পড়া হয় তা بلا واسطة সরাসরি ইলমে ওহী। সরাসরি ইলমে ওহী পড়তে এসেছি তখন তো আমার মাঝে একটা পরিবর্তন আসা দরকার। কলব, আমল ও ফিকির সব জায়গায় একটা পরিবর্তন আসা দরকার- এটা প্রথম আদব। এবং যে কোনো উসূলে হাদীসের কিতাবে آداب طالب الحديث একটা শিরোনাম একটা فصل থাকে, ওখানে تصحيح النية -এর কথা থাকে, থাকবেই স্বাভাবিক। আর تصحيح النية -এর সাথে বললাম تجديد النية-এর কথা।

দ্বিতীয় বিষয় হলো যা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা. দরসে তিরমিযীর শুরুতে তাম্বীহ করেছেন এবং ইনআমুল বারীর শুরুতেও তাম্বীহ করেছেন। উর্দু শুরূহ পড়া অনেকেই পছন্দ করেন না, কিন্তু এটা এজন্য না যে শরহটা উর্দু ভাষায়; বরং এটা এজন্য যে দাওরার ছাত্রদের মাঝে থাকতে হয় তাহকীকী মেযাজ, আর উর্দু শুরূহের মধ্যে এমন তাহকীকী মেযাজের শুরূহ এবং تقرير কম এতো একটা বিষয় আর দ্বিতীয়ত : দাওরায়ে হাদীসের তালিবুল ইলমের মাঝে এতটুকু যোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে বরং শরহে বেকায়া ও হেদায়ার মধ্যে তার এ ইস্তিদাদ পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ার কথা, যার দ্বারা সে আরবী শুরূহ মুতালাআ করতে পারে এবং আরবী র্শহ মুতালাআ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আরবী শরহ মুতালাআর ক্ষেত্রে তার কোনো وحشت না থাকে। কিন্তু এখন তালিবুল ইলমদের কিতাব বুঝা ও ইবারত বুঝার যোগ্যতা এমন যে, আরবী শুরূহ থেকে ভাগে, দূরে থাকে। আরবী র্শহ থেকে দূরে থাকার জন্য উর্দু র্শহ, এখন তো বাংলা র্শহও বের হয়ে গেছে, ওগুলোর দিকে رجوع করে। আরবী শরহ থেকে দূরে থাকার জন্য উর্দু বাংলা নোটের দিকে যাওয়া বিলকুল অপছন্দনীয়। কিন্তু যদি আরবী র্শহ থেকে দূরে থাকার জন্য না হয় বরং আপনি আরবী থেকেও বুঝতে পারেন, আরবীর সাথে الفت আছে انس আছে, আর উর্দু ও বাংলা র্শহও এমন হয় যেখানে ইলমী فوائد আছে বা যেখানে কোনো বহসের খোলাসাকে منظم ও مرتب আকারে পেশ করা হয়েছে, যা বুঝতে এবং ইয়াদ করতে সুবিধা; তাহলে সহায়কগ্রন্থ হিসেবে তা দেখা যেতে পারে। বাংলায় এমন কিতাব আছে কি না তা আমার জানা নেই। অনেকে درس ترمذي পড়ে معارف السنن থেকে ভাগার জন্য- এটা ঠিক নয়। معارف السنن -এর সাথে انس বা সম্পর্ক থাকতে হবে আর দরসে তিরমিযীর মধ্যে معارف السنن -এর একটা সহজ সরল খোলাসা পেয়ে যাবে, পড়বে ইয়াদ করবে। আমরা দরসে তিরমিযী পড়ি معارف السنن থেকে فرار করার জন্য বা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য- এ নিয়তগুলো ভাল নয়। বরং এটা মুতালাআ করতে হবে, একে তো আমি বললাম আলোচনার ملخص বা সারনির্যাস আমি পাব। معارف السنن মুতালাআ করার পর আমি এটা মুতালাআ করব। বা এটা মুতালাআ করে معارف السنن মুতালাআ করি। এটা এজন্য যে, একে তো হল খোলাসা নেওয়ার জন্য, আরেকটা হল কিছু কিছু জায়গায় তাঁর মেহনত আছে।

الملهم فتح تكملة -এ দেখা যায় তিনি ইমাম নববীর মুসলিমের শরহ আর فتح الباري থেকে নিয়েছেন এজন্য সব জায়গায় নিজস্ব মেহনত করার প্রয়োজন মনে করেননি এবং তিনি যত ব্যস্ত এত ব্যস্ততার মধ্যে এটা সম্ভবও ছিল না; কিন্তু কিছু বহস তিনি লিখেছেন, যেখানে অন্য شارحين হক আদায় করেননি; আর এটা এমন বিষয় যা ছেড়ে দেয়া যায় না এবং এ বিষয়ে নতুন مواد তালিবুল ইলমদের হাতে আসা দরকার। তাকমিলাতে তিনি মেহনত করে এমন এমন فوائد উদ্ঘাটন করেছেন দুই চারটা বা চার পাঁচটা বহস হবে, তাকমিলাতে আছে কিন্তু তার নযীর নেই।

এর কিছু নমুনা :

এক. رجم -এর হাদীস মুতাওয়াতির কিন্তু তার প্রায় সব طريق একসাথে জমা করে হাওয়ালা দিয়ে দিয়েছেন।

দুই. ইমাম যুহরী রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

نحن معاشر الانبياء لا نورث، ما تركناه صدقة.

এ বিষয়ে মুসলিম শরীফে লম্বা রেওয়ায়েত আছে, তারীখের কিছু কথা যা যুহরীর থেকে منقطعا বর্ণিত, মূল ঘটনার সাথে কিছু تاريخي মুনকাতি‘ রেওয়ায়েত مدرج হয়ে গিয়েছে। এ إدراج-এর উপর নববী রাহ. তাম্বীহ করেননি। فتح الباري যেহেতু মুসলিমের র্শহ নয় তাই এখানেও তার উপর তাম্বীহ নেই। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা. অনেক কিতাব ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন এবং হাদীস ও তারীখের পুরাতন কিতাবাদি ঘেটে তথ্য সংগ্রহ করে জমা করে এ বিষয়ের উপর تنبيه করেছেন।

তিন. এভাবে হযরত আলী রা. হযরত আবু বকর রা.-এর হাতে কবে বাইআত করেছেন এ বিষয়ে তারীখের কিতাবে اختلاف রয়েছে। কোনো রেওয়ায়েত ادراج-এর সমস্যার কারণে معلول। একটি جملة মূল হাদীসে মুর্দারাজ হয়েছে হুযুর অনেক মেহনত করে এর وضاحت করে দিয়েছেন।

চার. نصاب حد السرقة । ওখানে তাঁর নিজস্ব মেহনত রয়েছে, এরকম কিছু কিছু বহছ تكملة فتح الملهم -এ আছে। এ ধরনের মেহনত দরসে তিরমিযীতে কম। কারণ এটি তাকরীর, তাসনীফ নয়, তাকরীরের মুরাত্তিব তারতীবের সময়ে নতুন মুদাররিস। তারতীবের পর সাহিবে তাকরীর এটা নযরে ছানী করেননি। আবার তাকরীর সেই দরসের যে দরসের সময়ে দরস প্রদানকারীর বয়স মাত্র ২২ বছর। তারপরও এতে কিছু فوائد আছে। ঐসব فوائد -এর জন্য আপনি এসব কিতাব মুতালাআ করেন। আর যাল্লাত এবং তাসহীফাতের সমস্যার সমাধান মাসাদেরে আসলিয়্যার মুরাজাআত করে করেন।

আমি বলতে চাচ্ছি আপনি উর্দু র্শহ মুতালাআ করবেন কোন নিয়তে এবং তরীকা কী হবে? আরবী শরহ থেকে গাফেল হয়ে এগুলো পড়লে কীভাবে হবে?

যদি আপনি এজন্য نصر الباري দেখেন, যে ওখানে তরজমাটা সুন্দর করা হয়েছে তাহলে তো একটা হল। (অবশ্য نصر الباري থেকে ইস্তিফাদা করার আমার সুযোগ হয়নি।) কিন্তু فتح الباري ও عمدة القاري থেকে فرار করার জন্য نصر الباري পড়ে, এটা কেন?

দাওরায়ে হাদীসে একজন তালিবে ইলমের আরবী শুরূহ মুতালাআ করার এত লম্বা সময় থাকে না, কিন্তু অভ্যাস করে নিতে হয়। কিছু কিছু নির্বাচিত বহছ فتح الباري থেকে পড়বেন, যাতে তার সাথে انس পয়দা হয়। কিছু কিছু বহস আপনি عمدة القاري থেকে এবংفيض الباري থেকে পড়বেন, যাতে الفت পয়দা হয়। এরপর যখন সবক বেশি বেশি হচ্ছে, মুতালাআর সময় কম পাওয়া যায়, খারেজী দরস শুরু হয়ে যায় তখন আপনি শুধু انعام الباري পড়েন। মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেবের كشف الباري পড়েন। অর্থাৎ আরবী শুরূহের দিকেই আমার رجحان বেশি, এখন সময় কম বিধায় আমি إنعام الباري থেকে একটা খোলাসা লিখছি, كشف الباري থেকে একটা খোলাসা দেখছি বা إيضاح الباري থেকে দেখছি, যার কাছে যেটা সহজ মনে হয়। তবে দরসী তাকরীরটা অবশ্যই এমন হতে হবে যা সামগ্রিকভাবে, সার্বিক বিচারে মুসতানাদ এবং যার ব্যাপারে বলা যায় যে তালিবে ইলমের সামনে একটা মুফীদ কিছু আছে। এ ধরনের দরসী তাকারীর পড়তে নিষেধ নেই তবে সেটা হবে معاون হিসেবে, আর মূল মাদার হবে আরবী ইলমী ও তাহকীকী র্শহগুলো।

যাইহোক এসব فوائد-এর জন্য উর্দু র্শহ আমরা পড়ব। انعام الباري -এর كتاب البيوع -এ মুআমালাতের আলোচনা যেমন পাব, অন্যান্য র্শহে আমি তা পাব না। এখন দেখা যায়

بيع ما لم يملك، بيع ما لم يقبض، تلقى الجلب

এবং “نهى عن النجش” এগুলো নতুন পদ্ধতিতে প্রকাশ পাচ্ছে। এসব আগের চেয়ে অনেক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এখন বুঝা যায় যে, রাসূলের তালীমের উপর আমল করলে সমস্যা কীভাবে দূর হবে। পশ্চিমারা যে নতুন ফর্মূলা দিচ্ছে তার দ্বারা সংকট দূর হচ্ছে না বরং সংকট বেড়েই চলেছে বিশ্বব্যাপী। এ হাদীসগুলো কীভাবে বর্তমান যামানার সাথে منطبق হবে, হয়ে আছে আমার খবর নেই। এ বিষয়গুলো انعام الباري তে পাওয়া যায়, এটা فيض الباري তে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। সে সময় এ প্রেক্ষাপট ছিল না, এ হালত ছিল না। এটার জন্য আমি انعام الباري পড়ব। এমনভাবে জায়গায় জায়গায় যে فوائد আছে সেগুলোর জন্য আমি এসব উর্দু শরহ পড়ব যা مفتاح -এর حيثيت রাখে। এরকম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বুনিয়াদি হেদায়াত থাকে।

দ্বিতীয় কথা

ঐ ধরনের হেদায়াতের মধ্যে একটা হল যা انعام الباري -এর শুরুতে আছে, দরসে তিরমিযীর শুরুতে আছে, হযরত সেখানে তাম্বীহ করেছেন- দাওরায়ে হাদীসে আমরা হাদীস পড়ছি, হাদীস মানে কি? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালীমাত এবং তাঁর সীরাত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালীমাত ও সীরাত নিয়ে আমি দিনরাত আছি। এখন আমার আখলাকের মধ্যে, আমার আমলী যিন্দেগীর মধ্যে, ফিকরী যিন্দেগীর মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসা জরুরি। এত বছর যেভাবে আমার যিন্দেগী কাটালাম দাওরায়ে হাদীসের বছর যদি ঐভাবেই কাটে এটা কেমন কথা হবে। এটা তো হাদীসের প্রতি বড় অবহেলা ও سوء أدب হবে। আমাদের দাওরার উস্তাযগণ বলেছেন, আপনাদেরকেও আসাতিযায়ে কেরাম বলেছেন, দাওরায়ে হাদীসের বছর এমন একটি বছর, পিছনে যার কোনো নযীর যায়নি, ভবিষ্যতেও এর কোনো নযীর আসবে না। দরসে নেযামিতে আপনার পেছনে কি এমন কোনো বছর গিয়েছে, যার আগাগোড়া হাদীসের কিতাব ছিল? মিশকাতের বছর তো শুধু একটা কিতাব, আর তার আগে الصالحين رياض। তার আগে কোথাও কোথাও ألفية الحديث আছে। এটা তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা পড়া হয়। আর এ বছর চব্বিশ ঘণ্টা জরুরি কাজ ছাড়া

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم …

পড়া হয়। এ বছর হাদীস পড়া ছাড়া অন্য কোন মাশগালা নেই। দাওরার পরের বছর যদি আল্লাহ তাআলা তাঁকে হাদীসের কিতাব পড়ানোর তাওফীক দান করেন, তো আর কয় কিতাব দিবে, পুরো দাওরায়ে হাদীসের সব কিতাব কি দিবে। আর দিলেও কি আপনি পারবেন? একটা কিতাব থাকবে বা অর্ধেক থাকবে বা কয়েক পৃষ্ঠা থাকবে। তাহলে ভবিষ্যতেও আমার এমন সম্ভাবনা নেই যে, চব্বিশ ঘণ্টা আমার হাদীসের সাথ সম্পর্ক থাকব, ইল্লা মাশাআল্লাহ। তাহলে দাওরায়ে হাদীসের বছর এমন যেখানে রাত-দিন সকাল-সন্ধ্যা চব্বিশ ঘণ্টা আমার মাশগালা হল হাদীস। তাহলে সত্য কথা হলো, (যদিও এটা বলার মতো হালাত আমার নেই) পুরো বছর আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আছি।

أهل الحديث همو أهل النبي وإن + لم يصحبوا نفسه أنفاسه صحبوا

হাদীসের মাশগালা যাদের ওরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহল, যদিও তারা সরাসরি রাসূলের মোবারক ছোহবত লাভ করতে পারেনি, কিন্তু তারা রাসূলের أنفاس قدسية -এর ছোহবত লাভ করছে।

হাদীসের কিতাব তো নববী দীর্ঘ তেইশ বছরের একটি নববী আয়না এবং সীরাতের কিতাবও। যদি দিলের اتصال -এর সাথে কেউ এ হাদীস পড়ে, তার তো এক অস্বাভাবিক كيفيت থাকতে হবে। দাওরায়ে হাদীসের তালিবে ইলমের তো কোনো গুনাহ হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। দাওরায় হাদীসের ছাত্রদের চিন্তা এদিক সেদিক যাওয়ার সুযাগ নেই; যদি হাদীসের কিতাবের সাথে তার মন থাকে। তার দিল ও দেমাগ পুরোটাকে হাদীস ঘিরে রাখবে, পাকড়াও করে রাখবে। কিন্তু আমরা তো এত গাফেল এত গাফেল, দাওরায়ে হাদীসের কিতাব আমার মাথার পাশে, যখন ঘুমাই পাশে টেবিলের উপর কিতাব, যখন খাবার খাচ্ছি তখন আমার পাশে কিতাব, যখন দরসে আছি তখন আমার সামনে কিতাব। হাদীসের মধ্যে সাহাবী জিজ্ঞাসা করছেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেদায়েত দিচ্ছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নসীহত করছেন মিম্বরে বসে, নসীহত করছেন হেদায়েত দিচ্ছেন আর সাহাবী সে হেদায়েত ও নসীহত শুনছেন, মুহাব্বতের সাথে শুনছেন। তারপর তাঁরা তাবিয়ীদেরকে শুনাচ্ছেন। তাঁদের থেকে তাবিয়ীনরা মুহাব্বাতের সাথে শুনতেন এবং তারা তাবে তাবিয়ীনকে শুনাচ্ছেন- এভাবে ধারাবাহিকভাবে সংকলক ইমামদের কাছে এসেছে। তারা কিতাবে হাদীস সংকলন করে দিয়েছেন আর আমাদের উস্তাযগণ সে কিতাব সামনে রেখে আমাদের পড়াচ্ছেন।

একজন তালিবে ইলম যদি পড়ে-

سمعت عمر بن الخطاب رضي الله عنه على المنبر يقول: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إنما الأعمال بالنيات، وإنما لامرئ ما نوى، فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هجرته لدنيا يصيبها، أو امرأة ينكحها فهجرته إلى ما هاجر إليه.

তার দিলে যদি এ কথা হাযির থাকে, মসজিদে নববীর চেহারা যদি তার যেহেনে এসে যায়; যে হযরত উমর রা. মিম্বারে বসে বলছেন, সামনে সাহাবায়ে কেরামের কে বসা? সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা., আলী ইবনে আবি তালিব রা. বসা, উসমান রা.- তারাই তো বসা বা অন্য সাহাবীরা। কারা কারা এ মজলিসে ছিলেন সুনির্দিষ্টভাবে তো আমরা বলতে পারব না। কিন্তু এতটুকু জানি যে, ওখানে সাহাবী-তাবেয়ীদের এক জামাত বসা। তাদের মধ্যে আলকামা ইবনে আবি ওয়াক্কাস লাইসিও ছিলেন। হযরত উমর রা. মিম্বরে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ শুনাচ্ছেন, তিনি বলছেন,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم

কী দৃশ্যটা! কোনো কোনো রেওয়ায়েতে হাদীসটির শব্দমালা এমন :

يا أيها الناس إنما الأعمال بالنية…

(সহীহ বুখারী, কিতাবুল হিয়াল, বাব ১) এতে মনে হয় হাদীসটি কোনো খুতবায় ইরশাদ হয়েছে :

يا أيها الناس إنما الأعمال بالنية…

আমি যদি নববী যুগের সেই দৃশ্য দেখতে পাই যে, মসজিদে নববীতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন আর সাহাবায়ে কেরাম শুনছেন তখন এই হাদীসের আবেদন আমাদের দিলে কীভাবে জাগ্রত হবে। প্রত্যেক হাদীসেই এই কথা আসছে,

رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم، فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم

চৌদ্দশ বছর আগের সে মসজিদে নববীর হালত সব সময় যার সামনে হাযির, সে গান্দা চিন্তা কীভাবে করতে পারে। মন্দ চিন্তা তার মাথায় এসে কয় সেকেন্ড থাকতে পারে? দাওরার বছর তো তাসাওউফের বছর। তাযকিয়ায়ে কলব ও তাযকিয়ায়ে ফিকিরের চমৎকার সময় এই বছর। শুধু এই অনুভূতিটা জাগ্রত যে রাখতে পারে যে, এই বছর আমি যেন সাহাবায়ে কেরামের সাথে আছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে আছি। আমি আমার উস্তাযের কাছে যখন যাই তখন তো আমার দিলে গান্দা খেয়াল আসে না।

এই যামানার বুযুর্গদের মজলিসে যদি আল্লাহ কখনো বসার তাওফীক দেন- আধা ঘণ্টা, দশ মিনিট, পাঁচ মিনিট বা পনের মিনিট, তখন আমার দিলে গান্দা খেয়াল আসে না, ভালো খেয়াল আসে। তাহলে আমি যখন রাসূলুল্লাহর মজলিসে আছি তখন আমার দিলের হালতটা কেমন হওয়া উচিত?

আজকে সকালে পড়লাম المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده বিকেলেই যদি কোনো তালিবে ইলমকে আঘাত করি, কটাক্ষ করি, আরেকজনের গীবত করে ফেলি, তাহলে কেমন লজ্জাজনক কথা হবে! গীবত হারাম- এই সকালে পড়লাম, আর বিকালেই এ অবস্থা! এখন তো পরিবর্তন হওয়ার داعية আছে, একটু খেয়াল করলেই হয়ে যাবে। কারণ এখন واعظ ও ناصح খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি আপনাকে বলে যাচ্ছেন।

কোনো জায়গায় যাবেন, তো خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ -এর উপর আমল করেন। আপনি রিকসাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন এই, অমুক জায়গায় যাবেন, কত টাকা ভাড়া? না-মুনাসিব একটা ভাড়া চেয়ে বসলো। একেবারে ক্ষেপে গেলেন। আপনার দেমাগ গরম হয়ে গেল। দিলেন ধমক। আপনিও এমন কথা বললেন যা আপনার ক্ষেত্রে সাজে না। এই পড়ে আসলেন- خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ আর বাহিরে তার উল্টা করলেন। দু’দিন আমার বেখেয়ালিতে এবং আমার অনিচ্ছায় রিকসাওয়ালার সাথে আওয়াজ উঁঁচু হয়ে গিয়েছিল। এটার জন্য এখনো আমার আফসোস। দু’জায়গায় আমাকে দু’জন মানুষ দেখেছে। আমি তাদেরকে চিনি না। আমি এত লজ্জা পেয়েছি যে, এখনো আমার মনে হলে খুব লজ্জা লাগে। এটা হওয়া উচিত নয়। সে না-মুনাসিব ভাড়া চাইল, আপনি নরম ভাষায় বলেন, ভাড়া তো এত না, ভাই আমরাও তো আসা যাওয়া করি, অনেক বেশি চেয়েছেন। আপনি হেসে হেসে বলেন। এটা অভ্যাস করতে হবে। নিজের তবিয়তের খেলাফ গায়রে মা‘কুল কিছু দেখলেই তবীয়ত গরম হবে, ভাষা পরিবর্তন হবে, লাহজা পরিবর্তন হয়ে যাবে, না-মুনাসিব কথা আমার যবান থেকে বের হবে- এটা কেমন কথা? আমি চেষ্টা করবো ادفع بالتي هى أحسن-এর উপর আমল করতে। তাহলে তালিবে ইলম যে এখন পড়ে আসল-خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ এ অনুযায়ী আমল হবে। এই যে সিএনজির ভায়েরা কাছাকাছি হলে যেতে চান না, আমরা সবসময় তাদের সাথে কানুনি ভাষায় কথা বলি। যাবেন? এই খালি যাবে? আর ঢাকার তালিবুল ইলমরা শিখেছে সবসময় রিকসাওয়ালাদের সাথে ধমকিয়ে কথা বলতে। নিজের বয়সের কাছাকাছি বা একটু বড় হলে তুমি বলে। আর একেবারে যদি মুরব্বী হয় তাহলে আপনি বলে। কী অধিকার আপনার তাকে তুমি করে বলার? বেশি বয়সের হোক বা কম বয়সের হোক, কোন্ অধিকারে আপনি তুমি করে বলেন? আপনি রিকসায় বসেন আর সে চালক সেজন্যে? এটা তো কুদরতের কারিশমা! এ তো ইলাহী তাকসীম, আল্লাহ পারতেন আমাকে আপনাকে ঐ জায়গায় বসাতে। আপনার আমার কোনো যোগ্যতা ছিল না। তো এখন সে ঐ সুরে বলে আর সিএনজিওয়ালা বলে যাব না। আমি বলি, السلام عليكم ورحمة الله হাসিমুখে একটা সালাম দিয়ে বলি, ভাই ভাল আছেন। আমাদেরকে একটু দিয়ে আসবেন কষ্ট করে, এই তো সামনে। আমি দেখেছি কঠিন কোনো ওযর না থাকলে ‘না’ করে না। যত কাছের থেকে কাছে যান। ভাই, কষ্ট করে আমাকে একটু দিয়ে আসবেন। কোথায়? এই তো কাছে, এখানেই। এরপর আপনি দিবেন কত। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে আপনি দেন। সে আপনাকে একরাম করে এনেছে আপনি তাকে একরাম করে দেন। আমি দেখেছি এমন ব্যবহার হলে তার ওযর থাকলে বলে, ভাই আমি তো আপনাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু গ্যারেজে গাড়ি জমা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাইহোক তার একটা ওযর আছে। এই যে خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ এটা কি শুধু উস্তাযদের সাথে। যার মর্যাদা তোমার জানা আছে তার সাথে? না, বরং الناس এখানে لام الف টা استغراق -এর জন্য এসেছে। বড়-ছোট, ঘরে-বাইরে, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ।

মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দা.বা.-এর সাথে মসজিদে হারামে এক ভাই খারাপ ব্যবহার করেছেন। পরে সে যখন পরিচয় জানতে পারল তখন এসে বলল, হুযুর আমি চিনতে পারিনি। খুব মাযেরাত করছে। তখন তিনি বললেন, চিনতে পারার পরে তো এটা خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ নয়। একটা আম ভাল ব্যবহার সবাই পায়। পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় বুযুর্গ-সাধারণ সবাই পায়। এর চেয়ে আরো উপরের স্তরের ভালো ব্যবহার হল, أَنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ। সাধারণ ভাল ব্যবহার সবাই আমার কাছে পাওনা। এজন্য কারো সাথে মুআমালা করার সময় একটু খেয়াল করা দরকার, যাতে পরে আফসোস করতে না হয়। এমন না বলতে হয়- হুযুর আমি তো চিনিনি। হুযুর আমি চিনিনি- এটা কেন বলতে হবে আমাকে? আমি ন্যূনতম ভাল ব্যবহারটা তার সাথে করি। যাতে পরে আফসোস করতে না হয়। তো এইমাত্র পড়ে আসলাম خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ আর বের হয়েই রিকসাওয়ালার সাথে খারাপ ব্যবহার করলাম! এটা কেমন হল। এ জন্য দাওরায়ে হাদীসে যেহেতু নগদ নগদ এরশাদ আমার সামনে আসছে। এক হাদীস কয়েকবার আসছে, এখনই আমার মাঝে ইনকিলাব আসা দরকার। এখন যদি আমার মাঝে এই অনুভূতি পয়দা না হয় তাহলে আর কবে হবে? 

(চলবে ইনশাঅল্লাহ)

তৃতীয় কথা

দাওরায়ে হাদীসে আমরা যারা তাকরীরের খুব গুরুত্ব দিই। তাকরীরের পিছনে পড়ে আমরা দু’টি বিষয় থেকে গাফেল হই; বরং আমি বলবো আমরা কয়েকটি বিষয় থেকে গাফেল হয়ে যাই। খুব বেশি তাকরীর লিখতে গিয়ে, ইয়াদ করতে গিয়ে, তাকরীর থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে আমরা গাফেল হয়ে যাই। অথচ আদবের তাকাযা হলো ঐ জিনিসগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া যেগুলো এখন আমি বলব।

এক. হাদীসের সনদ ও মতনের সহীহ ও নির্ভূল পাঠ, القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتون الحديث وأسانيدها

হাদীসের মতন ও সনদের নির্ভুল, সঠিক ও স্পষ্ট পাঠ- এটা হাদীসের জন্য সবচে’ বড় আদব। হাদীস পড়ার সময় যেন এমন ভাব না হয়, যেন ট্রেন ছুটছে। ট্রেন ছুটলে দৌড়াদৌড়ি করে কারা? অন্য দেশিরা নয়, বাংলাদেশিরা; ট্রেন আসলে কী একটা হুলুস্থুল করে! বিমানে নেয়ার জন্য বাস এল, বাস ভরে গেলে আরেকটা আসবে; নিবেই সবাইকে। এখানেও শুরু করে কার আগে কে উঠবে। আবার বাস থেকে নেমে কার আগে কে বিমানে উঠবে; অথচ আমার আসন আছেই। এটা হলো বাঙ্গালী লোকদের স্বভাব। এই হাদীসের কিতাব পড়ার সময়ও এমন করে হঠাৎ এমনভাবে পড়া শুরু করে! আরে ভাই তোমার কি জ্বর উঠল? কে যেন তাড়া দিচ্ছে পিছন থেকে। অথচ হাদীসে আছে- عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ

তোমরা মসজিদে যখন আসবে তখন ধীরস্থিভাবে আস, হুড়াহুড়া করে আসবে না। তাকবীরে উলা ছুটলে ছুটুক। মাসবুক হওয়া থেকে বাঁচতে হলে আগে থেকেই রওয়ানা হও। কিন্তু হুড়াহুড়ির কারণে একজনের উপর আরেকজন পড়ে কী অবস্থা! এতে অন্যান্য নামাযীদের সমস্যা সৃষ্টি হয়।

নামাযের ক্ষেত্রে নবীজী যে নসীহত করেছেন এই নসীহতটা ঠিক হাদীসের মতন পাঠের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-

عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ

حدثنا الحميدي قال : حدثنا سفيان

পুরা বছর ঠিক এত তারতীলের সাথে পড়া যাবে না, তবে এমন হদরের সাথে পড়েন যাতে মাখরাজ যথাযথ আদায় হয়। পড়া দ্রুত হবে কিন্তু আপনার মাঝে তাড়াহুড়ার কোনো ছাপ থাকবে না। ফরীদাবাদে হযরত মাওলানা আবদুল হাফীয ছাহেব ছিলেন। পড়া খুব দ্রুত পড়তেন কিন্তু কেউ বুঝতো না যে তার মাঝে তাড়াহুড়ার কোনো ভাব আছে। তাড়াহুড়ার ভাব ছাড়া দ্রুত পড়া। তাড়াহুড়ার ভাব ছাড়া দ্রুত পড়া শিখতে হবে। বছরের শেষে যখন সময় থাকবে না তখন দ্রুত পড়েন, কিন্তু তাড়াহুড়ার কোনো ভাব থাকবে না। এরকম দ্রুত পড়াকে আমি নিষেধ করি না। আর যখন সময় থাকবে তখন ধীরে ধীরে পড়েন তারতীলের সাথে পড়েন। যাতে বুঝা যায় যে আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস পড়ছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ যখন আপনি তাঁকে শুনাবেন তখন আপনি ভুল পড়বেন নাকি? এটা যেহেনে সব সময় থাকতে হবে। এজন্য কয়েকটি কথা বলেছি :

এক. পাঠ নির্ভুল ও বিশুদ্ধ হতে হবে। নির্ভুল ও বিশুদ্ধ হওয়া মানে নাহু ছরফ ও লুগাতের কোনো গলতি থাকতে পারবে না। নামগুলোর মধ্যে ضبط -এর গলতি থাকতে পারবে না এবং তাজবীদের গলতি থাকতে পারবে না। তাজবীদের গলতী বলতে মাখরাজ ও ছিফাতে লাযেমার رعايت করা। কুরআনের মত ষোলআনা রেয়ায়েত হাদীসের মধ্যে করা জরুরি নয়। যেমন إنما الأعمال بالنيات খুব গুন্নার সাথে পড়লাম এমন করা জরুরি নয় । তাজবীদের যেটা লাযেমী অংশ যেটা ছেড়ে দিলে লাহনে জলী হবে সেটা রেয়ায়েত করা জরুরি।

আরেকটা বিষয় হল ইবারত واضح হতে হবে। অর্থাৎ একেবারে সাফ সুতরা হতে হবে, এমন যেন না হয় একটা অক্ষর বুঝা গেল না, কী পড়ল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কাতারের ছাত্ররা বুঝল না। এজন্য

القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتون الحديث وأسانيدها

হতে হবে। এটার জন্য মেহনত তো তাইসীরুল মুবতাদী থেকে শুরু হয়েছে। এসো আরবী শিখি থেকেই তো এর মেহনত শুরু হয়েছে। যে যতটুকু মেহনত করেছে ততটুকু ফল পাবে। যদি আগে থেকে দুর্বলতা নিয়ে দাওরায় এসে থাকে তো তার القراءة الصحيحة الراشدة হবে না। এখন তার পেছনের জন্য আফসোস করতে হবে এবং নির্ভুল পাঠ শেখার জন্য عهد করতে হবে। তো বিশুদ্ধ পাঠের জন্য তাকে হরকতওয়ালা নির্ভুল সহীহ নুসখা সংগ্রহ করতে হবে।

কিছু সহীহ নুসখার বিবরণ :

যেমন নাসায়ীর সহীহ নুসখা, যা শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর তাহকীকে ছেপেছে। তো আপনার জানতে হবে কোন্ নুসখাটা নির্ভুল হরকত লাগানো। যাদের নাহু ছরফে দুর্বলতা আছে তারা তো এখনই দুর্বলতা দূর করতে পারবে না। তাই তারা এ ধরনের নুসখা সংগ্রহ করলে ভাল।

বুখারী শরীফের এবং মুসলিম শরীফের সহীহ নুসখা আছে। বুখারী শরীফের তুর্কিয়ার একটা ছাপা। الطبعة السلطانية বা তার থেকে تصوير করে যে এডিশন ছাপা হয়েছে। চার খণ্ডে বুখারী, চার খণ্ডে মুসলিম ছেপেছে। এর মধ্যে পুরা হরকত লাগান আছে। আর সাধারণত যেটার মধ্যে বেশি হরকত লাগানো হয় সেখানে বেশি ভুল থাকে। কিন্তু এরা মাশাআল্লাহ এত বেশি মেহনত করেছে আমি একটা ভুলও পাইনি। এ কথা বলছি না যে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। হয়তো এক দুইটা থাকবে। এমন কি সেখানে عن ও في -এর মধ্যে হরকত লাগানো আছে। তো প্রধান আদব হলো নির্ভুল স্পষ্টতম বিশুদ্ধ পাঠ।

দুই. হাদীসের তরজমা ভালো করে বুঝা

তরজমা উস্তায যদি বলে দেন, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু অনেক লম্বা নেসাব- দুই বছরের দাওরা এক বছর করলে যা হয়। সেজন্য সব হাদীসের তরজমা তো উস্তাযগণ করতে পারবেন না কিন্তু কিছু কিছু উস্তায করে দেন। হয়তো পুরো কিতাবের তরজমা করে দেন নতুবা অধিকাংশ তরজমা করে দেন। আমরা তরজমার প্রতি খুব গুরুত্ব দেই। তরজমা বুঝা এবং শেখা দুটি কাজ। তরজমা শেখার জন্য দাওরার বছর যথেষ্ট নাও হতে পারে। এর জন্য বাংলার উপর মেহনত অব্যাহত রাখতে হবে। আর বুঝার মেহনত এখনই। আমি যা হাদীস পড়লাম তা আমি বুঝতে পারি- এতটুকু মেহনত এখনই করতে হবে।

শেখার কথা বললাম কেন? বুঝার পর এটা প্রকাশ করতে পারা। শুধু মাফহুম বুঝে গেলেই সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায় না। এটার জন্য আমার বাংলা ভাষা জানা থাকতে হবে। শব্দজ্ঞান থাকতে হবে। সাহিত্য জানা থাকতে হবে এবং বাংলার যে উসূলে তরজমা আছে সে সম্পর্কে আমার ধারণা থাকতে হবে। এগুলো যদি আমার আগ থেকেই মশক না হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে চলবে? এগুলোর উপর তালিবুল ইলমরা তো এখন থেকে মেহনত করতে পারে। এই মরা যামানার মধ্যেও তো কিছু জোনাকির আলো জ্বলে! এই আলোগুলো থেকে ইস্তেফাদা করার লোক কম। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দা.বা.-এর সম্পাদিত বাংলা আলকলম-এর (পুষ্পের) মধ্যে এই মেহনত চলছে। পুষ্পকে অবলম্বন করে এই মেহনত করা যায়। আমি তাঁর কাছে জোরদার দরখাস্ত করবো, (এই মেহনত ওখানেও আছে) সেখানে একটা আয়াত ও একটা হাদীসের তরজমা থাকবে। এক পৃষ্ঠা যেন পুরা থাকে। অর্ধেক পৃষ্ঠা কুরআনের তরজমা আর অর্ধেক পৃষ্ঠা হাদীসের তরজমা। এবং এমন তরজমা যেটা দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদের জন্য আদর্শ তরজমা হয়। মানে তরজমার প্রকারভেদ আছে; একটি আদবী তরজমা, ইলমী তরজমা, ফন্নী তরজমা- এভাবে তরজমার প্রকারভেদ আছে। হাদীসের তরজমা হতে হবে কানূনী এবং ইলমী তরজমা। আর সাথে যেন ভাষার সালাসাত (সাবলিলতা) থাকে। আপনার মাদরাসার উস্তায থেকেও আপনি তা হাসিল করতে পারেন। যারা এমন উস্তায পেয়ে যাবেন যার বাংলাতেও দক্ষতা আছে এবং ফাহমে হাদীসের গভীর ইলম আছে তাহলে তো ভাল। তিনি যে তরজমা করে দেন সেটা মনে রাখার চেষ্টা করবেন। নোট করে রাখবেন। আমার অনেক কষ্ট হয় এ ধরনের উস্তায যেখানে আছেন তাদের ছাত্রদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করি, এই হাদীসের তরজমা তোমার উস্তায কী বলেছেন? কিন্তু সে বলতে পারে না। অনেক উস্তায কিতাব বুঝিয়ে চলে যান তরজমার প্রয়োজন বোধ করেন না; যেহেতু সময় নেই। উস্তাযগণের আযমত কিন্তু থাকতে হবে। আল্লাহ একেকজনকে একেক মেযাজের বানিয়েছেন, একেক জনকে একেক যোগ্যতা দিয়েছেন। যে উস্তাযের কাছে যে মাহারাত আছে, যে কামালাত আল্লাহ দান করেছেন এটা তুমি উস্তায থেকে নেবে। আরেকজনের মধ্যে যেটা আছে তা নেবে, কিন্তু তুলনা করবে না- এই উস্তাযের মাহারাত বেশি, এই উস্তাযের কম। এরকম যদি তালিবুল ইলমরা তুলনা করতে থাক, যবানে বা দিলে, তবে তার যিন্দেগী বরবাদ হয়ে যাবে। একজন উর্দু তরজমা করেন তার থেকে আপনি উর্দু তরজমা শিখেন। এবং তাঁর অন্যান্য কামালাত আছে, আখলাক, আফকার থাকবে এগুলো তাঁর থেকে আপনি হাছিল করেন। কখনো তুলনা করব না। বরং তাঁর মাঝে যে গুণাবলী আছে আমি সেটার দিকে তাকাই, সেটা অর্জন করি। অযথা মুকারানা করে سوء أدب -এর ارتكاب করব না। আল্লাহ তোমাকে যদি এমন উস্তায মিলিয়ে দেন যার ভাষার যোগ্যতাও আছে আবার হাদীসের ফাহ্মও আছে। তিনি যে তরজমা করেন তা নোট করে রাখেন। যেমন, إنك لتحمل الكل و تكسب المعدوم

কী তরজমা করেছেন উস্তায? উস্তাযের তরজমা উস্তাযের কাছে রয়ে গেছে আর এখন তিনি উর্দু তরজমা দেখবেন, বাংলা তরজমা দেখবেন, আরবী তরজমা দেখবেন, এরপর নিজের থেকে একটা তরজমা করবেন। কেন আপনার ডায়েরীতে নোট নেই- আপনার উস্তায কী তরজমা করেছেন? আহাম আহাম جملة যেগুলোবা الكلم جوامع জাতীয় হাদীস যেগুলো এর তরজমা বিভিন্নভাবে হতে পারে, আমার উস্তায কোনটা করেছেন সেটা মনে রাখতে হবে, আমার কাছে নোট থাকতে হবে। এটা তরজমার প্রতি একটা মেহনত, এটা এক বছরেই হয়ে যাবে না। এখন থেকে মেহনত করতে থাকব, যাতে আমার মাঝে এ মেযাজ পয়দা হয় যে, আমি যখন কোনো হাদীসের তরজমা করব তখন কীভাবে আমি জাতির সামনে হাদীসের আদর্শ তরজমা পেশ করবো। আমি একটা হাদীস পড়ে তরজমা করলাম ওখানে শিক্ষিত লেকেরা আছে। তারা বলবে হুজুর তো হাদীস পড়ার পর তরজমা করেনি। অনেকে বলে, আমি তরজমা করছি; এরপর তরজমা না করে তাফসীর করে। তরজমা এক জিনিস আর তাফসীর ও র্শহ আরেক জিনিস। প্রথমে তরজমা করতে হবে আয়াতের, প্রথমে তরজমা করতে হবে হাদীসের; নির্ভুল তরজমা, সঠিক তরজমা। এটার জন্য বাংলা ভাষার মেহনত করতে হবে এবং কুরআন ও হাদীসের তরজমাগুলোর মধ্যে তুলনামূলক যেগুলো একটু মানসম্মত সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে এবং মিলিয়ে মিলিয়ে মুকারানা করে দেখতে হবে। এটা দাওরার বছর মাত্র দশটি হাদীসেই করি আমি। এরপর মেহনত চালু রাখি। তরজমার প্রতি খুব খেয়াল রাখি। তরজমা বোঝা এবং আদর্শ তরজমা শেখা। দাওরার বছরেই সব হবে না, তবে এখন থেকেই এ মেযাজ তৈরি করতে হবে।

তিন. هدايات الحديث

الحديث تقرير -এর প্রতি খুব জোর দেই আর هدايات الحديث থেকে গাফেল হয়ে যাই। একটা তাফসীর আছে, আবু বকর জাবের আলজাযায়েরীর أيسر التفاسير। আশা করি এখনো তিনি জীবিত আছেন, মোয়াম্মার হুযুর। তাঁর এ তাফসীরের মধ্যে একটা শিরোনাম থাকে هدايات الآيات। এরকম আপনি যখন একটা হাদীস পড়বেন তো আপনার মাথায়ও هدايات الحديث থাকবে। একটা হলো এই হাদীসের কী কী ফাওয়ায়েদ ও আহকাম مستنبط হতে পারে। এটার তো সীমারেখা নেই,অনেক।

عبارة النص، إشارة النص، إقتضاء النص، دلالة النص

এ চারটা তো আমরা নূরুল আনওয়ারে পড়েছি এ ছাড়াوجوه الدلالة আরো আছে। এসব ওযূহ-এর ভিত্তিতে হাদীসের থেকে فوائد،أقسام، آداب উদ্ঘাটন হতে পারে অনেক।

يا أبا عمير! ما فعل النغير؟

এই হাদীস থেকে মিকনাসার এক আলেম ৪শত ফায়েদা ইসতিম্বাত করেছেন। মূসা আলাইহিস সালাম সফর করে খাযির আলাইহিস সালামের কাছে গিয়েছেন ইলম শেখার জন্যে। এই যে ঘটনা কুরআনে আছে, হাদীসে আছে, এসব আয়াত এবং হাদীস থেকে ইলম, তালিবে ইলম ও মুআল্লিমের এবং তালিম ও তাআল্লুমের কী কী আদব উদ্ঘাটন হতে পারে এর উপর মেহনত করে কিতাব লেখা হয়েছে। আল্লামা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর শাগরিদ এ বিষয়ে রিসালা লিখেছেন-إرشاد الحليم إلى ما في قصة الكليم

এটার মধ্যে কয়েক শত ফায়েদা। এ রকম শত শত ফায়েদা আছে, আমি এটার কথা বলছি না।

অনেক فوائد ইস্তিম্বাত হবে, এখন এরপর ভবিষ্যতে আরো নতুন প্রেক্ষাপট দেখা দিবে তখন ঘাটাঘাটি করে দেখবে ও বলবে, আরে এই হাদীস থেকেই তো এটার সমাধান পাওয়া যায়। আগে কোনো شارح এই হাদীস থেকে ঐ সমাধান নেননি। তখন এ ধরনের ঘটনা তাদের বুঝে আসেনি। এখন ঘটনা ঘটেছে। আপনি ঘটনা মাথায় রেখে যখন হাদীসের কিতাব মুতালাআ করলেন। তখন দেখলেন যে আরে এই হাদীসের মধ্যেই তো এর সমাধান আছে। এটা চলতে থাকবে। কিন্তু কিছু একেবারে আম-ফাহাম হেদায়েত, বড় দাগের হেদায়েত, যা একটা হাদীস থেকে বুঝে আসে; সেটা মুযাকারা করতে হবে, নোট করতে হবে। এবং হেদায়েতগুলো গ্রহণ করে আমার আমলী যিন্দেগীতে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে

تصحيح قراءة الحديث، القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتن الحديث وإسناده এবং ترجمة الحديث ترجمة فصيحة بلغة الوطن

তিন নম্বর হল هدايات الحديث

এ তিনটা মেহনত হল এক নম্বর।

৪ নম্বর মেহনত হলো ফিকহুল হাদীস।

৫ নম্বর হলো তাকরীর। কিন্তু আমরা প্রথম চারটি বাদ দিয়ে পাঁচ নম্বরটা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। সময় বেশি লাগাই। আপনারা বলবেন আমাদের তাকরীর তো ফিকহুল হাদীস সম্পর্কে, না আপনাদের তাকরীর যা আপনারা বেশি পড়েন তা হলো ফিকহুল হাদীসের একটা অংশ। আপনাদের আলোচনা ইখতেলাফী মাসায়েলের মাযাহেব ও দালায়েল নিয়ে বেশি হয়।

আরেকটা কথা বলবো ইনশাআল্লাহ, যার দিকে মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব ইশারা করে গেছেন। ইখতেলাফী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সব ইমামের কাছে দলীল আছে। ফিকহে হানাফীর দলীল অন্যদের দলীলের চেয়ে মজবুত বা সমান পাল্লার। অন্যদের দলীল থেকে ফিকহে হানাফীর দলীল দুর্বল- এটা দু-চারটা মাসআলার ক্ষেত্রে হতে পারে। আকছার মাসায়েল বা যেগুলো নিয়ে হাঙ্গামা করে সেগুলোর ক্ষেত্রে ফিকহে হানাফীর দলীল হয়তো সমান পাল্লার আর না হয় অধিক শক্তিশালী। বেশী أصح, أقوى ও واضح। কিন্তু আমাদের এইসব দালায়েল পড়া, এগুলো খুঁজে বের করা, ইয়াদ করা- এ সব ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা। আমরা আমাদের তাকরীরের মধ্যে জোর দেই- অনেকগুলো দলীল, অনেকগুলো জবাব, জবাবের জবাব, অনেকগুলো وجوہ ترجيح ইত্যাদির প্রতি। নতুন প্রেক্ষাপটে এখন যেটা দরকার তা হলো ترين صحيح এবং ترين راجح একটা দুইটা তিনটা দলীল ইনতেখাব করেন। وجوہ ترجيح অনেক আছে তার মধ্যে আপনি ترين راجح উযূহে তারজীহ ইনতেখাব করেন। এরপর এটা ইয়াদ করেন হাওয়ালাসহ এবং সনদসহ। পারবেন না?

এটা কত কষ্টদায়ক-যাদের ইলমী বিষয়ে এবং দ্বীনের সহীহ فهم-এর বিষয়ের কোনো শেকড় নেই। বা নামকে ওয়াসতে শেকড়,তারা হাদীস শোনায় বাহাওয়ালা;আর আমাদের যাদের শেকড় আছে,আমরা যারা মুসতানাদ,আমরা বলি যে আমাদের দলীল কিতাবে আছে,দেখে বলতে হবে- هو عندي في الصندوق

আমি দাওরা ও মেশকাতের ছাত্রদের খেদমতে হাত জোড় করে দরখাস্ত করছি। আপনারা দাওরার বছর কমপক্ষে এ ‘আযম’ করেন, নামাযের যে মাসায়েলের মধ্যে ‘তানাউয়ে সুন্নতে’র ইখতেলাফ আছে এবং ইমামদের মাঝে দালায়েলের ইখতেলাফ আছে, এক্ষেত্রে যেটার উপর ফিকহে হানাফীর মাদার, তার দুটি বা তিনটি দলীল সাহাবীর নামসহ ও হাওয়ালাসহ মুখস্থ করেন এবং কমপক্ষে একটি হাদীস সনদসহ মুখস্থ করেন। এর থেকে সহজ কী হতে পারে! আর এখন থেকে ডায়েরী বানান, যার নাম হবে محفوظات। এখানে নির্বাচিত হাদীসগুলো নোট করেন। মতনসহ, সনদসহ ও যে কিতাব থেকে নিয়েছেন তার হাওয়ালাসহ। হাটহাজারীর হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয ছাহেব তাঁর শাগরিদদেরকে হাদীস মুখস্থ করতে বলেছেন। আমি তার এক শাগরিদকে দেখেছি, শুধু সাহাবীর নাম ও মত্নে হাদীস লিখে রেখেছেন। কিন্তু কোন কিতাব থেকে নিয়েছে তার উল্লেখ নেই। সে মনে করেছে আমার তো শুধু মতন দরকার। আরে ভাই! কত কিতাব আছে? তুমি কি বুখারী থেকে নিয়েছো না মুসলিম থেকে, না অন্য কোনো কিতাব থেকে, এটা কীভাবে বুঝবে? এখন থেকেই আমরা প্রত্যেক বিষয়ে হাদীস নোট করব সনদ মতন ও হাওয়ালাসহ। সাথে খ- ও পৃষ্ঠা নম্বর এবং হাদীস নম্বর লিখব। সবচেয়ে ভাল হবে সঙ্গে বাবও লিখলে। যেমন .كتاب الصلاة باب كذا এবং এটা সব সময় আমার সামনে থাকবে আমি মুখস্থ করতে থাকব। কিন্তু দাওরার বছর কমপক্ষে নামাযের ইখতিলাফী দালায়েলগুলোর মশহুর মশহুর মাসআলার তিনটি দলীল সাহাবীর নাম, মত্নে হাদীস ও হাওয়ালা এবং এই হাদীস কোন ইমাম সহীহ বলেছেন বা হাসান বলেছেন উক্তিসহ আমি মুখস্থ করব। এর মধ্যে কমপক্ষে একটি হাদীস সনদসহ মুখস্থ করব। পারবো না ইনশা আল্লাহ? এটা আরো সহজ হবে মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেবের দলীলসহ নামাযের মাসায়েল, যা মাকতাবাতুল আযহার থেকে ছেপেছে আর নবীজীর নামায, যা মাকতাবাতুল আশরাফ থেকে ছেপেছে এটা নিন। উম্মত যে মাসলাকের উপর আমল করছে, যে মাসলাকের দলীল আছে, তা সত্ত্বেও উম্মতকে ঐ মাসলাকের দলীল না শুনিয়ে অন্য মাসলাকের দলীল শুনিয়ে দিচ্ছে। এটা কোন فقيه -এর কাজ হতে পারে না। এসব যারা করে সে আপন জায়গায় অনেক বড় হতে পারে, আমার জানা নেই, কিন্তু তার মাঝে ফাকাহাত নেই। দ্বীনের ফাকাহাত যার মাঝে আছে, আদাবুল ইখতিলাফ নিয়ে যারা লেখাপড়া করেছে এবং এই মাসআলার ক্ষেত্রে সাহাবা ও তাবিয়ীনের মেযাজ যারা জানে, তারা এ কাজ কখনো করতে পারে না। উম্মতের যে বা যারা আমল করছে ترك القراءة خلف الإمام -এর উপর তাদের শোনাচ্ছেন قراءة خلف الإمام -এর হাদীস। আর বলছেন যে ترك القراءة -এর কোনো হাদীস নেই বা থাকলেও যয়ীফ।

এই ধরনের غير فقيه লোকেরা হাদীস শুনিয়ে দিচ্ছে হাওয়ালাসহ আর আপনি বলছেন, আছে, কিতাব খুলে দেখাতে হবে। ভাইয়েরা! তোমরা সময় ব্যয় করার ক্ষেত্র পাও না। গল্পগুজব করে, ঘুমিয়ে সময় নষ্ট কর। দাওরার মধ্যেও সময় পাও কিন্তু নষ্ট কর। অথচ مستشرقين -এর ফেতনা حديث منكرين -এর ফেতনা دشمنان اسلام -এর ফেতনা, ফেরাকে বাতিলার ফেতনা- এগুলো মোকাবেলা করার দরকার, সে প্রস্তুতি কারা নিবে? ছোট্ট ফেতনারই মোকাবালা করতে পারছ না, কারণ তোমরা নিয়তই করে রেখেছ যে এগুলো আমাদের কাজ না। অথচ এটা তোমাদেরই কাজ। যে মাদরাসায়ই তুমি থাক দাওরায়ে হাদীসের প্রতিটি তালিবে ইলম এসব ফিতনার মোকাবেলা করার যিম্মাদার এবং সে যদি হিম্মত করে তার জন্য তা সম্ভব। তোমরা হিম্মত বাড়াও নিয়ত কর। গাফলতের সাথে যদি থাক তাহলে তোমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। এই আশায় বসে থাকলে চলবে না যে, পীরজী হুযুর, হাফেজ্জী হুযুর, ছদর সাহেব হুযুরের মেহনতের বরকতে ঢাকা শহর তোমাদের হাতে থাকবে। এখন অনেক মসজিদ এমন লোকদের তত্ত্বাবধানে, যাদের ফিকরী সমস্যা এবং যাদের আকীদা-ফিকির বক্র। তাদের মিডিয়া আছে। আপনাদের কোনো মিডিয়া নেই। মিডিয়া সব ওদের হাতে। আপনারা ঘুমিয়ে থাকবেন আর ছদর সাহেব ও হাফেজ্জী হুযুরের বরকতে আপনাদের অস্তিত্ব ঠিক থাকবে- এই ভুল ধারণার কোনো অবকাশ নেই। সজাগ হতে হবে, মেহনত করতে হবে। হিফযুন নুসূস ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মেহনতের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন

(ধারণ ও লিখনে : মাওলানা আব্দুল হাকীম)

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *