হয়ত আমাদের অধিকাংশই নিজের বাবা মা এর প্রতি কোন কোন ব্যাপারে অসন্তুষ্ট, হয়ত এমন যে ভাবি, “বাবা মা এর এই আচরন এমন না হয়ে যদি তেমন হতো !! যদি এই কথা টা এভাবে না বলত ! আমার মা যদি একটু কম কথা বলত !! বাবা যদি একটু স্মার্ট হতো !! ইশ এরা আগের মানুষ কোথায় কি বলতে হয় তাও জানেনা !!”
আমাদের যারা নিজ বাবা মা এর প্রতি অসন্তুষ্ট এবং একজন জুরাইয এর কাহানী
আমাদের অনেকে তো বাবা মা এর উপর সম্পূর্নই অসন্তুষ্ট, হয়ত তার যথেষ্ট যৌক্তিক কারনও আছে। বাবা মা শুধু জন্ম দিয়েই খালাশ, কোন দায়িত্ব পালন করেইনা ঠিক মত আবার সারাদিন গালিগালাজ করে ! ভুল না হলেও সব কিছুতে ভুল ধরে।
এই একটা ব্যাপারে কিছু করার নাই। এই একটা মাত্র ক্ষেত্রেই আল্লাহ পক্ষপাতিত্ব করেছেন বাবা মা কে তিনি সীমাতীত মর্যাদা দিয়েছেন, এটা তার ইচ্ছা, তার উদারতা। এতই পাওয়ার দিয়েছেন বাবা মা কে যে তাদের দুয়া এবং বদদুয়া দুইটাই কবুল হয়। এখন যদি প্রশ্ন আসে যে আমি দোষ না করা সত্ত্বেও আমার বাবা মা অভিশাপ দিলেও কি কবুল হবে ?
জুরাইয এর কাহানী অনেকেরই জানা আছে:
বানী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইয নামের একজন পরহেজগার লোক ছিল। সে ইবাদতের জন্য একটি ইবাদাতখানা তৈরী করে তথায় সর্বদা ইবাদতে লিপ্ত ছিল। সে এক দিন নামাযরত (কোন রেওয়াতে আছে নফল নামাজ। আল্লাহ ভালো জানেন) অবস্থায় ছিল। এমন সময় তার মা এসে ডাক দিল। জুরাইজ বললঃ হে আমার প্রতিপালক কি করব? আমার মায়ের ডাকে সাড়া দিব? না নামাযে লিপ্ত থাকব? এই বলে সে নামাযের মধ্যে রয়ে গেল। মায়ের ডাকে সাড়া দিলনা। মা ব্যর্থ হয়ে চলে গেল। পরের দিন তার মা আবার আগমণ করল। সেদিনও জুরাইয নামাযে ছিল। তার মায়ের কন্ঠ শুনে সে বললঃ হে আমার প্রতিপালক আমি এখন কি করব? আমার মায়ের ডাকে সাড়া দিব? না নামাযে লিপ্ত থাকব? এই বলে সে নামাযের মধ্যে রয়ে গেল। মায়ের ডাকে সাড়া দিলনা। মা ব্যর্থ হয়ে আজও চলে গেল। তৃতীয় দিনেও একই ঘটনা ঘটল !
এবার তার মা রাগাম্বিত হয়ে জুরাইযের উপর এই বলে বদ্ দু’আ করল যে, “ হে আল্লাহ ! একে তুমি যেনাকারীর মুখ না দেখিয়ে মৃত্যু দিওনা ”
বনী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইজ ও তার ইবাদতের কথা আলোচিত হ’তে লাগল। এক ব্যভিচারী নারী ছিল। সে উল্লেখযোগ্য রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিণী ছিল। সে বলল, তোমরা যদি চাও, আমি তাকে (জুরাইজ) বিভ্রান্ত করতে পারি।
অতঃপর একদিন সেই মহিলা জুরাইযের কাছে গিয়ে নিজেকে পেশ করল। কিন’ জুরাইয সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করলনা। জুরাইযের গীর্জায় একজন ছাগলের রাখাল আসা-যাওয়া করত। মহিলাটি জুরাইযের কাছে কোন সুযোগ না পেয়ে রাখালের কাছে গিয়ে তার সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হল। এতে সে গর্ভবতী হয়ে গেল। প্রসব করার পর সে বলল এটি জুরাইযের সন্তান বলে সবাইকে প্রচার করতে থাকল ।
বনী ইসরাঈল (ক্ষিপ্ত হয়ে) তার কাছে এসে তাকে ইবাদতগাহ থেকে বের করে আনল, তার ইবাদতগাহ ধূলিসাৎ করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল। জুরাইজ বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল, তুমি এই নষ্টা মহিলার সাথে যেনা করেছ। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরাইজ বললেন, আমাকে একটু সুযোগ দাও ছালাত আদায় করে নেই। তিনি ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষ করে তিনি শিশুটির কাছে এসে তার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই শিশু! তোমার পিতা কে’? সে বলল, ‘আমার পিতা অমুক রাখাল’। উপস্থিত লোকেরা তখন জুরাইজের নিকটে এসে তাকে চুম্বন করতে লাগল এবং তার শরীরে হাত বুলাতে লাগল।
আর তারা বলল, এখন আমরা তোমার ইবাদতগাহটি সোনা দিয়ে তেরী করে দিচ্ছি। তিনি বললেন, দরকার নেই, বরং পূর্বের মত মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। অতঃপর তারা তাই করল।
শিক্ষাঃ
এইখানে জুরাইয সালাতের মত ভালো কাজ,ইবাদাতের কারনে যে সাড়া দিতে পারেনাই আর জুরাইযের মা এর বদদুয়া অন্যায় ছিলো তাও আল্লাহ মা এর বদদুয়া কবুল করেছিলেন এবং একই সাথে জুরাইজ যেহেতু নির্দোষ ছিলেন, তাই নিজ ক্ষমতা বলে প্রিয় বান্দা জুরাইজকে রক্ষা করেছিলেন, সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জুরাইজের তাওয়াক্কুল আর মা এর জবান উভয়েরই মর্যাদা দিয়েছেন বিচক্ষন আল্লাহ।
[রেফারেন্সঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, (বনী ইসরাঈলের মধ্যে) তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই দোলনায় কথা বলেনি, তার মধ্যে এই শিশু একটা ]
মুশরিক দের আল্লাহ সব থেকে ঘৃনা করেন, এত এত ঘৃনা যে সব বড় বড় পাপ তিনি ক্ষমা করে দিবেন কিন্তু মুশরিক কে ক্ষমা করবেন না বলে বলেছেন। পিতামাতা যদি শিরক কাজের আদেশ দেয় তা অমান্য করতে হবে কিন্তু তবুও তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখতে হবে, ব্যবহার ভাল করতে হবে, সেবা শশ্রুষা করতে হবে, দুনিয়াবী সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
‘যদি তাঁরা (পিতা-মাতা) তোমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য যা (শিরক) তোমার বোধগম্য নয়, তাহলে তুমি তাঁদের কথা অমান্য করো, (অর্থাৎ আমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না) তবুও পার্থিব জীবনে উৎকৃষ্ট পন্থায় তাঁদের সাথে সৎ সম্পর্ক বজায় রেখো। আর তুমি তাঁদের পথ অনুসরণ করো যারা (আমি এক) আমার প্রতি অবিচলভাবে আকৃষ্ট রয়েছে।’
[সূরা লুকমান : আয়াত ১৫]
পিতামাতাই জান্নাত।
এমন অনেক এবং অনেক নযীর আছে যে হয়ত কেউ সেইভাবে প্রচুর পরিমানে ইবাদাত করতে পারত না, হয়ত প্রচুর ভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টির হক আদায় করতে পারত না অথচ মাত্র একটি আমল দ্বারা, বাবা মা এর সেবা করার জন্য ডাইরেক্ট জান্নাতী হয়ে গেছে। আর জিব্রাইল (আঃ) রাসুল (সাঃ) কে বলেছিলেন, “আমি জান্নাতে যেয়ে দেখলাম এর চারিদিক কাটা (দুঃখ কষ্ট) দিয়ে ঘেরা” অর্থাৎ জান্নাত যেতে হলে দুঃখ কষ্টের বেড়ি বাধ সহ্য করেই যেতে হবে।
***যদি সত্যিই বাবা মা এর আচরন চূড়ান্ত অসহনীয় হয় তাহলে ধরেই নিই যে এই টাইপ বাবা মা দিয়েই আল্লাহ হয়ত আমাদের পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন !! যেই জিনিস (বাবা-মা) আমাদের জান্নাতের নিশ্চায়ক, যাদের দুয়া কবুলের ব্যাপারে গ্যারান্টেড সেইক্ষেত্রে আর নিজের জন্য কোন দুয়া কবুল করাতে চাইলে যাদের স্বদ্যবহার আমরা করতে পারি, সেই সত্তাগুলো তো হাজার কষ্টদায়ক হলেও কষ্ট পাবার কথা না।
হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতা হচ্ছে,জান্নাতের দরজা সমূহের মধ্যম দরজা। অতএব তুমি ইচ্ছা করলে, সেই দরজা নষ্ট কর বা সংরক্ষণ কর। -[ সুনানে তিরমিযি: ১৯০০]
জান্নাতের দরজা কাঠের, লোহার, স্বর্নের, ভালো, খারাপ, ফর্সা, কালো সুন্দর অসুন্দর যেমনই হোক তা দিয়ে প্রবেশ করতে আমাদেরকে তা সংরক্ষন করতেই হবে নিশ্চয় !
রাসূল (সা.) বলেছেন , “সে ব্যাক্তি অপমানিত হোক, আবার সে অপমানিত হোক এবং আবার সে অপমানিত হোক । সাহাবগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! কে সে ব্যাক্তি ? তিনি উত্তর দিলেন , যে ব্যাক্তি তার মাতা-পিতাকে বৃদ্ধাবস্হায় পেলো অথবা তাদের কোন একজনকে পেলো-তারপরও (তাদের খেদমত করে) নিজের জন্য জান্নাত নিশ্চিত করতে পারিনি ।” [মুসলিম]
আমরা যাদের বাবা মা এখনও বেচে আছে, তাদের আমাদেরকে ছেড়ে যাবার আগেই অন্তত নিজেদের জান্নাত যদি নিশ্চিত করে নিতা পারতাম, সৌভাগ্যবান আমরাই হতাম। জান্নাত পাবার শর্টকার্ট টেকনিকে।
‘‘হে আমার প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন ঠিক যেভাবে তারা আমাকে ছোট অবস্থায় লালন-পালন করেছেন !
“হে আমাদের মালিক, যে জবান তুমি দিয়েছ সেই জবান দিয়ে যেন তাদের প্রতি কোন কষ্ট সূচক শব্দ আর না বের হয়।”
“হে আল্লাহ, আমাদের যেই হাত দিয়েছ সেই হাত দিয়ে যেন তাদের সেবা করতে পারি প্রতিনিয়ত।
আর পরিশেষে, যদি তারা আমাদের অসন্তুষ্টির কোন কাজ করে, আমাদেরকে অকারন ভুল বুঝে , তাহলে শয়তানের প্ররোচনায় আমাদের রাগিয়ে দিওনা, বরং আমাদের ধৈর্য্য রাখার তৌফিক দিও। শৈশবে তারা আমাদের জন্য যা কষ্ট করে সেগুলো চোখের সাওমে ভাসিয়ে দিও আর তাদেরকেও দিও হেদায়াত।”
“হে আল্লাহ ! বয়স হবার সাথে সাথে তারাও যে শিশু হয়ে যাচ্ছে সেইটা বুঝার বিবেক আমাদেরকে দিও।
আর যেহেতু তুমি বলেছ, তাদের সন্তুষ্টিতে তোমার সন্তুষ্টী আর তাদের অসন্তুষ্টিতে তোমার অসন্তুষ্টি, তাই তাদের মাধ্যমে তোমাকে সন্তুষ্ট করার সামর্থ্য দিও।”
[নিজের বাবা মা কে আমি প্রায় কষ্ট দিয়ে ফেলি ! কত বার যে “উফ” শব্দেরও বেশী করেছি ! আল্লাহ এর আরশ কাপিয়েছি !! আল্লাহ আমাকে যেন ক্ষমা করেন। #সেলফ_রিমাইন্ডার ]