আদম আ. সৃষ্টির শুরুতে ছিলেন কেবলই একটা স্থাণু আকৃতিমাত্র। আঠালো, পোড়া মাটির দ্বারা তৈরি এক আকৃতি। আল্লাহ তাতে কুদরতি ফুঁ দিলেন, নাকের ছিদ্র দিয়ে এই ফুঁ আদম আ. এঁর মধ্যে প্রাণের সঞ্চারণ করল। রূহের প্রবেশ ঘটল।
এই যে জীবন যা আল্লাহ্র কুদরতি ফুঁ এঁর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সঞ্চারিত হয়েছে। যত মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেবে তাদের প্রত্যেকেই সে ফুঁৎকারের ধারাবাহিক অংশীদার রূপেই জন্ম নেবে।
সুতরাং এই রূহ- এই জীবন হচ্ছে আল্লাহ্র সেই ফুঁৎকার যা মানুষের কাছে এক মহান আমানত। ইসলামে তাই ‘জানের হেফাজত’ (Preservation of life) হচ্ছে মৌলিক কর্তব্যসমূহের একটা।
এই আমানতকে খেয়ানত করার অধিকার কারো নেই। মানুষের জীবন ও মৃত্যুর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব আল্লাহ্র। এই কর্তৃত্বকে মেনে নেওয়াটা ঈমানেরই অংশ।
এটাই আত্মসমর্পণ- এই সাবমিশন যে করে সেই প্রকৃতপক্ষে মুসলিম। এর বাইরে যাওয়াটা অবাধ্যতা।
‘আত্মহত্যা’ও মূলত ‘হত্যা’ই। আল্লাহ তা’আলা কোরআনে স্পষ্টত আত্মহত্যাকে নিজেদেরকে নিজেরা হত্যা করা হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
( وَلاَ تَقْتُلُواْ أَنفُسَكُمْ إِنَّ اللّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا )
‘তোমরা নিজেদের নিজেরা হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তো তোমাদের প্রতি দয়াবান’।
মানে যিনি আত্মহত্যা করছেন তিনিও আদতে খুন করছেন। তিনিও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, মার্ডারার, জালিম। ইসলাম তাকে এভাবেই অভহিত করছে।
কেননা ইসলামে নিজের কিম্বা অপরের কারোর জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অনুমতি কারোর জন্য নেই যতক্ষণ না তা ফিসাবিলিল্লাহ (In the cause of Allah) অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? মূলত হতাশা থেকেই তা করে। আর আশাবাদীতা একজন মুমিনের যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমস্ত কষ্টেও সে ধৈর্য ধারণ করে। আল্লাহ তো বলছেন,
‘অতঃপর আমি তো মন্দ পরিস্থিতিকে, ভাল পরিস্থিতিতে বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা সমৃদ্ধি লাভ করেছে এবং বলেছে, ‘আমাদের পূর্ববর্তীদেরও দুর্দশা ও আনন্দ উভয়ই স্পর্শ করেছে’। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৯৫]
আসলে আত্মহত্যার মাধ্যমে কেবল আল্লাহ্র আমানতের খেয়ানতই নয় বরং আরও অসংখ্য গুনাহ ও আল্লাহ্র অবাধ্যতা এর মধ্যে নিহিত আছে। প্রকৃতপক্ষে খুন এবং আরও অনেক গুনাহের সম্মিলিত রূপ হচ্ছে আত্মহত্যা।
সূরা আনআমেও আল্লাহ আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তাই আত্মহত্যা কোনও অংশেই কম অপরাধ নয়।
সুদ গ্রহণ, মদ পান, শুকরের মাংস খাওয়া জিনা কিম্বা পরকীয়ার চেয়ে কোনও অংশেই আত্মহত্যার গুনাহকে ছোট করার অবকাশ নাই।
আমরা যেমন মদপান করলে, মদ পান করার ফলে মাতালের প্রতি সহানুভূতিশীল হই না। জিনার করলে জিনা করার কারণে তার পক্ষপাতী হই না। পরকীয়া করার কারণে কারো প্রতি তার পরকীয়ার জন্য সহানুভূতিশীল হই না।
কেবল পাপ করেছে, আর সেই পাপের কারণে আমরা কখনোই কারো প্রতি সমর্থন, সিম্প্যাথি, দয়া নিয়ে হাজির হই না। তেমনি আত্মহত্যার প্রতি সিম্প্যাথি প্রদর্শন করাটাও অনুচিত।
এটা আত্মহত্যাকে প্রকারান্তরে লেজিটিমেসি দেয়। আল্লাহ্র হুকুমের প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শনের মত যে দুরাচার একে সরলভাবে গ্রহণ করা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
কারণ এই সহানুভূতির প্রদর্শন আত্মহত্যার বিস্তার ঘটাতে ভূমিকা রাখবে। সামাজিক স্বীকৃতির জায়গা করে দেবে। আর তাই কখনোই আত্মহত্যাকারীর জানাজায় নবীগণ অংশ নেন নি।
এমনকি ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিদের আত্মহত্যাকারীদের জানাজায় শরিক হতে ইসলামে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেন কোনও ভাবেই আত্মহত্যার কোনও প্রকার সহজীকরণ না হয়।
মানুষের বেদনায় আমাদের সহানুভূতি থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সহানুভূতি যেন আত্মহত্যার জন্য প্রখর না হয়ে উঠে।
আমাদের এই সহানুভূতি আত্মহত্যাকে যেন সামাজিক স্বীকৃতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্ত ব্যাপারগুলোয় সাবধান হই। আল্লাহ্র অবাধ্যতা থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চাই। (আরজু আহমেদ)