আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকরা ক্যারিয়ারকে ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়।

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকরা ক্যারিয়ারকে ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়। অভিভাবকরা সন্তানদের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকলেও তাদের দ্বীনদারি নিয়ে সামান্য মাথাব্যথা নেই। এটা আসলে পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব। আমরা বর্তমানে যেই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আছি সেখানে পুঁজিই সব। দ্বীন ও নৈতিকতার কোন মূল্য নেই এখানে। আমাদের এমন পুঁজিবাদী মানসিকতার সুযোগ নিয়ে কিছু লিবারেল মিশনারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তরুণদের দ্বীনি বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

রবি টেন মিনিট স্কুলের কথায় ধরুন। দেখবেন তাদের অধিকাংশ কন্টেন্ট শিক্ষা বিষয়ক। কিন্তু মাঝে মাঝেই তারা লিবারেল নৈতিকতা বিষয়ক কন্টেন্টও তৈরি করছে। তাছাড়া এর কন্টেন্ট মেইকার এবং পাবলিক ফেইস সবাই লিবারেল চিন্তাচেতনার। তাদের ফেবু গ্রুপ এবং পেইজগুলো একটু পর্যবেক্ষণ করলেই আপনি প্রভাবটা বুঝতে পারবেন। উন্নত শিক্ষা ও উন্নত ক্যারিয়ারের নেশায় তরুণরা কীভাবে লিবারেল ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা টেন মিনিটের সহায়তায় তরুণদের কাছে যেই পরিচিতি পেয়েছে সেই পরিচিতিটা ব্যক্তিগতভাবেও লিবারেলিজম প্রচারে কাজে লাগছে। প্রতারণার একটা ব্যাপার হল, টেন মিনিটে এখন কিছু ইসলামী কন্টেন্টও যোগ করা হয়েছে। সূরার অনুবাদ, আরবী ভাষা শিক্ষার মত কিছু বিষয় তারা নতুন করে এনেছে। জানিনা ইসলামী সেক্টরটাতে কারা কাজ করছে। কিন্তু এটাকে দ্বীনের খেদমত মনে করা ভুল হবে। কারণ আপনি একটা লিবারেল প্রতিষ্ঠানের জন্য ধর্মীয় ইমেজ তৈরি করে দিচ্ছেন। আপনি তাদের পক্ষে দলিল ও বৈধতার সোপান হচ্ছেন। ইসলামী শিক্ষার প্লাটফর্ম কী এতোই অসহায় হয়ে গেল যে, আপনাকে একটা লিবারেল প্রতিষ্ঠানকে প্রমোট করতে হচ্ছে!

তাদের সব কন্টেন্ট নিয়ে এক পোস্টে আলোচনা করা সম্ভব না। আমি কিছু কন্টেন্ট আপনাদের সামনে আনতে চাচ্ছি। একটা ভিডিওতে সাকিব বিন রশিদ এবং মিথিলা নামক একজন অভিনেত্রী “মশারি পদ্ধতি” নিয়ে কথা বলছে। আসলে “মশারি পদ্ধতি” নাম দিয়ে উক্ত ভিডিওতে তারা নারী সম্পৃক্ত ইসলামের অকাট্য ও সুস্পষ্ট কিছু বিধানকে কটাক্ষ করে। একটা মেয়ের অশ্লিল ড্রেসাপ নিয়ে পিতামাতার বাধ্যবাধকতা আরোপ, ছেলে ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা, মেয়েদেরকে বিনা প্রয়োজনে সন্ধার পর বাইরে অবস্থান করতে না দেয়া- এই বিষয়গুলোকে তারা নাম দিচ্ছে মেয়ে সন্তান প্রতিপালনের মশারি পদ্ধতি। অথচ এগুলো ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। বাবা মা হল সন্তানের অভিভাবক। সন্তানের উপর তাদের অবশ্যই কর্তৃত্ব এবং দায়িত্ব আছে। সন্তানদের দ্বীন শিখানো এবং তাদেরকে দ্বীনি নির্দেশনার ভিতরে রাখা মা বাবার আবশ্যিক দায়িত্ব। গাইরে মাহরাম ছেলেদের সাথে ট্যুরে যাওয়া, বিনা প্রয়োজনে বাইরে অবস্থান করা, অশ্লিল পোশাক পরিধান এগুলো তো সুস্পষ্ট হারাম বিষয়। মা বাবার উপর আল্লাহর দেয়া এই দায়িত্বকে তারা মশারি পদ্ধতি বলে তাচ্ছিল্য করছে। আর তরুণীরাও মনে করছে, আসলেই তো; আমার পিতামাতা আমার উপর জুলুম করছে। মানে এই বিধানগুলো দিয়ে আল্লাহ তার উপর জুলুম করেছে! এভাবেই তারা তরুণ-তরুণীদেরকে দ্বীনের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে।

পিরিয়ডের ব্যাপারটা একটু বুঝুন। তারা পিরিয়ড নিয়ে সমাজের ট্যাবু ভাঙ্গতে চাচ্ছে। কিন্তু এর পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে ইসলামকে দেখানোর চেষ্টা করছে। আসলেই ইসলাম তাদের উদ্দেশ্যের পথে একমাত্র বাঁধা। আর তাদের উদ্দেশ্য পিরিয়ড সংক্রান্ত সচেতনতা কিংবা ট্যাবু ভাঙ্গা না। বরং পারিবারিক ও সামাজিক হায়া বা লজ্জা বিনষ্ট করে দেয়া। ইসলাম পিরিয়ড নিয়ে যত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছে এবং যেই সুস্পষ্ট ও সামগ্রিক নির্দেশনা দিয়েছে সেটা পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম ও মতবাদ পারেনি। কুরআন, হাদীস ও ফিকহের কিতাবগুলোতে এব্যাপারে কোন প্রকার জড়তা ছাড়াই মুসলিমদের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আয়েশা রাঃ মুসলিম মেয়েদেরকে ধমক দিয়ে বলেছেন যে, এই ব্যাপারে জানতে ইতস্তত হওয়া যাবে না। নবীজির কাছে তারা এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ভাল করেই জেনে নিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সামগ্রিক একটি মূল্যবোধ হল হায়া, শরম। এটা ঈমানেরও অঙ্গ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমার লজ্জা না থাকলে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে পারবা। অতি জঘন্য কাজ হলেও তোমার করতে ভয় লাগবে না। এই হায়ার সীমানার ভিতরেই ইসলাম পিরিয়ড সংক্রান্ত ব্যাপারকে সমাধান করেছে।

একটা হল প্রাথমিকভাবে সন্তান ও শিক্ষার্থীকে এব্যাপারে শিক্ষা দেয়া। এটা হায়া। আরেকটা হল এই বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করা, প্রয়োজনীয় ও যথার্থ ব্যবস্থা থাকার পরও প্রতিবার ব্যাপারটা সবাইকে জানাতে গর্ববোধ করা। এটা নির্লজ্জতা। স্বামী-স্ত্রীর মিলন একটা বৈধ বিষয়। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে বাইরে গল্পে লিপ্ত হওয়া নিকৃষ্ট কাজ। আল্লাহর রাসূল যারা এমন করে তাদেরকে জঘন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এই লিবারেল মিশনারীরা এটাই যাচ্ছে। তারা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের ভিতর পরস্পর যেই লজ্জাবোধ সেটাকে ভাঙ্গতে চাচ্ছে। কারণ তখন অজাচার, সমকামিতা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যাবে। ঐ যে নবীজি বলেছেন, হায়া চলে গেলে সব নিকৃষ্ট বিষয় সম্ভব ও স্বাভাবিক হয়ে যায়।

আমাদের ভাল করে যেই বিষয়টা বুঝতে হবে সেটা হল, মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? উবুদিয়্যাত। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর উবুদিয়্যাতের ধারণাটা অনেক ব্যাপক। মুসলিম জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের চূড়ান্ত ব্যাপার এই উবুদিয়্যাত। আমরা মনে করি ইসলাম নির্দিষ্ট কয়েকটা বিশ্বাস আর নামাজ রোজার মাঝেই সীমাবদ্ধ। অথচ ইসলামে বিশ্বাসের জায়গাটা বেশ প্রসারিত এবং আমলের সীমানাটাও অনেক বিস্তৃত। উবুদিয়্যাত আল্লাহর একটি রশ্মি এবং রহমত। আমাদের ক্যারিয়ার, আমাদের পরিবার, আমাদের পেশা, পড়াশোনা সব জায়গায় উবুদিয়্যাতের রশ্মি আগলে রাখতে হবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে, আমরা ক্যারিয়ারের পিছনে পড়ে উবুদিয়্যাতের রশ্মি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি কিনা। কারো কাছ থেকে শিক্ষা নিতে গিয়ে এই রশ্মিকে ছিন্ন করে দিচ্ছি কি না! অথচ মহান আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমরা তাঁর রশ্মিকে সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরি। যখনই আমরা উবুদিয়্যাতের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হব আমরা তাঁর রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়ে যাব। আর তখনই আমরা তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে খোদাদ্রোহী হয়ে যাব। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। (ইফতেখার সিফাত)

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *