নবীজি যখন ‘নবীউল মালহামাহ’! –লেখক: মাওলানা আতিক উল্লাহ

নবীজি যখন ‘নবীউল মালহামাহ’! –লেখক: মাওলানা আতিক উল্লাহ
আমরা যখন প্রিয় নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথা শুনি, তার সীরাত পড়ার ইচ্ছে করি, অথবা নবীজির কথা মানুষকে বলতে উদ্যত হই, তখন তাকে কোনরূপে উপস্থাপন করি?
.
= উম্মতের চিন্তায় অত্যন্ত পেরেশান। একজন অত্যন্ত স্নেহশীল পিতা। একজন আদর্শ স্বামী। একজন অত্যন্ত সচেতন দয়ালু প্রতিবেশী। তিনি অসুস্থ ইহুদি শিশুকে দেখতে যান। তার চলার পথে নিয়মিত ময়লা রাখে, এমন ইহুদির ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখেন। বেশিরভাগ মুসলমান নবীজির সীরাত পড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে! কী অসম্ভব মমতাময় একটা মানুষ! বিধর্মীদের প্রতিও তিনি দয়ার সাগর! (হারবী-যিম্মী নির্বিচারে!)। মুসলিম দেশে হানাদার কাফির ও ইসলামী রাষ্ট্রে আশ্রিত কাফেরের মাঝে কোনও বাছবিচার ছাড়াই তিনি দয়া করে গেছেন! এমনটাই বর্তমানে অনেকে মনে করেন।

-তাঁর ‘খুলুক’ কেমন?
-কুরআন কারীমই তার ‘খুলুক’!
একজন স্ত্রীই স্বামীর ভেতর-বাহির সম্পর্কে নখদর্পণী ওয়াকিবহাল হয়ে থাকেন! আর স্ত্রী যদি ‘আয়েশা’ রা.-এর মতো তীক্ষè মেধাবী ও প্রতিভাবান কেউ হন? যিনি নবীজিকেও জানেন ও বোঝেন পাশাপাশি কুরআনও তার কাছে অপরিচিত নয়, তাহলে তার পর্যবেক্ষণ অবশ্যই তলস্পর্শী সত্যছোঁয়া হবেই!

তার মানে নবীজি তার জীবনে পুরো কুরআনকে ধারন করেছিলেন। বাস্তবায়ন ঘটিয়ে গেছেন। কুরআন কারীম সমগ্র মানবতার জন্যে ‘সংবিধান’। কুরআনের দুইমলাটের মাঝেই রয়েছে কেয়ামত পর্যন্ত অনাগত মানুষের পথনির্দেশ! এই কুরআনকেই নবীজি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে গেছেন!

কুরআন বুঝতে হলে, সীরাত বোঝা জরুরী। আম্মাজানের কথা অনুযায়ী নবীজির জীবনটাই ছিল কুরআনের প্রায়োগিক দিক! তার প্রতিটি কাজ ছিল কুরআনেরই প্রকাশ্য রূপ! সীরাতকারগন নবীজির জীবনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে থাকেন:
এক: মক্কীজীবন। তের বছর। মক্কায় অতিবাহিত করা সময়টাকেই মক্কীজীবন বলা হয়।
দুই: মদনীজীবন। ১০ বছর। হিজরতের পর মদীনায় কাটানো দিনগুলোই মদনীজীবন।
——————
মক্কী যুগে মুসলমানদের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে, কুরাইশের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করার মধ্য দিয়ে। বাহ্যিকভাবে মুসলমানরা ছিল চরমভাবে কোনঠাসা অবস্থায়। প্রতি পদে পদে তারা অসহায়ভাবে মার খেয়ে যাচ্ছিল। উপর-উপর দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউ মনে করতে পারতো: এভাবে চলতে থাকলে, এরা শিঘ্রিই বিলুপ্তির দিকে যাবে। এতশত চাপ সহ্য করে কিভাবে টিকবে? কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে দেখলেই বোঝা যাবে, কাফেরদের সেই অমানুষিক নির্যাতনই মুসলমানদের ‘ঈমানের ভিতকে কতোটা পাষাণপোক্ত করে দিচ্ছিল, তাদের আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটাচ্ছিল। তাদেরকে আরও বেশি কষ্টসহিষ্ণু করে তুলছিল! তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্যে আরও কতো বেশি উপযোগী করে তুলছিল! তাদেরকে বিশ্বজয়ী ইস্পাতপ্রত্যয়ী করে তুলছিল! তাদেরকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম শারীরিক ও মানসিক ‘ফিটনেস বিল্টইন’ করে দিচ্ছিল!

মদনীজীবন ছিল ফসল তোলার সময়। মক্কীজীবনে অর্জিত-সঞ্চিত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটানোর সময়। মুসলমানরা মক্কীজীবনে জীবনবাজি রেখে আগলে রাখা ইসলামের মর্যাদা তারা রক্তমাংসে বুঝতে পেরেছিল। ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে বুকে লালন করা ইসলামের ভালোবাসার মূল্য তাদের কাছে অন্য এক অনন্যতায় উন্নীত ছিল। তের বছরের প্রস্তুতির প্রয়োগ কিভাবে হবে! আল্লাহর হিকমত বোঝা বান্দার সাধ্য নয়। রাব্বে কারীম মুসলমানদের ভেতরে সঞ্চিত শক্তির যথাযথ প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ করে দিলেন, জিহাদের বিধান জারী করার মাধ্যমে।

আল্লাহ অত্যন্ত হিকমতপূর্ণ পন্থায় সাহাবীগনকে গড়ে তুলেছিলেন। স্তরে স্তরে। ধাপে ধাপে। বিশ্ব-মানবতার নেতৃত্বদানের জন্যে। ঘষামাজা ছাড়া এমন উপযোগিতা তৈরী হওয়া সম্ভবই ছিলো না। নিবিড় তারবিয়তি পরিচর্যা ছাড়া এমন জানবাজ-আত্মত্যাগী দিগি¦জয়ী করে গড়ে তোলা সহজ ছিল না। এজন্য মদনীজীবনেও আল্লাহ তা‘আলা সাহাবীগনকে পর্যায়ক্রমে আগে বাড়িয়েছেন। অবশ্য আল্লাহ তা‘আলা চাইলে, কোনও মাধ্যম ছাড়াই সবকিছু করতে পারেন। বিশিষ্ট হানাফী ফিকহদি ইমাম সারাখসী রহ. এমনটাই ব্যক্ত করেছেন।

এবার আমরা ধাপগুলো দেখি:
প্রথম ধাপ: আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা রেসালতকে তাবলীগ করতে হুকুম করা হলো। পাশাপাশি মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলা হলো। তাদেরকে উপেক্ষা করতে বলা হলো:
-আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন! আর মুশরিকদের পরোয়া করবেন না! (হিজর:৯৪)।
একটু আগেই বলে এসেছেন:
-আমি পরম ঔদাসীন্যের সাথে ওদের ক্রিয়াকর্ম উপেক্ষা করুন (হিজর:৮৫)।

দ্বিতীয় স্তর: দাওয়াত দেয়ার পর বিতর্ক জন্ম নিবে। প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। ধেয়ে আসবে প্রপাগান্ডাল ঢল। এখন? দেখা যাক:
-আপনি হিকমত ও উত্তম ওয়াজের মাধ্যমে আপনার রবের দিকে দাওয়াত দিন (নাহল:১২৫)।
-আহলে কিতাবের সাথে উত্তমপন্থায় বিতর্ক করুন (আনকাবুত:৪৬)।

তৃতীয় স্তর: কিতালের অনুমতি প্রদান:
-যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো! কারণ তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে (হজ: ৩৯)।

চতুর্থ স্তর: কাফিররা যদি শুরু করে, তাহলে কিতালের ‘হুকুম’ প্রদান:
-যাদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে: আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ (হাজ:৪০)।

পঞ্চম স্তর: কিতালের হুকুম প্রদান। শর্তারোপ করা হলো, আশহুরে হুরুম-পবিত্র মাসসমূহ অতিবাহিত হতে হবে:
– আশহুরে হুরুম (রজব-জিলকদ-জিলহজ-মহররম) অতিবাহিত হয়ে গেলে, মুশরিকদের সাথে লড়াই করো!

ইমাম যাহহাক রহ. বলেন:
-এই আয়াত কাফিরদের সাথে কৃত সমস্ত চুক্তিকে নসখ-রহিত করে দিয়েছে। অবশ্য সূরা তাওবা নাযিল হওয়ার পরই কাফিরদের সাথে কৃত সমস্ত চুক্তি চূড়ান্তভাবে রহিত হয়ে গিয়েছিল। এটা ইবনে আব্বাস রা.-এর মতামত।

ষষ্ঠ স্তর: কোনও শর্ত ছাড়াই সরাসরি কিতালের আদেশ প্রদান:
-আল্লাহর পথে লড়াই করো এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু দেখেন (বাকারা: ২৪৪)।
-মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা করো (তাওবা ৫)।

কারো কারো মতে, কুরআন কারীমের আটচল্লিশ/চুয়ান্নটা সূরায় ১১৪ আয়াতে মুশরিকদের সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবগুলোই ‘নসখ’-রহিত হয়ে গেছে, তাওবার পঞ্চম আয়াতের মাধ্যমে।
————-
অনুমতি পেয়েই নবীজি কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। সারিয়া-গাযওয়া পাঠাতে শুরু করলেন। কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে! কুরাইশদের বিরুদ্ধে। আরবের বৃহতশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে! জাযীরাতুল আরবের দিকে দিকে ভয়-শংকা ছড়িয়ে পড়লো। সাহাবীদের তরবারির ভয়, মরুভূমির হিংস্রজন্তুর চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়ে কুফফারদের বুক কাঁপাতে শুরু করলো:
-আমাকে নুসরত প্রদান করা হয়েছে, সামনের দিকে একমাস দূরত্বে থাকতেই, কাফিরদের মনে ভীতিসঞ্চার করার মাধ্যমে। পেছন দিকেও একইভাবে নুসরত করা হয়েছে (সহীহ জামে: ৪২২১)।

সীরাতের পাঠক মাত্রই জানা আছে, কিতালের অনুমতি পাওয়ার পরপরই নবীজি কতোগুলো অভিযানের ইন্তেজাম করেছিলেন।
হিজরতের ছয় মাস পর থেকেই শুরু হয়েছিল অভিযান প্রেরণের কার্যক্রম।
নবীজি স্বয়ং অংশ নিয়েছেন ২৬টি অভিযানে। এর মধ্যে নয়টিতে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। সর্বমোট ৬০টা অভিযান প্রেরণ করেছেন এই দিনগুলোতে।
তারমানে নবীজি গড়ে প্রতি বছর দুইটির বেশি অভিযানে অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ মাসে একটি করে অভিযান। আর যদি আশহুরে হুরুমের বিধানকে ধরে নিয়ে চার মাসকে বাদ দেই, তাহলে প্রতি সাড়ে তিনমাস অন্তর অন্তর একটি অভিযানে বের হয়েছেন!

আর যদি সমস্ত অভিযানকে (৬০টি) হিশেবের মধ্যে আনলে, তাহলে প্রতি দুই মাসে একটি করে অভিযান প্রেরণ করা হয়েছে। আশহুরে হুরুম বাদ দিলে, হিশেব দাঁড়ায়, প্রতি মাসে একটি করে অভিযানে সাহাবায়ে কেরাম বের হয়েছেন।

একটি অভিযানে আসা ও যাওয়ার পেছনে সময় যদি ১৫ বা ২০ দিন ধরি, তাহলে দেখা যায়, সাহাবায়ে কেরাম মদনী জীবনের চারভাগের তিনভাগই কাটিয়েছেন নবীজির সাথে ‘কিতালে’।

মদনী জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল অভিযান আর অভিযান। একটা অভিযান থেকে মদীনায় ফিরে এসেছেন, একটু পরেই আরেকটা অভিযান রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। মদীনার চিত্রটাই এমন ছিল। সাড়ে নয় বছর ধরেই এটা একাধারে চলেছিল।

নবীগনের রেসালত প্রচারের ক্ষেত্রে আল্লাহর একটা ‘সুন্নাত’ হলো: অনেক ত্যাগ-কুরবানি করতে হয়। নবী ও তার উম্মতগন তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ ব্যয় করার পরই একটা ধর্মের বিজয় আসে। অনেক রক্তের বিনিময়ে একটা উম্মত আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। রক্তপাত নিজেদের এবং কুফফারের। বদর যুদ্ধের পর, যখন আটককৃত কুরাইশদেরকে বন্দী হিশেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হলো, আল্লাহ তা‘আলা নবীকে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন:
-নবীর পক্ষে উচিত নয় বন্দীদিগকে নিজের কাছে রাখা, যতক্ষণ না দেশময় ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে। তোমরা পার্থিব সম্পদ কামনা করো, অথচ আল্লাহ চান আখেরাত! আল্লাহ পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা।
যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকে লিখিত একটি বিশেষ ‘বিষয় (বিধান)’ না হতো, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, সেজন্য বিরাট আযাব এসে পৌঁছত (আনফাল: ৬৭-৬৮)।

কল্পনা করা যায়! আল্লাহর তার প্রিয় হাবীবকে কঠিনভাবে সতর্ক করছেন। এমনকি আযাবের হুমকিও প্রদান করেছেন। ভাবা যায়? কেন?
= কাফেরদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করার আগে কেন তাদেরকে বন্দীরূপে গ্রহণ করা হলো? আগে তো আল্লাহর যমীনে আল্লাহর কালিমা উঁচু হতে হবে, তারপর অন্য কিছু!

এই ছিলো পেয়ারা নবীর জীবন। বর্তমানের কয়জন যুবক নবীজির শারীরিক শক্তিমত্তার কথা জানে? যুদ্ধক্ষেত্রে তার শৌর্য-বীর্যের কথা জানে? সীরাতের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটা আজকালকার পাঠ্যসূচী থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। মায়েদের গল্প থেকে হারিয়ে গেছে। শিক্ষকের নসীহত থেকে উধাও হয়ে গেছে। খতীবদের বয়ান থেকে সযত্নে ছুটে গেছে। আমরা নবীজি সম্পর্কে শুধু জানি: তিনি দয়ার নবী। নবীর জীবনে: আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা, আল্লাহর জন্যে ঘৃণা করার ব্যাপার নেই। নবীজির জীবনে ওয়ালা-বারা বলে কিছু নেই। কিতাল বলে কিছু নেই।

আমরা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি, কেমন ছিল নবীজির শক্তি-সাহস! কেমন ছিল কঠিন মুহূর্তে নবীজির অবস্থান! কেমন ছিল যুদ্ধের ময়দানে নবীজির তৎপরতা!
(এক) আনাস রা. বলেছেন:
-নবীজি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। সবচেয়ে দানশীল মানুষ। সবচেয়ে সাহসী মানুষ।
একরাতে মদীনাবাসী এক বিকট আওয়াজ শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। সবাই আওয়াজের উৎসের দিকে ছুটে গেলো, সবাই অবাক হয়ে দেখলো, নবীজি সেদিক থেকে আসছেন। তিনিই সবার আগে সেদিকে গিয়েছিলেন। ফিরে আসতে আসতে তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন:
-ভয় পেয়ো না! ভয় পেয়ো না!
নবীজি তখন আবু তালহার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ছিলেন। ঘোড়ার পিঠে জিনপোষ ছিল না। মুখে লাগামও ছিল না। নবীজির গলার সাথে তলোয়ার ঝোলানো ছিল (বুখারী-মুসলিম)
এই হাদীসের অনেক ব্যখ্যা করা হয়। নবীজি সবার আগে একা একা অকুস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন। লাগাম ছাড়াই ঘোড়দৌড় করাতে পারতেন। অতি দক্ষ সওয়ার না হলে, লাগাম ছাড়া ঘোড়ায় চড়ার দুঃসাহস কেউ করবে না।

(দুই) নবীজি অসাধারণ ঘোড়সওয়ার ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে সবার আগে আগে থাকতেন। ময়দানের চরম বিপদজনক ফ্রন্টেও সাহাবায়ে কেরামকে পেছনে ফেলে, নবীজি এগিয়ে যেতেন। আলী রা. নবীজির সাহসিকত সম্পর্কে বলেছেন:
-বদরের দিন কঠিন পরিস্থিতিতে নবীজির কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন শত্রুদের একদম কাছাকাছি অবস্থানে। আমাদের চেয়ে এগিয়ে! সেদিন তিনি ছিলেন সবচেয়ে সাহসী দাপুটে যোদ্ধা! (আহমাদ)।

(তিন) কায়েস গোত্রের এক লোক বারা রা.কে প্রশ্ন করেছেন:
-তোমরা কি হুনাইনের দিন নবীজিকে রেখে ময়দান ছেড়ে দিয়েছিলে?
-হু! তবে নবীজি আপন জায়গায় অটল হয়ে ছিলেন। তার মধ্যে ভয়ের লেশমাত্রও ছিল না। হওয়াযিন গোত্রের লোকেরা ছিল অতি সুদক্ষ তীরন্দায! তাদের তীরবাযির সামনে আমরা টিকতেই পারছিলাম না। নবীজি তার শাদা খচ্চরের পিঠে অনঢ় হয়ে ময়দানে সাবেত কদম ছিলেন। আবু সুফিয়ান খচ্চরের লাগাম ধরে ছিলেন। নবীজি নিঃশঙ্ক অকম্প গলায় আবৃত্তি করে বলছিলেন:
আমি সত্য নবী, আমি মিথ্যা নবী নই (বুখারী-মুসলিম)।
শত্রুর দিক থেকে বৃষ্টির মতো তীর ধেয়ে আসছিল। বড় বড় বীররা তিষ্ঠোতে পারেন নি। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু নবীজি? তিনি পাহাড়ের মতো নিষ্কম্প হয়ে আগাগোড়া ময়দানে জমে ছিলেন।

বারা রা. আরো বলেন:
-যুদ্ধ যখন চরম সঙ্গীন আকার ধারন করতো, আমরা নবীজির কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতাম! আমাদের মধ্যে সেরা বীরেরাও নবীজির কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতো (মুসলিম-ভাবার্থ)।

যারা সারা বিশ্বে ঘোড়া দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আরব-আজমের রাজা-বাদশাদের গদি উল্টে দিয়েছেন, তারা পর্যন্ত নবীর কাছে আশ্রয় নিতো!

আমরা হামযার বীরত্বের কথা পড়ি! খালিদের দুঃসাহসিক অভিযানের কথা পড়ে চোখ বড় বড় করি, যোবায়ের-এর বীরত্বের কথা পড়ে চমকিত হই। মিকদাদ বিন আমরের শৌর্যের কথা পড়ে অবাক হই। রাদিয়াল্লাহু আনহুম। কিন্তু নবীজির বীরত্বের কথা আমাদের পড়ার বাইরে থেকে যায় অনেক সময়। নবীজির বীরত্বব্যঞ্জক তৎপরতার কথা মনে থাকে না। বড় বড় ডাকসাইটে বীর সাহাবীরাও যে যুদ্ধের ভয়াবহ পর্যায়ে নবীজির কাছে আশ্রয় খুঁজতো সেটা সামনে আনি না।

একেক সময় একেক সমস্যা দেখা দিত মদীনার জীবনে। অপ্রত্যাশিত বিপদ এসে উদয় হতো। নবীজি অটল! অন্যেরা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছে, নবীজি আক্রমণোদ্যত হয়ে সক্রিয় থেকে কাজ চালিয়ে গেছেন। সাথীরা পিছু হটে গেলেও, তিনি অবিচল!
আত্মবিশ্বাসের সাথে ‘একে’ গুপ্তহত্যা করতে লোক পাঠাচ্ছেন। ‘ওকে’ শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করতে বলছেন। ‘তার’ রক্তকে বৈধ ঘোষণা করছেন। এই কবীলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ওই কবীলার ঘরবাড়ি-বাগানফসল বিধ্বস্ত করে দিচ্ছেন। পুড়িয়ে দিচ্ছেন! সমস্ত পুরুষকে হত্যা করছেন, নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করে নিয়ে আসছেন। তাদের ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দিচ্ছেন!

ইহুদিনেতা কা‘বা বিন আশরাফকে হত্যার জন্যে পাঠিয়েছেন। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে। সাথে আওস গোত্রের তার তিনভাইকেও। মুহাম্মাদ ইহুদি কবির কল্লা কেটে নিয়ে এল। খুশিতে নবীজির চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

কা‘ব বিন আশরাফ-হত্যায় আওস গোত্রের অসামান্য কীর্তি দেখে, খাযরাজ গোত্রে ‘গিবতাহ’ হলো। তারা পিছিয়ে থাকতে চাইল না। তারাও নবীজির কাছে আরেক দুষ্ট ইহুদি সাল্লাম ইবনু আবিল হুকাইককে হত্যার অনুমতি চাইল! সানন্দে অনুমতি দিলেন।

মক্কায় প্রবেশ করলেন নবীজি। প্রায় বিশজনেরও বেশি নারী-পুরুষের রক্ত হালাল বলে ঘোষণা দিলেন। এমনও বললেন:
-তারা যদি কা‘বার গিলাফ ধরেও ঝুলে থাকে, তবুও তাদেরকে হত্যা করো!
আবদুল উযযা বিন খাতাল সত্যি সত্যি আত্মরক্ষার্থে কা‘বার গিলাফ ধরে ঝুলেছিল। নবীজিকে এ-সংবাদ পৌঁছানো হলো। তিনি নির্দ্বিধায় বলে দিলেন:
-তাকে হত্যা করো!

নবীজি যে কাজ শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার ওফাতের পরও সে ধারা বন্ধ হয় নি। পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধের পর থেকে, আব্বাসী খিলাফাহর মাঝামাঝি পর্যন্ত যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল ‘ইকদামী’ অভিযান! দিফায়ী নয়।
ইকদামী হলো, নিজেরা আগে বেড়ে কুফফারকে আক্রমণ করা। দিফায়ী হলো, আক্রান্ত হলে রুখে দাঁড়ানো। পাশ্চাত্যের প্রপাগান্ডার প্রভাবে কিছু লোক মনে করে, ইসলামে কোনও ইকদামী অভিযান নেই। সবই দিফায়ী। মানে ইসলাম শান্তির ধর্ম! তারা যুদ্ধ করে না। যাও করেছে, সেগুলো আত্মরক্ষার্থে করেছে! ভ্রান্তির সীমা থাকা উচিত!

নবীজি তার শিষ্যদেরকে সাহসিকতার শিক্ষ দিয়ে গিয়েছিলেন। আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। শিষ্যরা অক্ষরে অক্ষরে সে শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তারা শিক্ষা পেয়েছিলেন: কিতাল ছাড়া উম্মাহর কোনও গৌরব নেই। সম্মান নেই। ইজ্জত নেই। তারা জানতেন:
-যে নিজে বিজয়ী হতে এগিয়ে যায় না, সে বিজিতই থেকে যায়!

সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন কুরআন ও হাদীসের বাস্তব প্রতিফলন। তাদেরকে বলা হলো:
-তোমরা তার (আল্লাহর) রাস্তায় জিহাদ করো
তারা একবাক্যে লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছেন (মায়েদা:৩৫)।

তাদেরকে বলা হয়েছিল:
-তোমরা বের হয়ে পড়ো স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে! (তাওবা:৪১)।
= লাব্বাইক!

তাদেরকে বলা হয়েছিল:
-তোমরা আল্লাহর রাস্তায় কিতাল করো (বাকারা: ১৯০)
= লাব্বাইক!

তাদেরকে বলা হয়েছিল:
-আর তারা যদি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের কাছে সাহায্য কামনা করে, তবে তাদের সাহায্য করা তোমার কর্তব্য (আনফাল: ৭২)।
= নির্দ্বিধায় লাব্বাইক!

তাদেরকে বলা হয়েছিল:
-অতঃপর তোমরা যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তখন তাদের গর্দান উড়িয়ে দাও! (মুহাম্মাদ: ৪)
= সানন্দে লাব্বাইক!

তাদের রব তাদেরকে বলেছিলেন:
-নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জানমাল ক্রয় করে নিয়েছেন, জান্নাতের বিনিময়ে (তাওবা: ১১১)।
= তারা বলেছেন আমরা এই লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তিকে বাতিল করবো না!

যখনই তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ আসতো, তারা একবাক্যে সবাই বলে উঠতো:
-আমরা শুনলাম এবং মানলাম! (বাকারা: ২৮৫)।
তারা নবীজির দিকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারতো না:
-জিহাদ এখন ফরয হয়েছে? ফরয হলে সেটা ফরযে আইন নাকি ফরযে কেফায়াহ? সুন্নাত নাকি ওয়াজিব? এখনই বের হতে হবে নাকি বিলম্ব করলেও চলবে?

তাদের রব তাদেরকে বলেছিলেন:
-তোমার তোমাদের রবের ক্ষমার দিকে ধাবিত হও (আলে ইমরান: ১৩৩)।
= তারা সত্যি সত্যি দ্রুত ধাবিত হয়েছিল। ইবনুল হুমাম রা.-এর হাতে খেজুর ছিল, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলার সময় বললেন:
-আমি এই খেজুরগুলো খেয়ে শেষ পর্যন্ত দেরী করলে, সময়টা দীর্ঘ হয়ে যাবে, আমাকে দ্রুত রবের ডাকে সাড়া দিতে হবে! জান্নাতে যেতে হবে!

তারা কোনও পরিস্থিতিতেই ভীত হতেন না। তারা নিজেদের সংখ্যার কমবেশি হওয়া নিয়ে ভাবিত হতেন না:
-যখন মুমিনরা শত্রুবাহিনীকে দেখল, তখন বলল: আল্লাহ ও তার রাসুল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তার রসুল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পায় (আহযাব: ২২)।
আরো স্বীকৃতি আছে:
-মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি (আহযাব: ২৩)।
নবীজি সা. ও সাহাবায়ে কেরাম রা. কথায় বিশ্বাসী ছিলেন না, কাজে বিশ্বাসী ছিলেন একদিক থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান নাযিল হয়েছে ,আরেক দিকে তারা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে পড়েছেন! কারো কোনও নিন্দার ভয় করেন নি। কারো চোখ রাঙানির ভয় করেন নি। কারো সমালোচনার শংকায় পিছু হটেন নি। আল্লাহ আর তাদের মাঝে কোনও অন্তরায় ছিলো না।

আমরা কাকে অনুসরণ করবো?
-তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উসওয়ায়ে হাসান। উত্তম আদর্শ (আহযাব: ২২)।

নবীজি বলে গেছেন:
-আমি রহমতের নবী। আমি মালহামার নবী (আহমদ)
= মালহামা মানে মহাযুদ্ধ।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *