[১]
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ মানে বিবাহ পরবর্তী ধর্ষণ—স্বামী কর্তৃক ধর্ষণ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Marital rape বা spousal rape. বয়সে শব্দটা খুব বড় নয়—গত শতকের শুরুর দিকেও এটি অচেনাই ছিল। মুসলিম বিশ্ব তো বটেই, অমুসলিম অনেক দেশও এই ধারণাটিকে অদ্যবধি সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করেনি।
কয়েকদিন আগেও দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের এক প্রশ্নে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বৈবাহিক ধর্ষণের ধারণাটি প্রত্যাখান করে। অদ্যবধি বাংলাদেশের আইনেও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ শব্দটিকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
মুসলিম বিশ্বের বাইরেও এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে ধর্ষণের জন্য গুরুতর শাস্তির ব্যাবস্থা থাকলেও আইনত বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকারই করা হয় না। এর কারণ কি? ফাঁকটা কোথায়?
[২]
বিয়ে বিষয়টা কি, একটু বুঝা যাক। পাশ্চাত্যের ধারণায় বিয়ে হলো নিছক কো-হ্যাবিটেশন। ‘বৈধ যৌন সম্পর্ক’ কথটাও আর সেখানে বোধহয় প্রযোজ্য নয়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি নিছক কো-হ্যাবিটেশন? মুসলিম বিশ্ব কিংবা পাশ্চাত্যের বাইরে অন্য সভ্যতাগুলো কিন্তু তা বলে না। একটু খেয়াল করুন—
ক.
পরিবারের ঘানি টানতে গিয়ে পুরুষেরা আত্মহুতি দেয়। পাশ্চত্যের বাইরে প্রায় সব সভ্যতার দৃশ্য একই। পাশ্চাত্যের ভেতরেও যে এ দৃশ্য একেবারেই চোখে পড়েনা, তা নয়। নিজের পিতার দিকে লক্ষ্য করুণ, কথাটা বুঝে আসবে। মাতারাও অনেক পরিশ্রম করে, আত্মহুতি দেয়।
খ.
পরিবারে আমরা সবাই সবার প্রতি অধিকার দেখাই—স্বামী স্ত্রীর প্রতি, স্ত্রী স্বামীর প্রতি; পিতা পুত্রের প্রতি, পুত্র পিতার প্রতি। স্ত্রী-সন্তানরা শপিং করার জন্য স্বামীর প্রতি অধিকার দেখান না, একটু জোড় খাটান না—এমনটা বিরল। পরিবারে পুরুষ কিন্তু আনন্দের সাথেই সেসব আবদার গ্রহণ করেন, যদিও কষ্ট হয়।
বুঝা যাচ্ছে, আমাদের সভ্যতায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেবল কো-হ্যাবিটেশন নয়, এখানে অনেক সেকরিফাইসও আছে।
[৩]
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ শব্দটি প্রয়াগের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখুন—
ক.
বিবাহের উদ্দেশ্যই হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে শারীরিকভাবে তৃপ্ত করবে। কাজেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক সম্পর্ক হয়। এজন্য স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য আকর্ষণীয়। স্বামী-স্ত্রীর শরীর পরস্পরকে টানে, আকর্ষণ করে—এটাই স্বাভাবিক। ধর্ষনের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
খ.
স্ত্রীর এই মিলনটি তার সাথেই হচ্ছে, যার সাথে সে ইতিপূর্বেও বহুবার মিলিত হয়েছে। উভয়ের প্রতি উভয়ে আকৃষ্টও হয়েছে— বার বার, বহুবার। চেনা শরীর, চেনা অনুভূতি। এই পুরুষটি তার জন্য ত্যাগস্বীকারও করেছে বহু। তাহলে এক্ষেত্রে স্ত্রীর যদিবা কোনো আপত্তি থেকেও থাকে, সে আপত্তির প্রকৃতি ও গভীরতা কেমন হবে—ধর্ষকের প্রতি যেমন আপত্তি, তেমন? একটু চিন্তা করুন, জট খুলে যাবে।
গ.
স্ত্রীর এই আপত্তির প্রকৃতিকে আমরা তিনটি শ্রেণীতে রাখতে পারি—
১. স্বাভাবিক বা হালকা আপত্তি; এটাকে স্বাভাবিক অর্থে বিরক্তিও বলা যায়।
২. জোড়ালো আপত্তি, কিন্তু স্বামীর সোহাগের প্রেক্ষিতে তা পরিবর্তীত হয়। তখন স্ত্রীও ঔৎসুক হয়ে ওঠে।
৩. শেষ অবদি জোড়ালো আপত্তি বজায় থাকা এবং এই আপত্তির মুখেই জোড়পূর্বক মিলিত হতে বাধ্য হওয়া।
এই তিন প্রকার আপত্তির মধ্যে প্রথম দুটি একেবারে স্বাভাবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দুইটিই হয়ে থাকে। এই দুইটি স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার গণ্ডির মধ্যেই পরে। একে ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ বলারও সুযোগ নেই।
তৃতীয় প্রকারটি অস্বাভাবিক—স্ত্রীর কোনো প্রকার অসুস্থতা ছাড়া এ ধরণের আচরণ একবারেই বিরল। কারণ মানুষের শারীরিক চাহিদা তাকে এতবারে শেষ পর্যন্ত নিস্পৃহ থাকতে বাঁধা দিবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে ব্যাতিক্রমটা ঘটে, তার বহু কারণ আছে।
[৪]
এবার বলি, ইসলাম কি বলে।
নারী-পুরুষ পরস্পরের সম্মতিতে স্বাভাবিকভাবে মিলিত হবে—এটাই ইসলামেরও পছন্দ। রাসুলুল্লাহ (স) সফর থেকে ফেরার সময় মদীনায় এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন, সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করতেন না।
একবার নববিবাহিত হজরত জাবের রা. সরফ থেকে ফিরে সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে তিনি বাঁধা দেন। তিনি (সা) বলেন,
“তোমরা অপেক্ষা করো; পরে রাতে অর্থাৎ এশা নাগাদ ঘরে যাবে, যাতে নারী তার অবিন্যস্ত চুল আচড়ে নিতে পারে প্রবাসি স্বামীর স্ত্রী ক্ষুর ব্যাবহার করতে পারে।” [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৮৬৫]
আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত অন্য একটি জয়ীফ হাদিসে তিনি বলেন,
“তিনটি বিষয় নির্দয়তা—তার একটি হলো, যখন কোনো পুরুষ কোনো প্রকার সংবাদ ছাড়াই স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়। সংবাদ হলো : রসিকতা ও চুম্মন। কারও উচিত নয় তার স্ত্রীর উপর ষাঁড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া।”
এই হাদীসগুলোকে সামনে রাখলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, রাসুলুল্লাহ সা. স্বামী-স্ত্রীর কেমন মেলামেশাকে পছন্দ করতেন।
এখন বলি অগ্রাধিকারের প্রশ্নে—স্ত্রী যদি আপত্তি করে তাহলে? শরীয়াহ এই আপত্তির কারণ জানতে চাইবে। আপত্তির কারণ হতে পারে—
১. ঋতুস্রাব বা গর্ভপরবর্তী রক্তপাত।
২. স্বামীর এমন কোনো যৌন আচরণ, যা শরীয়াহ সমর্থন করে না। যেমন : পায়ুপথে সঙ্গম।
৩. শারীরিকভাবে স্ত্রীর অসুস্থ থাকা, যে অবস্থায় মিলন সম্ভব নয়।
৪. স্বামী কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত, মিলনের ফলে স্ত্রীর শরীরে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা আছে।
৫. স্বাভাবিক বিরক্তি বা মিলনে অনিচ্ছা। অর্থাৎ, উপর্যুক্ত কোনো কারণ নেই; নিছক মানসিক বিরক্তির কারণে আপত্তি।
প্রথম চারটি ক্ষেত্রেই শরীয়াহ নারীর অনিচ্ছাকেই প্রাধাণ্য দিবে, এক্ষেত্রে স্বামী কোনো প্রকার জোরাজুরি করতে পারবে না। জোর করলে বরং স্ত্রী আদালতের দ্বারস্ত হতে পারবে। পঞ্চম ক্ষেত্রে ইসলাম স্ত্রীকে বলবে নমনীয় হতে, পুরুষের ইচ্ছাকে প্রাধাণ্য দিতে। কারণ—
১. ইসলাম বড় ক্ষতি থেকে বাঁচতে ছোট ক্ষতিকে স্বীকার করে নেয়। স্ত্রী সহবাস না করলে স্বামী অন্য কোনো নারীকে আক্রমণ করেও বসতে পারে; তখন ক্ষতিটা আরও বেশি হবে। স্ত্রীরে চেয়ে সেই নারীর কষ্ট নিশ্চয় অনেক বেশি হবে, সাথে লঞ্ছনাও যোগ হবে।
২. ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে ‘গায়ের পোশাক’এর মতো— নৈকট্যে ও ভালোবাসায়। কাজেই একটু জোর খাটাতে অসুবিধা কোথায়! জোর তো উভয়েই খাটাবে, এতে সম্পর্ক আরও নিবির হবে।
৩. স্বামী-স্ত্রীর সহবাস বিষয়টিই এমন যে, শেষ অবদি দু’জনেই আনন্দ পায়, যদিও শুরুতে কোনো একজন বিরক্ত থাকে। শতকরা নব্বইভাগ ক্ষেত্রে অবস্থা এমনই।
[৫]
এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি অস্বাভাবিক কেন হলো?
সভ্যতা যখন অতিমাত্রায় বস্তুবাদের দিকে ধাবিত হয়, তখন ত্যাগের প্রবণতা কমে যায়, স্বার্থপরতা সৃষ্টি হয়। এই পরিবেশে মানুষ অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। পারিবারিক সম্পর্কগুলো তখন ভঙ্গুর হয়ে যায়—স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক আকর্ষণ আর কাজ করে না। শুরুতে সম্মতি না থাকলেও শেষ অবদি সম্মতি ফিরে আসার যে প্রবণতা, সেটি তখন আর কাজ করে না।
এর আরেকটা কারণ পরকিয়া প্রেম। শরীরের একটা স্বাভাবিক চাহিদা থাকে, সে চাহিদা লিমিটেড।; অফুরন্ত নয়। কোনো স্ত্রীর পরকিয়া থাকলে খুব সম্ভব সে আর স্বামীর সাথে শারীরক সম্পর্কে আগ্রহী হবে না। শেষ অবদি আনন্দ পাওয়ার যে ব্যাপর, সেটাও আর কার্যকরী হবে না। পশ্চিমের ঘটনাগুলোও সব এমনই। স্ত্রী অফিস আদালতে বন্ধু-বান্ধব বা বসের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, ঘরে ফিরছে ক্লান্ত হয়ে, শারীরিকভাবে নিস্পৃহ হয়ে। এই অবস্থায় স্বামীর সোহাগ তো অসৈহ্য হবেই— এই অজাচিত সোহাগ থেকে বাঁচতেই ওদের আইন লাগবে; স্বামীকে ফাসানোর আইন। পরকিয়া না থাকলে স্বামীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিতান্তই হাস্যকর।
যে সভ্যতা পরকিয়াকে প্রমোট করতে চায়, তার প্রয়োজন ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ শব্দটি । স্বামী-স্ত্রীর নিবিড় সম্পর্ককে উপভোগ করতে চায় যে সভ্যতা, তার বৈবাহিক ধর্ষণের মতো নোংরা শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই।
[আগের লেখাটা অনেকটা ফিকহি ধাঁচের ছিল। ফাজায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকেও একটা আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি]
১
শুরুতেই জানা দরকার ফরজ ও নফল সম্পর্কে ইসলামের দর্শনটা। যাকিছু অত্যাবশ্যকীয়, যা নির্ধারিত না হলে শরীয়াহর কাঠামোই নষ্ট হবে—তাকে শরীয়াহ ফরজ করেছে। ফরজকে পালনের নির্দেশ দিয়েছে (হারাম থেকে বাঁচাও ফরজ)।
যেসব বিষয় শরীয়াহর মূল কাঠামো নির্ধারক নয়, তবে শরীয়াহর সৌন্দর্য বর্ধক ও রুচি নির্ধারক, সেগুলোকে নফল সাব্যস্ত করা হয়েছে। নফল পালনের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, এর বহু ফাজায়েলও বর্ণনা করা হয়েছে।
নফলগুলোর মাধ্যমে শরীয়াহর রুচি ও সৌন্দর্য বোঝা যায়। নফলকে বাদ দিয়ে শুধু ফরজ পালনের মাধ্যমে শরীয়াহর মূল সৌন্দর্য ও রুচি ফুটে ওঠে না।
একটা উদাহরণ দেই। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অধিকার প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
“স্ত্রীদের প্রতি তোমাদের অধিকার হলো তারা তোমাদের গৃহে অবস্থান করবে, তোমাদের অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না। এ ছাড়া কোনো অধিকার তোমাদের নেই।” [তিরমিজি, হাদিস নং : ১১৬৩]
এই হাদিসের আলোকে ফকীহগণ একটা নাজুক মাসআলা বের করেন। হাদিসটির আলোকে তাঁরা বলেন, ঘরের রান্না-বান্না নারীদের জন্য শরীয়াহ নির্দেশিত ফরজ নয়। স্ত্রী খাবার প্রস্তুত করতে অস্বীকৃতি জানালে স্বামী আইনের আশ্রয়ও নিতে পারবে না, তাকে বাধ্য করতেও পারবে না। একই হাদিস থেকে প্রমাণ হয়, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করাও স্ত্রীর জন্য ফরজ নয়। [মুফতি তাকী উসমানী, ইসলাহি খুতুবাত ২/৪৩]
এখন চিন্তা করুন—স্ত্রীরা যদি শুধু এই ফরজের উপরে আমল করেন, তাহলে? পুরো সাংসারিক ব্যাবস্থাই এতে ভেঙ্গে যেতে পারে। মূলত শরীয়াহ ফরজ ও হারাম শব্দদ্বয় দিয়ে কঠোরভাবে ব্যাক্তিগত অধিকারগুলোকে সংরক্ষণ করে আর নফলের মাধ্যমে পারস্পারিক সম্পর্ককে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। এজন্য ফরজগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নফলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
স্বামীর উপরে অনেক কিছুই ফরজ করা হয়নি সত্য, তবে সেগুলোকে নফল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একই কথা স্ত্রীর ক্ষেত্রেও। এই নফল নির্দেশনাগুলোকে এড়িয়ে গেলে সংসার কখনোই সুখের হবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন :
“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ এবং আত্মীয় স্বজনকে দান করার আদেশ দেন।” [সুরা নাহল : ৯০]
সদাচারণ (ইহসান) হচ্ছে অপরকে তার প্রাপ্য অধিকারের চাইতে বেশি দেওয়া এবং নিজের অধিকার নেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি না করা, কিছু কম হলেও কবুল করে নেওয়া। [মা’আরিফুল কুরআন, ই.ফা. ৫/৩৮৩]
কারও থেকে পাওনার চেয়ে কম নেওয়া ফরজ নয়, তবুও আল্লাহ তায়ালা ইহসানের নির্দেশ দিয়েছেন। পারস্পারিক সম্পর্কে নফলের গুরুত্ব এখান থেকেই বুঝা যায়। এখন চিন্তা করুন—ইহসানের হকদার স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে হতে পারে!
২
পরিবারে আমাদের নারীরা নানাভাবে নির্যাতিত। এই কথাটা বোধহয় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আসমানী ধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠানোর দায়িত্ব ইসলাম ও মুসলমানেরই সবচেয়ে বেশি ।
নানা কারণে নারীদের শারীরিক চাহিদা পুরুষের চেয়ে অনেক কম দেখা যায়। কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করুন—
- বিভিন্ন প্রকার স্ত্রীরোগে আক্রান্ত ও হরমোনজনিত সমস্যা।
- নানা কারণে নারীরা পুষ্টি ঘাটতিতে ভুগে। শারীরিক দূর্বলতা তাদের যৌন চাহিদাকেও হ্রাস করে।
- সংসারে কাজের চাপে নারীরা অধিকাংশ সময় অত্যন্ত ক্লান্ত থাকে। এই ক্লান্তির মধ্যে শারীরিক চাহিদার বিষয়টি কাজ করে না। কারণ এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন।
- নারীদের একটা বড় অংশকে প্রতিমুহূর্তে নানা ধরণের সাংসারিক চাপ মোকাবেলা করতে হয়। এই চাপে শারীরিক চাহিদাগুলো হাড়িয়ে যায়।
- নবদম্পতির ক্ষেত্রে এর বাইরেও অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকে যা নারীর যৌন চাহিদাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে।
পুরুষের উচিত স্ত্রীর এই সমস্যাগুলো বুঝে তা নিরসনের ব্যাবস্থা করা। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করা। নিজের যৌন চাহিদা পূরণের পূর্বে তাকেও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। যৌনতার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে স্ত্রীর কোনো দূর্বলতা থাকলে তা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া এবং এ ক্ষেত্রে ইহসান করা। সাথে সাথে নিজেও ধৈর্যধারণ করা।
একটা কথা আমরা একবারেই ভুলে যাই— স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলনও একটা শিল্প, এটি একটি উত্তম ইবাদতও। কাজেই একে সুন্দর করা চাই, শৈল্পিক করা চাই। কোনো একজনের অনিচ্ছা কিংবা অপ্রস্তুতির মধ্যে এই শৈল্পিকতা সম্ভব নয়। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
“তিন বিষয় নির্দয়তা—তার একটি হলো, যখন কোনো পুরুষ কোনো প্রকার দূত বিনিময় ছাড়াই স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়। সংবাদ হলো : রসিকতা ও চুম্মন। কারও উচিত নয় তার স্ত্রীর উপর ষাঁড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া।”
৩
যৌনতা কিন্তু একপাক্ষিক নয়, দ্বিপাক্ষিক। স্বামীর ন্যায় স্ত্রীও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ। কাজেই স্বামীর উচিত স্ত্রীর চাহিদার প্রতিও যথাযত খেয়াল রাখা।
ইমাম আল-গাজালি রাহ. লিখেছেন—
“পুরুষের বীর্যপাত হলে কিছুক্ষণ এমনিভাবে থেমে থাকবে, যাতে স্ত্রীর প্রয়োজনও মিটে যায়। কেননা কখনও কখনও স্ত্রীর দেরিতে হয়; তখন পুরুষের সরে যাওয়া তার জন্য পীড়ার কারণ হয়। … স্বামীর উচিত প্রতি চার দিনে একবার সহবাস করা। অবশ্য এর চেযে বেশি-কমও হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে স্ত্রীর চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা স্ত্রীকে সতী রাখা স্বামীর উপরে ওয়াজিব।” [আল-গাজালি, এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ২/৫০]
স্ত্রীর হকের দিকে দৃষ্টিপাত করেই ফকিহগণ বলেন, চার মাসের বেশি সফরের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। স্ত্রী অনুমতি না দিলে সে সফর বৈধ হবে না। যদিও তা হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ সফর হয়। [মুফতি তাকী উসমানী, ইসলাহি খুতুবাত ২/৫৪]
৪
বিশ্বাসী নারীর প্রতি আবেদন—
মানবসভ্যতা এই মুহূর্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছে। চারিদিকে চলছে শয়তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উৎসব। পরিকল্পিতভাবে যৌনতাকে প্রমোট করা হচ্ছে ঈমান ধ্বংসের অস্ত্র হিসেবে। শয়তানের এই কূটচালের ফলাফল হিসেবে সমাজে বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে অশ্লীলতা, অযাচার, ধর্ষণ ও সমকামিতার মতো নোংরামি। মানবতার এই দূর্দিনে ঈমানদার নারীদের রয়েছে বিরাট দ্বায়িত্ব। আপনার দায়িত্বে অবহেলা হতে পারে মানবসভ্যতা ধ্বংসের কারণ।
আপনি চিন্তা করুন তো— বিরাট সমুদ্রের মধ্যে এক টুকরো চর; সেটিও যদি ডুবে যায়, তাহলে এর অধিবাসীদের কি হবে? প্রিয় বোন, চারদিকে অশ্লীতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র, মাঝখানে একটুকরো চর, একটা ছোট দ্বীপ—স্বামী-স্ত্রীর হালাল সম্পর্ক; এই চরটুকুও যদি মাথাচারা দিয়ে ভেসে না থাকে তাহলে এই সভ্যতার কি হবে?
প্রিয় বোন, স্বামীর বৈধ ডাকে সারা দিন, একটু কষ্ট করে হলেও। আপনি সারা না দিলে শয়তান এই চরটুকুও ধ্বংস করে ছাড়বে। আপনি পুলকিত হোন, আপনার স্বামী আপনার কাছেই আবদার করেছে, নষ্ট লোকের মতো বাইরে নোঙর ফেলেনি।
প্রিয় বোন, আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন—আল্লাহ তায়ালা আপনার কষ্টের বিনিময় দিবেন জান্নাতে; শুধু স্বামীর চাহিদা পূরণের বিনিময় নয়, একটা সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর বিনিময়!
লেখকঃ মুজাজ্জাজ নাঈম