বাচ্চাদের হােমস্কুলিং-এর একটা স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ করছে নাদিয়া আপু, তিথি সহ একটা সিন্ডিকেট। মােটামুটি ১০-১২ বছর বয়েস অব্দি কীভাবে হােমস্কুলিং করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এন্ট্রি নেওয়া যায়, একটা স্কুলের সাথে এ বিষয়টা নিয়ে একটা সিস্টেম ডেভেলপ করার চেষ্টা করছে। এটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই একজন আলােকিত নারীর আলােকিত কান নগদে করে বসল বিদ্রোহ;
- ‘সব বুঝলাম। কিন্তু তােদের ইসলামপন্থীদের এই একটা বাতিক আমি কোনােভাবেই মানতে পারি না, তেতে ওঠে ইউরােমুগ্ধতা। মেয়েরা এখন চাঁদে চলে যাচ্ছে। আর তােরা এখনও মেয়েদের, ঘরেই টেনে রাখছিস। নারীশিক্ষার ব্যাপারটা ইসলামের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাস তােরা, সব হুজুরদের এই একটা টেন্ডেন্সি আমি দেখেছি। মেয়েদের স্কুলে যাবার বিরুদ্ধে, নারীশিক্ষা সহ্যই হয় না এদের।
- “শিক্ষা কাকে বলে? বল’, উত্তেজনাকে খেলতে হবে স্থিরতা দিয়ে। আগুনকে খেলতে চাই পানি, আগুনকে আগুন দিয়ে বিলকুল খেলতে নেই।
- এটা কেমন প্রশ্ন? শিক্ষা আবার কাকে বলবে? শিক্ষা মানে শেখানাে?
- কী শেখানাে?’, রুমার গালটা নেড়ে দেয় তিথি। শােনাে হে অবলা নারী, তােমার এই ‘শিক্ষা’র সংজ্ঞার ভিতরেই সব রহস্য, সর্ষের ভিতরেই ভূত’।, ইচ্ছে করে রাগায় মেয়েটাকে। তিথির স্বভাবই এটা। গায়ে মেখে লাভ নেই।
- মানে কী? কী বলতে চাচ্ছিস?’, চশমার উপর দিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি হানল রুমা।
- ‘মানে’, হেলান দিয়ে লম্বা কথার প্রস্তুতিটা নিল তিথি। আজ পশ্চিমা বিশ্ব। ‘নারীশিক্ষা’র বয়ান দিচ্ছে আমাদের। নারীদেরকে যে শিক্ষিত করতে হয়, এবং এটাও যে একটা কাজ, বিশেষ মনােযােগের দাবি রাখে—এটা ইউরােপকে মুসলমানরাই শিখিয়েছে। নারীদের ব্যাপকহারে শিক্ষিত করা—এটা ইসলামের পেটেন্ট। তবে এখানে কথা আছে, বন্ধু’, বিজ্ঞের মতাে দেখাচ্ছে তিথিকে, মহিলা শেয়াল পণ্ডিত।
- ‘ঝেড়ে কাশাে’, শীতল কণ্ঠে।
- আচ্ছা, আয় দুজনে মিলে কাশি।
ইউরােপ যখন ‘খ্রিস্টধর্ম-সামন্তসমাজ’ থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদ’ সেট-আপে আসছে, মােটামুটি অষ্টাদশ শতকে। সেটাকে বলে এনলাইটেনমেন্ট’-এর যুগ। নতুন করে সব কিছুর সংজ্ঞা ঠিক করা হচ্ছে। শিক্ষা’র সংজ্ঞাও বদলে গেল। আগে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল— লিখতে-পড়তে পারা, শৃঙ্খলা শেখানাে আর নৈতিক চরিত্র গঠন। আর এখন তার সাথে যােগ হলাে:
নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য যােগ্য নাগরিক তৈরি,
নতুন অর্থব্যবস্থার জন্য কর্মী তৈরি যারা চাকুরিতে আসবে।
নতুন ব্যক্তি’ তৈরি, যারা ‘সফলতা’র নতুন সংজ্ঞার জন্য প্রস্তুত হবে।[১]
এখন তাে সারা পৃথিবীই পুঁজিবাদের কজায়। ফলে বর্তমান ‘সেকুলার শিক্ষা এই পুঁজিবাদী উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এটুকু বুঝলি?
- “আচ্ছা’, জানার আর ভাবার বিষয় এগুলােই।
- তা হলে ‘নারীশিক্ষা’ মানে কী দাঁড়াচ্ছে?
মেয়েদেরকে তাদের দেওয়া রাষ্ট্র-কাঠামাের যােগ্য নাগরিক বানানাে।
পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থার কর্মী বানানাে।
‘ব্যক্তি হিসেবে মেয়েদের তৈরি করা, যারা ধর্মকে ঝেড়ে ফেলে নিজের নৈতিকতার মাপকাঠি ঠিক করতে পারে। নিজেকে পশ্চিমাদের সংজ্ঞায় যেটা ‘সফলতা’ সেভাবে গড়ে তুলতে পারে। খ্যাতি-অর্থ-পদ-আধুনিকতার দাসে পরিণত হতে পারে। মনে আছে তাে, সেদিন ‘স্বাধীনতা নিয়ে কী আলােচনা করেছিলাম?[২]
- ‘মনে থাকবে না মানে। এত অ্যাটিপিক্যাল কথাবার্তা ভােলা যায়?’, ঝগড়াই বেধে গিয়েছিল সেদিন। তবে কিছু টোকা তাে লেগেছেই।
- এখন তাের ‘নারীশিক্ষা’ মানে যদি হয় ‘এই’, তা হলে ইউরােপের বাকি সব সংজ্ঞার মতাে, ঐ নারীশিক্ষার সাথেও ইসলাম একমত না। এই যে এদেশের বড়াে বড়াে আলিমগণ যে এই সেক্যুলার ‘নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলেন, এই কারণে বলেন।
- ‘ওওও’, আলােকিত মগজে সন্ধ্যের আবছায়া।
- আর কী শেখানাে হচ্ছে শিক্ষার নামে। ‘পশ্চিমা শিক্ষা দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টই হলাে: পাশ্চাত্য সভ্যতার মহান ধারণাগুলাে যেন বুঝিয়ে দেওয়া যায় শিক্ষার্থীদের। কেননা এই আইডিয়াগুলাে চিরন্তন, ধ্রুব সত্য এবং সর্বযুগের সমাধান [৩]
১৮৩৪ সালে ভারতে শিক্ষা প্রসারের জন্য কমিটি করা হয়। এর প্রধান ছিলেন লর্ড মেকলে। স্কীমের রিপাের্টে কমিটির উদ্দেশ্য হিসেবে লেখেন—
“বর্তমানে এমন একটি শ্রেণী তৈরি করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা নেওয়া উচিত, যারা আমাদের ও আমাদের মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজাদের মাঝে ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করবে। এরা হবে এমন একটা শ্রেণী, যারা রক্তে-গায়ের রঙে তাে ভারতীয়, কিন্তু রুচি-মতামত-নীতি-বিচারবুদ্ধিতে হবে ইংরেজ। এই শ্রেণীর কাছে আমরা দায়িত্ব দেব তাদের দেশী প্রচলিত কথাগুলােকে সংস্কার করার এবং পশ্চিমা পরিভাষা নিয়ে তাদের স্থানীয় ভাষাগুলােকে সমৃদ্ধ করার। তাদেরকে আমরা যানবাহন হিসেবে দেব বিভিন্ন ডিগ্রি, যাতে চড়ে তারা এই জ্ঞান পৌঁছে দেবে বাকি জনগণকে’ |[৪]
- আর কিছু বলতে হবে?’, জবাবে মাথা নাড়ে রুমা। বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা। বর্তমান সেকুলার শিক্ষার উদ্দেশ্য তােমার আমার মাথায় পাশ্চাত্য ভােগবাদী কালচার গেঁথে দেওয়া, যাতে আমি তাদের পণ্যের বাজার হই, চাকুরির নামে তাদের শ্রমিক হই। দেখ, ছােটোবেলা থেকে শেখায়, ‘এইম ইন লাইফ’ ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব। শেখায় না যে ব্যবসায়ী’ হব, উদ্যোক্তা হব।
কিন্তু মেয়েদেরও যে শিক্ষাদীক্ষার দরকার, সেটা যে ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার, আর বিবেকবান প্রজন্ম বানাতে শিক্ষিত মায়ের যে কোনাে বিকল্প নেই’- এটা নেপােলিয়নবাবু বলার আগেই সমাজে প্রচলন করে ফেলেছে ইসলাম। এজন্যই বললাম “পেটেন্ট।
- পশ্চিমা সেকুলার শিক্ষা বাদ দিলাম, ইসলাম কেমন শিক্ষার কথা বলে।
- আচ্ছা। এখানে তিনটে বিষয়:
শিক্ষার পরিবেশটা কেমন?
কী শেখানাে হচ্ছে? কারিকুলাম?
শেখার উদ্দেশ্য কী? কী প্রােডাক্ট বেরােচ্ছে?
- ওকে।
তিনটা পয়েন্টেই প্রচলিত পুঁজিবাদী শিক্ষার সাথে ইসলামের সংঘর্ষ রয়েছে। আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। পুঁজিবাদ একটা বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি, একটা মাপকাঠি, যেটা ইউরােপ থেকে এসেছে। আর ইসলাম আরেকটা বিপরীত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ওয়ার্ল্ডভিউ, আলাদা মাপকাঠি। পুঁজিবাদের মাপকাঠি মানুষের তৈরি। আর ইসলামের স্ট্যান্ডার্ড সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দেওয়া।
ইসলাম বলছে-সহশিক্ষা হারাম, পর্দা ফরজ [৫] তােমাদের ফ্রিমিক্সিং মানি না।
ইসলাম বলছে- ইলম শেখা ফরজ। ইলম কী? আভিধানিক অর্থ না, পারিভাষিক অর্থ নিতে হবে। নবিজি যে অর্থে বলেছেন, সাহাবারা যে অর্থে বুঝেছেন, সেটা। ইলম হলাে ‘ইলমে ওহি’ – কুরআন-হাদীস৷ কারিকুলাম হবে ইলমভিত্তিক। তােমাদের পাশ্চাত্য দর্শন গেলানাে কারিকুলাম চলবে না।
আর তিন, ইসলাম বলছে- এই শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে, মা’রিফাত (আল্লাহকে চেনা) কেননা জিন ও মানুষকে আল্লাহ তাঁর পরিচয় অর্জন ও তাঁর দাসত্বে জীবন কাটানাের জন্য সৃষ্টি করেছেন। নাস্তিক বানানাে শিক্ষা চলবে না।
- কিন্তু বন্ধু তিথি, এখানে একটা কথা আছে। শুধু কুরআন-হাদীস শিক্ষা দিলে কি চলবে? নামাজ-রােজা [৬] ছাড়া মেয়েরা কি আর কিছুই শিখবে না। দুনিয়া কত এগিয়ে গেছে, মানুষ মঙ্গলগ্রহে চলে যাচ্ছে, আর মুসলিম কত মেয়েরা পিছিয়ে আছে।
- ‘তাের আর কি দোষ, প্রায় শতভাগ মুসলিমেরই এই ধারণা। ইসলাম বলতে ইবাদাত ছাড়াও যে আরও বহুকিছু, ২০০ বছরের উপনিবেশ আমল সেকথা আমাদেরকে ভুলিয়েই দিয়ে গেছে। যে ইসলাম পরিবারনীতি শেখায়, যে ইসলাম সমাজ পরিচালনা শেখায়, শেখায় সমরনীতি কিংবা অর্থনীতি—সেই ইসলামকে লুকিয়ে রাখা শিখিয়েছে। চিনিয়ে গেছে ‘ধর্ম যার যার’ টাইপ ইসলাম, করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস৷ যেন এসব ইসলামের অংশই না’, টেবিলের লাগােয়া শেলফ থেকে ডায়েরিটা টেনে নেয় তিথি। উলটে যায় পৃষ্ঠারা কালাে রক্ত বুকে নিয়ে।
- তা হলে?
- শােন তবে’, পড়ে চলে তিথি। কারিকুলাম হবে ইলমে ওহি-ভিত্তিক [৭] কুরআন-হাদীস তাে আছেই। এর সাথে তা থেকে উৎসারিত-
ইসলামি অর্থনীতি- যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা।
• রাষ্ট্রবিজ্ঞান- ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা
• ফিকহ বা ইসলামি আইনশাস্ত্র- দণ্ডবিধি, পারিবারিক আইন, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন, মুসলিমের অধিকার-কর্তব্য।
• ইসলামি নীতিশাস্ত্র বা ইথিকস
• ওহিভিত্তিক ব্যবসায় শিক্ষা বা ক্রয়বিক্রয়, পার্টনারশিপ কারবার নীতিমালা
• আরবি সাহিত্য ও ব্যাকরণ।[৮]
• ইতিহাস ।
• গণিতশাস্ত্র। এখনকার ক্যালকুলাস দিয়ে ভাবলে হবে না। তারা ব্যবসায়িক জমা-খরচ ও উত্তরাধিকার বণ্টনের অংকই শিখত মেইনলি। আর বীজগণিত তাে আরও পরের আবিষ্কার।
• এ ছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা আছে যেমন, এস্ত্রয়ডারি ডিজাইন, ক্যালিগ্রাফি, [৯] অনুলিপিকরণ, স্থাপত্য, জ্যামিতিক নকশা করা। – তাহারাত বা পবিত্রতা, মানে পরিচ্ছন্নতা, পার্সোনাল হাইজিন এবং
জীবাণুমুক্তকরণ শেখা- আজকের প্রিভেনটিভ মেডিসিন [১০] যাকে বলে।
• আর চিকিৎসাবিজ্ঞান- ডাক্তার হিসেবে আম্মাজান আয়িশা রা. এর খ্যাতি ছিল ব্যাপক। শুধু মেডিসিন না,[১১] সার্জারিতেও[১২] তিনি ছিলেন বিখ্যাত। আরেকজন নারী সাহাবি বিখ্যাত ছিলেন। শিফা বিনতে আবদুল্লাহ।[১৩] মেডিকেল রিলেটেড টপিক বলে শেষ দুটো কান লাগিয়ে শুনল রুমা।।
‘হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে প্রধানমন্ত্রী(উজিরে আযম) নিজাম-উল-মুলক তুসী রহ. ফর্মাল কারিকুলাম তৈরি করেন। যাকে বলা হয় “নিজামী সিলেবাস”। দর্শন, কালামশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, মেডিসিন, প্রকৌশল সব-সহ প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়ানাে হতাে। (এখন শুধু প্রথম তিনটি পড়ানো হয়) একই কারিকুলাম পড়ানাে হতাে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই।
মুঘল আমলে ভারতের মেয়েদের সিলেবাস ছিল আরবি গ্রামার, গণিত, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন এবং অন্যান্য বিজ্ঞান সহযােগে।
শুধু ভারতেই না, এই যে, ইয়েমেনে যাইনাব আল-মুয়াইয়াদি [১৪] শিখছেন গ্রামার, তর্কশাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, ফিকহ, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য। সেখানকার সিলেবাসেরও একটা ধারণা কিন্তু পাওয়া গেল।
- আচ্ছা… বেশ বেশ।
- অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা। মানে বাচ্চা বয়সেই, বেতন ছাড়াই, সরকারি পলিসি বানিয়ে, কারিকুলামের মধ্য দিয়ে, পশ্চিমা মতবাদগুলাে শেখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
১৪০০ বছর আগে, যখন মানুষ গণশিক্ষা-র কথা কল্পনাও করতে পারত না। তখন ইসলাম ফরয করেছে ন্যুনতম প্রাথমিক ইলম শিক্ষা। [১৫] নারী-পুরুষ-বাচ্চা-বুড়াে। নির্বিশেষে। ক্যান ইউ ইমাজিন?
এখানে আমরা আরেকটা ভুল করি। ইসলাম বাধ্যতামূলক করেছে ওহিভিত্তিক জীবনঘনিষ্ঠ ইলম। যেটুকু মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে সব্বাইকে জানতেই হবে, সেটা ফরজ। অনেকে আবার এটাকে সেট করে সেকুলার শিক্ষায়; পিএসসিএসএসসি পাশকে ফরজ বানিয়ে ফেলে। আজকের ‘শিক্ষা’ আর ‘ইলম’ এক জিনিস না। শিক্ষা মানে পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষা, মানবরচিত মাপকাঠি। আর ইলম হলাে আল্লাহর মাপকাঠি শেখা। আর ওহিভিত্তিক ইলম মানে শুধু ইবাদত না, ২৪ ঘণ্টায় যে যে ক্ষেত্রে একজন মানুষ কাজ করে সবকিছুকেই কাভার করে (এগুলোও তো ইবাদাতের অংশ! লেখক কেনো ইবাদাত লিখেননি বুঝতে পারিনি আসলে!)। কেবলই যেটা বললাম।
- ‘মােটকথা আমাদের একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা সভ্যতা ছিল’, রুমা ‘ঔন’ করছে। নিজের মনে করছে।
এটা একটা বিরাট ব্যাপার। জাতীয়তাবাদ আমাদের ‘ডিজ-ঔন’ করা শিখিয়েছে। আরাকানীরা আমার কেউ না। সিরিয়ান শিশুরা। ইরাকী, ইয়েমেনী, লিবিয়ান, সােমালি, ফিলিস্তিনী। তারা বাংলাদেশী না, সাে আমার কেউ না ওরা। নবিজি আমাদের এটা শেখাননি। আমাদেরকে ‘ঔন(Own)’ করা শিখিয়েছেন। উম্মাহ শিখিয়েছেন। দেহের মতাে, মাথাও আমার, পা-ও আমার। যে-কোনাে এক জায়গায় অসুখ হলে পুরাে দেহ ভােগ করতে শিখিয়েছিলেন। আর পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের জাতীয়তাবাদ শিখিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে উম্মাহ।
- হ্যাঁ। অতএব, পশ্চিম থেকে কোনাে দর্শন কোনাে ধারণা নেওয়ার দরকার নেই আমাদের। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিনিময় হতে পারে। কিন্তু এনলাইটেনমেন্টের ওসব মানবীয় সংজ্ঞা, ওসব মাপকাঠি আমাদের দরকার নেই।
আমাদের রয়েছে স্রষ্টাপ্রদত্ত সংজ্ঞা ও ভালােমন্দের মাপকাঠি। হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম— কিন্তু ইসলাম ধর্ম না। ইসলাম হলাে দ্বীন, জীবনবিধান, লাইফস্টাইল, ওয়ার্ল্ডভিউ। কবে যে বুঝব এসব আমরা… , তিথির দীর্ঘশ্বাসে ডায়েরির পাতায় উল্টোয় না। ডায়েরিরই পাতা উল্টোতে হাত লাগে, হাত। কেবল দীর্ঘশ্বাসে কিছুই হয় না, কিচ্ছু না।
- বুঝে ফেলেছি প্রায়। টেনশন নিস না।
- দেখ রুমা। ইউরােপ যেমন তাদের এনলাইটেনমেন্ট যুগে খ্রিস্টধর্মকে খেদিয়েছে। ভ্রষ্ট ধর্মকে সমাজ-রাষ্ট্র থেকে হটিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করেছে। আর সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি পরিচালনার জন্য বানিয়েছে মানবরচিত কিছু নিয়মকানুন। এখন তাদের সেই নিয়মকানুনগুলাে মুসলিম দেশে দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। সরকারকে দিয়ে সেক্যুলার পলিসি করিয়ে ‘ধর্ম যার যার’ করে দিয়েছে। সত্যধর্ম ইসলামকেও হটিয়ে দিয়েছি আমরা, ইসলাম এখন শুধু মাসজিদে। মাসজিদে ঢুকার সময় প্যান্ট গুটায় ছেলেরা, আবার বেরিয়ে ছেড়ে দেয়। এজন্য আজ ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সমাজ, ইসলামি বাজার ব্যবস্থার দেখা মেলা ভার।
• ফলে যে পরিবেশে ইসলাম মেয়েদের শিক্ষার কথা বলেছিল, সেকুলার স্কুলকলেজ- ভার্সিটিতে সেই পরিবেশ আর নেই। শিক্ষকের হাতে ছাত্রী বা সহপাঠীর কাছে সহপাঠিনীর ধর্ষণ-হয়রানি এগুলাে এখন সয়ে গেছে ।
• যে শিক্ষা ইসলাম মানবজাতির জন্য এনেছিল, সেকুলার কারিকুলামে সেই শিক্ষা আর নেই। কারিকুলাম এখন পাশ্চাত্য দর্শনকে জোর করে ধ্রুব সত্য বানানাের হাতিয়ার।
• শিক্ষার মাধ্যমে ইসলাম যে পবিত্র মানুষ গড়ে তুলতে চাচ্ছিল, সে মানুষ বের হবে না সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থায়। এই শিক্ষায় ডিগ্রি আসে, মনুষ্যত্ব আসে না।
সুতরাং যদিও ইসলাম নারীদের শিক্ষিত করার কথা বলে, কিন্তু সেটা বর্তমান সেকুলার শিক্ষা না। সেটা সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা না। বর্তমান সহশিক্ষা ব্যবস্থা কোনােভাবেই ইসলামে জায়েয না, কম্বাইন্ড স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়া জায়েয না।[১৬]
- তা হলে মেয়েরা কী শিখবে? বসিয়ে তাে রাখা যায় না একেবারে।
- নেপােলিয়নের কথা খুব চলে: শিক্ষিত মা দাও, শিক্ষিত জাতি দিচ্ছি। পুঁজিবাদী শিক্ষা তাে মা-কে জার্নালিজম শেখাচ্ছে৷ জার্নালিজম শিখে মা বাচ্চাকে কি শিক্ষিত করবে। যদি শিক্ষিত জাতি-ই দরকার, তা হলে শেখানাে তাে দরকার ছিল ‘চাইল্ড এডুকেশান’, ‘নিউট্রিশন’, ‘চাইল্ড-সাইকোলজি’ এগুলা।
আর মা-কে শিখিয়ে পাঠাচ্ছ জবে, সারাদিন। আর এদিকে বুয়ার কাছে জাতি খুব শিক্ষিত-বিবেকবান হচ্ছে, না কি? আমার ডিগ্রি পুঁজিবাদের কাজে আসছে। পাবলিকের সার্ভিসে লাগছে। ভেবে দেখ, আমি মাস্টার্স পাশ, ফার্স্ট ক্লাস। আমি ৯টা-৫টা ব্যাংকে, আর আমার সন্তানকে পড়াচ্ছে মেট্রিক-ইন্টার পাস মানুষ। তা হলে শিক্ষিত জাতি গঠনে আমার ডিগ্রির কী ফায়দা?
অথচ ইসলাম এটাই করতে বলছে। আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ হােমম্যানেজার হতে যা যা শিখতে হবে, ইসলামের দৃষ্টিতে সেটাই নারীর প্রকৃত শিক্ষা। নারী শিক্ষা নেবে, প্রয়ােজনীয় শিক্ষা, যেটা জীবনে তার লাগবে। আর নিজের পুরাে । মেধা-শিক্ষা-শ্রম প্রয়ােগ করবে ঘরে৷ এটাই তার অফিস, তার প্রতিষ্ঠান, তার ফার্ম। তার আসল ‘ক্যারিয়ার। যেখানে তৈরি হবে শিক্ষিত আদর্শ জাতি, গড়ে উঠবে ইসলামি সভ্যতা।
রেফারেন্সঃ
[১] The new social and economic changes also called upon the schools, public and private, to broaden their aims and curricula. Schools were expected not only to promote literacy, mental discipline, and good moral character but also to help prepare children for citizenship, for jobs, and for individual development and success. [https://www.britannica.com/topic/education/Western-education-in-the-19th-centuryl
ডাবল স্ট্যন্ডার্ড ২.০ বইয়ের প্রথম গল্পে ‘ব্যক্তির পশ্চিমা সংজ্ঞার সাথে মিলিয়ে নিন।।
[২] ডাবল স্ট্যন্ডার্ড ২.০ বইয়ের প্রথম গল্পের আলােচনাটা তিথি সবার সাথেই করে।
[৩] Perennialism দর্শন।
‘For Perennialists, the aim of education is to ensure that students acquire understandings about the great ideas of Western civilization. These ideas have the potential for solving problems in any era. The focus is to teach ideas that are everlasting, to seek enduring truths which are constant, not changing, as the natural and human worlds at their most essential level, do not change? (Philosophical Perspectives in Education, Oregon State University SCIROT
[৪] Minute on Indian Education, 2nd February, 1935; Thomas Babington Macaulay, point 12.
[৫] পর্দা কেন প্রয়ােজন ও সহশিক্ষার ফল কী দাঁড়িয়েছে ইউরােপে সেটা বড়াে আলােচনা। লেখকের গােটা একটা বই-ই এর উপর—‘মানসাঙ্ক’ নাম। আগ্রহীরা দেখতে পারেন। আজ ইউরােপকে অনুসরণ করলে। ইউরােপের মত খেসারত দিতে আমরা তৈরি আছি তাে? অলরেডি খেসারত দিতে হচ্ছে। সংক্ষেপে সহশিক্ষার বাস্তবতা দেখুন ডাবল স্ট্যন্ডার্ড ২.০ বইয়ের পরিশিষ্ট ২০।
[৬] নামাজ-রােজা নিছক ধর্মীয় আচার নয়। মানুষের আত্মিক জীবনে, দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে, ব্যক্তিগত “ভ্যাস-নিয়মানুবর্তিতায়, সমাজ-জীবনে, কর্মজীবনে, অর্থ ও বাজারব্যবস্থায়, রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থায় এর প্রভাব তাম ও অপরিসীম। এজন্য এগুলােকে বলা হয়েছে দ্বীনের খুঁটি। এই সামগ্রিক সিস্টেমের ভিত্তিই ঈমাননামাজ-রােজা-যাকাত-হাজ্জ।
[৭] এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে? তা হলে কি রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান-মানে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ‘ইলম’ না? পরিশিষ্ট ১৩ দ্রষ্টব্য। বড়াে আলােচনা, গল্পের ভিতর করা গেল না।
[৮] মুসলিম স্পেনে বেশ ক’জন মহিলা কবি-সাহিত্যিক ছিলেন যাদের খ্যাতি পুরাে সাম্রাজ্যব্যাপী ছিল। ৩য় হিজরি শতকে সেভিলের মারইয়াম বিনতে ইয়াকুব মহিলাদের সাহিত্যের প্রফেসর ছিলেন। এছাড়া বুজায়া। শহরের গাসসানিয়া, সেভিলের দাদী আসিয়া, গ্রানাডার নাজন, স্বভাবকবি ওয়াল্লাদা প্রমুখ খুবই মশহুর ছিলেন। মক্কার খাদিজা নুওয়াহরী, যাইনাব বিনতে কামালুদ্দিন হাশেমী, মরক্কোর সারা বিনতে আহমাদ, উন্মে। হুসাইন বিনতে কাযীয়ে মক্কা, উম্মে আলি বিনতে আবুল ফরজ সূরী প্রমুখের কাব্যচর্চা ইতিহাস মনে রেখেছে।
[৯] ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হস্তলিপিবিদ্যা একটি বহুল চর্চিত ও প্রয়ােজনীয় বিষয় ছিল। বহু নারী লিপিকার রাষ্ট্রীয় অনুলিপিকারের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের মাঝে কাতেবা বিনতে আকরা বাগদাদী ছিলেন ‘উস্তায’ পর্যায়ের। আরও ছিলেন লুবনা উলুসী, মুযনাহ উলুসী৷ কেবল কর্ডোভা শহরের পশ্চিমাঞ্চলে ১৭০ জন আলিমা ছিলেন যারা কুরআন অনুলিপি করতেন। এছাড়া সাফিয়া বিনতে আবদুল্লাহ উন্দুলুসী, ফখরুমি। শুহদা বিনতে আহমাদ (উপাধি ছিল লিপিকার), আয়িশাহ বিনতে উমারা ইফ্রিকিয়াহ প্রমুখ ক্যালিগ্রাফি জগতে বিখ্যাত ছিলেন।
[১০] দেখুন লেখকের আরেকটি বই ‘কষ্টিপাথর’, শুদ্ধি প্রকাশনী।
[১১] ইবনু আবী মূলায়কা আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা-কে বললেন, আমরা আপনার কবিত্ব ও বাগ্মীতা। দেখে চমৎকৃত হই না। কারণ আপনি আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কন্যা। আর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বাগ্মীতা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু আপনি চিকিৎসাবিদ্যা কীভাবে শিখেছেন? আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লে বাইরে থেকে আগত প্রতনিধিদল তার চিকিৎসা করত। আমি সেগুলাে মনে রাখতাম। (হাকিম, মুসতাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১)
[১২] সাহাবি উরওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “আমি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে অন্য কোনাে মহিলাকে ইলমে তীব ও অস্ত্রপচার বিদ্যার অতীব পারদর্শী হতে দেখিনি। (মুহাম্মাদ ইবনু সাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭৫)।
[১৩] শিফা বিনতে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, একদিন তিনি হাফসা রা. এর সাথে বসে ছিলেন। নবিজি স. এলেন এবং বললেন, কেন তুমি তাকে (আম্মাজানকে) রােগের চিকিৎসা শেখাচ্ছ না যেমন তাকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছ? ( আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদ)।
[১৪] মৃত্যু ১১১৪ হি.
[১৫] ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। (ইবন মাজাহ, হাদীস : ২২৪; তবরানী-আওসাত, হাদীস : ৯)।
[১৬] সালাফী ফতােয়া : islamqa.info এর ফতােয়া নং ১২৮৯৯৬ ও ১২০০ । The meeting together, mixing, and intermingling of men and women in one place, the crowding of them together, and the revealing and exposure of women to men are prohibited by the Law of Islam (Shari’ah).
দেওবন্দের ফতােয়া: https://www.darulifta-deoband.com/ এর প্রশ্ন নং 48955 ও 781 এবং https://timesofindia.indiatimes.com/india/Deoband-says-co-education-unlawful/articleshow/2182795.cms
প্রবন্ধাংশটি ডা. শামসুল আরেফিন লিখিত “ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ২” বই থেকে নেয়া।