আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবীদের পরিচয়।

আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবীদের পরিচয়।

সমগ্র বিশ্বে এ আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবী সম্প্রদায় সংঘবদ্ধভাবে না পূর্বে কখনাে ছিলাে আর না এখন আছে। শুধুমাত্র হিন্দুস্থানই এমন একটি দেশ, যেখানে কোথাও কোথাও এ দলটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এটাও অবশ্য ব্রিটিশ শাসনামলে, নচেৎ এর পূর্বে এ সম্প্রদায়টির নাম ও নিশানা হিন্দুস্থানসহ পৃথিবীর কোথাও ছিলাে না। হিন্দুস্থান তথা ভারত উপমহাদেশে যখন ইসলাম এসেছে তখন থেকে নিয়ে ব্রিটিশদের আগমন পর্যন্ত এর সকল অধিবাসী হানাফী ছিলাে, কেউ লা-মাযহাবী ছিলাে না।
স্বয়ং লা-মাযহাবী সম্প্রদায়ের মুজাদ্দিদ ও শীর্ষ আলেম নওয়াব সিদ্দীক খান পর্যন্ত এ রূঢ় সত্যকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ তরজমানে অহহাবিয়্যাতে লিখেছেন:

তরজমানে অহহাবিয়্যা : পৃ. নং ২০)
অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশে মুসলামানদের সার্বিক অবস্থা এই যে, যখন থেকে এখানে ইসলাম এসেছে তখন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত (অর্থাৎ ব্রিটিশদের আগমন পর্যন্ত) এর অধিবাসীরা হানাফী মাযহাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাে এবং এখনাে আছে এবং এখানে এই মাযহাবেরই আলেম, বিদ্বান, বিচারক ও মুফতীর ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এ দলটি এতই বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সম্প্রদায় যে, এদের মূলনাম আজও অমীমাংসিতই থেকে গেছে। প্রথমদিকে এ দলটির কোনাে নামই ছিলাে না। পরবর্তীতে নিজেদেরকে এরা আহলে হাদীস, মুহাম্মাদী ও মুওয়াহহিদী বললেও সমাজে এরা গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাযহাবী ও ওহাবী নামে পরিচিতি পায়।

সুপ্রসিদ্ধ লা-মাযহাবী আলেম মুহাম্মাদ শাহ শাহজাহানপুরী নিজে স্বীকার করতঃ স্বীয় গ্রন্থ আল ইরশাদ ইলা সাবীলির রাশাদে লিখেছেনঃ
অর্থাৎ সম্প্রতি হিন্দুস্থানে এমন একটি অপরিচিত মতবাদের উন্মেষ ঘটেছে, যে সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ একেবারেই অনবগত। অতীতে এ চিন্তাধারার লােক কোথাও নামমাত্র থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এতাে বেশী কখনাে দেখা যায়নি। ইদানিংকালেই শুধু তাদের নাম শােনা যাচ্ছে। এরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বা মুহাম্মাদী বা মুওয়াহহিদ বলে, কিন্তু প্রতিপক্ষ দলে এদের নাম গাইরে মুকাল্লিদ, অহাবী বা লা-মাযহাবী বলে সম্বােধন করা হয়। (আল ইরশাদ ইলা সাবীলির রাশাদ: পৃ. নং ১৩)
এ নবউদ্ভাবিত দলটির প্রতিষ্ঠাতার নাম মৌলভী আব্দুল হক বেনারসী (মৃত: ১২৭৬ হি.), যিনি শহীদ সাইয়েদ আহমাদ রহ. এর মুজাহিদীন দল থেকে বহিস্কৃত ছিলেন।

লা-মাযহাবী দলের অন্যতম প্রধান ইমাম শাইখুল কুল ফিল কুল (একচ্ছত্র মহান ব্যক্তিত) বলে পরিচিত মৌলভী নযীর হুসাইন দেহলবীর উস্তাদ মাওলানা আব্দুল খালেক স্বীয় সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ তাম্বীহুয যাল্লীনে লিখেছেন:
অর্থাৎ এই নবআবিস্কৃত দল তথা গাইরে মুকাল্লিদীনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৌলভী আব্দুল হক বেনারসী, যিনি কিছুদিন যাবত বেনারসে অবস্থান করছিলেন। (এবং চার মাযহাবের ইমামগণের তাকলীদ অস্বীকার করে নতুন একটি ফেরকার সূত্রপাত করছিলেন। হযরত আমীরুল মুমিনীন সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. তার এ ধরনের অসংখ্য ভ্রান্ত কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে দল থেকে বহিস্কার করে দেন এবং হারামাইন শরীফাইন তথা মক্কা ও মদীনার উলামায়ে কিরাম (তার জঘণ্য কর্মকাণ্ডের জন্য) তাকে হত্যা করার ফতােয়া প্রদান করেন। কিন্তু (এ যাত্রায়) সে কোনােরকমে তথা থেকে পলায়ন করে বাঁচে। (তাম্বীহুয যালীনঃ পৃ. নং ৩১, আহলে হাদীস আওর ইংরেজ: পৃ. নং ১৯)

মৌলভী আব্দুল হক বেনারসী ১২৪৬ হিজরীতে শহীদ সাইয়েদ আহমাদ রহ. এর দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে ভারতবর্ষে প্রথম লা-মাযহাবী ফেরকার সূচনা ও ভিত রচনা করেন। এজন্য বর্তমান আহলে হাদীস নামধারী এ লা-মাযহাবী দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও ভিত্তিস্থাপনকারী বলে তিনি স্বীয় মতাদর্শের অনুসারীদের নিকট স্বীকৃতি পান। তিনি বেনারসে বসেই তার মিশনের কার্যক্রম শুরু করেন এবং সেখানেই সর্বপ্রথম জামিয়া সালাফিয়া বেনারস’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজো বিদ্যমান।

অবশ্য আব্দুল হক বেনারসী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ দলটিকে সাংগাঠনিক ও সংঘবদ্ধরূপে একটি অগ্রসরমূখী বড় মিশন হিসেবে তুলে ধরেন শাইখুল কুল ফিল কুল বা একচ্ছত্র মহান ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত মাওলানা সাইয়েদ নীর হুসাইন দেহলবী। তিনি রচনা, লেখনী, বক্তৃতা ও অসামান্য মেহনত করে এ নবজন্মা । দলটিকে একটি পূর্ণ দলরূপে দাঁড় করিয়ে এর মতাদর্শ জনগণের নিকট তুলে ধরেন। এরপর এর প্রচার বাড়তে থাকে এবং সুবিধান্বেষীরা এ নতুন মতের ছায়ায় নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নেয়। আর এভাবেই ব্রিটিশামলে জন্ম নেয়া এ দলটি সব ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের মিশন এগিয়ে নিয়ে যায়।

লা-মাযহাবী দলের উত্থানের প্রেক্ষাপট

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, ইংরেজ শাসনামলের পূর্বে এদের কোনাে নাম-নিশানাও পাওয়া যায় না। অখণ্ড ভারতে এ দলটির উত্থান ব্রিটিশ সরকারের কৃপা ও নেক নজরেরই বিষফল। ব্রিটিশ শক্তি যখন উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এ উপমহাদেশে তাদের অভিশপ্ত পা রাখলাে তখন নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব স্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রথমত তারা মুসলমানদের মাঝে অনৈক্যের বীজ রােপন করার পায়তারা করলাে। কুটকৌশল ও শয়তানী বুদ্ধিতে দক্ষ বলে পরিচিত এ ব্রিটিশ শক্তি ডিভাইড এ্যান্ড রুল অর্থাৎ প্রজা ও সাধারণ মানুষের মাঝে লড়াই ও মতানৈক্য সৃষ্টি করাে এবং নিজেরা আরামে বসে শাসনকার্য পরিচালনা করাে- মূলনীতি প্রয়ােগ করলাে। অখণ্ড ভারতের একমাত্র ব্রিটিশবিরােধী বৃহৎ শক্তি মুসলিম। জনগােষ্ঠির মাঝে অনৈক্য-অমিল ও পারস্পারিক গণ্ডগােল সৃষ্টি করার হীন লক্ষ্যে প্রথম আঘাত হানলাে মাযহাবের উপর। কারণ, ব্রিটিশ সরকার ভালােভাবেই জানতাে যে, নির্দিষ্ট একটি মাযহাব অনুসরণ করলে ইচ্ছামতাে কুরআন-হাদীসের ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যা প্রচার করা যাবে না। এজন্য প্রথমে মানুষদের মাযহাবী স্বাধীনতা প্রদান করা হবে এবং মাযহাব মানার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে সরাসরি কুরআন ও সহীহ হাদীস দেখে চলার আহ্বান করা হবে। যেহেতু নির্দিষ্ট মাযহাব না মেনে নিজে নিজে কুরআন ও সহীহ হাদীস মানার শ্লোগানের ছদ্মাবরণে রয়েছে স্বীয় মর্জি মােতাবেক যেকোনাে অপব্যাখ্যা করার অবাধ সুযােগ। এতে নিজেদেরও সুবিধা হবে আর সত্যিকার ইসলামেরও মারাত্মক ক্ষতি হবে। মূলত ব্রিটিশদের এ অশুভ চিন্তা ও ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ লা-মাযহাবী দলের উত্থান। পরবর্তীতে মাযহাব না মানা এ ফেতনার উদরেই হাদীস না মানার ফেতনা , শেষনবী না মানার তথা কাদিয়ানী ফেতনা, বিজ্ঞান ও আধুনিকতাপ্রবণ ফেতনাসহ বিভিন্ন ফেতনা ও দলের জন্ম হয়। (আহলে হাদীস আওর ইংরেজ: পৃ. নং ৯-১০)

মাযহাবগত স্বাধীনতার অর্থ হলাে, নির্দিষ্ট মাযহাব মানার কোনাে বাধ্যবাধকতা থাকবে না; বরং স্বীয় বুঝমতে কুরআন-হাদীসের যে ব্যাখ্যা বুঝবে। সেটাই বলবে, পূর্বসুরীদের কৃত ব্যাখ্যা দেখা বা জানার কোনােই প্রয়ােজন নেই।

কুরআন-হাদীসের শব্দের অর্থ নিজের ইচ্ছামতাে পরিবর্তন করলে তাকে কেউ প্রশ্ন করার অধিকার নেই যে, এ অর্থ আপনি কোথা থেকে পেলেন? কারণ, এটা মাযহাবী স্বাধীনতায় অবৈধ হস্তক্ষেপের শামিল!

মূলত এভাবেই মাযহাবী স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কুচক্রী একটি দল। ইসলামের ঐক্যকে বিনষ্ট করে ব্রিটিশ সরকারের অভিষ্ট হীন উদ্দেশ্য পূরণ করে তাদের নেকদৃষ্টি অর্জন করেছে। এ স্বাধীনতা যে ব্রিটিশদেরই দেয়া, তার প্রমাণ বিভিন্নস্থানে লা-মাযহাবীদেরই শীর্ষস্থানীয় আলেমদের স্বীকৃতি থেকে বুঝা যায়।

লা-মাযহাবী দলের অন্যতম মুখপাত্র নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার আগমনের সুফল ও মাযহাবগত স্বাধীনতা প্রদানের প্রশংসা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
অর্থাৎ ইতিহাস দেখলে জানা যায় যে, এ ব্রিটিশ শাসনামলে সর্বস্থরের জনগণের যে নিরাপত্তা, শান্তি ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা (পূর্বের) কোনাে শাসনামলেই ছিলাে না। আর এর কারণ এটা ছাড়া অন্য কিছুই বুঝা যায় না যে, ব্রিটিশ সরকার প্রত্যেক মাযহাব ও গােষ্ঠিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। (তরজমানে অহহাবিয়্যা: পৃ. নং ১৬)

অন্য একস্থানে তিনি লা-মাযহাবীদের প্রতি ইংরেজদের কৃপার কথা উল্লেখ করে বলেন:
অর্থাৎ আর এ লােকসকল (লা-মাযহাবীগণ) স্বীয় দীন ও মতাদ ব্যাপারে ঐ স্বাধীনতা ভােগ করে আসছে, যার ঘােষনা ব্রিটিশ সরকারের থেকে বারবার করা হয়েছে। (তরজমানে অহহাবিয়্যা: পৃ. নং ২২)

আরেক জায়গায় তিনি নিজেদের ইংরেজপ্রীতি ও মাযহাববিদ্বেষ প্রকাশ করতঃ লিখেছেন:
অর্থাৎ আর মাযহাবের অনুসরণকারীগণ চায় যে, ঐ মাযহাবগত কঠোরতা এবং নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণপ্রবণতা এবং পৈতৃক মূর্খতা ও গোঁড়ামী, যা তাদের মাঝে পূর্ব থেকেই চলে আসছে তা বহাল থাকুক এবং মাযহাবগত স্বাধীনতা থাকায় ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত যে শান্তি ও নিরাপত্তা ভারতবর্ষের জনগণ পেয়েছে তা বিলুপ্ত হয়ে যাক। (তরজমানে অহহাবিয়্যা: পৃ. নং ১১০)
উপরােক্ত বর্ণনা ও স্বীকারােক্তি থেকে বুঝা যায়, যেনাে লা-মাযহাবীগণ ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত মাযহাবগত স্বাধীনতার কুৎসিত গর্ভে জন্ম নেয়া একটি বিষফোড়া, যারা ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণে বড় একটি মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। আর ইসলাম নামক গাছের উপর রক্ত বর্ষণ এবং গােলাবর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাতিলদের বিভিন্ন রণাঙ্গনে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ব্রিটিশ সরকারের নিকট যেনাে এ বার্তাই প্রেরণ করতে চাইছিলাে যে, আমরা তাে তােমাদের দেয়া মাযহাবগত স্বাধীনতার কারণেই অস্তিত্বে এসেছি বিধায় আমরা সদাসর্বদা তােমাদের খেদমতে অনুগত থাকবাে। এটা শুধু ধারনা বা অনুমানই নয়; বরং বাস্তবিকই তা ঐতিহাসিক এক সত্য, যা সত্যপিয়াসু ইতিহাসপড়ু য়াদের অজানা থাকার কথা নয়।

সত্যিকার আহলে হাদীস কারা?

যারা বুখারী, মুসলিম, তিরমিযীসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাব পড়েছেন এবং উলুমে হাদীস সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন তারা ভালাে করেই জানেন যে, মহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামের কাজ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় দুটি দলের জন্য দুটি আলাদা আলাদা উপাধী নির্ধারণ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসীন কিরামের দায়িত্ব যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস বর্ণনা করা অর্থাৎ হাদীসটি যে শব্দে বর্ণনা পরম্পরায় চলে আসছে তা ইয়াদ(মুখস্থ) করে অন্যের নিকট পৌছে দেয়ার মাধ্যমে বা কিতাবের পাতায় লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা তাই তাদেরকে আসহাবুল হাদীস বা আহলুল হাদীস অর্থাৎ হাদীস বর্ণনা ও সংরক্ষণকারী বলা হয়। আর ফুকাহায়ে কিরামের কাজ হলাে , হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা এবং হাদীসের মধ্যে বাহ্যিকভাবে কোনাে কিছু সাংঘর্ষিক মনে হলে তার উত্তম ও সঠিক সমন্বয় সাধন এবং সমাধান করা।

ইমাম তিরমিযী রহ. সত্যিই বলেছেন,
অর্থাৎ ফুকাহায়ে কিরামই তাে হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্বন্ধে অধিক অবগত। (জামে তিরমিযী: ১/১৯৩ [আল মাকতাবাতুল আশরাফিয়া, দেওবন্দ])

এজন্য তাদেরকে আসহাবুর রায় অর্থাৎ গবেষক ও আইন বিশারদ বলা হয়। তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য হলাে, মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামের যুগ অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছে। অসাধারণ মেধা, বিস্ময়কর প্রতিভা ও খােদাপ্রদত্ত সে ইলম ও জ্ঞানের দুয়ার বহু আগেই রূদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অবিশ্বাস্য শােনা গেলেও সত্যিকার ইতিহাস তাে এটাই বলে যে, এক এক আহলে হাদীস তথা মুহাদ্দিসের সনদসহ হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ হাদীস মুখস্ত ছিলাে। ইমাম বুখারী রহ. এর ছয় লক্ষ, ইমাম মুসলিম রহ. এর তিন লক্ষ, ইমাম আবু দাউদ রহ. এর পাচ লক্ষ, ইমাম আবু ঘুরআ রাযী রহ. এর সাত লক্ষ এবং ইমাম আহমাদ রহ. এর দশ লক্ষ হাদীস ইয়াদ ছিলাে। অথচ পরবর্তীতে সনদসহ শুধু বুখারী শরীফের সাত-আট হাজার হাদীস মুখস্তকারী মুহাদ্দিস খুঁজে পাওয়াও দুস্কর। আর বর্তমান যুগের কথা তাে বলাই বাহুল্য। মােটকথা সনদসহ মুখস্ত করার যুগ অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
পূর্বেই এ আলােচনা গত হয়েছে যে, লা-মাযহাবী এ সম্প্রদায়টি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম গ্রহণ করেছে এবং প্রতিপক্ষরাও তাদের বিভিন্ন না আখ্যায়িত করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করল নিজেদের নাম আহলে হাদীস বরাদ্দ করাতে সক্ষম হয়। কারণ, তারা ভালাে করেই এ বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলাে যে, মুসলিম উম্মাহর কাছে সমাদৃত ও সম্মানিত এ উপাধি নিজেদের দলের নামে ব্যবহার করতে পারলে সাধারণ মুসলমানদেরকে সহজেই আকৃষ্ট করা যাবে। তারা আহলে হাদীস উপাধিটির মূল অর্থ গােপন করে নিজেদের দলের সবার নাম আহলে হাদীস বলে প্রচার করলাে। অথচ সাধারণ একজন আহলে হাদীস কেন, তাদের বড় বড় আলেমদেরও এক হাজার হাদীস মুখস্ত আছে কিনা সন্দেহ! আর সনদসহ হয়তাে একশ হাদীসও মুখস্ত নেই। সুতরাং এ আহলে হাদীস নামটি পুরােটাই ধােকা ও প্রতারণার খােলস।

আসল আহলে হাদীস তাে তারাই যারা হাদীসের সনদ ও মতন (হাদীস বর্ণনাকারীদের সূত্রপরস্পরা ও মূল ভাষ্য) ইয়াদ করে এর সংরক্ষণ ও হেফাযত করেছেন এবং এর অনুকরণ-অনুসরণে নিজেদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছে। বিশ্ববরণ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
অর্থাৎ আমরা শুধুমাত্র হাদীস শবণ, লিখন বা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ব্যক্তিদেরকে আহলে হাদীস মনে করি না; বরং আহলে হাদীস বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝি, যারা হাদীস ইয়াদ, পর্যবেক্ষণ, প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ অর্থ অনুধাবন করার। যােগ্যতাসম্পন্ন এবং বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে হাদীসের একনিষ্ঠ অনুসারী। (মাজমূআতুল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া: ৪/৯৫; তাহকীক: আমের আল জাযযার ও আনওয়ার আল বায [দারুল অফা , বৈরূত])

হাফেয মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আল অযীর বিন আলী হাদবী রহ. বলেন:
অর্থাৎ এটা একটি জ্ঞাত বিষয় যে, আহলে হাদীস বলতে তাদেরকেই বুঝায়, যারা এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে খিদমাত করেছেন এবং এর অন্বেষণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। [আর-রাওজুল বাসিম: ২/২৫৭ (দারু আলামিল ফাওয়ায়িদ, মক্কা)]
এ দু’টি বর্ণনা থেকে প্রকৃত আহলে হাদীসের পরিচয় পাওয়া যায়। সুতরাং নিজেদেরকে শুধু আহলে হাদীস বললেই সত্যিকার আহলে হাদীস হওয়া যায়।

প্রকৃত আহলে হাদীস হতে হলে তাে প্রচুর হাদীস ইয়াদ করতে হবে, এর সনদ ও ব্যাখ্যা জানা থাকতে হবে এবং জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে এর অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করতে হবে। অথচ বর্তমান আহলে হাদীস নামধারী এ লা-মাযহাবী সম্প্রদায়ের মাঝে এসকল গুণের একটিও পাওয়া যায় না।

আসল আহলে হাদীস হতে হলে দরকার পরিপূর্ণ যােগ্যতা ও অসীম কুরবানীর। লা-মাযহাবী দলে যােগদান করলেই আহলে হাদীস হওয়া যায় না। আহলে হাদীস তাে উলামায়ে কিরামের মধ্য থেকে বিশেষ একটি দলের নাম। তাহলে লা-মাযহাবী দলের সবার নাম আহলে হাদীস হয় কী করে? অথচ এদের অধিকাংশ লােকই এমন, যারা কুরআন ও সহীহ হাদীস শব্দ দু’টি আরবীতে পর্যন্ত লিখতে পারবে না। তাই এদের নাম আহলে হাদীস রাখাটা একেবারেই বেমানান ও অসামঞ্জস্যশীল।

এজন্য আমাদের বড়দের কেউ কেউ এদেরকে আহলে হাদীস না বলে আহলে হদস (অপবিত্র) বলে থাকেন। আমি বলি, এদের নাম আহলে হাদীস থাকলেও কোনাে অসুবিধা নেই। কেননা, হাদীস শব্দটির দুটি অর্থ আছে। এক: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও সম্মতি। দুই: নব্য ও নতুন। এ লা-মাযহাবী সম্প্রদায় যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও সম্মতির অনুসারী তথা হাদীসে রাসূলের প্রকৃত ধারক বাহক নয় তাই এরা দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে আহলে হাদীস, যার অর্থ নব উদ্ভাবিত। সত্যিই নামের সঙ্গে বাস্তবতার চমৎকার মিল! তেরােশ হিজরীতে উথিত দলটির নাম এ হিসেবে যুৎসই ও সঠিকই হয়েছে। আল্লাহ এদের চক্রান্ত ও ধােকাবাজি থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন!

লা-মাযহাবীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মতৎপরতা

ইতিহাস অধ্যায়ন করলে দেখা যায় যে, হকের মােকাবেলায় বা সবসময় নতুন নামে, নতুন কৌশলে বিশেষ কোনাে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তাই অনেক সময়ই বাতিলদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অস্পষ্ট এ অজ্ঞাত থেকে যায়। তবুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের অস্বাভাবিক ও চক্রান্তমূলক সব কর্মকাণ্ডে তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়ে যায়।
এ লা-মাযহাবী সম্প্রদায়ের উত্থান যেহেতু ইংরেজ শাসনামলে তাই তাদের এ উত্থানের সাথে ইংরেজ সরকারের কোনাে গােপন আঁতাত থাকাটাই স্বাভাবিক। আর বাস্তবে ঘটেছেও তাই। তাদের বিভিন্ন জিহাদবিরােধী কর্মকাণ্ড, ইংরেজদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং নিজেদের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের বক্তব্য ও লিখনী থেকে পরিস্কারভাবে বুঝা যায় যে, লা-মাযহাবী দলের উত্থান এবং আবির্ভাব একমাত্র ইংরেজদের ইসলামবিরােধী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে দ্বিধাদ্বন্ধ সৃষ্টির জন্যই হয়েছে। এছাড়াও মুসলমানদের সহীহ আকীদা, দীন ও মাযহাবের মধ্যে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে তাদেরকে সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুত করাটাও তাদের টার্গেটের অন্তর্ভুক্ত।

এ ব্যাপারে লা-মাযহাবী দলের অন্যতম প্রধান আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বলেন:
অর্থাৎ আমাদের নবউদ্ভাবিত মাযহাবে (তাকলীদের ব্যাপারে) স্বাধীনতা তাে ব্রিটিশ সরকারের আইনের চাহিদা মােতাবেকই। তিনি আরাে বলেন, ভারতের অনুগত রাষ্ট্র নেপালের তাে মাযহাবী স্বাধীনতার ব্যাপারে সর্বদাই চেষ্টা ছিলাে , যা ভারত সরকারের একান্ত বিশেষ চাহিদা। [তরজমানে অহহাবিয়্যা : পৃ. নং ২৩]

এভাবে লা-মাযহাবী দলের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র অকীলে আহলে হাদীস মৌলভী মহাম্মাদ হুসাইন বাটালবী তাে আরাে ধাপ অগ্রসর হয়ে ব্রিটিশ শাসনকে ইসলামী খেলাফতের চেয়েও উত্তম বলে অভিহিত করেছেন।
মাওলানা ফযল হুসাইন বিহারী তার আল হায়াত বা’দাল মামাত গ্রন্থে মৌলভী মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালবীর জীবনের জঘণ্যতম এ উক্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
অর্থাৎ এ আহলে হাদীস দলটি ব্রিটিশ সরকারের কল্যাণপ্রত্যাশী, চুক্তি রক্ষাকারী এবং অনুগত প্রজা হওয়ার অত্যন্ত পরিস্কার এবং শক্তিশালী প্রমাণ হলাে, এরা (লা-মাযহাবীগণ) ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকা কোনাে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে থাকার চেয়ে উত্তম মনে করে। [আল হায়াত বা’দাল মামাত: পৃ. নং ৯৩]

আহলে হাদীসের একটি দলের নাম ‘গুরাবা আহলে হাদীস। এদের প্রধান নেতা মুহাম্মাদ মােবারক বলেন, এ গুরাবা আহলে হাদীসের ভিত্তি স্থাপন করাই হয়েছে মূলত মুহাদ্দিসীনে কিরামের সাথে মতানৈক্য করার জন্য। শুধু এটাই নয়; বরং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অবিসংবিদিত নেতা সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. এর বিরুদ্ধাচরণ করে ইংরেজদের খুশী করাও ছিলাে এর বিশেষ উদ্দেশ্য।(উলামায়ে আহনাফ আওর তাহরীকে মুজাহদীন : পৃ. নং ৪৮) |

মৌলভী হুসাইন আহমাদ বাটালবী তাে ইংরেজদের খুশী করা এবং তাদের অনুগ্রহ ও কৃপা লাভের আশায় জিহাদ করার বিপক্ষে আল ইকতিসাদ ফী মাসাইলিল জিহাদ’ নামে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থও রচনা করেন। এতে তিনি জিহাদের মতাে ইসলামের মহান ও কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী একটি বিধানকে মানসুখ বা রহিত ঘােষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। অথচ এর বিপরীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদকে ঈমানের মূল আখ্যা দিয়ে স্পষ্টভাবে ঘােষণা করেন:
অর্থাৎ আনাস রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিনটি বিষয় হলাে ঈমানের মূল।

এক: কালেমা পাঠকারীকে হত্যা ও কষ্ট দেয়া থেকে নিবৃত্ত থাকা; কোনাে গােনাহের কারনে তাকে কাফের বলবে না এবং কোনাে আমলের কারনে তাকে ইসলাম থেকে বহিস্কার করবে না।
দুই: জিহাদ, যা আমার নবুওয়াতের সময় থেকে নিয়ে আমার শেষ উম্মত (অর্থাৎ ঈসা আ.) দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত চলতে থাকবে। এ জিহাদের বিধানকে না কোনাে যালিমের যুলুম বাতিল করতে পারবে আর না কোনাে ইনসাফগারের ন্যায়পরায়ণতা রহিত করতে পারবে।

তিন: তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা। [আবু দাউদ: ২/৩২৪-৩২৫; হাদীস নং ২৫৩৪ (দারুল কিতাবিল আরাবী, বৈরুত)]
এভাবেই এ লা-মাযহাবী সম্প্রদায়টি ইংরেজদের খুশী করতে গিয়ে কুরআন হাদীসের বিরােধিতা করতে একটুও থামকে দাঁড়ায়নি। এরাই নাকি হাদীসের অনুসারী!

হুসাইন আহমাদ বাটালবীর বিশিষ্ট শিষ্য মৌলভী আলতাফ বলেন:
অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার আমাদের (লা-মাযহাবীদের) মতাে মুসলামানদের জন্য আল্লাহর রহমত স্বরূপ। [আল হায়াত বা’দাল মামাত: পৃ. নং ৯৩]

এ লা-মাযহাবী সম্প্রদায়টি ইংরেজদের স্বার্থ রক্ষায় এতােটাই নিষ্ঠাবান ছিলাে যে, নিজের ঈমান-দীন ও ইসলাম বিকিয়ে হলেও তাদের বিপক্ষে যেতে প্রস্তুত ছিলাে না। এ উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেলাে এবং ইসলাম ও মুসলামানদের বিরূদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ও কুচক্রান্ত একে একে প্রকাশ পেতে থাকলাে তখন হিন্দুস্থানের প্রায় সকল উলামায়ে কিরাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতােয়া দিলেন এবং এ ফতােয়ানামায় বড় বড় প্রায় সকল উলামায়ে কিরামই দস্তখত করেন। আর এ ফতােয়ার কারণেই সমগ্র ভারতবর্ষে মুসলামানদের মাঝে জযবা ও স্পৃহার এক তুফান বয়ে গেলাে এবং সবার ঈমানী জোশ জেগে উঠলাে। আর এ ভিত্তিতেই ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ নামে ব্রিটিশবিরােধী গণআন্দোলন হয় এবং এরপর এ চেতনার বিস্ফোরণেই একসময় ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

কিন্তু আফসােসের বিষয় হলাে, এ আযীমুশ শান ফতােয়ায় দস্তখত দিতে কিছু স্বার্থান্বেষী, দুনিয়ালােভী মৌলভী অস্বীকৃতি জানিয়ে এর বিরােধিতা করে বসে। এসকল গাদ্দার , সুবিধাভােগী ও দুনিয়াদার মৌলভীদের শীর্ষে রয়েছে লামাযহাবীদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম নযীর হুসাইন। [রেফারেন্স যুক্ত করা হবে ইনশা আল্লাহ]

মােটকথা লা-মাযহাবী এ দলটির একমাত্র সাধনা ও লক্ষ্য ছিলাে, কী করে ব্রিটিশ সরকারকে সর্বদা খুশী রাখা যায়। এর জন্য এরা নিজেদের দীন-ঈমান বিসর্জন, কুরআন-হাদীসের ভুল ও অপব্যাখ্যা এবং শরীয়তের স্পষ্ট বিধানসমুহের বিরােধিতাসহ সব ধরনের কাজ করতে প্রস্তুত ছিলাে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে হলে আলাদা একটি বই হয়ে যাবে। তাই খুব সংক্ষিপ্তাকারে এখানে তাদের ব্রিটিশসখ্যতা ও বন্ধুত্বের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবাে। এতে তাদের মুখােশ কিছুটা হলেও উন্মুক্ত হবে বলে আশা করি।

ব্রিটিশদের সাথে লা-মাযহাবীদের সখ্যতা ও সম্পর্ক

প্রথমে আমরা আলােচনায় আনবাে লা-মাযহাবীদের কেন্দ্রীয় এবং অন্যতম প্রধান ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানের দাস্তান। লা-মাযহাবীগণ যাকে ইমামুস সুন্নাহ, মুজাদ্দিদে হিন্দ ও খাতামুল মুহাদ্দিসীন উপাধিতে ভূষিত করেছে এবং কোনাে কোনাে দৃষ্টিকোণ থেকে তার মর্যাদা ও সম্মান শাইখুল কুল ফিল কুল বলে পরিচিত মৌলভী নযীর হুসাইন দেহলবীর চাইতেও বেশী ছিলাে।(প্রাগুক্ত: পৃ. নং ৪৩)

এই নওয়াব সিদ্দীক খান ইংরেজদের সুদৃষ্টি ও কৃপা লাভের আশায় অনেক জঘণ্য ও খারাপ পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি ১৮৫৭-এর আযাদী আন্দোলনের মুজাহিদদেরকে যালেম, নির্বোধ, ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী, মূর্খ, ইসলামবিমূখ, কবীরা গােনাহে জড়িত এবং চুক্তি ভঙ্গকারী বলে বিভিন্ন শব্দে গালি-গালাজ করেছেন। একপর্যায়ে তিনি এদেরকে দুনিয়া-আখেরাতের মহাক্ষতিগ্রস্ত এবং ঈমান থেকে দূরবর্তী বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ তরজমানে অহহাবিয়্যাতে লিখেছেন:
অর্থাৎ ইংরেজ সরকারেরর আনুগত্য এবং ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করা এদের মতে (অর্থাৎ লা-মাযহাবীদের মতানুসারে) সকল আবশ্যকীয় দায়িত্বের তুলনায় বড় দায়িত্ব। [তরজমানে অহহাবিয়্যা: পৃ. নং ২৯]

নাউযুবিল্লাহ! এর চেয়ে দীনের উপর বড় আঘাত আর কী হতে পারে? যার নিকট যালেম, কাফের এবং তৎকালীন সময়ে ইসলামের সবচে বড় দুশমন ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য করা সবচে বড় ফরয এবং অবশ্যপালনীয় কর্তব্য তার ব্যাপারে আমরা আর কী বলবাে? বিবেকসম্পন্ন যেকোনাে ব্যক্তি এদের কুমতলব ও অসৎ উদ্দেশ্য সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে। প্রকারান্তরে নওয়াব সিদ্দীক এটাই বলতে চেয়েছেন যে, তাওহীদ, রেসালাত, নামায, রােযা, হজ্জ, যাকাত আর কী বড় ফরয; বরং এর চেয়েও বড় ফরয দায়িত্ব ও কর্তব্য হলাে ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করা! যে ব্যক্তি ইংরেজ সরকারের আনুগত্যকে বড় কর্তব্য ও ফরয মনে করবে না সে সবচে বড় ফরযের অস্বীকার করায় ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে! আরও সহজে বলা যায়, যে ব্যক্তি ইংরেজ সরকারের গােলামী মেনে নিবে সে সবচে বড় মুমিন এবং যে ইংরেজ সরকারের গােলামী মানবে না সে সবচে বড় কাফের এবং বেঈমান! হায় আফসােস!! কী। জঘণ্যতম মন্তব্য !!! তিনি জিহাদের বিরােধিতা করতে গিয়ে লিখেছেন:
অর্থাৎ সুতরাং নিজের মাযহাবের হুকুম সম্বন্ধে অজ্ঞ ঐসকল (হানাফী) লােকদের একটু এ বিষয়ে চিন্তা করা উচিত যে, ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা শেষ হয়ে যাওয়া এবং আজ যে শান্তি ও নিরাপত্তা আছে তা জিহাদের নামে অরাজকতার অন্তরালে উঠিয়ে দেয়াটা চরম বােকামী ও নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। [প্রাগুক্ত: পৃ. নং ৭]

তিনি হিন্দুস্তানকে দারুল ইসলাম ঘােষণা দিয়ে আরাে লিখেছেন:
অথাৎ বর্তমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে কারাে এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, ভারতবর্ষ দারুল ইসলাম (ইসলামী দেশ)। [প্রাগুক্ত: পৃ. নং ৪৮]

কথা কারাে অজানা নয় যে, দারুল ইসলাম হওয়ার জন্য যেসকল শর্ত মরেছে, তন্মধ্য থেকে অন্যতম প্রধান একটি শর্ত হলাে, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার দায়িত্বভার মুসলিম খলীফার হাতে থাকবে এবং দেশে ইসলামী বিধি-বিধান প্রকাশ্যভাবে জারি থাকবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইংরেজ শাসনামলে এ শর্তগুলাে পাওয়া যাওয়া তাে দূরে থাক; বরং মুসলমানদের নিরাপত্তা ও সাধারণ নাগরিক সুযােগ-সুবিধা ও অধিকার, যা সাধারণত বিশ্বের প্রায় সবদেশেই থাকে তাও ছিলাে না। শুধু তাই নয়; বরং ব্রিটিশ সরকার আলেম উলামা ও মুসলমানদের উপর অত্যাচারের যে স্টীমরােলার চালিয়েছিলাে, তা চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের বর্বরতাকেও একপর্যায়ে হার মানিয়েছিলাে। সুতরাং এরকম অবস্থায় হিন্দুস্তানকে দারুল ইসলাম বলার দুঃসাহস দেখানাের উদ্দেশ্য ইংরেজদের খুশী করা ছাড়া আর কিছুই ছিলাে না। কারণ, হিন্দুস্তানকে দারুল ইসলাম বলার অর্থ হলাে এদেশে জিহাদ করার কোনাে অবকাশ নেই। যেহেতু জিহাদ তাে করতে হয় কুফরী রাষ্ট্রের সাথে, দারুল ইসলামে আবার জিহাদ কার সাথে? তাই সাধারণ মুসলমানরা এ কথা শুনে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবে যে, এ দেশ দারুল ইসলাম হলে তাে জিহাদ করা যাবে না। এতে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদেরই লাভ। আর লা-মাযহাবীগণ তাে এটাই চেয়েছিলাে।

ফযল হুসাইন বিহারী লিখেছেন:
অর্থাৎ মিয়া সাহেব (লা-মাযহাবীদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম নবীর হুসাইন দেহলবী) সর্বদাই হিন্দুস্তানকে দারুল আমান বা নিরাপত্তার দেশ বলতেন। কখনাে তিনি একে দারুল হরব বা যুদ্ধকবলিত কুফুরী রাষ্ট্র বলেননি। [আল হায়াত বা’দাল মামাত: পৃ. নং ১৩৪]
আমার মনে হয়, মিয়া সাহেবের কথা পুরােপুরি সঠিক না হলেও এক দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিকই আছে। কেননা, ইংরেজ শাসনামলে হিন্দুস্তান তাে তাদের জন্যই আতংক ও নিরাপত্তাহীনতার দেশ ছিলাে, যারা মুসলমান ও ইংরেজবিরােধী। লা-মাযহাবীগণ যেহেতু ইংরেজদের গােলামী করে তাদের বন্ধুত্ব অর্জন করেছিলাে তাই তাদের জন্য এদেশ ছিলাে নিরাপত্তা ও শান্তির আবাস। [ফিরকায়ে আহলে হাদীসে পাক ও হিন্দ: পৃ. নং ৭৪]

হুসাইন আহমাদ বাটালবীর সমর্থন ও অনুসরণে সিদ্দীক হাসান খান লিখেছেন:
অর্থাৎ ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বা মাযহাবগত স্বাধীনতার সুযােগ প্রদানকারী কোনাে বিচারক ও শাসকের বিরূদ্ধে ধর্মীয়ভাবে যুদ্ধ-জিহাদ করা সম্পূর্ণরূপে অন্যায় ও নিষিদ্ধ। আর ঐসকল লােক, যারা ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরূদ্ধে বা মাযহাবী স্বাধীনতা প্রদান করেছে এমন কোনাে শাসনকর্তার বিরূদ্ধে অস্ত্রধারণ করে এবং ধর্মীয় জিহাদ করতে চায় এরা সবাই রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বিদ্রোহীদের শান্তির উপযুক্ত বলে গণ্য হবে। [তরজমানে অহহাবিয়্যা: পৃ. নং ১২০, আহলে হাদীস আওর ইংরেজ: পৃ. নং ৫৮-৫৯]

কতবড় দালালী ও পক্ষপাতিত্ব! যেখানে ভারতবর্ষসহ সমগ্র বিশ্বের বড় বড় শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামের মতে ইংরেজ শাসনামলে ভারতবর্ষ ছিলাে দারুল হরব বা কুফুরী সরকারশাসিত দেশ এবং এ সরকারের বিরূদ্ধে জিহাদ করে ইসলামবিদ্বেষী এ সরকারকে উৎখাত করা সবার উপর ফরয দায়িত্ব। সেখানে ব্রিটিশবিরােধী মুজাহিদদেরকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিদ্রোহী! আবার এ বিদ্রোহের ফলে তাদেরকে নাকি শাস্তিও পেতে হবে। হ্যা, বাস্তবেই তারা পার্থিব শাস্তি পেয়েছেন। হাজার হাজার আলেম ও কারীকে শহীদ করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান ঘরহারা, সম্পদহারা হয়েছেন। কিন্তু এসবের বিনিময়ে একদল জান্নাত খরীদ করেছে আর অন্য একটি দল ব্রিটিশদের কৃপা ও নিরাপত্তা নিয়ে জাহান্নামের পথ প্রশস্ত করেছে।

লা-মাযহাবী এ দলটির ইংরেজ ও ব্রিটিশপ্রীতির এরকম আরাে অনেক কথা আছে, যা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভবপর নয়। সারাটা জীবন ইংরেজদের গােলামী এবং সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়েই এরা সময় কাটিয়েছে। মূলত এরা এদের কাজে ও লক্ষ্যপূরণে অনেকটাই সফল। কারণ, এদের প্রধান উদ্দেশ্যেই ছিলাে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করে ফেলা এবং ইংরেজদের গােলামী করে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেদের নয়া উদ্ভাবিত দলটিকে প্রতিষ্টিত একটি রূপ দেয়া, যাতে তাদের মতাদর্শ জনগণের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া যায়। আজ ইংরেজরাও নেই এবং নেই সে ইংরেজবিরােধী মর্দে মুজাহিদ উলামায়ে কিরামও। কিন্তু রয়ে গেছে ইংরেজদের রােপিত সে লা-মাযহাবী ফেতনার চারাগাছটি, যার বিষফলে এখনাে প্রতিনিয়ত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমাদের আকাবির এক হাতে তলােয়ার নিয়ে যেমন ইংরেজদের বিরূদ্ধে মাঠে জিহাদ করেছেন তেমনি অন্য হাতে কলম নিয়ে এসকল ফেতনার দাতভাঙ্গা জবাবও দিয়েছেন। এখন ইংরেজরা না থাকলেও লা-মাযহাবীদের দাপট ও তর্জন-গর্জন সমন্তরালভাবেই চলছে। তাই আমরাও আসছি দু’হাতে কলম নিয়ে, বাতিল বিনাশের শপথ নিয়ে; দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের সহিত, ইনশাআল্লাহ।

মুফতী তারেকুজ্জামান (আল আযহার, মিশর)

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *