দুনিয়ার বুকে আজ যত জাতি রয়েছে তাদের প্রত্যেকের ইতিহাস হচ্ছে উত্থান ও পতনের ইতিহাস। একটি জাতি যখন পতনোন্মুখ হয়, ঘোর অমানিশায় ছেয়ে যায় তার ভাগ্যাকাশ, তখন সময়ের প্রয়োজনেই দাঁড়িয়ে যায় কিছু লোক, যারা জাতিকে আশার আলো দেখায়, ফিরিয়ে নিয়ে আসে সংগ্রামের স্পৃহা। আবার, যখন একটি জাতি পতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, হতে থাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত, তখনও কিছু লোক এক বুক সাহস নিয়ে এগিয়ে আসে দুঃসহ সময়ের এই নাগপাশ হতে জাতিকে মুক্তি দিতে। এদের অনেকেই সফল হয় আবার অনেকে হয় ব্যর্থ। কিন্তু, তারা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করে যায়, আর এই চেষ্টা করে যাওয়া লোকগুলোই হচ্ছে ইতিহাসের নায়ক। প্রত্যেক জাতি তাদের স্ব স্ব ঐতিহাসিক নায়কদের সযত্নে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখে। এটি প্রত্যেকটি জাতির দায়িত্ব। এই নায়কদের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস পঠনের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রজন্ম অনুপ্রেরণা লাভ করে, পায় সংগ্রামী চেতনা। দুঃসময় যখন জাতির আকাশ পুনরায় ছেয়ে ফেলে তখন তারা এই সমস্ত নায়কদের কাছেই ফিরে আসে অদম্য প্রেরণা লাভের নিমিত্তে।
কে নায়ক? – ব্যাপারটি কিন্তু আপেক্ষিক। একজন মানুষ কোন জাতির কাছে নায়ক হলেও অন্য জাতির কাছে হতে পারে চরম শত্রু। যেমনঃ রোকনুদ্দীন বাইবার্স (রহঃ), মুসলিমদের কাছে তিনি একজন নায়ক হলেও খৃষ্টানদের চোখে তিনি চরমতম শত্রু। তাই এটি মনে রাখতে হবে যে, এই লিখায় যারা নায়ক বলে সম্বোধিত হয়েছে তারা সবাই যে আমার দৃষ্টিতে নায়ক এমনটা আবশ্যিক নয়।
আলোচনার স্বার্থে আমি ঐতিহাসিক নায়কদেরকে মূলতঃ দুই শ্রেণীতে ভাগ করব,
প্রথমত, তারা যারা স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠীর কাছে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তারা হচ্ছে প্রধান ঐতিহাসিক নায়ক। যেমনঃ মুসলিমদের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) বা সালাহউদ্দিন আল আইউবি (রহঃ), তাঁরা হচ্ছেন আমাদের প্রধান ঐতিহাসিক নায়ক। তেমনিভাবে কমিউনিস্টদের কাছে ভ্লাদিমির লেনিন (Vladimir Lenin) বা চে গুয়েভারা (Che Guevara) হচ্ছে তাদের প্রধান ঐতিহাসিক নায়ক।
দ্বিতীয়ত, তারা যারা কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট জাতি অথবা ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের ব্যাপারে মানুষের জানাশোনা একটু কম। এরা হচ্ছে স্থানীয় বা দেশীয় নায়ক। যেমনঃ আলজেরিয়ার আবদেল কাদের আল জাযাইরি (Abdelkader El Djezairi) (রহঃ), ভারতের বালাকোটের শহীদ সৈয়দ আহমাদ বারেলভী (Syed Ahmad Barelvi) (রহঃ), বাংলাদেশের মীর নিসার আলী (রহঃ), রাশিয়ার গ্রিগরি পটেমকিন (Grigory Potemkin), হাঙ্গেরির জন হুনিয়াদি (John Huniyadi) অথবা অধুনা ক্রোয়েশিয়ার ন্যাশনালিস্ট লিডার ফ্রানিয়ো টুজমান (Franjo Tuđman)। এরা সবাই তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে অথবা দেশে খুবই বিখ্যাত, এবং সবাই-ই তাদের নিজ নিজ দেশের জাতীয় নায়ক। তবে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের খ্যাতি পূর্বের বর্ণিত প্রধান ঐতিহাসিক নায়কদের মত নয়। তাই এদেরকে আমি স্থানীয়, দেশীয় বা জাতীয় নায়ক বলব।
পৃথিবীর সব জাতিই তাদের ইতিহাস পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে প্রধান ও স্থানীয় নায়কদের সম্মিলনে। পৃথিবীর সব দেশেই আন্তর্জাতিক তথা প্রধান নায়কদের পাশাপাশি স্বদেশী জাতীয় নায়কদেরও যথাযোগ্য সম্মান দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়ঃ ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা লিবিয়ার বিখ্যাত ওমর মুখতার (রহঃ), আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা আবদেল কাদের আল জাযাইরি (রহঃ), ডাচদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ইন্দোনেশিয়ার ইমাম মুহাম্মাদ সায়াহাব (Muhammad Syahab aka Tuanku Imam Bonjol) (রহঃ) এবং দিপোনেগোরো (Diponegoro) অথবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রামে লিপ্ত দাগেস্তানের ইমাম শামিল (Imam Shamil) (রহঃ) এর কথা। লিবিয়ান, আলজেরিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান অথবা ককেশীয় মুসলিমরা খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এবং সালাহউদ্দিন আল আইউবি (রহঃ) এর সাথে সাথে তাদের নিজস্ব এই সমস্ত ঐতিহাসিক নায়কদের আজও যথাযোগ্য সম্মান ও গর্বের সাথে স্মরণ করে, তাঁদের নিয়ে আজও যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা করে। এরা সবাই তাঁদের নিজ নিজ দেশে জাতীয় নায়ক। বহিরাক্রমণকারী শত্রুদের দমন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সমস্ত নায়করা সব সময় তাঁদের জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
এবার খৃষ্টানদের দিয়ে কিছু উদাহরণ দিই। খৃষ্টানদের কাছে ফ্রাঙ্কিয়ার (Francia, আজকের ফ্রান্স ও জার্মানি) সম্রাট শার্লাম্যান (Charles Martel aka Charlemagne) হচ্ছে সেরূপ, আমাদের কাছে সালাহউদ্দিন আল আইয়ুবী (রহঃ) যেরূপ। এই শার্লাম্যানই পল্টিয়ারের যুদ্ধে (Battle of Poitiers, 10 October 732) ইউরোপে উমাইয়া খিলাফতের বিজয়জাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপ তার খৃষ্টান সত্ত্বা ধরে রাখতে পেরেছে মূলতঃ এই শার্লাম্যানের কারণেই। শার্লাম্যান হচ্ছে খৃষ্টানদের একজন অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ঠিক একইভাবে বহুজাতিক ক্রুসেডার বাহিনী সালাহউদ্দিন আল আইউবির (রহঃ) কাছে পরাজিত হওয়ার পর নতুন করে ক্রুসেড পরিচালনা করায় ইংল্যান্ডের রিচার্ড দ্যা লায়নহার্ট (Ricard the Lionheart) পুরো খৃষ্টান জগতের কাছে মহানায়ক। প্রায় প্রত্যেক ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রেই তাই শার্লাম্যান ও রিচার্ডকে ক্রিসচিয়ানিটির মহানায়ক হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। কিন্তু, তাই বলে নিজেদের স্থানীয় নায়কদের ব্যাপারে কিন্তু তারা উদাসীন নয়। উসমানীদের ইউরোপমুখী জিহাদের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ-সংগ্রাম দাড় করানোর জন্য হাঙ্গেরিয়ানরা জন হুনিয়াদি (John Huniyadi), রোমানিয়ানরা ভ্লাদ দা ইম্পেইলার (Vlad the Impaler), পোলিশরা ইয়ান সোবিয়েস্কি (Jan Sobieski), সার্বিয়ানরা লাজার রেবলিয়ানোভিচ (Lazar Hrebeljanović) এবং স্টেফান টমাসেভিচ (Stephen Tomašević), রাশিয়ানরা পটেমকিন (Grigory Potemkin), আলবেনীয় খৃষ্টানরা স্কান্দারবেগ (Skanderbeg aka Gjergj Kastrioti) – কে আজও নিজেদের জাতীয় নায়ক হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তাদের নিয়ে গর্ব করে ও মূর্তি বানায় এবং নিজেদের সন্তানদের নাম তাদের নামে রাখে। এছাড়া, নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (যেমনঃ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) নাম এই সমস্ত নায়কদের নামের সাথে মিলিয়ে রাখে। নিজ নিজ দেশে এদের এত সম্মান কারণ, স্ব স্ব খৃষ্টান দেশগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় এরাও মুসলিমদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছে, যেমনটা করেছিল শার্লাম্যান ইউরোপে খৃষ্টানদের অস্তিত্ব রক্ষায়। এর মানে এই নয় যে এই সমস্ত দেশের অধিবাসীরা শার্লাম্যান বা লায়নহার্টের ব্যাপারে জ্ঞান রাখে না বা তাকে নিয়ে গর্ব করে না। অবশ্যই তারা জ্ঞান রাখে এবং গর্বও করে কিন্তু নিজেদের স্বদেশীয় ঐতিহাসিক নায়কদের একদমই ভুলে গিয়ে নয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্তহীন দ্বন্দ্ব ও নিজেদের খৃষ্টান আইডেন্টিটি রক্ষায় এই সমস্ত জাতিসমূহ সবসময় তাদের জাতীয় নায়কদের কাছ থেকে আশা ও অনুপ্রেরণা লাভ করে, লাভ করে সাহস ও প্রত্যয়।
এখন আসি সে সমস্ত নায়কদের আলোচনায় যারা ছিল খৃষ্টানদের ধর্মগুরু। খৃষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় ফিগারহেডগুলোর (Figurehead) মধ্যে রয়েছে জন দ্যা এপোসল, পিটার দ্যা এপোসল, জেইমস দ্যা এপোসল, সেইন্ট নিকোলাস, আথানাসিয়াস দ্যা গ্রেট, ইউসেবিয়াস, সেইন্ট অগাস্টিন, সেইন্ট জেরোম, সিরিল অব আলেকজান্দ্রিয়া ইত্যাদি। খৃষ্টানদের প্রায় সবাই-ই এদের সম্মান করে, কারণ এরা হচ্ছে খৃষ্টানদের প্রধান সব ধর্মীয় নায়কসমূহ। কিন্তু, তারপরও প্রায় সব ইউরোপিয়ান দেশেরই নিজ নিজ জাতীয়তার পেট্রোন সেইন্ট (Patron Saint) আছে। তারা সাধারণত সেই সমস্ত রাজা যারা প্রথম খৃষ্টানধর্ম গ্রহণ করেছিল অথবা সেই সমস্ত ধর্ম প্রচারক যারা প্রথম সেই সব জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে খৃষ্টানধর্ম প্রচার করেছে অথবা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে। যেমনঃ রাশিয়ার রাজা প্রথম ভ্লাদিমির (Vladimir Sviatoslavich) এবং রাণী ওলগা (Olga of Kiev), সার্বিয়ার সেইন্ট সাভা (Rastko aka Saint Sava), পোল্যান্ডের স্টানিস্লাউস অব ক্রাকো (Stanislaus of Cracow), জার্মানির সেইন্ট বনিফাস (Saint Boniface), স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরির ভয়টেহখ (Vojtěch aka Adalbert of Prague), ফ্রান্সের ডেনিস (Denis) এবং মারটিন (Martin of Tours) ইত্যাদি। এই সমস্ত দেশীয় ধর্মপ্রচারক ও রাজারা তাদের নিজ নিজ দেশে ক্রিসচিয়ানিটির প্রধান প্রধান সব ফিগারহেডদের সাথে ঐতিহাসিক জাতীয় নায়ক হিসেবে সমাদৃত হয়। তাদের নামে বাচ্চাদের নাম রাখা হয়, নাম রাখা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। যুদ্ধবিগ্রহ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি তারা ওই সমস্ত দেশের কালচারাল আইডেন্টিটিতে রূপ নিয়েছে।
সুতরাং, আমরা এ থেকে বুঝতে পারছি যে প্রত্যেক দেশ/ জাতিই আন্তর্জাতিক তথা প্রধান নায়কদের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক নায়কদেরও গুরুত্বের সাথে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখে এবং তাদের নিয়ে অধিকতর চর্চা করে। সম্প্রতি তুর্কিরা তাদের ঐতিহাসিক নায়কদের নিয়ে যে সিরিজসমূহ তৈরি করছে তা এরই প্রমাণ। নিজেদের ঐতিহাসিক নায়কদের গৌরবময় ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়া প্রত্যেক জাতিরই দায়িত্ব। এটা না করতে পারলে জাতি হারায় তার আইডেন্টিটি, হারায় অনুপ্রেরণার উৎস ও সংগ্রামের স্পৃহা।
সম্প্রতি, বাংলাদেশীদের মধ্যে ইতিহাসপাঠ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশী মুসলিমরা আজ দুনিয়ার তাবৎ ইতিহাসের ব্যাপারে জানছে। ওসমানী খিলাফতের প্রত্যেক সুলতানের নাম মুখস্থ করছে। মামলুক, সেলজুক ও আইয়ুবী সালতানাতও লিস্ট থেকে বাদ যাচ্ছে না। আন্দালুস শাসন করা সালতানাতগুলোও অতি বেশীই আপন। দিল্লী ও মুঘল সালতানাত সম্পর্কে তো আগে থেকেই অনেক কিছু জানে। তালেবানের সফলতার পর নতুন একদল লোক আবার সারাদিন গজনবী সালতানাত ও আবদালী সাম্রাজ্য নিয়ে পড়ে আছে। তারা এই ফ্যান্টাসিতে ভুগছে যে আফগান মুজাহিদরা এসে উপমহাদেশের মুসলিমদের আবার রক্ষা করবে যেরূপ আহমদ শাহ আবদালী (রহঃ) রক্ষা করেছিলেন মারাঠাদের হাত থেকে। তুরস্ক ও উসমানীদের নিয়ে অতিরিক্ত ফ্যান্টাসির কারণে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন এরদোয়ানের উপর লিখা বইও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। এরতুরুল বর্তমানে বাজওয়ার্ড আমাদের মধ্যে। অবস্থাদৃষ্টে এখন এমন মনে হচ্ছে যে, বাঙ্গালীরা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে অতি দক্ষিনের মালাক্কা সালতানাত হতে অতি উত্তরের শিবির খানাত (Siberian Khanate – By Tatar Muslims) সবার ব্যাপারেই জানবে ও গর্বিত হবে। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের মুসলিম ভূমিগুলো ও তাদের ঐতিহাসিক নায়কদের ব্যাপারে আমরা জানব না বা তা নিয়ে গর্ব করব না। অবশ্যই আমি সেই সমস্ত ইতিহাস পঠনের বিপরীতে নই এবং অতি অবশ্যই আমি সারা জাহানে মুসলিমদের সোনালী সময়গুলোর গর্বে গর্বিত হওয়ার বিপরীতে নই। তবে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নায়কদের ব্যাপারে একদমই না জেনে যখন দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে ব্যাপারটি চলে যায় তখন অবশ্যই সমালোচনা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
ইসলামের প্রধান নায়কদের পাশাপাশি নিজস্ব ইসলামী নায়কদের সম্পর্কে জানা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু, বর্তমানে এই দেশে ইসলামের প্রধান নায়কদের উপর কিছু কাজ হলেও আমাদের নিজস্ব নায়কদের নিয়ে একেবারেই কোন কাজ হচ্ছে না। অথচ, এরা আমাদের শিকড়ের অংশ। জাতির দুঃসময়ে এরাই হতে পারত আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। হতে পারত আমাদের সাহস ও প্রত্যয়ের জায়গা। তাই ইসলামের প্রধান সব নায়কদের পাশাপাশি নিজস্ব ইসলামী নায়কদের নিয়ে কাজ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে আমরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারছি না। বাঙ্গালী মুসলিমদের ঐতিহাসিক নায়ক কারা? – বুকে হাত দিয়ে কয়জন বলতে পারব যে এই প্রশ্নটি জীবনে একবার হলেও আমরা নিজেদের করেছি? আমাদের প্রিয় এই বাংলা অঞ্চল কীভাবে ও কাদের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হল? বাংলাদেশ যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তা কীভাবে ও কাদের কারণে হল? প্রশ্নগুলো কেউ এখন আর করে না। ফলে বাঙ্গালী আজ নিজস্ব ইতিহাসবিমুখ দেউলিয়া এক জাতি। নিজেদের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নায়কদের ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নিশ্চয় কোন এক ভোর সকালে উঠে বাঙ্গালীরা সমবেতভাবে মুসলিম হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি? তাহলে আজকের এই অবস্থায় আসতে নিশ্চয় অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই অবস্থায় আসতে কাদের অবদান রয়েছে? কাদের রক্ত-ঘাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে আমরা আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছলাম? কারা সেই মহানায়ক? – আমরা কি জানতে আগ্রহী নই তাঁদের ব্যাপারে?
বাংলার সুলতানি আমলের সুলতানদের সম্পর্কে আমাদের কতটুকু জানাশোনা আছে? আমরা কয়জন এই সময়ের অন্তত তিন জন সুলতানের নাম বলতে পারব? ইলিয়াস শাহী সালতানাত, হোসেন শাহী সালতানাত, কররানি সালতানাত সম্পর্কে কি আমরা পরিষ্কার ধারণা রাখি? নেপাল ও উড়িষ্যা বিজয়ী সুলতান ইলিয়াস শাহ (রহঃ) সম্পর্কে জানতে কেন আমাদের আগ্রহ হয় না? তাঁর পশুপতিনাথ বিজয় কি আপনার কাছে রোমাঞ্চকর মনে হয় না? আচ্ছা, উপরে উল্লেখিত সালতানাতগুলোর সুলতানদের নাম কি আমরা আলাদা করে বলতে পারব? অথচ তাঁরা কিন্তু প্রায় দীর্ঘ ২৫০ বছর বাংলা শাসন করেছে। এই সমস্ত মহানায়কদের শত শত বছরের ক্রমাগত জিহাদ-কিতালের ফলে এক এক করে এই অঞ্চলের বিভিন্ন ভূমি মুসলিমদের অধীনে আসে, তাঁদের অক্লান্ত দাওয়াহ’র ফলে কোটি কোটি মানুষ আজ যুক্ত হয়েছে উম্মাহ’র অংশ হিসেবে। ইসলাম প্রচারে বাংলার এই সমস্ত ঐতিহাসিক মহানায়কদের অবদান কি কম?
আজ মাহমুদ গজনবী (রহঃ) অমর হয়ে আছেন আমাদের হৃদয়ে, কিন্তু, সোমনাথের মতই গুরুত্বপূর্ণ আসামের কামাখ্যা ও উড়িষ্যার জগন্নাথ বিজয়ী বিগ্রহ বিনাশকারী মোহাম্মদ ফারমুলি (রহঃ), যার প্রচণ্ড নির্ভীকতায় একে একে পতিত হয়েছিল মিথ্যার প্রধান কেন্দ্রগুলো, তাঁর ব্যাপারে আমরা কয়জন জানি? কিংবা তাঁর পৃষ্ঠপোষক সুলাইমান খান কররানির (রহঃ) ব্যাপারে? এরাই আমাদের ঐতিহাসিক নায়ক যাদের ব্যাপারে আমাদের জানতে আগ্রহ হয় না। সুলতান মোহাম্মদ আল ফাতিহ’র (রহঃ) আলবেনিয়া কিংবা বসনিয়া বিজয়, কানুনি সুলতান সোলাইমানের (রহঃ) নেতৃত্বে সংঘটিত মোহাচের যুদ্ধ (Battle of Mohács) তথা হাঙ্গেরি জয় যদি আমরা এত আগ্রহ নিয়ে পড়তে পারি তাহলে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র (রহঃ) আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যা বিজয় কেন আগ্রহ নিয়ে পড়ছি না? তাঁর কি আন্তরিকতা কম ছিল ইসলাম প্রচারে? নাকি বাংলার মুসলিমদের মহানায়ক বলেই তাঁকে নিয়ে এত অনাগ্রহ? হ্যাঁ এটা ঠিক যে সুলতানি বাংলা মধ্যপ্রাচ্য হতে দূরবর্তী হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের পাওয়ার-পলিটিক্স ও চিরন্তন ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনে (যেমনঃ ক্রুসেড) অবদান রাখার সুযোগ পায়নি। তাই এর নায়কদের নিয়ে রোমান্টিসাইজ করা হয় না যেমনটা অন্যদের নিয়ে করা হয়। কিন্তু, তাই বলে তাঁদের সংগ্রাম কিন্তু বিন্দুমাত্র কম ছিল না; এটা ভুলে যাওয়া চলবে না।
এছাড়া আমাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক আলিম ও দাঈ’দের ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? তাঁদের জিহাদ ও দাওয়াতী জীবন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা প্রত্যেক বাঙ্গালী মুসলিমের দায়িত্ব। বাংলার মুসলিম ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র শাহ জালালের (রহঃ) জিহাদ ও দাওয়াতী জীবনের ব্যাপারে কি আমরা পরিপূর্ণভাবে জানি? তাঁর কারামতির ব্যাপারে সব জানলেও তিনি যে এক সশস্ত্র যুদ্ধের পর সিলেটের ভূমি অধিকার করেছেন তা জানি না। তাঁর সাথে থাকা মুজাহিদ হায়দার গাজী, শাহ ফারহান (শাহ পরান), সৈয়দ নাসিরুদ্দিন, সিকান্দার শাহ গাজী, গাজী বুরহানউদ্দিনদের (রহঃ) জিহাদ ও সংগ্রামময় জীবনের ব্যাপারে জানতে আমাদের ইচ্ছা হয় না। সেনাপতি ও দাঈ খান জাহান আলী (রহঃ) ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক ধর্মভীরু সুলতান মাহমুদ শাহের (রহঃ) ইসলামের প্রতি মেহনত নিয়ে কোন বিশদ আলোচনা হয় না। লিখা হয় না কোন সহজপাঠ্য বই। ইলিয়াস শাহী সালতানাত পতনের পর রাজা গণেশের হাতে বাংলায় ইসলামের আলো নিভতে বসেছিল। প্রচণ্ড আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাকে দমনের জন্য সংগ্রাম করে যান শাইখ নূর কুতুব উল আলম (রহঃ)। তাঁর নামই হয়ত আমরা অনেকে শুনিনি। দ্বীন প্রচারক আমাদের গৌরব এই সমস্ত নিজস্ব আলিম ও দাঈ’দের নিয়ে আমাদের নিজেদেরই কোন উচ্ছ্বাস নেই। তাঁরাই আমাদের ঐতিহাসিক নায়ক, অথচ কি নিদারুণ অবহেলিত আজ তাঁরা।
আচ্ছা এত আগের ইতিহাস বাদ দিই। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া তিতুমীর বিদ্রোহের নায়ক মীর নিসার আলীকে (রহঃ) আমরা কতটুকু সম্মান দিতে পেরেছি? অথবা ফরায়েজী আন্দোলনের হাজী শরীয়তউল্লাহকে (রহঃ)? তাঁদের নাম জানাটাই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নাকি তাঁদের কর্মের ব্যাপারেও আমাদের জানাশোনা দরকার ছিল? বালাকোটের যুদ্ধে অনেক বাঙ্গালী আলিম শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ইতিহাস কি কখনও পড়েছি? সৈয়দ আহমাদ বারেলভীর (রহঃ) অন্যতম শিষ্য বালাকোটের যোদ্ধা ও সংঘটক নোয়াখালীর মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীনের নাম হয়ত আমরা কখনও শুনিইনি। এভাবেই নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নায়কদের ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে আমরা হয়ে পড়ছি শিকড়হীন, আমাদের ইসলামী চেতনা হয়ে পড়ছে দুর্বল। .
এখন আসি কেন নিজস্ব ঐতিহাসিক ইসলামী নায়কদের ব্যাপারে আমাদের জানতে হবে, তাঁদের নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং গর্বিত হতে হবে। এর কারণ হল, তাঁদের নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করবে তখন তা মানুষের মনে এক প্রকার স্টিমুলাস (Stimulus) হিসেবে কাজ করবে। সাধারণ মানুষ তখন নিজেদের ইতিহাস পড়তে আগ্রহী হবে। মানুষ যখন তাঁদের ইতিহাস পড়বে তখন কয়েকটি বিষয় ঘটবে।
প্রথমত, তারা তাদের পূর্বপুরুষ এই সমস্ত নায়কদের ব্যাপারে জানতে পারবে। তাঁদের সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করতে পারবে। এইভাবে নিজেদের অতীতের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার মাধ্যমে তারা গর্বের জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে। ফলে বর্তমানে আমাদের মুসলিম পরিচয়ের যে ঐতিহ্যবিহীন দেউলিয়াত্ব দশা সেটা কেটে যাবে। গর্ব করার জন্য তখন অন্য জাতির দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকতে হবে না। নিজেদেরই কিছু নায়ক পেয়ে যাব যাদের নিয়ে কম গর্ব করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, সেই সমস্ত নায়কদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের সাথে আমাদের বর্তমান সংগ্রামকেও রিলেট করতে পারব। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে যে শত্রুরা ছিল তারা আজও বিদ্যমান রয়েছে। যে গরু খাওয়ার কারণে গাজী বুরহানুদ্দিন (রহঃ) তাঁর সন্তান ও নিজের এক হাত হারিয়েছিলেন সেই একই কারণে হিন্দের মুসলিমরা লিঞ্চিং এর শিকার হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শ্রীহট্টের গৌর গোবিন্দের বংশধররা আজ সারা ভারতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সুতরাং, ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের মুসলিমরা পরম্পরাসূত্রে সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করবে। যখন তারা পড়বে যে এক সময় এই বাংলার মুসলিমদের কালী পূজা ও দুর্গা পূজার জন্য কর দিতে হত, দাঁড়ি রাখার জন্য কর দিতে হত, মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য কর দিতে হত, এমনকি সন্তানের ইসলামিক নাম রাখার জন্যও কর দিতে হত, গরু খাওয়ার জন্য জীবন দিতে হত তখন তারা বুঝতে পারবে যে মুশরিক আর মুসলিমদের মাঝে এই দ্বন্দ্ব পূর্বেও ছিল। তখন তারা নিজেদের সেই সমস্ত সংগ্রামের নায়কদের উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করবে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে এই সংকট মোকাবেলায়।
তৃতীয়ত, যখন তারা এই ক্রমান্বয়ে চলে আসা সংগ্রামের সাথে নিজেদেরকে রিলেট করতে পারবে ও এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হবে এবং নিজেদের পূর্বকার সমস্ত সংগ্রামী নায়কদের উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করবে তখন এই শয়তানি শক্তির দমনে তারা নতুন করে সংগ্রামের জন্য উৎসাহ খুঁজে পাবে। তারা বুঝতে পারবে যে একজন মুমিনের জীবন মানেই সংগ্রাম। সেটা ৫০০ বছর আগে হোক বা পরে। সুতরাং, নতুন প্রজন্ম হতোদ্যম হবে না।
চতুর্থত, নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে যে বর্তমানে মুসলিম হিসেবে তারা যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে তা একদিনের নয় বরঞ্চ বহুদিনের সংগ্রামের ফসল। যা কিছুই মানুষ সংগ্রাম করে অর্জন করে তা ধরে রাখতে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অনেক বেশি এগ্রেসিভ হয়। সুতরাং, সংগ্রামী নায়কদের ইতিহাস জানার ফলে বর্তমান প্রজন্মের মুসলিমরা তাঁদের মুসলিম পরিচয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারবে। ফলে তারা এটিকে রক্ষায় আরও অনেক বেশি এগ্রেসিভ হবে। তারা এই দেশে ইসলাম ধরে রাখাতে ও মুসলিমদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার ক্রমাগত উন্নয়নের জন্য নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করবে।
পঞ্চম, বর্তমানে হিন্দুস্তানে ইররিডেন্টিস্ট (Irredentist) আর.এস.এস (RSS) সাম্রাজ্যবাদীদের স্বপ্ন হচ্ছে উপমহাদেশের সমস্ত মুসলিম দেশ দখলে নিয়ে সেখানে তাদের তথাকথিত রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং, এর বিপরীতে আমাদের সেই সমস্ত নায়কদের ইতিহাস পড়তে হবে যারা এইরূপ হুমকির শিকার হয়েছিল। বর্তমানের আর.এস.এস – কে কিছুটা মারাঠাদের সাথে তুলনা করে যেতে পারে। তাই আমাদের ইতিহাস পড়তে হবে সেই সমস্ত নায়কদের যারা মারাঠাদের এই বাংলায় রুখে দিয়েছিল। জনগণ এই সমস্ত নায়কদের ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে এই হুমকি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং একে দমনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সংগ্রামী স্পৃহা অর্জন করতে পারবে।
ষষ্ঠত, যখন আমরা এই দেশে ইসলাম প্রচারে জীবন বিলিয়ে দেয়া ঐতিহাসিক দাঈ ও আলিমদের ব্যাপারে আরও বেশী করে জানব তখন তাদের মত স্বার্থহীনভাবে ইসলাম প্রচার করার জন্য অনুপ্রাণিত হব। যাদের কারণে এই পৌত্তলিক ভূমি শরীয়াহ’র ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল তাঁদের সম্মানে শরীয়াহ’র প্রতি বেশি বেশি ভালোবাসা তৈরি হবে ও শরীয়াহ আইন ফিরিয়ে আনার জন্য অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হবে। তাঁদের মত জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’র প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে ইনশা আল্লাহ্।
এছাড়াও আরও বিবিধ কারণ আছে যা লিখা দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে আর লিখলাম না।
এখন আসি আমরা কি করতে পারি এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এর আলোচনায়। আমাদের করণীয় অনেক কাজ রয়েছে। আমি নিচে কয়েকটি উল্লেখ করলামঃ
১। ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই উন্নতমানের পেজ এবং গ্রুপ খুলতে হবে যেখানে আমাদের নিজস্ব ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নায়কদের ব্যাপারে আলোচনা হবে, পোস্ট দেয়া হবে। কিছু ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে যেখানে এই সংক্রান্ত সকল ম্যাটেরিয়াল সহজেই পাওয়া যাবে।
২। অডিও-ভিজুয়াল প্রচারণার জন্য খুব ভালমানের ইউটিউব চ্যানেল খুলতে হবে। এই ক্ষেত্রে কিংস এন্ড জেনারেলস (Kings and Generals), ইনভিক্টা (Invicta), নলেজিয়া (Knowledgia), হিস্টোরি-মার্চে (History Marche) ইত্যাদি চ্যানেলের মত উন্নত এনিমেশনভিত্তিক চ্যানেল তৈরি করতে হবে।
৩। দ্বীনি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে আসতে হবে। এই সমস্ত ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নায়কদের নিয়ে কথা বলতে হবে, ফেসবুক ও টুইটারে তাদের নিয়ে পোস্ট দিতে হবে, এলাকাভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে, বিনামূল্যে এই সংক্রান্ত বই বিতরণ করতে হবে।
৪। এই ব্যাপারে সহজপাঠ্য বই লিখতে হবে এবং তা জনপ্রিয় করার জন্য সমস্ত স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটির লাইব্রেরীতে আমরা এই ধরণের ইতিহাসভিত্তিক বই বেশী করে ছড়িয়ে দিতে পারি। এছাড়া শিশুদেরকে তাদের স্বদেশী ইসলামী নায়কদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এই সংক্রান্ত কার্টুনও তৈরি করতে হবে।
৫। ইসলামী সকল প্রতিষ্ঠানের নাম যেন এই সমস্ত স্বদেশী মহামান্য ইসলামী নায়কদের নামে করা যায় সেজন্য চেষ্টা-তদবির চালাতে হবে। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তন করে এরূপ ভালো নাম বাছাই করে রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি আস্তে আস্তে এর আওতা বাড়িয়ে অনৈসলামিক কাজের সাথে যুক্ত নয় এমন সব প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে দিতে হবে।
৬। প্রভাবশালী ইসলামী ব্যক্তিত্বদের জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে হবে যেন এই সমস্ত ইসলামী নায়কদের নামে মানুষরা তাদের সন্তানদের নাম রাখতে উদ্বুদ্ধ হয়। আমাদের সন্তানদের বেশী বেশী করে এরূপ নামকরণ করতে হবে এবং তাদের জানাতেও হবে যে কেন তাদের এইরুপ নামকরণ করা হয়েছে যাতে তারা বাঙ্গালী মুসলিম হিসেবে গর্বিত হতে পারে।
৭। ইতিহাসের এই নায়করা যেই জন্য যুদ্ধ করেছেন সেই কারণগুলো যেন মানুষ আরও আপন করে নেয় তার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে। যেমন তিতুমীর ও হাজী শরীয়তউল্লাহ (রহঃ) দাঁড়ি রাখার অধিকার, পূজায় কর না দেয়া ইত্যাদির জন্য সংগ্রাম করেছেন। আমাদেরকে তাই দাঁড়ি রাখা ও অন্য ধর্মের উপাসনায় সহযোগিতা না করা – ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ, ইসলামের নিদর্শনগুলো আমাদেরকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হবে।
বড় কথা হচ্ছে, আমাদের নিজস্ব এই সমস্ত ঐতিহাসিক ইসলামী নায়কদের কেন্দ্র করে একটি কালচারাল মুভমেন্ট তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে। এদেরকে আমাদের কালচারাল আইডেন্টিটির অংশ করে ফেলতে হবে। ইনশা আল্লাহ্ এতে অবস্থার অনেক উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। তবে তা করতে গিয়ে আমাদের প্রধান সমস্ত ইসলামী নায়কদের জানার ব্যাপারে যেন গাফেলতি না করে বসি সেজন্যও খুব সতর্ক থাকতে হবে। উভয়ের মধ্যে ব্যালেন্স স্থাপন করতে হবে আমাদের। সব শেষে, আমার আহবান থাকবে বিষয়টি নিয়ে আর দেরী না করে ঐকান্তিকভাবে ভেবে দেখার জন্য।