মুসনাদে আহমাদ থেকে বর্ণিত একই বর্ণনায় পাওয়া যায় উমর (রাঃ) আরও বলেন যে, এটি আরাফায় বিকালে নাযিল হয়েছিল আর দিনটি ছিল পবিত্র জুমু’আহ।

প্রথম আয়াত

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

“……আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার (প্রতিশ্রুত) নিয়ামত আমি পূর্ণ করে দিলাম, আমি তোমাদের জন্য ইসলামকেই দ্বীন (জীবনবিধান) হিসেবে মনোনীত করলাম……” (সূরা আল মায়িদাহ , ৫ :৩)

এ আয়াত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলো যে, দ্বীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে এবং দ্বীন ইসলামে আর না কোন কিছু না যোগ হবে অথবা না তা থেকে কিছু বাদ পড়বে। বিদআতের বিরোধীতার জন্য এবং আল্লাহ্‌র দেখানো পথকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য এই আয়াত বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা সাহাবীরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।

এই আয়াতটি আ’রাফার দিনে নাজিল হয় এবং এটি নাজিল হওয়ার পর থেকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তিকাল পর্যন্ত (ইবন জারির আত তাবারীর মতে ৮১ দিন ) হালাল-হারাম এর ব্যাপারে আর কোন আয়াত নাজিল হয় নি।

হযরত আনতারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ যখন এই আয়াতটি নাযিল হয় তখন উমর (রাঃ) কাঁদতে শুরু করলেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাঁদার কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “আমরা এই দ্বীন সম্পর্কে আরও বেশী আশা করছিলাম। কিন্তু তা যখন পূর্ণতা লাভ করেছে, তখন তো এর চেয়ে বেশী আশা করা যায় না বরং ক্রমান্বয়ে এর অবনতিই আশংকা করা যায়।” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, “তুমি সত্য বলেছো।” (তাফসীর ইবন কাসির, তাফসীর তাবারী)

সুবহান আল্লাহ্‌! উমর (রাঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে, দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা লাভের মাধ্যমে হালাল-হারাম আর আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত ওহী স্থগিত থাকার অর্থ হল রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) শীঘ্রই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। আর তিনি কি চমৎকারভাবেই না দ্বীন এর এই “কমে যাওয়া”র ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যা কিনা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আরেকটি হাদিস দিয়ে সমর্থিত হয়, যেখানে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “নিঃসন্দেহে, ইসলাম শুরু হয়েছিল অপরিচিত অবস্থায় আর তা পুনরায় ফিরে যাবে অপরিচিত অবস্থায় -সে অপরিচিতদের জন্য সুসংবাদ।” (মুসলিম, তিরমিযি)

একটি অবাক করা ব্যাপার হল, অধিকাংশ মুসলিমরা (হোক আলিম অথবা অন্যান্যরা) এই আয়াতের ব্যাপারে মোটেও সৎ না অথচ ইয়াহুদিরা এই আয়াত এর তাৎপর্য ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলো আর উমর (রাঃ) এর কাছে এই আয়াত সম্পর্কে তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলো –

“আপনি এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করেছেন যা আমাদের উপর নাযিল হলে আমরা দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম।” তখন উমর (রাঃ) বললেন, “আমি জানি এই আয়াত কখন আর কোথায় নাযিল হয়েছিল, এবং যখন এই আয়াত নাযিল হয়েছিল তখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথায় অবস্থান করেছিলেন – (এটা নাযিল হয়েছিলো) আ’রাফার দিনে, আর আল্লাহ’র শপথ! আমি আ’রাফায় ছিলাম।” (বুখারি)

মুসনাদে আহমাদ থেকে বর্ণিত একই বর্ণনায় পাওয়া যায় উমর (রাঃ) আরও বলেন যে, এটি আরাফায় বিকালে নাযিল হয়েছিল আর দিনটি ছিল পবিত্র জুমু’আহ।

ইবন মারদাওিহ থেকে বর্ণিত আছে যে আলি (রাঃ) বলেন, “যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আ’রাফায় দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন আর এটা ছিল বিকেল (আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়)।”

সাহাবীরা এই আয়াত নাযিল হওয়ার বরাবর সময় ও স্থান সম্পর্কে জানতেন,আর এই আয়াত তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ইসলামের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র অনুমোদন ও নিশ্চয়তা প্রদান করে, যা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দেওয়া বিরাট এক অনুগ্রহ।

মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য এই দ্বীন অর্থাৎ জীবনব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে দিয়েছেন, আর এই দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে মনোনীত করার পর এতে কোন কিছু যুক্ত করা বা বর্জন করে দেওয়ার ব্যাপারে এই দ্বীন সম্পূর্ণ মুক্ত।

এই ব্যাপারটি তো এমনকি ইহুদীরা পর্যন্ত ভালভাবে বুঝতে পেরে উমার (রাঃ) কে বলেছিল যে তাদের উপর এই আয়াত নাযিল হলে তারা দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতো। কিন্তু সাহাবীরা – যারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সত্যিকার অর্থেই নিজেদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, তারা এই আয়াতের তাৎপর্য বুঝতে পেরেও যে দিন এই আয়াত নাযিল হয়েছিলো তার স্মরণে প্রতি বছর ওই একই দিন এ ঈদ পালন করার মত বিদআত চালু করার কোন ইচ্ছা পোষণ করতেন না, যদিও এই আয়াত উম্মাহকে এক চরম মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। কারন সুন্নাহ ও বিদআত সম্পর্কে তারা খুব ভালমতোই জানতেন আর এটাই হল রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা দ্বীনের ক্ষেত্রে নিজেদের মর্জি মোতাবেক চলতেন না, তারাই ছিলেন সুন্নতের সর্বোত্তম অনুসারী আর এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ অংশ।

ইবন কাসির (রহ.) বলেন, “আল্লাহ’র দেওয়া শ্রেষ্ঠ রহমতগুলোর একটি হল এই যে, তিনি দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন,তাই মুসলিমদের অন্য কোন জীবনব্যবস্থা আর তাদের নিজেদের নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য নবীর প্রয়োজন নেই। এ কারনেই আল্লাহ্‌ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কে খাতামুন-নাবিয়্যিন হিসেবে ভূষিত করেছেন এবং জিন ও মানবজাতির কাছে তার বার্তাবাহক হিসেবে পাঠিয়েছেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)যেগুলো হালাল বলেছেন কেবল সেগুলোই হালাল আর যেগুলো হারাম বলেছেন কেবল সেগুলোই হারাম। কেবলমাত্র সেগুলোই দ্বীনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে যেগুলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যেগুলো আমাদের জানিয়ে যাননি সেগুলো কখনও দ্বীনের অংশ হতে পারে না। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সবই ছিল সত্য ও শুদ্ধ, এমনকি তাতে কোন ধরনের সূক্ষ্ম ভুল বা অসততা ছিলোনা।”

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি ইসলামে বিদআত শুরু করে আর মনে করে সেটা কল্যাণকর, সে যেন দাবী করলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতারণা করেছে। আল্লাহ্‌ কি বলেছেন তা পড়ুন – ‘…… আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার (প্রতিশ্রুত) নিয়ামত আমি পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবনবিধান) হিসেবে আমি ইসলামকেই মনোনিত করলাম……’ (সূরা আল মায়িদাহ, ৫:৩)। তাই দ্বীনের ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সাহাবিদের সময় যেটা দ্বীনের অংশ ছিল না, সেটাকে এর পরবর্তী সময়েও দ্বীনের অংশ হিসেবে মনে করা ও পালন করা যাবে না। আর এই উম্মতের শেষ অংশ ততক্ষন পর্যন্ত কখনোই পরিশুদ্ধ হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা এই উম্মতের প্রথম অংশ (সাহাবা) যেটা দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়েছিলেন তারাও সেটা দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়।” (ইমাম শাতিবী’র আল ই’তিসাম)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “এমন কিছুই নেই যেটার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ আদেশ দিয়েছেন অথচ আমি আদেশ দেই নি। আর না এমন কিছু আছে যা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ নিষেধ করেছেন অথচ আমি নিষেধ করিনি।” (বায়হাকি, ৭/৭৬)

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি তোমাদের যা কিছু করতে আদেশ করেছি সেগুলো ছাড়া এমন কিছু তোমাদের না বলে যাইনি যা তোমাদেরকে আল্লাহ’র নিকটবর্তী হতে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে; এবং আমি তোমাদের যা কিছু থেকে নিষেধ করেছি সেগুলো ছাড়া এমন কিছু তোমাদের না বলে যাইনি যা তোমাদের জাহান্নাম এর নিকটবর্তী ও আল্লাহ্‌ থেকে দুরবর্তী করে দিবে।”

আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ওফাতের পূর্বেই দুই ডানায় ভর করে উড়ে যাওয়া পাখি থেকেও আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন।” (মুসনাদে আহমাদ)

এক মুশরিক সালমান আল-ফারসী (রাঃ) কে বলল, “তোমাদের নবী তো তোমাদের সবই শিখিয়েছেন, (এত বেশী শিখিয়েছেন যে) এমনকি টয়লেটের ব্যাপারেও।” সালমান আল ফারসী (রাঃ) জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদেরকে এটাও নিষিদ্ধ করেছেন যে আমরা যেন কিবলামুখী হয়ে টয়লেট না করি আর তিনটির কম পাথর দিয়ে পবিত্রতা অর্জন না করি, আর ডান হাত পবিত্রতা অর্জনের জন্য ব্যবহার না করি এবং গবর বা হাড়কে পবিত্রতার কাজে ব্যবহার না করি।” (মুসলিম)

আয়েশা (রাঃ)থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি এমন কাজ করলো যা (দ্বীনের ক্ষেত্রে) আমাদের (রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের) অনুসরনে না, তবে সে কাজটি প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারি ও মুসলিম)

আশ-শাওকানি (রহ.) নাইলুল আওতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসটির প্রতি ভালোভাবে মনোযোগ দেওয়ার জন্য এবং এই হাদিসটি (উপরের হাদিসটি) মন্দের (মুনকার) বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ও মুনকারকে বাতিল করতে উপদেশ দিয়েছেন।

“যে আমাদের দ্বীনে নতুন কোন প্রথা চালু করলো যা এই দ্বীনের কোন অংশ নয়, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত।” (মুসনাদে আহমাদ)

ইবন রজব (রহ.) এই হাদিস সম্পর্কে বলেন, “এই হাদিসটি একটি পরিস্কার দলিল যে, যেসব কাজ (দ্বীনের ক্ষেত্রে) শারিয়াহ দ্বারা অনুমদিত নয় সেগুলো অবশ্যই ইসলাম কতৃক প্রত্যাখ্যাত।” (জামি’ আল উসুল, ১/১২০)

আল-মারওয়াজি (রহ.) তার আস-সুন্নাহ গ্রন্থে বলেন, উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) বলেন, “সুন্নত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে কারো কোন ওজর থাকার মানে হয় না যে, কেউ এমন একটি ভুলের উপর পথভ্রষ্ট অবস্থায় আছে যাকে সে হিদায়াত মনে করছে।”

দ্বিতীয় আয়াত

وَأَنَّ هَـٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“এটিই আমার দেখানো পথ, এটিই অনুসরন কর এবং অন্য কোন পথ অনুসরন কর না, অন্যান্য পথগুলো তার পথ থেকে তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের এটি আদেশ করছেন যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। ” (সূরা আল আনআ’ম :১৫৩)

ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)মাটিতে একটি দাগ কাটলেন আর বললেন, ‘এটিই আল্লাহ’র দেখানো সরলপথ’। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ডানে-বামে কিছু দাগ কেটে বললেন, ‘এই সরলপথের আশেপাশে বেশ কিছু পথ আছে, তার প্রত্যেক পথের মাথায় শয়তান আছে, যে ওই পথের দিকে ডাকে।’ এরপর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।” (মুসনাদে আহমাদ, সুনান নাসাঈ, মুসতাদরাক হাকিম, দারিমী)

মুজাহিদ (রহ.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এই আয়াতে অন্যান্য পথ বলতে বুঝানো হয়েছে প্রবৃত্তির অনুসরন ও বিদআতকে।”

আশ-শাতিবী (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “সরলপথ হচ্ছে আল্লাহর দেখানো সেই পথ, যে পথে তিনি আহবান করেন এবং এই পথটি হল সুন্নত। আর অন্যান্য পথ হল তাদের পথ, যারা এই পথ থেকে মতানৈক্য করে ও আল্লাহ্‌র পথ থেকে সরিয়ে রাখে; এরা হল বিদআতি। এই পথগুলোকে গুনাহের পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নি, কারন গুনাহের কাজকে কেউ সর্বদা অনুসরনের পথ হিসেবে নেয় না, কারন তা শারিয়াহ’র বিপরিত; বরং এই ব্যাখ্যাটি নব উদ্ভাবিত প্রথা বা বিদআত এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাকে ভাল মনে করে করা হয় অথচ তা শারিয়াহ’র সাথে সাঙ্ঘর্ষিক।”

ইবন মাসউদ (রাঃ) কে একবার সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরলপথ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেনঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এই পথের শুরুতে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে গিয়েছেন, যার সমাপ্তি জান্নাতে। এর ডানে ও বামে দ্রুতগামি মানববাহী ঘোড়া (এটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে তারা যে গতিতে মানুষকে দোযখে পরিচালিত করবে তাকে) এই সরলপথের উপর চলতে থাকা মানুষদের তাদের সাথে আসার জন্য জন্য তাদের ডাকতে থাকে; তাই যারা তার ডাকে সারা দিবে তা তাদেরকে দ্রুত জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে এবং যারা ওই সরল পথের উপর অবিচল থাকবে, সেই অবিচলতা তাদেরকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করবে।”

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন,“আমার উদাহারন সে ব্যক্তির মতো, যিনি আগুন জ্বালালেন, এবং যখন আগুন তার চারদিক আলোকিত করলো, পতঙ্গ ও সে সকল কীট যারা আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে, তারা দলে দলে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো আর সে ব্যক্তি তাদের বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু তারা সে ব্যক্তিকে পরাস্ত করে ঝাপিয়ে পড়তে লাগলো। ঠিক তেমনি আমিও তোমাদের কোমর ধরে তোমাদেরকে আগুন থেকে পিছনে টানছি এটা বলে যে – ‘আগুনের কাছ থেকে তোমরা ফিরে আস’, কিন্তু তোমরা আমাকে পরাস্ত করে তাতে ঝাপিয়ে পড়ছো।” (বুখারি, মুসলিম; মুসলিম শরিফে সামান্য কিছু শাব্দিক পরিবর্তনের সাথে এ হাদিসটি বর্ণিত আছে,শেষের দিকে তার বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত সংযোজন আছে।)

আল ইরবাদ ইবন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “…… আমি তোমাদের কে এক সুস্পস্ট হিদায়াতের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত হচ্ছে দিনের মতো। ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়া কেউই এই পথ থেকে পথভ্রষ্ট হবে না।“ (মুসনাদ আহমাদ, ইবন মাজাহ, মুসতাদরাক হাকিম)

“আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, এই দুটো জিনিস আঁকড়িয়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এগুলো হল আল্লাহ্‌’র কিতাব ও আমার সুন্নত।” (মুসতাদরাক হাকিম)

“…… যে (ব্যক্তি) আমার সুন্নত অনুসরণ করলো সে হিদায়াতপ্রাপ্ত হল, আর যে (ব্যক্তি) বিদআত অনুসরন করলো সে ধ্বংস হল।” (মুসনাদ আহমাদ)

আবু নাজিহ আল ইরবাদ বিন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একবার রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ উপদেশ দিলেন,যা আমাদেরকে ভীষণভাবে প্রকম্পিত করলো আর আমাদের অন্তরে ভয়ের ঢেউ আঘাত করলো আর আমাদের চোখের অশ্রু বর্ষণ করলো। …… তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে তারা অনেক ব্যাপারে মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের জন্য আবশ্যক হবে আমার সুন্নতের অনুসরণ করা আর আমার খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নতের অনুসরণ করা এবং তাদের সুন্নতের সাথে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকবে, এবং দ্বীনের মধ্যে সকল বিদআত সম্পর্কে সতর্ক থাকবে কারন প্রত্যেক বিদআত ভুল পথের দিকে পরিচালিত করে।” (দাউদ – হাদিস ৪৬০৭; তিরমিযি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭৬; ইবন মাজাহ’র আল মুকাদ্দিমাহ – হাদিস ৪২; মুসনাদ আহমাদ – ৪/১২৬/১২৭; আবু দাউদ ও তিরমিযি এই হাদিসকে নির্ভরযোগ্য হাদিস হিসেবে বলেছেন।)

এবং, খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নত অনুসরণের ব্যাপারে উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সুন্নত প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং খুলাফায়ে রাশিদিন সেই সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। সুতরাং সেই সুন্নতের চর্চা প্রমান করে কোন ব্যক্তির আল্লাহ্‌র কিতাবের উপর বিশ্বাস,আল্লাহ্‌কে মান্য করার পরিপূর্ণ ইচ্ছা আর আল্লাহ’র দেওয়া দ্বীনের উপর অবিচলতার ক্ষেত্রে তার সত্যবাদিতা। কেউ এই সুন্নতের বিকৃতি সাধন করতে পারবে না, আর না পারবে কোন কিছু মান্য করতে যা এর বিরোধীতা করে। যে এই সুন্নাহ মেনে চলবে সে সঠিক পথেই চলবে, আর যে এর মাধ্যমে আল্লাহ’র সাহায্য খুঁজবে সে বিজয়ী হবে; এবং যে এর বিরোধিতা করবে ও একে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে আর অন্য কোন পথ অনুসরন করবে, আল্লাহ্‌ তাকে সেই পথেই ছেড়ে দিবেন যে পথ সে অনুসরন করতে চায়, ফলে সে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে, কতই না নিকৃষ্ট সে বাসস্থান।” (ইগাতুল লাহফান, ১/১৫৯)।

হুযায়ফা ইবন আল-ইয়েমেন (রাঃ) বলেন, “ ইবাদাতের ক্ষেত্রে সাহাবীরা যা করেন নি, তা কখনও করবে না।” (আবু দাউদ)

“আমি তোমাদেরকে দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার ব্যাপার থেকে সাবধান করছি। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।” (সুনান নাসাঈ ৫/২৬৮, ইবন মাজাহ ৩০২৯, মুসনাদে আহমাদ ১/২১৫,৩৪৭)

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একদিন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য তিন ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর স্ত্রীদের নিকট আসলো। যখন তাদেরকে (সে ব্যাপারে) জানানো হল, তখন তারা বলল, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে আমাদের তুলনা কোথায়, যার আগে-পরের সব গুনাহ আল্লাহ্‌ মাফ করে দিয়েছেন ?”

এরপর তাদের একজন বলল, “আমি সর্বদা সারা রাত সালাত আদায় করি।” অপরজন বলল, “আমি সর্বদা রোযা রাখি, কখনও রোযা ছাড়ি না।” তৃতীয় ব্যক্তি বলল, “আমি সর্বদা মেয়েদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকি, কখনও বিয়ে করব না।”

এমন সময় রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদের কাছে আসলেন আর বললেন, “তোমরাই কি সেসব লোক যারা এসব কথা বলেছ ? আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহ্‌কে তোমাদের থেকে বেশী ভয় করি আর তার নিষিদ্ধ কাজ থেকে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশী পরহেয করি। এরপরেও আমি কোন দিন রোযা রাখি আর কোন দিন ছেড়ে দেই। আমি নামাজও পড়ি, ঘুমিয়েও থাকি, আমি বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হবে সে আমার কেউ নয়।” (বুখারি, মুসলিম)

এই হাদিস থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, তিন ব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়্যতে কিছু ইবাদাত করতে চাচ্ছে যার মাধ্যমে তারা আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জন করতে চায় আর তাদের গুনাহগুলো ঝরিয়ে ফেলতে চায়। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জলজ্যান্ত উদাহারন দেখিয়ে সুন্নতের সীমারেখা দেখিয়ে দেন আর জানিয়ে দেন, যে কেউই এই সীমারেখা থেকে বিমুখ হবে আর অন্য কোন পথ অন্বেষণ করবে (এমনকি নিয়্যত বিশুদ্ধ হলেও), তার সাথে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোন সম্পর্ক থাকবে না। নিঃসন্দেহে সেভাবেই আল্লাহ্‌কে ভয় করা (তাকওয়া অবলম্বন করা) উচিত, যেভাবে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌কে ভয় করতেন।

সাহাবাদের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, তারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নতের প্রতি বিশুদ্ধভাবে আনুগত্য করতেন আর বিদআতকে ঘৃণা করতেন (যেহেতু তা সুন্নতের বিপরীত) ও এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন চলতেন। নিঃসন্দেহে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতের ব্যাপারে তারাই হলেন তাদের পরবর্তী যে কারো থেকে অধিক জ্ঞানী।

কিছু সাহাবা থেকে নিচের এই বর্ণনাটি পাওয়া যায়ঃ

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “আমরা আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) এর বাসার সামনে অপেক্ষা করছিলাম একসাথে ফজর সালাত আদায় করতে মাসজিদে যাওয়ার জন্য। আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ) আমাদের কাছে আসলেন আর বললেন, ‘আব্দুর রহমান (আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ) কি বেরিয়ে গিয়েছে ?’ আমরা বললাম, ‘না।’। অতঃপর তিনিও আমাদের সাথে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) ঘর থেকে বের হলে মসজিদে রওনা দেওয়ার জন্য আমরা উঠে গেলাম।

আবু মুসা (রাঃ) তাকে বললেন, “আব্দুর রহমান, আমি কিছুক্ষন আগে মসজিদে এমন একটা ব্যাপার দেখলাম, যা আমার কাছে ভাল বলে মনে হয় নি।” আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কি ছিল ?”

আবু মুসা (রাঃ) বললেন, “আপনি যদি বেঁচে থাকেন তবে আপনিও তা দেখবেন। মসজিদে আমি একদল লোক দেখলাম যারা ছোট ছোট দলে বৃত্তাকার হয়ে বসে সালাতের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক বৃত্তাকার দল একজন দলপতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আর প্রত্যেক ব্যক্তির হাতে ছোট পাথর আছে। যখন দলের আমির বলে, ‘একশবার আল্লাহু আকবর বলো’, তখন তারা একশবার আল্লাহু আকবর বলো। এরপর বলা হয় ‘একশবার লা ইলাহা ইল্লালাহ বল’, তখন তারা একশবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। এরপর বলা হয়, ‘একশবার সুবহান-আল্লাহ বলো’, তারা একশবার সুবহান আল্লাহ বলে।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তাদেরকে তুমি কি বলেছ ?”

আবু মুসা (রাঃ) বললেন, “আমি আপনার মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলাম, তাই তাদের কিছু বলিনি।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তুমি কি তাদেরকে এর বদলে তাদেরকে নিজেদের গুনাহ গুনে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সওয়াব পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে আসতে পারলে না ?”

এরপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) মাসজিদের দিকে গেলেন আর আমরাও তার সাথে গেলাম।

তিনি মাসজিদে গিয়ে একটি দলের কাছে গেলেন (যারা একসাথে সেই কাজ করছিলো) আর বললেন, “তোমরা এগুলো কি করছ ?”

তারা বলল, “আব্দুর রহমান, এই ছোট পাথরগুলো দিয়ে আমরা আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও সুবহান আল্লাহ কতবার বলছি তা গুনে রাখছি।”

তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের গুনাহগুলোই গুনে রাখো, আমি তোমাদের নিশ্চিতভাবে বলছি, তোমাদের কোন সওয়াবই হচ্ছে না। দুর্ভাগ্য তোমাদের হে লোকেরা, কত দ্রুতই না তোমরা ধ্বংস হবে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীরা যেখানে জীবিত এবং না তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) পোশাক এখনও জরাজীর্ণ হয়েছে আর না তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) পাত্রদানি ভেঙ্গেছে। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, তোমরা অনুসরন করছো এমন একটা দ্বীনের, যেটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর দ্বীনের থেকে উত্তম (তোমাদের দাবী অনুসারে)অথবা তোমরা বিপথগামীতার দরজা খুলছো।”

তারা বলল, “আল্লাহ’র শপথ করে বলছি হে আব্দুর রহমান, আমাদের ভাল নিয়্যতের কারনে আমরা এটা করছি, অন্য কোন নিয়্যত এতে নেই।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তাতে কি ? কত মানুষই না ভাল নিয়্যতে ভাল কাজ করতে চায় কিন্তু সেগুলো (সত্যিকার অর্থে) করতে পারে না ? রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সেসব মানুষ সম্পর্কে জানিয়েছেন যারা কুরআন তিলাওয়াত করবে অথচ তাদের উপর এর কোন প্রভাব থাকবে না বরং কুরআন তাদের কণ্ঠনালীই অতিক্রম করবে। আল্লাহ’র শপথ করে বলছি,আমি প্রায়ই নিশ্চিত যে তোমাদের মধ্যে বেশিরভাগই সে ধরণের লোক।”

এরপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) তাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

আমর ইবন সালামাহ (রাঃ) বললেন, “সেই দলের সাথে থাকা অনেক ব্যক্তিকেই আন-নাহরাওয়ান এর যুদ্ধে খারিজিদের পক্ষ হয়ে আমাদের (সাহাবাদের) বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা দেখেছিলাম।”

[ সুনান দারিমী (১/৭৯) এবং আবু নাঈম এটি নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়েত এ বর্ণনা করেছেন। ]

আবদুল্লাহ ইবন আবি সালামাহ থেকে বর্ণিত আছে যে সাহাবী সা’দ ইবন মালিক (রাঃ) দুজন মানুষকে হজ্জ পালন করার সময় বলতে শুনলেন, “লাব্বাইক সাল-মা’আরিজ (আমরা শুনলাম এবং আসলাম, হে ঊর্ধ্বগমনের পথের মালিক)”, সা’দ ইবন মালিক (রাঃ) বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সময়ে আমরা (সাহাবীরা) এটি কখনও বলিনি।”

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “সালাফদের বাণী ও পথের সাথে লেগে থাকো, দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত ব্যাপার থেকে সতর্ক থাকো, কারন দ্বীনের ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবিত প্রত্যেক কিছুই বিদআত।” (আস-সুয়্যুতির’র সাউনুল মানতাক গ্রন্থে বর্ণিত)

ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, “সুন্নতের মৌলিক নীতিগুলো হল………… বিদআত থেকে দূরে থাকা, আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহি।” (উসুল আস সুন্নাহ)

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, “উম্মতের প্রথম ভাগ যা দ্বারা উপকৃত হয়েছিল, তা ছাড়া অন্য কিছু উম্মতকে উপকৃত করবে না।” (ইবন তাইমিয়্যাহ’র কিতাব – কাইদাহ জালিলাহ ওয়া তাওাসসুল ওয়াল ওয়াসিলাহ)

ইমাম আল-আওযায়ি’র বলেছেনঃ “সবরের সাথে নিজেকে সুন্নতের গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ করে নাও আর এ ব্যাপারে সাহাবীদের অবস্থান কখনও অতিক্রম করবে না; তাদের মত করে সুন্নত আঁকড়ে ধরার চেষ্টা কর আর তারা যা পরিহার করতেন তা পরিহার করে চল। সালাফ আস-সালিহিনদের (সাহাবী এবং তাদের অনুসারীদের) পথকে গ্রহন করে নাও, নিশ্চয়ই যেটা তাদের জন্য পর্যাপ্ত ছিল তা তোমাদের জন্যও পর্যাপ্ত।” (ইবন আল-জাওজী (রহ.) তার কিতাব তালবিস ইবলিস)

ইমাম জুহরী (রহ.) ইমাম মালিক (রহ.) এর এই উক্তিটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেনঃ “সুন্নাহ’র সাথে নিজেকে আটকিয়ে রাখাটা ঠিক যেন নুহ (আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নৌকার উদাহারনের ন্যায়। যে এতে চড়ল সে বেঁচে গেল এবং যে তা করলো না সে ধ্বংস হয়ে গেলো।” (দারিমী)

সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) বলেন, “কাজ ছাড়া কোন কথাই গ্রহণীয় নয়; আর কাজ ও কথা সঠিক নিয়্যত ছাড়া পরিশুদ্ধ নয়; এবং কথা, কাজ ও বিশুদ্ধ নিয়্যত সঠিক হয় না যতক্ষন না পর্যন্ত তা সুন্নত অনুযায়ী করা হয়।”

সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) আরও বলেন, “অন্যান্য যেকোনো পাপের তুলনায় বিদআত শয়তানের নিকট অধিক প্রিয়, কেননা পাপ থেকে তওবা করা হয় (এটাকে পাপ হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায় বলে) কিন্তু বিদআত থেকে তওবা করা যায় না (কারন মানুষ বিদাআতকে ইবাদাতের নতুন একটা ভাল রূপ হিসেবে বিশ্বাস করে, যা তাকে সেটাকে পাপ হিসেবে চিন্তা করতে দেয় না, এভাবে তার জন্য তওবা করা হয়ে উঠে না।)” (শারহ উসুল ই’তিকাদ)

তিনি আরও বলেন, “… অতএব তোমরা মূল বিষয়ের [রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীদের জামাআত] সাথে নিজেদের দৃঢ়ভাবে আটকিয়ে রাখো।” (আল হিলইয়া, ৬/৩৭৬)

শাইখ আল-বারবাহারি (রহ.) বলেন, “জেনে রেখো, যে দ্বীন আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এসেছে, সেটি সুউচ্চ ও পবিত্র। এটি এমন কোন দ্বীন নয় যা কিনা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও মনগড়া মতামতের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দ্বীনের পবিত্র জ্ঞান আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে আমরা পাই, সুতরাং সেটা বাদ দিয়ে তুমি তোমার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না আর এর মাধ্যমে নিজেকে দ্বীন থেকে পথভ্রস্ট করো না এবং দ্বীনের গন্ডি ছেড়ে দিয়ো না। সুন্নত থেকে পথভ্রষ্ট হওয়ার কোন কারণই গ্রহণীয় নয় কারন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সুন্নতকে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সাহাবীদের কাছে সুন্নতকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। মনে রাখবে, তারাই হলেন জামাআত, তারাই উম্মতের প্রকৃত অংশ, আর তাদের সত্যিকার অনুসারীরাই সেই জামাআতের অন্তর্ভুক্ত।”

তৃতীয় আয়াতঃ

وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا

“যে ব্যক্তি তার কাছে প্রকৃত সত্য স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে আর ঈমানদারদের পথ ছেড়ে অন্য নিয়মনীতির অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ধাবিত করব যেদিকে সে ধাবিত হয়েছে, তাকে আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দিব, কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল সেটি।” (সূরা আন-নিসা, ৪ :১১৫)

ইমাম ইবন কাসীর (রহ.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এ আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ গ্রহন করে। এর ফলে তাদের অবস্থান শারিয়াহ’র অবস্থানের অন্যদিকে হয়, যদিও সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট আর তারা সেটা জানেও।”

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে যাবে (তবে) সে ছাড়া, যে সেখানে প্রবেশ করাকে প্রত্যাখ্যান করবে।” তখন জানতে চাওয়া হল, “কে প্রত্যাখ্যান করবে ?” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যে আমাকে মেনে চলবে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমাকে অমান্য করে সে যেন জান্নাতে প্রবেশ করাটা প্রত্যাখ্যান করলো।” (বুখারী)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন, “আমি হাউজের (হাউজে কাউসারের) পাড়ে তোমাদের আগে উপস্থিত থাকবো। যে সেখানে উপস্থিত হবে, সেখান থেকে সে পান করার সুযোগ পাবে। আর যে একবার সে হাউজ থেকে পান করবে সে কখনোই তৃষ্ণার্ত হবে না। অবশ্যই এমন কিছু দল আমার কাছে উপস্থিত হবে যাদেরকে আমি (আমার উম্মত বলে) চিনতে পারবো এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। কিন্তু এর পরই তাদের ও আমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেওয়া হবে।”

আবু সাঈদ খুদরি বর্ণিত একই হাদিসে এরপর বলা হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বলবেন, “এরা তো আমারই অনুসারী।” তখন বলা হবে, “আপনি নিশ্চয়ই জানেন না যে, আপনার পড়ে এরা দ্বীনের মধ্যে কই পরিবর্তন করেছে।” এটা শুনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলবেন, “যারা আমার পড়ে (দ্বীনের মধ্যে) পরিবর্তন করেছে, তারা দূর হোক, দূর হোক।” (বুখারী, মুসলিম – ভিন্ন বর্ণনায় হাদিসটি উল্লেখ করা আছে)

“যে ব্যক্তি বিদআত করে অথবা বিদআতিকে সমর্থন করে, তার উপর আল্লাহ্‌, তার ফেরেশতা এবং পুরো মানবজাতির অভিশাপ বর্ষিত হয়।” (বুখারী, মুসলিম)

চতুর্থ আয়াতঃ

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“… সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের এ ব্যাপারে ভয় করা উচিত যে তাদের উপর (এ বিরুদ্ধাচরনের জন্য এ দুনিয়ায়) কোন ফিতনা এসে পড়বে কিংবা (পরকালে) কোন কঠিন আযাব এসে তাদের গ্রাস করে নিবে।” (সূরা নূর, ২৪ :৬৩)

ইমাম ইবন কাসীর (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “যে ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশের এবং তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নতের, হুকুমের, নীতির আর শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। মানুষের কথা ও কাজকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নত ও হাদিসের সাথে মিলিয়ে দেখা উচিত। যদি সেটা তার সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে সেটা ঠিক আছে, আর যদি সুন্নাতের সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে।”

এক ব্যক্তি ইমাম মালিক (রহ.) কে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক কোথা থেকে আমাকে ইহরাম করতে হবে ?” তিনি বললেন, “যেখান থেকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) করতেন – যুল হুলায়ফাহ।” লোকটি বলল, “আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কবর এর পাশ থেকে তা করতে চাই।” তিনি বললেন, “সাবধান! সেটা কর না। আমি ভয় করছি যে তোমার উপর ফিতনা আপতিত হবে।” লোকটি বলল, “তা কেন হতে যাবে ? আমি যেখান থেকে করতে চাচ্ছি সেটা তো যুল হুলায়ফাহ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।” তিনি বললেন, “তুমি এমন কোন ভাল কাজ করতে যাচ্ছ যার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কোন নির্দেশ দেন নি ?” এরপর ইমাম মালিক (রহ.) লোকটিকে সূরা নূর এর এ আয়াতটি (৬৩) তিলাওয়াত করে শুনালেন।

পঞ্চম আয়াতঃ

يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ

“সেদিন (বিচার দিবসে) কিছু সংখ্যক চেহারা শুভ্র হয়ে যাবে (আমলনামা ভাল হওয়ার কারনে) আর কিছু সংখ্যক চেহারা কাল হয়ে যাবে (আমলনামা খারাপ দেখার কারনে) ,যাদের মুখ কালো হয়ে যাবে তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, ‘তোমরা কি ইমান এর পরও কুফরি করেছো ? এখন তোমরা যা প্রত্যাখ্যান করেছো তার কারনে আযাব ভোগ করতে থাকো।’ ” (সূরা আল-ইমরান, ৩ : ১০৬)

ইবন আব্বাস (রাঃ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “সুন্নতের অনুসারিদের মুখমণ্ডল শুভ্র (উজ্জ্বল) হবে আর বিদআতী লোকদের চেহারা কালো (হতাশায় বিষাদময়) বর্ণ ধারণ করবে।”

কুরতুবি (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ’র দ্বীনের কোন কিছু পরিবর্তন করবে সে ওই কাল বর্ণের চেহারার লোকদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এদেরকেই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাউজে কাউসার এর নিকট যেতে বাধা দেওয়া হবে আর সেখান থেকে পান করাতে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নিষেধ করা হবে।”

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “বিদআতী ব্যক্তি যতক্ষন পর্যন্ত তার বিদআত ছেড়ে দিবে না, ততক্ষন পর্যন্ত তার তওবা কবুল করা হবে না।” (তাবারানি, বায়হাকি)

ষষ্ঠ আয়াতঃ

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا

“তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহ’র রসূলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে এমন সব ব্যক্তির জন্য,যারা আল্লাহ’র সাক্ষাত পেতে আগ্রহী আর যারা পরকালের মুক্তিলাভের আশা করে।” (সূরা আহযাব, ৩৩ : ২১)

ইবন আব্বাস (রহ.) ও মুওাওিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রহ.) একবার কাবা তাওয়াফ করছিলেন, এটি ছিল মুওাওিয়া’র খিলাফাহ’র সময়কার ঘটনা। মুওাওিয়া (রহ.) তাওয়াফ করার সময় পবিত্র কাবা’র চারটি কর্নার স্পর্শ করছিলেন। এটি দেখে ইবন আব্বাস (রহ.) বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)শুধু দুটি কর্নার স্পর্শ করতেন (হাজরে আসওয়াদ ও ইয়েমেনি কর্নার)।” মুওাওিয়া (রহ.) বললেন, “আল্লাহ’র ঘরের কোন কিছুকেই উপেক্ষা করা উচিত না।” তখন ইবন আব্বাস (রহ.) সূরা আহযাব এর এই আয়াতটি (২১) তাকে তিলাওয়াত করে শুনালেন। এটা শুনার পর মুওাওিয়া (রহ.) যেটাকে ভাল মনে করে সেটার উপর আমল করছিলেন, তা থেকে সাথে সাথে নিজেকে সরিয়ে নিলেন।

সপ্তম আয়াতঃ

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا

“এবং রসুল তোমাদের যা কিছু (অনুমতি) দেন তা গ্রহণ করো, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা হাশর, ৫৯ : ৭)

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি তোমাদের কিছু করতে আদেশ দিলে তা তোমরা তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী করতে থাকো,আর কোন কিছু নিষেধ করলে তা থেকে বিরত থাকো।”(বুখারি,মুসলিম)

আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, “একবার রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সফরে রোযা ভাঙলেন এবং তা করার জন্য অন্যদেরও অনুমতি দিলেন (একে বলে রোখসত – শারিয়াহ’র নির্ধারিত কারনে কোন ফরয শিথিল হলে তাকে রোখসত বলে, যেমন ফরজ রোযা শারিয়াহ’র কিছু নির্ধারিত কারনে ওই বিশেষ অবস্থা কেটে গেলে তারপর কাযা আদায় করা যায়)। এরপরও কিছু মানুষ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর আদেশ থেকে বিরত থাকলো। এ কথা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে পৌঁছালে তিনি খুতবা দিলেন এবং প্রথমে আল্লাহ’র প্রসংশা করলেন আর এরপর বললেন, ‘সেসব লোকের কি হলো, যারা আমি যা করি তা থেকে বিরত থাকে ? আল্লাহ’র শপথ! তাদের থেকে আমিই আল্লাহ্‌কে বেশী জানি এবং তাদের থেকে আমিই আল্লাহ্‌কে বেশী ভয় করি।’ ” (বুখারি, মুসলিম)

এক ব্যক্তি উমর (রাঃ) এর উপস্থিতিতে হাঁচি দিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ এবং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” উমর (রাঃ) লোকটিকে আঘাত করলেন আর বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদেরকে হাঁচি দেয়ার পর শুধুমাত্র ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাই শিখিয়েছেন।” (তিরমিযি)

আলকামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “এক মহিলা ইবন মাসউদ (রাঃ) এর নিকট এসে জানতে চাইলেন, ‘আমি শুনলাম আপনি নাকি উল্কি লাগানো আর পরচুলা ব্যবহার করা হারাম বলেছেন ? এটি কি আপনি আল্লাহ’র কিতাব বা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত থেকে পান ?’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘আমি এটা আল্লাহ’র কিতাব এবং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত থেকেই বলছি।’ মহিলাটি বললেন, ‘আল্লাহ’র শপথ। আমি কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারটি খুঁজে দেখেছি, কিন্তু হারাম হওয়ার বিষয়টি পাইনি।’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি এই আয়াতটি পাননি – এবং রসুল তোমাদের যা কিছু (অনুমতি) দেন তা গ্রহণ করো, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।’ মহিলাটি বললেন, ‘জী, তা পেয়েছি।’ ইবন মাসউদ বললেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি যে, ভ্রু তুলে ফেলা, পরচুলা ও উল্কি হারাম।’ মহিলাটি বললেন, ‘এমন কি হতে পারে না যে, আপনার পরিবারের কোন সদস্যদের মধ্যে এগুলো আছে ?’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘তাহলে ঘরে ঢুকে দেখুন।’ এরপর মহিলাটি ইবন মাসউদের ঘরে ঢুকে যা দেখতে চেয়েছিলেন তা দেখলেন এবং বের হয়ে এলেন আর বললেন, ‘আমি এই ব্যাপারে কিছুই দেখলাম না।’ ইবন মাসউদ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘আপনার কি আল্লাহ’র ন্যায়নিষ্ঠ দাসের এই সাক্ষটি জানা নেই –আমি তোমাদের করতে নিষেধ করি অথচ তা আমি নিজেই পালন করি না, আমি এ ব্যাপারটা করার ইচ্ছা পোষণ করি না। ’ ” (তাফসির ইবন কাসির)

ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) তার একটি কিতাবে বিদআত সম্পর্কে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের কুফরির কারন হলো বিদআত। তারা তাদের দ্বীনে নতুন বিষয় উদ্ভাবন করেছিলো আর সেগুলো তাদেরকে মুসা (আ’’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ঈসা (আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশিত পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। ”

অষ্টম আয়াতঃ

الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا

“এরা হল সেসব লোক – যাদের সব প্রচেষ্টা এই দুনিয়ায়ই বিনস্ট হয়ে যাচ্ছে, অথচ তারা মনে করছে তারা ভাল কাজই করে যাচ্ছে।” (সূরা কাহফ, ১৮ :১০৪)

ইমাম তাবারি (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, “এটি তাদের দিকে নির্দেশ করছে, যারা কোন একটি কাজকে ভাল ও আল্লাহ্‌ সন্তুস্ট হবে এরকম মনে করে কাজটি করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হলো আল্লাহ্‌কে অমান্য করা ও ইমানদারদের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া।”

ইমাম ইবন রজব (রহ.) বিদআত নিয়ে লিখিত তার কিতাবে বলেন, “… আল্লাহ্‌কে খুশি করার নিয়্যতে কোন হারাম কাজকে ভাল মনে করে করা একটি বিদআত, যেমন – আল্লাহ্‌কে নিয়ে কোন গান করা।”

নবম আয়াতঃ

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

“তোমরা কখনো তাদের মত হয়োনা – যাদের কাছে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সুস্পস্ট নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আর (নিজেদের মধ্যে) নানা ধরণের মতানৈক্য সৃষ্টি করছে; এরাই হল সেসব মানুষ – যাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।” (সূরা আল ইমরান, ৩ :১০৫)

কুরতুবি (রহ.) বলেন, “বেশিরভাগ আলিমদের মতে, এই আয়াত ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আলিমদের মতে এটি মুসলিম উম্মাহ’র বিদআতিদের নির্দেশ করছে।”

TGS inovation-2

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *