যৌবনের প্রেসক্রিপশন
কয়েকদিন আগের কথা। বইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। ফেসবুকে এসে ঢুঁ মেরে, আবার চলে যাই। একদিন ঢুঁ মেরেছিলাম। তখনই একটি মেসেজ এসে শো করল। ওপেন করে দেখলাম, একজন অপরিচিত ভাই সালাম দিয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু সময় চেয়েছেন, কী যেন কথা বলতে চান। তার মেসেজে অনুনয়, বিনয় ও কাতরতার আলামত পরিস্ফুট। সালামের জবাব দিয়ে বললাম- জী ভাই, বলুন! তিনি লাইনেই ছিলেন। জবাব দিলেন,
-ভাইয়া, একটা মাসআলা জানার ছিল।
-আমি মুফতি নই; তবুও বলুন!
-বিয়ে না করলে কি গুনাহ হবে?
আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। এটা আবার কেমন প্রশ্ন! বিয়ে না করলে গুনাহ হতে যাবে কেন?! আমি বুঝতে পারলাম- ব্যাপার কিছু একটা আছে। হুট করে কোনো জবাব দেওয়া ঠিক হবে না। আসল ব্যাপার তলিয়ে দেখতে হবে। আমি জবাব দিলাম,
-বিয়ে না করলে গুনাহ হয় না; আবার গুনাহ হয়ও। এটা আপেক্ষিক। ব্যক্তিভেদে এই হুকুম। পুরো ব্যাপারটা না বুঝা ছাড়া শিওর কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাকে কি একটু খুলে বলবেন?
-ভাইয়া, আমি বিয়ে করতে চাই, কিন্তু বাবা-মা করতে দিচ্ছেন না!
-বুঝলাম, বাবা-মা করতে দিচ্ছেন না, কিন্তু এখানে গুনাহর কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
-বাবা-মা করতে দিচ্ছেন না, অথচ আমার বিয়ে করাই লাগবে!
-করাই লাগবে মানে, আপনি কি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেন না?
-না, ভাইয়া! খুব কষ্ট হচ্ছে!
-আপনার বয়স কত?
-ভাইয়া, আমার বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই।
-আপনি কী করেন?
-ভাইয়া, আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে এখন ছোটোখাটো একটা চাকুরি করছি।
-তাহলে সমস্যা কী? মোটামুটি রোজগার করেন; পড়াশোনাও শেষ। আপনার বাবা-মা বাধা দিচ্ছেন কেন?
-তাদের কথা হলো, আরও কয়েক বছর যাক; আমি আরও ভালো একটা চাকুরি করি। ক্যারিয়ার গড়ি। তারপর নাহয় দেখেশুনে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।
-কিন্তু ততদিনে যে আপনার যৌবন মাটি, সেই হিসেব কি আছে তাদের?
-তাই তো! এটা তারা বুঝতেই চাচ্ছেন না!
-বিয়ে না করলে কি আপনার গুনাহে লিপ্ত হবার ভয় আছে?
-হ্যাঁ, ভাইয়া।
-জিনা করার মতো অবস্থা কি?
-জী, ভাইয়া! বিয়ে না করলে নাজানি কখন আবার জিনা করে ফেলি! এজন্যই আপনাকে মাসআলা জিজ্ঞেস করেছি।
-আপনার জন্য বিয়ে করা ওয়াজিব। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে ফেলুন, তবুও জিনা থেকে বাঁচুন।
-কিন্তু বাবা-মা যে মোটেও মানছেন না।
-না মানুক তারা; আপনি বিয়ে করে ফেলুন।
-তাদের অমতে বিয়ে কি হবে?
-জী, হবে। আমাদের হানাফি মাজহাব অনুযায়ী বিয়েতে অভিভাবকের উপস্থিতি জরুরি নয়। থাকা ভালো। না থাকলে বিয়ে হয়ে যাবে।
-বুঝলাম, কিন্তু এভাবে কি কেউ মেয়ে দেবে?
-হ্যাঁ, এটা একটা কথা। আপনার আস্থাভাজন কেউ কি নেই, যিনি আপনাকে এ ব্যাপারে হেল্প করবেন?
-না ভাইয়া! আবার কোনো মেয়ের সাথে আমার সম্পর্কও নেই।
-তা না থাক; সেটা বুঝাতে চাইনি।
-কী করব আমি, বুঝতে পারছি না!
-আপনি যথাসম্ভব বাবা-মাকে বুঝাতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে বড় কোনো মুরুব্বি ধরুন। আপনার হালত বুঝাতে চেষ্টা করুন। এবং পাশাপাশি মকবুল সময়গুলোতে দুআর আমল চালিয়ে যান।
-ইনশাআল্লাহ, ভাইয়া।
এই হলো আমাদের শিক্ষিত সমাজের অবস্থা। মাস্টার্স পাশ একটা ছেলে, ছোটখাটো একজন চাকুরিজীবী, বিয়ের জন্য পাগল, এমনকী জিনায় লিপ্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা, নিজের চরিত্র ও দীন হেফাজত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তবুও এই সমাজের বাবা-মায়েরা তাকে বিয়ে করতে দেয় না! তাদের আরও বড় চাকুরি দরকার! আরও ক্যারিয়ার গড়ার বাকি! এই জাহিলিয়াত আমাদের পুরো সমাজটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরকম ছেলেরাই যখন বংশের মুখে চুনকালি দিয়ে নিজে নিজেই বিয়ে করে ফেলে, তখন আবার বাবা-মায়েরা বউসহ ছেলেকে ঠিকই গ্রহণ করতে পারে!
জেনে নেওয়া দরকার যে, বিয়ের হুকুম পাঁচটি-
১। ওয়াজিব : নারীর প্রতি এমন তীব্র টান থাকে যদি, এহেন অবস্থায় জিনায় লিপ্ত হবার ভয় থাকে, আবার বিয়ে করার সামর্থ্যও থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় বিয়ে করা ওয়াজিব।
২। সুন্নাহ : নারীর প্রতি সহজাত টান আছে, তবে এমন নয় যে, জিনায় লিপ্ত হবার ভয় আছে। পাশাপাশি বিয়ে করার সামর্থ্যও আছে, এমন অবস্থায় বিয়ে করা সুন্নাহ।
৩। মানদুব : শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধির উদ্দেশে বিয়ে করা মানদুব।
৪। হারাম : যার বেলায় এটা নিশ্চিত যে, বিয়ে করলে স্ত্রীর ক্ষতি হবে। যেমন কারও শরীরে মরণব্যাধী এইডস ভাইরাস থাকলে। এমন ব্যক্তির জন্য বিয়ে করা হারাম।
৫। মাকরুহ : যার নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ নেই, যা আছে তা সহজাত। জিনায় লিপ্ত হবারও ভয় নেই। তবে বিয়ে করলে স্ত্রীর ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন তার যদি রূঢ় স্বভাব হয়, বা বউ পেটানোর মতো বদ খাসলত থাকে, এমন ব্যক্তির জন্য বিয়ে করা মাকরুহ।
পুনশ্চ : ও হ্যাঁ, সেই ভাই কিছুদিন আগে মেসেজ করেছেন। মেসেজে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া! আব্বু-আম্মুকে ম্যানেজ করতে পেরেছি। মুরুব্বি ধরে বুঝিয়ে ফেলেছি। ইনশাআল্লাহ মেয়ে দেখা হচ্ছে। জাযাকাল্লাহ।’
আনুল হক কাসেমী