শাইখ শোআইব আল আরনাউত: তাহকিকের ক্ষেত্রে অনন্য এক নাম

শাইখ শোআইব আল আরনাউত: তাহকিকের ক্ষেত্রে অনন্য এক নাম
.
নিকট অতীতে পরিপক্বতা ও স্বচ্ছতার সাথে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুবারক হাদীসের সর্বাধিক তাহকীক যিনি করেছেন, তিনি হলেন, জগদ্বিখ্যাত মুহাক্কিক ও হাদিস বিশারদ, উলুমুল হাদীস শাস্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব, আল্লামা শাইখ শুআইব ইবনে মুহাররাম আল আরনাঊত আল হানাফী রাহিমাহুল্লাহু তা’আলা।

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস তাহকীকের কাজে ব্যয় করেছেন। ৫২ খন্ডে প্রকাশিত তাঁর তাহকীককৃত “মুসনাদে আহমদ” হলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সবচেয়ে বড় কারনামা। মিশরের “আত ত্ববআতুল মাইমানিয়্যাহ” থেকে মোট ছয় খন্ডে “মুসনাদে আহমদ” ছেপেছিল। সেই ছয় খন্ড বিশিষ্ট “মুসনাদে আহমদ” কে শাইখ রাহি. তাঁর নিপুণ তাহকীক ও তা’লীকের মাধ্যমে ৫২ খন্ডে পৌছিয়েছেন।

হাদিস তাহকীকের ক্ষেত্রে মরহুম নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেবের মারাত্মক বিচ্যুতি ও ভুলগুলোকে মুসনাদে আহমদ এবং অন্যান্য হাদিসের কিতাবের তাহকীকে একাধিক জায়গায় চিহ্নিত করে দিয়েছেন। হাদিস তাহকীকের ক্ষেত্রে আলবানী সাহেবের শাস্ত্রীয় দৈন্যতাও একাধিক জায়গায় বিভিন্ন বাক্যে প্রকাশ করেছেন।যেমন মুসনাদে আহমদের তাহকীকের এক জায়গায় আলবানী সাহেব সম্পর্কে বলেছেন,
…ممن ينتحل صناعة الحديث ( تحقيق الشيخ شعيب للمسند: ٦/٢٤٩)
মরহুম আলবানী সাহেব সম্পর্কে “সহীহ ইবনে হিব্বানের” তাহকীকের এক জায়গায় বলেন,
…وأخطأ من رماه بالتدليس ممن ينتحل صناعة الحديث في عصرنا … ( تحقيق الشيخ شعيب لصحيح ابن حبان:١٦/١٨٦)

শাইখ রাহি. সিরিয়ার দামেশক শহরে ১৩৪৬ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেছেন। ধার্মিক পরিবারে জন্ম হওয়ার সুবাদে বাবা মায়ের কাছেই ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি এবং কুরআনে কারীমের বেশ কয়েক পারা মুখস্থ করেন। সম্ভবত কুরআনে কারীমের মর্ম এবং সূক্ষ্ম বিষয়াদি জানার লক্ষ্যেই অল্প বয়স থেকে তিনি আরবি ভাষা শেখার প্রতি গুরুত্বারুপ করেন। এজন্য প্রায় দশ বছরেরও অধিক সময় দামেশকের মসজিদ এবং বিভিন্ন পুরাতন মাদরাসার মজলিস সমূহে সারফ নাহু এবং বালাগাত নিয়ে অধ্যয়ন করেন।তৎকালীন দামেশকের শীর্ষ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের কাছে আরবি ভাষা অধ্যয়ন করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, আল্লামা শাইখ সালেহ আল ফুরফুর, আল্লামা শাইখ আরিফ আদ দাওজী রাহিমাহুমাল্লাহ প্রমুখ।

এরপর শাইখ রাহি. ফিকহে ইসলামী অধ্যয়নের প্রতি মনোনিবেশ করেন। এক্ষেত্রে তিনি একাধিক প্রাজ্ঞ শাইখের সান্নিধ্যে থেকে বিশেষভাবে ফিকহে হানাফীর গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। এর মধ্যে রয়েছে, আল্লামা শুরুম্বুলালী কৃত “মারাকিল ফালাহ”, ইমাম মাউসিলী কৃত “আল ইখতিয়ার”, “মুখতাসারুল কুদুরী” , “রদ্দুল মুহতার”(ফাতাওয়ায়ে শামী) সহ প্রভৃতি কিতাব। ফিকহে ইসলামী অধ্যাপনার সময়কাল ছিল সাত বছর।

এই দীর্ঘ সময়ে তিনি মুসতালাহুল হাদীস, উসুলে ফিকহ, তাফসীরুল কুরআন সহ ইত্যাদি বিষয়ও অধ্যয়ন করেন।

শাইখ রাহি. নিজের এবং তাঁর সমসাময়িক অনেকের ব্যাপারে হাদীস শাস্ত্রের ক্ষেত্রে দৈন্যতা পরিলক্ষিত হলে উলুমুল হাদীসের উপর তাখাসসুস এবং হাদিসের কিতাবাদি তাহকীকের গুরুত্ব অনুভব করলেন। বিধায় ইসলামী তুরাস এবং হাদিস তাহকীকের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নিজেকে পুরোপুরি ফারেগ করে নিলেন। এজন্য তিনি আরবী ভাষার পাঠদানের দায়িত্বও ছেড়ে দিলেন। যে দায়িত্বটি তিনি ১৯৫৮ ঈসায়ী সন থেকে পালন করে আসছিলেন।

১৯৫৮ ঈসায়ী সনে দামেশকস্থ “আল মাকতাবুল ইসলামী” নামক প্রকাশনার হাদিস এবং ইসলামী তুরাসের তাহকীক বিভাগের দায়িত্বশীল হওয়ার মাধ্যমে তাহকীকের জগতে তাঁর পদচারণা হয়। এই প্রকাশনার সাথে দীর্ঘ বিশ বছর যুক্ত থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির প্রায় সত্তরেরও অধিক খন্ড নিজের তাহকীকে প্রকাশ করেন।

এরপর শাইখ রাহি. ১৯৮২ ঈসায়ী সনে জর্ডানের আম্মানস্থ প্রকাশনা “মুআসসাসাতুর রেসালা”র সাথে যুক্ত হয়ে তাহকীকের কাজ করেন। এই প্রকাশনা থেকে তাঁর তাহকীককৃত সবচেয়ে নিপুণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি প্রকাশ হয়। “মুআসসাসাতুর রিসালা” থেকে প্রকাশিত তাঁর তাহকীককৃত কয়েকটি কিতাবের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলো,
১. মুসনাদে আহমদ(৫২ খন্ড)
২. সুনানে তিরমিযী(১৬ খন্ড)
৩. সুনানে দারাকুতনী (৫খন্ড)
৪. সিয়ারু আলামিন নুবালা (২৫ খন্ড)
৫. সুনানে নাসাঈ (১২ খন্ড)
৬. ইমাম নাসাঈ কৃত “আস সুনানুল কুবরা”
৭. সহীহ ইবনে হিব্বান
৮. ফাতহুল বারী।

২৬ মুহাররাম ১৪৩৮ হিজরী সনে এই কিংবদন্তি মনীষী জর্ডানের আম্মান শহরে ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। তার রেখে যাওয়া তুরাস থেকে আমাদেরকে বেশি বেশি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।

তথ্যসূত্র: “المحدث شعيب الأرناؤوط ، جوانب من سيرته وجهوده في تحقيق التراث” এটি লিখেছেন শাইখ রহ. এর প্রিয় ছাত্র ইবরাহীম আল কুফাহী হাফি.। শাইখ রাহি. সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা এই কিতাবটি মুতালা’আ করতে পারেন।

লেখক:আবদুল আযিয মাহবুব, শিক্ষক, শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার

তাহকীক বলতে কোন একটা হাদীসের মান বিশ্লেষন বুঝায়, মানে কোন একটা হাদীস ঠিক কতখানি বিশুদ্ধ তা নির্নয়ের জন্যেই হাদীসের তাহকীক করা হয়। এ কাজ করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়।

হাদীস তাহকীক করতে গেলে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান তো থাকতেই হবে পাশাপাশি সিরাত(রাসূল, সাহাবী, সালাফদের জীবনী) সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। রাবীদের নাম, জীবনী, সকল রিজাল শাস্ত্রে তাদের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তার সব কিছু মুখস্ত থাকতে হবে আরো অনেক কিছুই জানা থাকতে হয়। সহীহ, জয়ীফ, হাসান, জাল, মওযু হাদীসের বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *