৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ। প্রথমবারের মত মুসলিমরা তাদের প্রথম কিবলাহ জয় করেছে। জাঁকজমকে ঠাসা জেরুজালেমবাসী অপেক্ষা করছে মুসলিম জাহানের খলিফার জন্য। চুক্তি হয়েছিল — জেরুজালেমের চাবি হস্তান্তর করা হবে, তবে কেবল মুসলিম জাহানের খলিফার কাছেই। উমার ইবনুল খাত্তাব (রদিআল্লাহু আ’নহু) জেরুজালেম প্রবেশ করলেন… মলিন বেশে, চৌদ্দ তালিযুক্ত ভূষণে।
মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন সাহাবি আবু উবাইদা (রদিআল্লাহু আ’নহু)। সদ্য দখল করা জেরুজালেমের কাফির আর জাহিলদের কাছে মুসলিমদের নেতা সাধারণ বেশভূষায় আসার ফলে যদি মানহানি হয়! সেটা তো অসহ্য ব্যাপার হবে! তাই আবু উবাইদা উমার ইবনুল খাত্তাবকে পরনের কাপড়টি পরিবর্তন করে নিতে পরামর্শ দিলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব তখন আবু উবাইদার বুক চাপড়ে স্মরণ করিয়ে দিলেন,
“ নিশ্চয়ই আমরা এক অপদস্থ জাতি ছিলাম; আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আমরা যদি আল্লাহ আমাদের যা দিয়ে সম্মানিত করেছেন তা বাদে অন্য কোনোকিছুতে সম্মান খুঁজে বেড়াই, তবে আল্লাহ আমাদের পুনরায় অপদস্থ করবেন।”
রদিআল্লাহু আ’নহুম।
এস্কেটোলজি হল শেষ জামানায় কী হবে তা নিয়ে ধর্মীয় বর্ণনা, ভবিষ্যদ্বাণী, চিন্তাধারা ইত্যাদি। আর ইহুদি এস্কেটোলজি খুব চটকদার। কীভাবে কোন বছরগুলো ওদের সুফল বয়ে আনবে, কীভাবে ওরা ধাপে ধাপে ইসরাঈল রাষ্ট্র পুনরুত্থান করবে, ওদের মাসীহ দাজ্জাল আসবার জন্য কেমন প্রস্তুতি নিতে থাকবে, কোন র্যাবাই কী বললেন, কোন কোন বিষয়গুলো এখনও পর্যন্ত মিলে গিয়েছে এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকা যেন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলামে কী বলা হল, আমরা নিজেদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি — তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
ইহুদিদের ভ্রান্ত, বিকৃত, বাতিল বিষয়াদি ইহুদিরা দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরে আছে আর সে অনুযায়ী আমল করে যাচ্ছে; অথচ আমরা মুসলিমরা হক হয়েও নিজেরা তো নিজেদের দায়িত্ব পালন করছি না; বরং আরও ওদের এস্কেটোলজি নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে রয়েছি। ইহুদিদের বাতিল ধর্মের এস্কেটলজি নিয়ে ওরা যত সিরিয়াস, আমরা আমাদের হক দ্বীনের প্রতি যেন ততটাই উদাসীন — এই ম্যাসেজকে ‘কেন্দ্র’ করে ওদের এস্কেটোলজি কিছুটা আলোচনা হতে পারে। কিন্তু দাঈ’ ইলাল্লাহদের মধ্যে যারা এস্কেটোলজি নিয়ে আলোচনা করছেন তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন দাঈ’ ব্যতীত অধিকাংশই মূল মেসেজ থেকে সরে যাচ্ছেন। এতে সাধারণেরাও দায়িত্ব সচেতন না হয়ে ফালতু বিষয়ের আলোচনাতেই জড়িয়ে থাকছেন। অথচ মূল মেসেজই ভুলে গিয়ে ওদের এস্কেটোলজি নিয়ে পাড়াপাড়ি তো চূড়ান্ত বোকাদের লক্ষণ। শয়তানের সুস্পষ্ট ধোঁকা!
রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর ইচ্ছায় শেষ জামানার অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। কিয়ামতের ছোট অনেকগুলো আর বড় বড় দশটি আলামত আমরা রাসূলুল্লাহর ﷺ বিভিন্ন হাদিস থেকে জানতে পারি। কিন্তু সহীহ হলেও ‘কিয়ামতের লক্ষণসমূহ’ বা ইসলামিক এস্কেটোলজি নিয়েও বাড়াবাড়ি করে বিভ্রান্ত হয়ে যাবার নমুনা রয়েছে। দ্বীনের দুইটি মৌলিক বিষয়ে ন্যূনতম উপলব্ধি না থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে।
এক. শেষ জামানার ভবিষ্যদ্বাণী সংক্রান্ত হাদিসগুলো শরীয়াতের উৎস নয়। বরং প্রথম জামানায় সংঘটিত রাসূলুল্লাহর ﷺ জীবনী, বিধিবিধান সম্পর্কিত আয়াত, হাদিস, সেগুলোর প্রয়োগ ইত্যাদি হল শঈয়াতের উৎস। কিন্তু সুবহান-আল্লাহ! অনেক মানুষ শেষ জামানার বিষয়গুলো থেকে বাড়াবাড়ি করে শরীয়াতের প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “শেষ জামানায় ফিতান অনেক বৃদ্ধি পাবে। সে সময় বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তি থেকে উত্তম হবে। দাঁড়ানো ব্যক্তি হাঁটাচলা করা ব্যক্তি থেকে উত্তম হবে।” এই হাদিস থেকে কেউ মনগড়া এক বিধান বের করে ফেলল যে এখন তো অনেক ফিতনাহ চলছে! তাই তার বসে থাকাই কল্যাণকর!
মডারেট শায়খদের এমন সুস্পষ্ট ত্রুটি থেকে শুরু করে এবিষয়ে সবচেয়ে বাড়াবাড়ি করা শায়খ ইমরান নজরের ফিতনাহ উদাহরণযোগ্য।
দুই. শেষ জামানার যে বিষয়গুলো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ অস্পষ্ট রেখেছেন, সেই বিষয়গুলো খাহেশাত থেকে ‘নির্দিষ্ট করে’ ব্যাখ্যা করে দেওয়া আরেকটি ফিতান। যেমনঃ রোমানদের সাথে মুসলিমদের এক চুক্তি হবে, এটা হল এই যে অমুক চুক্তি — এমন ধারণা। এছাড়া ইয়াজুজ মা’জুজ হল ইউরোপ আর আমেরিকানরা — এইধরনের যুক্তিভিত্তিক হাস্যকর ভ্রান্তি তো রয়েছেই।
(তবে নির্দিষ্টকরণের কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। কিছু ঘটনা শুধু একবারই ঘটবে বলে হাদিস থেকে বোঝা যায় এবং সেগুলো উলামাগণ নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন উটের গলা পর্যন্ত আলো হওয়া বা বায়তুল মুকাদ্দাস জয়ের ঘটনা)
.
তাহলে শেষ জামানার এত কথা, এত হাদিস বর্ণনা কেন করা হল — সেই প্রশ্ন এসেই যায়। কারণটা হল আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে দেওয়া। শেষ জামানার আলোচনাগুলো সবসময় সেদিকেই ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহকে ﷺ কোনো একজন বেদুঈন যখন জিজ্ঞেস করেন যে কিয়ামত কখন হবে তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ পাল্টা প্রশ্ন করে উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমি তার জন্য কী প্রস্তুত করেছ?”
শায়খ উসাইমিন (রহিমাহুল্লাহ) এসম্পর্কে লিখেছেন, “কিয়ামত অনেক তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। এই মহাঘটনার নিকটবর্তিতা সম্পর্কে মানুষকে আগেভাগে সতর্ক করা প্রয়োজন বিধায় আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের জন্য বেশ কিছু আলামত সৃষ্টি করেছেন।” [মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড-২, ফতোয়া নং- ১৩৭]
.
[৪]
তাহলে অন্যসব বাতিল ধর্মগুলোর এস্কেটোলজি আর আমাদের হক দ্বীনেরও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে ভ্রান্ত অনুসরণ বাদ দিলে ‘আমাদের করণীয় কী’ সে প্রশ্নটিই কেবল বাকি থাকে। বিশেষ করে জেরুজালেমও যখন একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে ইহুদিদের কাছে চলে যাচ্ছে তখন আমরা কী এমন করতে পারি যা আমাদেরকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করবে? আল্লাহর নুসরাহের দুয়ার খুলে দেবে? উত্তরটা সহজ — আল্লাহর দ্বীনে ফিরে যাওয়া।
.
ইবন উমার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি,
إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ وَتَرَكْتُمُ الْجِهَادَ سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلاًّ لاَ يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ
“যখন তোমরা আই’নাহতে (রিবাহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বা লেনদেন) লিপ্ত হয়ে যাবে, আর তোমরা গরুর লেজ ধরে থাকবে আর কৃষিকাজে তৃপ্ত হয়ে যাবে, এবং যখন তোমরা জিহাদকে ছেড়ে দিবে, তখন আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর তা তোমাদের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনে ফিরে যাও।”
[আবু দাঊদ ৩৪৬২, সহীহ]
দ্বীন থেকে বিমুখ থেকে দুনিয়ার ব্যবসা, বাড়ি, স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি বলেই তো আজ আমাদের এই দশা। আল্লাহ তবে কেন আমাদের বিজয় দেবেন? আল্লাহ রব্বুল আলামীন তো বলেন,
قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُڪُمۡ وَإِخۡوَٲنُكُمۡ وَأَزۡوَٲجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٲلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَـٰرَةٌ۬ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَـٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡڪُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٍ۬ فِى سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِىَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَہۡدِى ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَـٰسِقِينَ ( ٢٤ )
“(হে নবী আপনি) বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, পত্নী, গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যেটাকে তোমরা পছন্দ কর — আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।”
(সূরা তাওবাহ, ২৪)
.
ফিলিস্তিনি মুসলিমদের নিয়ে শায়খ আযযামের (রহিমাহুল্লাহ) এক ক্ষোভ ছিল। তারা বিদ্রোহ করতো ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগই গাইরুল্লাহ নিয়্যাতে হতো। এমনকি এখনও তারা বাতিল আস্যাবিয়্যাহ থেকে সরে আসতে পারে নাই। মাসজিদুল আকসাও দখল হয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে কিন্তু ফিলিস্তিনের ভাইবোনদের বেশিরভাগই দ্বীনের জন্য কিছু না করে ফিলিস্তিনের পতাকা-ভূমি উদ্ধারকেই এখনও সহীহ নিয়্যাত মনে করছেন। অথচ ফি-সাবিলিল্লাহর নিয়্যাত ছাড়া অন্যকোনো গাইরুল্লাহ নিয়্যাতে আল্লাহর নুসরাহ তো দূরের কথা, বারাকাহও থাকে না। আর বাকি উম্মাহ? আমরা তো গান্ধীবাদীদের মত মিছিল আর বয়কট নিয়েই পড়ে রয়েছি। ভুলেই যাচ্ছি যে মুসলিমদের হাতে যখনই পবিত্র জেরুজালেম বিজয় হয়েছিল তা হয়েছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ কিতালের সুন্নাহতেই, যা আজ ফারজিয়্যাত পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে।
.
তাই আজ সময় এসেছে আল্লাহর দ্বীনে ফিরে গিয়ে নিজেদের কর্তব্য-সচেতন হবার। নইলে যে আমাদের প্রতিস্থাপন করে হলেও আল্লাহ এই দ্বীনের বিজয় দেবেন। তখন তো আমাদের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ আর কেউ হবে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার, মেনে নেওয়ার এবং মেনে চলার তাওফিক দিন।
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَن يَرۡتَدَّ مِنكُمۡ عَن دِينِهِۦ فَسَوۡفَ يَأۡتِى ٱللَّهُ بِقَوۡمٍ۬ يُحِبُّہُمۡ وَيُحِبُّونَهُ ۥۤ أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلۡكَـٰفِرِينَ يُجَـٰهِدُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوۡمَةَ لَآٮِٕمٍ۬ۚ ذَٲلِكَ فَضۡلُ ٱللَّهِ يُؤۡتِيهِ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٲسِعٌ عَلِيمٌ ( ٥٤ )
“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় দ্বীন থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।”
(সূরা মায়িদাহ, ৫৪)