আজকাল অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন যে স্ত্রীরা স্বামীর জন্য রান্না করতে বাধ্য নয়।

আজকাল অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন যে স্ত্রীরা স্বামীর জন্য রান্না করতে বাধ্য নয়। এই কথাটা নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। অনেকে সন্দিহান হচ্ছেন, সংশয়ে ভুগছেন যে ,যদি স্ত্রী রান্না করতে বাধ্য না হন তাহলে বাসার কাজকর্ম কীভাবে চলবে। এটা আসলে একধরণের অচলাবস্থা তৈরি করছে। বড় সমস্যা হল এসকল দাবিদাররা ফকিহদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাচ্ছেন। সমস্যা কেবল এটুকুই নয়, এরকম দাবি যারা করে থাকেন তাদের চাহিদা হচ্ছে স্বামী বাড়ির সব কাজ করবে আর তারা বসে বসে নেট চালাবেন, ব্যবসা করবেন কিংবা চাকরি করবেন, জানিনা এগুলো কতটা ইসলামসিদ্ধ বিষয়।

তো মূল পয়েন্টে ফিরে আসি। আসলেই কী ফিকহ বলছে যে নারীরা রান্না করতে বাধ্য নয়? আমরা এ বিষয়ে ইমাম কাসানীর(রাহ.) একটা আলোচনা পড়ি, তিনি বলেন-

ولو جاء الزوج بطعام يحتاج إلى الطبخ والخبز فأبت المرأة الطبخ والخبز يعني بأن تطبخ وتخبز لما روي أن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – قسم الأعمال بين علي وفاطمة – رضي الله عنهما – فجعل أعمال الخارج على علي وأعمال الداخل على فاطمة – رضي الله عنهما – ولكنها لا تجبر على ذلك إن أبت ويؤمر الزوج أن يأتي لها بطعام مهيأ، ولو استأجرها للطبخ والخبز؛ لم يجز ولا يجوز لها أخذ الأجرة على ذلك؛ لأنها لو أخذت الأجرة لأخذتها على عمل واجب عليها في الفتوى فكان في معنى الرشوة فلا يحل لها الأخذ، وذكر الفقيه أبو الليث أن هذا إذا كان بها علة لا تقدر على الطبخ والخبز أو كانت من بنات الأشراف، فأما إذا كانت تقدر على ذلك وهي ممن تخدم بنفسها تجبر على ذلك

“যদি স্বামী এমন খাবার ও রুটি নিয়ে আসে যা রান্না করা লাগবে তাহলে তার রান্না করা ও রুটি বানানো উচিত। কেননা বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী ও ফাতিমাহ(রা.) এর মাঝে কাজকর্ম বন্টন করে দিয়েছিলেন। বাইরের কাজকর্ম আলী(রা.) কে দিয়েছিলেন আর ভেতরের কাজকর্ম সব ফাতিমাহ(রা.) কে দিয়েছিলেন।
তবে যদি স্ত্রী অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তাঁকে বাধ্য করা যাবে না, স্বামী তার জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য আনতে বাধ্য হবে। যদি স্বামী তাকে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রান্না করাতে ও রুটি বানাতে চায় তাহলে এই কাজ জায়েয নয় এবং এই কাজের বিনিময়ে অর্থ নেয়া স্ত্রীর জন্য জায়েয হবে না।
কেননা সে যদি এই অর্থ নেয় তাহলে তা এমন কাজের জন্য নিল যা নির্ভরযোগ্য ফতোয়া অনুযায়ী তার ওপর ওয়াজিব, এটা একপ্রকার ঘুষ হল যা গ্রহণ করা তার জন্য হালাল নয়।
ফক্বীহ আবুল লাইস(রাহ.) বলেন এটা তখন হবে (অর্থাৎ স্ত্রী বাধ্য হবে না) যখন তার কোনো কারণ থাকবে যেমন সে হয়ত রান্না করতে বা রুটি বানাতে সক্ষম নয়, অথবা সে অভিজাত পরিবারের মেয়ে (high class/rich kid)। যদি সে এই কাজে সক্ষম হয় এবং সে এমন মেয়েদের কেউ হয় যারা(পিতার বাড়িতে) নিজেদের কাজ নিজেরা করে থাকে তাহলে সে ঐকাজে বাধ্য হবে”[১]

ইমাম কাসানীর(রাহ.) আলোচনা থেকে মোটামুটি স্পষ্ট হয় যে নারী কখন বাধ্য নয়। তবুও আসুন এবার ইমাম মুসিলীর(রাহ.) আলোচনাটা পড়ি, তিনি বলেন-

ولا تجبر المرأة على الطبخ والخبز إذا امتنعت، ويأتيها بمن يخبز ويطبخ، لأن الواجب عليه الطعام، قالوا: وهذا إذا كانت لا تقدر على ذلك، أو كانت من بنات الأشراف، وإن كانت تقدر وتخدم نفسها تجبر عليه لأنها متعنتة

“যদি নারী রান্না করতে বা রুটি বানাতে অসম্মত হয় তাহলে তাকে বাধ্য করা যাবে না। (স্বামী) তার জন্য এমন কাউকে এনে দেবে যে রুটি বানাতে ও রান্না করতে পারে। কেননা খাদ্যের বন্দোবস্ত করা স্বামীর জন্য ওয়াজিব। (ফক্বীহগণ) বলেন, এটা তখন হবে যদি নারী এই কাজে সক্ষম না হয়। কিংবা যদি সে অভিজাত পরিবারের মেয়ে হয়। কিন্তু যদি সে সক্ষম হয় এবং নিজের খিদমত নিজেই করতে পারে তাহলে তাকে বাধ্য করা হবে, কেননা সে একগুঁয়ে”[২]

আল-ফাতাওয়াউল হিন্দিয়্যার ভাষ্য হচ্ছে-

وإن قالت: لا أطبخ، ولا أخبز قال في الكتاب: لا تجبر على الطبخ والخبز، وعلى الزوج أن يأتيها بطعام مهيإ أو يأتيها بمن يكفيها عمل الطبخ والخبز قال الفقيه أبو الليث – رحمه الله تعالى – إن امتنعت المرأة عن الطبخ والخبز إنما يجب على الزوج أن يأتيها بطعام مهيأ إذا كانت من بنات الأشراف لا تخدم بنفسها في أهلها، وإن لم تكن من بنات الأشراف لكن بها علة تمنعها من الطبخ والخبز أما إذا لم تكن كذلك فلا يجب على الزوج أن يأتيها بطعام مهيأ كذا في الظهيرية قالوا: إن هذه الأعمال واجبة عليها ديانة، وإن كان لا يجبرها القاضي كذا في البحر الرائق

“যদি স্ত্রী বলে, আমি রান্না করব না এবং রুটি বানাব না , তাহলে কুদুরিতে বলা হয়েছে যে তাকে রান্না করতে ও রুটি বানাতে বাধ্য করা যাবে না, আর স্বামীর দায়িত্ব হবে তার জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য আনবে কিংবা তার জন্য এমন কাউকে আনবে যে রান্না করবে ও রুটি বানিয়ে দেবে। ফক্বীহ আবুল লাইস (রাহ.) বলেছেন, যদি নারী রান্না করতে ও রুটি বানাতে অসম্মত হয় তাহলে স্বামীর জন্য ওয়াজিব যে সে তার জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য এনে দেবে, (শর্ত হচ্ছে) যদি সে অভিজাত পরিবারের মেয়ে হয় এবং পরিবারে থাকাকালীন সে নিজের খিদমত না করে থাকে তো।
আর যদি সে অভিজাত পরিবারের মেয়ে না হয় কিন্তু যদি তার এমন কোনো রোগ থাকে যার ফলে সে রান্না করতে ও রুটি বানাতে অক্ষম (তাহলেও স্বামী তার জন্য খাদ্য আনবে)।
কিন্তু যদি তা না হয় (অর্থাৎ উপরের কোনোটাই না) তাহলে তার জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য আনতে স্বামী বাধ্য নয় যেমনটা যাহিরীয়্যায় রয়েছে।
(ফক্বীহগণ) বলেন, এসকল আমল দ্বীনী দায়িত্ব হিসেবে নারীর ওপর ওয়াজিব। যদি সে না করে তাহলে বিচারক তাকে বাধ্য করতে পারে না, যেমনটা আল বাহরুর রাইকে রয়েছে”[৩]

এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে তাতে যা স্পষ্টত বোঝা যায় যে মূলত অভিজাত পরিবারের নারী কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম নারী রান্নাবান্না করতে বাধ্য নয়, অসুস্থ থাকা অবস্থাতেও কথা একই, বাকি রইল সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা, তাদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। আসলে রান্নাবান্না করাটা নারীর দ্বীনি দায়িত্ব এটা তো আর আদালতের ইস্যু নয়। ইহসানের ভিত্তিতে একসাথে এই পথ চলা উচিত।

ফকিহগণ তো এভাবেও ভাগ করেছেন যে স্ত্রীর স্ট্যাটাস অনুযায়ী স্বামী খাদ্য যোগাতে বাধ্য। তাহলে যারা নিজেরা হাই ক্লাসের নন স্বামী যদি এই অজুহাতে আপনাদের কখনোই উন্নত খাদ্য, পোশাকও আবাস না জোগায় তখন আপনাদের বক্তব্য কী হবে? ইমাম সারাখসী(রাহ.) যেমন বলেছেন-
لا تجبر، ولكن إذا لم تطبخ لا يعطيها الإدام وهو الصحيح

“তাকে বাধ্য করা হবে না, কিন্তু যদি সে না রাঁধে তাহলে স্বামী তাকে তরকারি দেবে না, আর এটাই সঠিক”[৪]

সমাধানটা সহজ, কেননা স্বামী খাদ্য জোগাতে বাধ্য, কেবল রান্না করা ভাত হোটেল থেকে এনে দিলেও চলে, কিংবা নিজেও রেঁধে খাওয়াতে পারে, তরকারি জোগাতে তো আর বাধ্য নয়। এছাড়া মুফতি মুহাম্মাদ বিন আদম (হাফি.) সহ অনেকেই মত প্রকাশ করেন যে নারী আসলে স্বামীর জন্য রাঁধতে বাধ্য, উপরের আলোচনা এ বিষয়টাকে অনেকটাই বিশ্লেষণ করে। যেখানে বলা হয়েছে বাধ্য নয় তা আইনগত দিক থেকে বলা হয়েছে আর যেখানে বলা হয় বাধ্য সেটা দ্বীনি দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে।

যাই হোক, এই বিষয়ে আলোচনা শেষ করছি মুফতি তাকি উসমানী(হাফি.) এর একটা বক্তব্য দিয়ে-

It is true that from a pure legal point of view, a wife may refuse to cook meals or to do other household works, but on the other hand, the husband may refuse to give her permission to meet her relatives. If both of them are restricted to such a crude legal relationship, an atmosphere of mutual understanding cannot be developed between them.

In short, a wife is not legally bound to render the household services, however it is advisable that she performs these functions as a measure of cooperation

“এটা সত্যি যে আইনানুগ দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায় যে একজন স্ত্রী হয়ত খাবার রাঁধতে কিংবা অন্যান্য ঘরোয়া কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, কিন্তু অন্যদিকে স্বামীও তাকে তার আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। যদি তারা উভয়েই এরূপ ত্রুটিপূর্ণ আইনানুগ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে তাহলে তাদের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি হতে পারবে না।
সংক্ষেপে বলা যায়, একজন স্ত্রী আইনানুগভাবে বাড়ির কাজ করতে বাধ্য নয়, তবে এটাই সুবিবেচনাপ্রসূত হবে যে সে এসকল কাজ সহযোগীতার পদক্ষেপ হিসেবে করবে”[৫]

[১) ইমাম কাসানী(রাহ.), বাদাঈউস সানাঈ: ৪/২৪
২) ইমাম মুসিলী(রাহ.), আল ইখতিয়ার: ৪/৫
৩) আল ফাতাওয়াউল হিন্দিয়্যাহ: ১/৫৪৮
৪) ইমাম ইবন আবিদীন(রাহ.), আর রাদ্দুল মুহতার: ৩/৫৭৯
৫) Mufti Muhammad Taqi Usmani, Contemporary Fatawa, P. 124 /125, Compiled & Edited by Mohamed Shoaib Omar]

উস্তাজ মানজুরুল কারিম

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *