আব্দুল্লাহ ফাহাদ নামের একজন দ্বীনি ভাই গ্রুপে টাইট ফিটিং ছাড়াও ডিজাইন করা বোরকা ও নিকাব নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। পোস্টের মূল বক্তব্য ছিল মোটামুটি এরকম :
কিছু দ্বীনি বোনেরা পর্দার উদ্দেশ্যে এমন কিছু ডিজাইন করা বোরকা-নিকাব পরিধান করেন, যা কিছু দ্বীনি ভাইকে আকর্ষিত করে। এতে করে ফিতনাহ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। তাই পোস্টের লেখক অনুরোধ করেছেন যেন, বোনেরা এরকম ডিজাইন করা বোরকা না পরেন। পোস্টটির কমেন্টে অনেকেই ভাইয়ের বিরোধিতা করে।
ভাইয়ের বক্তব্য উপস্থাপনা নিয়ে আমারও কিছু আপত্তি আছে। ভাই তার পোস্টে নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো শক্ত ভিত্তি দেখাননি। উল্টো বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছেন যে, “এটা হয়তো শারীয়াহ এর কোনো বিধান না, কিন্তু যেহেতু কিছু দ্বীনি ভাইদের সমস্যা হয় তাই বোনেরা এই ধরণের বোরকা না পরার অনুরোধ”। অথচ বিষয়টা মোটেও শারীয়াহ এর বাইরের কোনো কিছু না। এছাড়াও তিনি পোস্টের দুই একটা জায়গাতে অযথার্থ শব্দের প্রয়োগ করেছেন। তবে, মোটাদাগে ভাইয়ের মূল বক্তব্যে ভুল কিছু ছিল না। ভাষাও যথেষ্ট অমায়িক ছিল। কিন্তু এরপরও বোনদের অনেকেই (সাথে কিছু ভাইয়েরাও) মূল বক্তব্য বোঝার চেষ্টা না করেই তার পোস্টের জন্য কমেন্টে যেভাবে তাকে আক্রমণ করেছেন তা মোটেই ভালো কিছু ছিল না। পরবর্তীতে সম্মানিত এডমিনদের কেউ একজন পোস্টটির কমেন্ট সেকশন অফ করে দেন। সাথে বাজে কমেন্টগুলোও ডিলিট করে দেন।
যাই হোক। ডা. শামসুল আরেফীন তার ‘মানসাঙ্ক’ বইয়ের ১০৬-১০৯ পৃষ্ঠায় উক্ত বিষয়ে বেশকিছু আলোচনা এনেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় ঈষৎ পরিমার্জনা সহকারে নিচে তা উল্লেখ করলাম। শামসুল আরেফীন ভাইয়ের বই যারা পড়েছেন তারা জানেন, ভাই হাওয়ার উপরে কিছু লেখেন না। নিম্নোক্ত প্রতিটি পয়েন্টের পেছনে শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে বইটি পড়তে পারেন।
……
নারীর পোশাক তার সৌন্দর্যের অংশ। পোশাক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। নয়তো “এটাতে আমাকে কেমন মানিয়েছে” বা “এই ড্রেসে তোমাকে দারুণ লাগছে” এই বাক্যগুলো থাকতো না।
আরও কাহিনী আছে। Fetishism এর একটা প্রকার আছে, কাপড়ের প্রতি আকর্ষণ। আমাদের আলিমগণ তো পুরুষের চলাচলের রাস্তায় নারীর ভেজা পোশাক মেলে দিতেও নিষেধ করেন। কারণটা এতদিন পর একটু একটু বুঝে আসছে। ফিকহি আলোচনা একপাশে রেখে যদি আমাদের আলোচনা ধরে বলি, উদ্দীপক বা ডোজ না হতে চাইলে আপনাকে আলবত আপনার সুন্দর পোশাকটা ঢাকতে হবে। তাহলে আপনি কেমন আবরণ দ্বারা নিজেকে আবৃত করবেন? জিলবাব বা বোরকা কেমন হলে তা আপনাকে উদ্দীপকের ভূমিকা নেওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে? চলুন দেখি, বিজ্ঞানই আমাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যায়।
১.
বোরকা অনুজ্জ্বল রঙের হবে। কালো বেস্ট। কারণ কালো রঙ আলোর পুরোটুকু শুষে নেয়। তাই কালো বস্তু থেকে দর্শকের চোখে আলো আসে না। নজর কাড়ে না। কালো না হলেও কালো জাতীয় (নেভি ব্লু, ধূসর)। মোটকথা ম্যাদামারা রঙের হওয়া চাই। উজ্জ্বল রঙ, হলুদ-লাল-নীল-গোলাপী রঙ ভিজুয়াল ফিল্ডে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এমন রঙের বোরকা “বোরকার উদ্দ্যেশ্য” পূরণ করে না।
২.
প্রচলিত বোরকার কাপড় একটা আছে সিল্কের মতো চকচকে। কালো হলেও চকচকে জিনিস আলো প্রতিফলন করে। তাই, ভিজুয়াল ফিল্ডে যেকোনো চকচকে বস্তু নজর কাড়ে। এমন কাপড়ের বোরকায়ও উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।
৩.
হালে বোরকার কাপড় হিসেবে কিছু ফেব্রিক বেশ জনপ্রিয়। এই কাপড়ের সমস্যা হলো বেশি আন্দোলিত হয়। আর আমরা দেখেছি ভিজুয়াল ফিল্ডে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নড়াচড়ার দিকে দৃষ্টি চলে যায়। ফলে উদ্দীপকতা কমাতে বা নিজেকে দৃষ্টির অলক্ষে রাখতে এ জাতীয় বোরকাও অনুপযোগী।
৪.
বোরকার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো — আপনার নিচের সুন্দর পোশাক যেটা আপনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে, সেটা ঢাকা। যাতে আপনি কারোর দৃষ্টি আকর্ষক না হন। যেহেতু কে আপনাকে দেখে কী ভাবছে, কী ডোজ নিচ্ছে, কী কল্পনা করছে আপনি জানেন না। ডিজাইনওয়ালা আর নানান ফ্যাশনেবল বোরকা তো সেই সৌন্দর্যবর্ধকই হয়ে গেল, লাউ আর কদু। তাহলে শুধু শুধু ডাবল পোশাক পরে কী লাভ হলো? কেউ যদি আপনাকে বলে— “বাহ, এই বোরকায় তো তোমাকে দারুণ মানিয়েছে” অথবা “চমৎকার লাগছে তোমাকে”, তাহলে সেই বোরকা পরা অনর্থক। কারণ আপনি তো সুন্দর লাগার জন্য বোরকা পরছেন না, বরং সৌন্দর্য ঢাকার জন্যই সেটা পরার কথা।
৫.
অর্ধস্বচ্ছ শিফন/জর্জেট জাতীয় কাপড়ের বোরকা পরার চেয়ে না পরাই তো ভালো। শুধু শুধু গরমে দুই স্তর সিনথেটিক কাপড় পরার কী দরকার। পর্দার উদ্দেশ্যও পূরণ হলো না, আবার গরমে কষ্টও হলো। আর মানুষের স্বভাব হলো কৌতূহল। যা স্পষ্ট দেখা যায় তারচেয়ে, যা আবছা দেখা যায় তার প্রতি কৌতূহল বেশি কাজ করে। ফলে অর্ধস্বচ্ছ বোরকা আপনাকে আরো বেশি নজর আহ্বানকারী করে তুলবে।
৬.
বোরকা পরে কোমরের কাছে ফিতা যদি বেঁধে নেন, তবে বোরকা পরার উদ্দেশ্য ব্যাহত হলো। বোরকার উদ্দেশ্য ছিল আপনার দেহকাঠামোকে অস্পষ্ট করে দেয়া। ফিতা বেঁধে কোমরের মাপকে প্রকাশ করে সেই গড়নকে আপনি স্পষ্ট করে দিলেন।
৭.
হাল আমলের বোরকার ফ্যাশন হলো ঘের অনেক বেশি রাখে গাউনের মতো। সেদিন এক ফেসবুক পেইজ দেখলাম যারা দাবি করেন যে, তারা শারঈ বোরকা বিক্রি করেন। দেখলাম লিখেছে, “ঘের অনেক বেশি… You will feel like a princess”। মানে হলো রাজকন্যারা যেমন বেশি ঘেরওয়ালা গাউন পরে সেরকম। বেশ, নিজেকে নিজে রাজকন্যা মনে হলে তো সমস্যা নাই। কিন্তু রাস্তার লোকে রাজকন্যা মনে করে চেয়ে থাকলে তো সমস্যা। পর্দার উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। আর অতিরিক্ত কাপড় থাকলে তা হাঁটার সময় আন্দোলিত হবে বেশি, ফলে ফোকাস টানবে বেশি।
৮.
আরেকটা ফেব্রিক সম্পর্কে বলে আমাদের এই আলোচনা শেষ করবো, যেটা এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। ‘লন’ কাপড় পরতে আরামদায়ক হলেও শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে বেশি। ফলে বাইরে থেকে শরীরের অবয়ব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যদিও আপনার পোশাকটা ফিটিং না বা স্বচ্ছ না। আপনি ভাবছেন সব তো ঢাকাই! আসলে কাপড় লেপ্টে থেকে সব অবয়ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। লিনেনও তাই। মাহরাম ব্যক্তিদের সামনেও তাই
এসব কাপড়ের পোশাক পরহেজ করা দরকার।
আবু ইয়াযীদ মুযানি রহিমাহুল্লাহ বলেন, হযরত উমার রদিয়াল্লাহু আনহু মহিলাদেরকে কাবাতি (মিশরে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বললো, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে। [১]
তাহলে কেমন বোরকা পরলে উদ্দীপক হিসেবে আপনার ভূমিকা মিনিমাম হবে?
১. নিকাবসহ কালো বা কালোজাতীয় রঙের বোরকা।
২. সুতি ধরণের কাপড় যা অতিরিক্ত দুলবে না বা লেপ্টে থাকবে না। বরং কিছুটা ফুলে থাকবে। বডি শেপকে অস্পষ্ট করে দেবে। কাপড় সুতি হলে সিনথেটিক কাপড়ের চেয়ে আরামও পাবেন বেশি। আরেকটা ব্যাপার আছে। সুতি কাপড়ে ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে পরিপাটিভাব থাকে না। ফলে আপনার দিকে কেউ লক্ষ্যই করবে না, চোখ পড়লেও অনীহাভরে সরিয়ে নিবে। বোরকা পরার মূল উদ্দেশ্য সবচেয়ে সুন্দরভাবে পূরণ হবে।
.
[১] মুসান্নাফে ইবনু আবী শাইবা, হাদীস : ২৫২৮৮, সূত্র : খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহিমাহুল্লাহ) এর বই — পোশাক, পর্দা ও দেহসজ্জা।
……
পরিশেষে বলবো, দ্বীনি ভাইবোনেরা নিজেদের চিন্তা ভাবনাকে উন্নত করেন। মুসলিম মেয়েদের পর্দা নিয়ে কেউ কিছু বললেই আপনারা যেভাবে রেডিমেইড ধারণা করে বসেন যে, তিনি ছেলেদের নজর এর হেফাজতের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, এটি মোটেও ঠিক নয়। মহান আল্লাহ ﷻ যেন আমাদের সবাইকে সর্বাবস্থায় তাঁর বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করেন, আমীন।
– © নাসিহাহ থেকে