বাঙ্গালী কিংবা আফগানী সংস্কৃতি আবার কি?
মানুষের বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস কেন্দ্রিক আচার আচরণ ও জ্ঞানের একটি সমন্বিত কাঠামোকে সংস্কৃতি বলে। একটা সমাজের মানুষ যেই বিশ্বাস লালন করে এবং সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় পর্যায়ে যেসব কর্মসাধন করে এর সবগুলোই সংস্কৃতির ব্যাপক অর্থের অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিটি দ্বীন এবং সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত থাকে কিছু বিশ্বাসের উপর। এই বিশ্বাসগুলোই হল মূল। আক্বীদা বা বিশ্বাসের কারণে এক দ্বীন অপর দ্বীনের সাথে বিরোধ করে। এক সভ্যতার সাথে অপর সভ্যতার দ্বন্দ্ব হয়। এই বিশ্বাসগুলো থেকে যেসব কর্মের জন্ম হয় এবং যেসব আচার-আয়োজন প্রকাশ পায়, তাকেই বলে সংস্কৃতি।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। ইসলামের ট্রাডিশনাল কিছু বিশ্বাস কিংবা আক্বীদা রয়েছে। যেগুলো পোষণ করা ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারে না। মূলত ইসলামের সমস্ত ইবাদাত,মু’আশারাত ও মু’আমালাত এই বিশ্বাসগুলোরই প্রতিচ্ছবি এবং দাবির বাস্তবায়ন।
প্রতিদিন পাঁচবার আযান, পাঁচওয়াক্ত জামাত, জুমু’আর সম্মেলন, আমাদের দ্বীনি মজলিসসমূহ, ইলমের হালাকাগুলো, খালি গলায় নাশিদসন্ধা, আমাদের শাহাদাত, (জি)হাদ, বিজয় উৎযাপন, ইফতার, সেহরী, ঈদের সালাত, ঘরোয়া তা’লীম, পর্দার পোশাক, নারী-পুরুষের সহজাত দায়িত্ব ও অধিকারের বাস্তবায়ন এসব কিছুই তো মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি। দ্বীনের প্রতিটি শি’আরই ইসলামী সাংস্কৃতির অংশ। আমাদের তিলাওয়াত, আমাদের হাদীস পাঠ, আমাদের ঘোড়সওয়ারি, আমাদের তীরিন্দাজি (আধুনিক সময়ে ভিন্ন কিছু ভেবে নিন), আমাদের দৌঁড় প্রতিযোগীতা সর্বোপরি আল্লাহর রাহে শত্রুর বিরুদ্ধে (জি)হাদের প্রস্তুতিমূলক সমস্ত তৎপরতাই ইসলামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
সংস্কৃতির এই মৌলিক সংজ্ঞা যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে ইসলামী সংস্কৃতি ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি নিয়ে দেশীয় সেকুলারদের বাইনারি প্রকল্প বোঝা এবং তার বিরুদ্ধে মজবুত অবস্থান নেয়া সহজ হবে। বাঙ্গালী কোন বিশ্বাসের নাম না। এটা কেবল ভৌগলিক একটি পরিচয়। রাষ্ট্র কিংবা সমাজ জীবিত কোন সত্তা নয় যে এগুলো স্বতন্ত্রভাবে কোন বিশ্বাস লালন করতে পারবে। সুতরাং মৌলিকভাবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজের পার্মানেন্ট কোন সংস্কৃতি নেই। কারণ সংস্কৃতির জন্য নির্দিষ্ট বিশ্বাস জরুরী। আর মানব সত্ত্বা ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ এই বিশ্বাস লালন করার ক্ষমতা রাখে না।
সংস্কৃতির সম্পর্কটা আদর্শ ও বিশ্বাসের সাথে। আদতে ভাবগতভাবে বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলতে তেমন কিছু নেই। স্থানীয় কিছু প্রথার বাইরে এখানে যা চলে, তা হয়ত ইসলামী সংস্কৃতি কিংবা সেকুলারীয় সংস্কৃতি নতুবা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে সেকুলাররা আমাদের উপর যেটা চাপিয়ে দিতে চায় সেটা দেখা যাবে হয়ত লিবারেলীয় সংস্কৃতি অথবা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি।
যেমন পহেলা বৈশাখের উৎসবের কথাই ধরুন। এই উৎসবের সম্পর্ক হিন্দুয়ানী বিশ্বাসের সাথে। সুতরাং এটা বাঙ্গালী সংস্কৃতি না, বরং হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। এমনিভাবে থার্টিফাস্ট নাইটের কথাই ধরুণ। এই উৎসবের সম্পর্ক খ্রিষ্টান বিশ্বাসের সাথে। ফলে এটা ক্রিশ্চিয়ান কালচার। এমনিভাবে বেপর্দা, ফ্রি মিক্সিং, অশ্লিলতা এগুলো বাঙ্গালী সংস্কৃতি না, বরং হিন্দুয়ানী কিংবা লিবারেলীয় সংস্কৃতি। আবার পর্দা, টুপি, দাঁড়ি, পাঞ্জাবি, হিজাব এগুলোও আফগানী- ইরানী সংস্কৃতি না, বরং ইসলামি সংস্কৃতি। মৌলিকভাবে সংস্কৃতিগুলোকে এভাবে সংজ্ঞায়ন ও চিহ্নিত করলে সেকুলারদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মুসলিমদের সন্দিহান করার সুযোগ কমে আসবে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও তারা বেকায়দায় পড়বে।
ঐতিহাসিক বাস্তবতার দিক থেকেও এই অঞ্চলে সুপ্রাচীন কাল থেকেই মুসলিমদের বসবাস করে এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তারাই এই অঞ্চল শাসন করেছে। ফলে ইসলামী সংস্কৃতির প্রচলন এখানে একদম শিকড়ে প্রোথিত। আর বর্তমান বাস্তবতার কথা বললে এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই মুসলিম। ফলে তাদের বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতি নামে যদি কিছু থাকে তবে সেটা ইসলামী সংস্কৃতির সমর্থক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুসলিমদেরই অধিকাংশ সদস্য এটাকে মানবেন না। কথিত প্রগতিশীলদের কথা না হয় বাদই দিলাম।
আলি মিয়া নদভী রহঃ খুব সুন্দর বলেছেন। সকল জাতিরই মৌলিক কিছু চিন্তা ও সংস্কৃতি থাকে। তবে যদি তাদেরকে সেই চিন্তা ও সংস্কৃতি থেকে সড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে তারা নিছক কিছু আনুষ্ঠিকতার মাঝে আটকে যায়। তাদের অতীত- ইতিহাস ও কাজের ধারাবাহিকতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই সেই জাতি ধীরে ধীরে নিজেদের মৌলিক বিশ্বাস ও জীবন দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং এভাবেই সে জাতি ধীরে ধীরে ভিতরে ভিতরে মনের দিক দিয়ে এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে “মুরতাদ” হয়ে উঠে। ( দুস্তুরুল হায়াত)
ইফতেখার সিফাত