হাদীস বিষয়ক মৌলিক নীতিমালা
হাদীস বিষয়ক কিছু মৌলিক নীতিমালা যা সামনে থাকলে হানাফী মাযহাবের উপর উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের উত্তর সহজেই বুঝে আসবেঃ
১. সর্ব প্রথম যে কথাটি জেনে রাখা দরকার তা হলঃ
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম কিতাব দুটি সহীহ হাদিসের সংকলন মাত্র, এই দুটি কিতাবের বাহিরে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে, এটা শুধু মৌখিক দাবিই নয়, বরং এটা এমন এক বাস্তবতা যা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই, একথা স্বয়ং বুখারী ও মুসলিম রহ. ও স্বীকার করেছেন।
আর হাদীসের সিহ্যাত তথা বিশুদ্ধতা কোন কিতাবের উপর নির্ভর করে না যে, অমুক কিতাবে থাকলে সহীহ না থাকলে যঈফ, এ ধরণের কথা কোন বিবেকবান মানুষও বলতে পারে না, বরং হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ভর করে হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতিতে বর্ণিত শর্তাবলীর উপর, যে হাদীসের মধ্যে উক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাবে সেটাই সহীহ হাদীস, আর যে সকল হাদীস শর্তের মাপকাঠিতে উন্নীত নয় সেটা সহীহ নয়।
অতএব, সহীহ হাদীস শুধু বুখারী-মুসলিমেই আছে অন্য কোন কিতাবে নেই, অথবা অন্য কিতাবের হাদীসসমূহ এ দুটোর চেয়ে নিম্নমানের এ ধরণের ভিত্তিহীন কথা কোন নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস থেকে বর্ণিত নেই এবং কার্যত এর কোন বাস্তবতাও নেই।
মোটকথা, যে কোন হাদীসকে বিচার করতে হবে হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতির আলোকে, নির্দিষ্ট কোন কিতাবের আলোকে নয়, এই বিষয়টি মাথায় রেখে কেউ যদি বিচার করে তাহলে হানাফি মাযহাবের বিরুদ্ধে প্রচারিত অনেক অমূলক অভিযোগ ও অপপ্রচারের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে।
২. মুজতাহিদ ইমামগণের মাঝে পরস্পর মতপার্থক্যের যে রূপটি আমরা ফিকহের কিতাবাদিতে দেখি এবং একই মাসআলায় এক ইমাম থেকে একাধিক উক্তি পাই, এর প্রধান কারণ হল, একই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী হাদীস পাওয়া যাওয়া, আয়াত ও হাদীস একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখা, আয়াত ও হাদীসব্যাখ্যা সাপেক্ষ হওয়া অথবা কোন নতুন বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে কোন স্পষ্ট বিধান না পাওয়া যাওয়া। সাধারণত এই ধরনের বিষয়েই ইমামগণের ইজতিহাদ করতে হয়, আর প্রত্যেক মুজতাহিদের তরীকে ইস্তেদলাল ও ইস্তিমবাত তথা দলীল-প্রমাণের প্রায়োগিক পদ্ধতি ও মাসাইল আহরণের নীতিমালা সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র । যেমন একই বিষয়ে দৃশ্যত বিরোধপূর্ণ হাদীস থাকলে মুজতাহিদগণ কীভাবে সমাধান করেন এর একটু নমুনা দেখলে আমরা বুঝতে পারবো যে, মতপার্থক্য না হয়ে কোন উপায় নেই।
একই বিষয়ে দৃশ্যত বিরোধপূর্ণ হাদীস থাকলে ইমাম মালেক রহ. মদীনাস্থ ফুকাহায়ে কেরামের আমল অনুযায়ী ফায়সালা দিয়ে থাকেন এই ভিত্তিতে যে, মদিনা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর, খুলাফায়ে রাশেদীনের অবস্থানস্থল, আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূল ﷺ এর বাসভূমি, অহী নাযিল হওয়ার স্থান। অতএব মদীনাবাসীই ওহীর মর্ম অনুধাবনে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী থাকবেন এটাই স্বাভাবিক, সুতরাং কোন হাদীস তাদের আমলের বিপরীত হলে অবশ্যই সেটা হয়ত মানসুখ তথা রহিত, বা ব্যাখ্যাকৃত, বা ব্যক্তি বিশেষ বা স্থান বিশেষ এর সাথে সম্পৃক্ত, বা মূল ঘটনা এখানে অসম্পূর্ণ ভাবে উদ্ধৃত হয়েছে, তাই এটি দলীলযোগ্য নয়।
ইমাম শাফিয়ী রহ. এ ক্ষেত্রে হেজাযবাসি ফকীহগণের আমল পরিলক্ষণ করেন, পাশাপাশি সর্বাধিক সহীহ হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করেন। কোন বর্ণনাকে এক অবস্থার সাথে এবং অন্য বর্ণনাকে অন্য অবস্থার সাথে নির্ধারণ করে যথাসম্ভব মিল করে দেন। অতঃপর যখন তিনি ইরাক ও শেষ জীবনে মিসর সফর করেন, সেখানে নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে অনেক বর্ণনা শুনেন, তন্মধ্যে কিছু বর্ণনা তার নিকট হেজাযবাসির আমলের উপর প্রাধান্য পায়, ফলশ্রুতিতে শাফিয়ী মাযহাবে অনেক মাসআলায় নতুন-পুরাতন দুই ধরনের উক্তি পাওয়া যায়।
ইমাম আহমাদ রহ. প্রতিটি হাদীস বাহ্যিক অবস্থার উপর বহাল রাখেন, মাসআলার প্রেক্ষাপট এক হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটিকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে দেন। তার মাযহাব ইজতিহাদের বিপরীত ও হাদীসের যাহের অনুযায়ী, তাই হাম্বলী মাযহাবকে যাহেরীও বলা হয়।
ইমাম আবূ হানীফা এবং তার আসহাবগণের নীতি হলঃ সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর মধ্যে এমন একটি যুক্তিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, যেন সকল হাদীসের মাঝেই একটি অর্থবহ প্রেক্ষাপট তৈরী হয় এবং কোন একটি হাদীসকেও বর্জন করতে না হয়।
অধিকন্তু বাহ্যিক বিরোধটাও দূর হয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে তারা শরী‘আতের মৌলিক নীতিমালার সাথে বিশেষ করে কুরআন শরীফের কোন আয়াত দ্বারা সমর্থিত কোন হাদীসকে মৌলিকরূপে গ্রহণ করেন, যদিও সেটা সনদের দিক থেকে কিছুটা কম সহীহ, হাসান হয়, বা মারজুহ হয়, আর তুলনামূলক অধিক সহীহ হাদীসটির বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা করেন, এ নীতিই ছিল আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রাযি. এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা রাযি. এর।
(৩) কোন হাদীসের সহীহ-যঈফ হওয়া নির্ধারণ করাও একটি ইজতিহাদি বিষয়, এ কারণেই জারহ ওয়া তা’দীল তথা হাদীসের সনদ নিরীক্ষণ শাস্ত্রের সম্মানিত ইমামগণের মাঝেও একই হাদীসের সনদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা যায়, একজন ইমাম সহীহ বা হাসান বলেন, অন্যজন বলেন যঈফ, হাদীসশাস্ত্রের সাথে সামান্য সম্পর্ক আছে, তারা এ কথা ভালো করেই জানেন।
এ ভিত্তিতেই ইমাম আযম রহ. একটি হাদীসকে আমলযোগ্য মনে করে গ্রহণ করেন, পক্ষান্তরে অন্য ইমামের দৃষ্টিতে তা যঈফ মনে হওয়ায় তিনি উক্ত হাদীস তরক করেন। তবে যেহেতু ইমাম আযম রহ নিজেই মুজতাহিদ ছিলেন, তাই অন্য কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ বা উক্তি তার বিরুদ্ধে দলীল হতে পারে না, এটাই ইজতিহাদের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নীতি।
(৪) কখনো এমন হয় যে, কোন একটি হাদীস ইমাম আযম রহ. পর্যন্ত সহীহ সনদে পৌঁছেছে, এ জন্য তিনি তা গ্রহণ করেছেন এবং তদানুযায়ী আমল করেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে কোন রাবীর দুর্বলতা হেতু হাদীসটির মাঝে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাই পরবর্তী ইমামগণ সেটাকে গ্রহণ করেন নি। অতএব পরবর্তীকালের সৃষ্ট দুর্বলতার দায় কিভাবে ইমাম আযম রহ. এর উপর চাপানো যায়? আর এর উপর ভিত্তি করে তিনি যঈফ হাদীসের উপর আমল করেছেন; এ কথা বলা কি যুক্তিসঙ্গত হবে?
(৫) অনেক সময় একটি হাদীসের একাধিক সনদ থাকে, কোনটা সহীহ; কোনটা যঈফ, এ ক্ষেত্রে যিনি হাদীসটি যঈফ সনদে পেয়েছেন; তিনি হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন, আর যিনি সহীহ সনদে পেয়েছেন তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যেমনঃ হাদীস শরীফে এসেছেঃ
من كان له إمام فقرائة الإمام له قرائة.
অর্থঃ ইমামের পিছনে নামায পড়েন, ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত সাব্যস্ত হবে।
বিশেষ দু’একটি সনদের কারণে কোন কোন মুহাদ্দিস হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন, কিন্তু হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে ইবনে মানী ও কিতাবুল আছার ইত্যাদি গ্রন্থে সম্পূর্ণ সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
(৬) অনেক সময় একটি হাদীসের সবগুলি সনদই যঈফ হয়, কিন্তু একাধিক সনদের সমষ্টিগত বিচারে হাদীসটিকে গ্রহণ করা হয়, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে হাসান লিগাইরিহি বলা হয়, এ জাতীয় হাদীসের উপর যারা আমল করেন; তাদেরকে যঈফ হাদীসের উপর আমলকারী বলা ইনসাফপূর্ণ আচরণ হবে না। যেমন-একটি হাদীস হল,
كل قرض جر منفعة فهو ربا.
(অর্থঃ ঋণের বিনিময় যে লাভ অর্জিত হয় তাই সুদ)
হাদীসটি অনেকগুলো সনদে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সবগুলি সনদই যঈফ, তবে যেহেতু অধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে; তাই মুহাদ্দিস আযীযী রহ. ‘আস-সিরাজুল মুনীর’ এ হাসান লি গাইরিহি বলেছেন। আর হাসান লিগাইরিহী মানের হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা স্বীকৃত ব্যাপার। সুতরাং হাদীসের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে লাভ অর্জন করা সূদ সাব্যস্ত হয়েছে। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম- খণ্ডঃ১পৃ. ৫৬৮)
আমাদের অনেক বন্ধুগণ মনে করেন যে, যঈফ হাদীস মওযু তথা জাল হাদীসের পর্যায়ে, তাই যঈফ হাদীসকেও জাল হাদীসের মত ছুড়ে ফেলেন, অথচ কোন মুহাদ্দিসই এমনটি করেন নি, কেননা মুহাদ্দিসগণ ও মুজতাহিদ ইমামগণ সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, যঈফ হাদীস ফাযায়েল ও মুস্তাহাব বিষয়ে শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য, আহকামাত তথা দ্বীনের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসের উপর আমল করা বা দলীল দেওয়া যায় কিনা এ বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও ইমাম আবূ হানীফা রহ., ইমাম মালেক রহ. এবং ইমাম আহমাদ রহ. এর মতে আহকামাতেও যঈফ হাদীসের উপর আমল করা যায়, এটা মুহাদ্দিসীনের এক অংশের কর্মপন্থাও। যথা আবূ দাঊদ, নাসাঈ, আবূ হাতেমের শর্ত হল দু’টিঃ
১. দুর্বলতাটি গুরুতর না হওয়া
২. মাসআলার ক্ষেত্রে এছাড়া অন্য কোন হাদীস না পাওয়া যাওয়া।
এ কারণেই ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেনঃ যঈফ হাদীস আমাদের নিকট কিয়াস বা রায় থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য। এমনকি ইমাম শাফিয়ী রহ, যিনি মুরসাল হাদীসকে যঈফ সাব্যস্ত করেন; তিনিও যেখানে মুরসাল ছাড়া অন্য কোন হাদীস পাওয়া যায় না, সেখানে মুরসাল হাদীস অনুযায়ীই আমল করেন। তা ছাড়া ইমাম শাফিয়ী রহ. তার কিতাবুল উম্ম এ অনেক মুরসাল হাদীস দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। (আছারুল হাদীসিশ শরীফ, পৃ. ৩৬, ৩৭, ৩৮)
শায়খ আব্দুল্লাহ আস সিদ্দিক আল গুমারী রহ. বলেন, আহকামের মধ্যে যঈফ হাদীস আমলযোগ্য নয় কথাটিকে অনেকেই বা সকলেই একটি স্বীকৃত নীতি মনে করেন, আসলে বিষয়টি এমন নয়। …তিনি আরও বলেন, আমাদের মাকতাবায় তাজুদ্দীন আত-তিবরীযী এর মি’য়ার নামক কিতাব আছে, সংকলনকারী কিতাবটিকে ফিকহী তারতীবে সাজিয়েছেন, প্রত্যেক অধ্যায়ে কিছু যঈফ হাদীস উল্লেখ করেছেন; যেগুলো চারও মাযহাবের ইমামগণ সম্মিলিতভাবে বা এককভাবে গ্রহণ করেছেন। (আছারুল হাদীসিস শরীফ পৃ. ৩৮)
শুধু তাই নয়, কখনো যদি কোন যঈফ হাদীসের উপর সকল সাহাবা ও তাবেঈন যুগ যুগ ধরে আমল করে থাকেন; তাহলে এ কথাই বুঝতে হবে যে, এই হাদীসটি মূলত সহীহ, যদিও তার সনদ যঈফ। আর এ নীতির ভিত্তিতেই لا وصية لوارث (অর্থঃ ওয়ারিশদের জন্য ওসিয়ত করা বৈধ নয়।) এ হাদীসটিকে সকল মুজতাহিদ গ্রহণ করেছেন।
এমনকি এ উসূলের ভিত্তিতে কোন কোন ক্ষেত্রে যঈফ বর্ণনাকে সহীহ বর্ণনার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। ইমাম আবূ হানীফা রহ. ও কখনো প্রাসঙ্গিক দলীলের ভিত্তিতে যঈফ হাদীসকে প্রাধান্য দেন এবং তার উপর আমল করেন, যেমন অন্যান্য ইমামগণও করেছেন, সুতরাং এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার কোন সুযোগ নেই।
(৮) অনেক সময় দেখা যায়, ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মাযহাবকে সহীহভাবে জানারই চেষ্টা করা হয় না, অজ্ঞতাবশতঃ তার মাযহাবকে হাদীস পরিপন্থী ধরে নেওয়া হয় এবং অনৈতিকভাবে তাঁকে দোষারোপ করা হয়, যেমনঃ কোন কোন শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসও এ জাতীয় ভুলের শিকার হয়েছেন, অথচ একথা বলার অপেক্ষ রাখে না যে, হানাফী মাযহাব সম্পূর্ন কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশুদ্ধ ও সংগঠিত শক্তিশালী মাযহাব। তথাপি উপরোক্ত অযাচিত ভুলের শিকার আহলে হাদীসের অধিকাংশ তথাকথিত আলেমগণও।
উদাহরণত বিখ্যাত আহলে হাদীস আলেম হযরত মাওলানা ইসমাইল সালাফী রহ. কেই দেখুন, তিনি “তা’দীলে আরকান” এর মাসআলায় হানাফী মাযহাবের সমালোচনা করে লিখেনঃ হাদীস শরীফে আছে, ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নামায পড়ল, কিন্তু রুকু-সেজদা ধীর-স্থীরতার সাথে আদায় করল না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন,”صل فإنك لم تصل” নামায পড়ে নাও, কারণ তুমি নামায পড় নি, (অর্থাৎ, শরী‘আতের দৃষ্টিতে তোমার নামায অস্তিত্বহীন) এরূপ ক্রমান্বয়ে তিনবার হল। এই হাদীসের ভিত্তিতে আহলে হাদীস, শাফিয়ী, ও অন্য কিছু ইমাম মনে করেন, রুকু-সেজদা ধীরস্থীরভাবে আদায় না করলে নামায আদায় হবে না। আর হানাফীগণ বলেন, রুকু-সেজদার অর্থ জানার পর আমরা হাদীসের ব্যাখ্যা আর নামায না হওয়ার সিদ্ধান্ত মানি না(?) (অর্থাৎ, নূন্যতম রুকু-সেজদা করলেই নামায হয়ে যাবে)’।
অথচ এটা হানাফী মাযহাব সম্পর্কে একটি ঘৃণ্য মিথ্যাচার।
বাস্তব কথা হল, হানাফিগণও “صل فإنك لم تصل” এই হাদীসের ভিত্তিতেই বলেন, যদি রুকু-সেজদা পূর্ণ ধীর-স্থীরতার সাথে আদায় না করে, তাহলে ওয়াজিব তরক করার দরূন পুনরায় নামায পড়া ওয়াজিব। অতএব হানাফীগণ উপরোক্ত হাদীসের পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নকারী এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই, তবে ইমাম আযম রহ. ‘ফরজ’ ও ‘ওয়াজিব’ এর মাঝে পার্থক্য করেন, ধীর-স্থিরতাকে ওয়াজিব বলেন, আর অন্য ইমামগণ এই পার্থক্য মানেন না, তাই তারা ধীর-স্থীরতাকে ফরয বলেন।
ইমাম আযম রহ. বলেন,
কুরআনে কারীম ও মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয় হল ফরজ। আর ‘খবরে ওয়াহিদ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয় হল ওয়াজিব। আমলগতভাবে এ দুয়ের মাঝে তেমন কোন ফরাক নেই, ফরয ছেড়ে দিলেও নামায পুনরায় আদায় করতে হয়, ওয়াজিব ছেড়ে দিলেও নামায পুনরায় আদায় করতে হয়। এ দুইয়ের মাঝে শুধুমাত্র ব্যাখ্যাগত পার্থক্য রয়েছে, ফরয ছেড়ে দিলে তাকে সরাসরি নামায পরিত্যাগকারী বলা হবে, পক্ষান্তরে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে বলা হবে ওয়াজিব পরিত্যাগকারী , অর্থাৎ তার ফরয দায়িত্ব আদায় হয়ে গেছে।
একটু ঘুরিয়ে এটাকে এভাবেও বলা যায়, ওয়াজিব ত্যাগ করলে নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব, আর ফরয ত্যাগ করলে নামায পুনরায় আদায় করা ফরয।
আর এটা উপরোক্ত হাদীসের পরিপন্থী কিছু নয়, স্বয়ং এই হাদীসের শেষাংশেই এর পক্ষে সমর্থন রয়েছে, অর্থাৎ,ধীরস্থিরতা বর্জনকারীর নামাযকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাতিল বলেন নি, বরং ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন, এ কথাটি ইমাম আযম রহ. এর পক্ষে একটি শক্তিশালী দলীল, যেমন তিরমিযী শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঐ সাহাবীকে বললেন “صل فإنك لم تصل” অর্থাৎ, নামায পড়ে নাও, কারণ তুমি নামায পড় নি, তখন বিষয়টি সাহাবায়ে কেরামের কাছে খুবই কঠিন মনে হচ্ছিল যে, একজন লোক একটু দ্রুত নামায পড়ল, তাই তাকে বলা হচ্ছে, “তুমি নামায পড়নি” এর কিছুক্ষণ পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তির অনুরোধে নামাযের সহীহ তরীকা শিক্ষা দিতে গিয়ে ধীর-স্থিরভাবে নামায পড়ার তাগীদ করলেন এবং বললেন,
فإذا فعلت تمت صلوتك وإذا انتقصت منه شيئا انتقصت من صلوتك. (رواه الترمذى(৩০২:
‘এই কাজটুকু যখন তুমি করবে, তোমার নামায পূর্ণ হয়ে যাবে, আর এতে কোনরূপ ত্রুটি করলে তোমার নামায ত্রুটিপূর্ণ রয়ে যাবে’।
এখানে তার নামায বাতিল হওয়ার কথা বলেন নি, ধীর-স্থিরতা ফরয হলে তার নামায ত্রুটিপূর্ণ নয়, বরং বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
এই হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত রিফায়াহ রাযি. বলেন,
وكأنه هذا أهون عليهم من الأولى أنه انتقص من ذلك شيئا انتقص من صلوته ولم تذهب كلها.
অর্থাৎ, এটি সাহাবায়ে কেরামের কাছে প্রথম কথার তুলনায় সহজতর মনে হয়েছে। কেননা এই বিষয়গুলির মধ্যে কোন ত্রুটি হলে নামাযতো ত্রুটিপূর্ণ হবে, তবে পূর্ণ নামায বাতিল হবে না। (তিরমিযী শরীফ হা, নং, ৩০২,২৬৯৬)
হাদীসের এই অংশটি হানাফীদের আমলকে সুস্পষ্টরূপে পরিপূর্ন সমর্থন করছে, তারা হাদীসের প্রথম অংশের ভিত্তিতে বলেন, “তা’দীলে আরকান” তথা “ধীর-স্থিরতা”র সাথে নামায না পড়লে তা পুনরায় আদায় করতে হবে, আর শেষাংশের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, যদি “তা’দীলে আরকান” ব্যতীত নামায পড়ে, সেক্ষেত্রে তাকে নামায বর্জনকারী বলা যাবে না। আচ্ছা এই ব্যাখ্যার পর একটু চিন্তা করে বলুন, ‘হানাফীগণ হাদীসের ব্যাখ্যা মানে না’ এ ধরণের মন্তব্য কি ঠিক? এটা কি হানাফী মাযহাবের অপব্যাখ্যা ও এর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার নয়?
সারকথা হল, অনেক সময় হানাফী মাযহাবের প্রকৃত অবস্থান না জেনে না বুঝেই অনেকেই পাইকারীভাবেই বলে দেন যে, এটা হাদীস বিরোধী মাযহাব।
উল্লেখিত মূলনীতির আলোকে যদি কেউ হানাফী মাযহাবের পর্যালোচনা করেন, দলীল-প্রমাণের আলোকে নিরীক্ষণ করেন, তাহলে তার সামনে দিবালোকের ন্যায় এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে যে, হানাফী মাযহাব যঈফ হাদীস নির্ভর হওয়া তো দূরের কথা, বরং এটি সুদৃঢ় দলীলভিত্তিক একটি মাযহাব, যা কুরআন-সুন্নাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী। এই মাযহাবে সতর্কতা ও খোদাভিরুতার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা হয়েছে।
শা‘রানী রহ. ইমাম শাফিয়ী রহ.ও ইমাম আযম এর সমালোচনাকারীদের জবাব লিখেন, তিনি বলেন,
হে অভিযোগকারীগণ, তোমরা তারাহুড়া কর না, কারণ, ইমাম আযমের অনেকগুলি মুসনাদ থেকে আমার তিনখানা মুসনাদ পড়ার তৌফীক হয়েছে, যার দ্বারা আমি বুঝতে পেরেছি যে, তাদের অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন, উপরন্তু তার মাযহাবকে আমি সকল মাযহাবের তুলনায় কুরআন ও সুন্নাহর অত্যাধিক নিকটবর্তী পেয়েছি।
(মীযানুল কুবরা,১/৮২-৮৫)
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বাস্তবতা অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।