হুর ও ঈর্ষা
প্রথমত :
হুর আমার জীবনের অনেক পরের বিষয়। হুর নিয়ে জেলাস হওয়ার আগে জান্নাতে যেতে পারব কিনা, সেটাই আমার প্রথম চিন্তার বিষয়। বারযাখ ও দোযখের যে ভয়ানক শাস্তি তা থেকে বাঁচতে পারব কিনা, যে ভয়াবহ দিনে বাচ্চারা ভয়ে বুড়ো হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে, সূর্য মাথার ওপর নেমে আসবে, মুখে কুলুপ এটে দেয়া হবে, নিজের হাত পা নিজেরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, সেদিন আমার বিচার কী হবে, এটাই দুনিয়ায় আমার একমাত্র চিন্তা হওয়া উচিত। হাশরের দিন একগ্লাস পানি খেয়ে পিপাসা নিবারণ করতে পারি, অতটুকু আমলও কি আছে আমাদের?
আল্লাহর দয়ায় সেই ভয়াবহ দিন শেষে জান্নাতে যদি চলে যেতে পারি কোনোমতে তবে আর কী চাই? বিনা হিসাবে, আল্লাহর ক্ষমা যদি পাই তবে আর কী লাগে!
এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা লাভের প্রতি দ্রুত ধাবিত হও এবং সে জান্নাতের প্রতি যার আয়তন আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সমান।’ [আল ইমরান-১৩৩] অর্থাৎ মানুষের জীবনে জান্নাত লাভ করাটাই মূল বিষয়।
দ্বিতীয়ত:
জান্নাতের নেয়ামত অসংখ্য। এই অসংখ্য নেয়ামতরাজির মধ্যে হুর অনেক পরের বিষয়। কুরআনে আল্লাহ তাআলা হুরের নিয়ামতের আগে বর্ণনা করেছেন অন্যান্য নেয়ামতের কথা। আল্লাহ তাআলা তার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরী করে রেখেছেন, যা কোন চোখ দর্শন করেনি, কোন কর্ণ শ্রবন করেনি, এবং মানুষের অন্তরে যার কল্পনা পর্যন্ত হয়নি।
আল্লাহ বলেন, কেউ জানে না, তাদের জন্য নয়নাভিরাম কী কী উহ্য রাখা হয়েছে, তাদেরই কর্মের প্রতিদান স্বরূপ। [সাজদাহ-১৭]
জান্নাতের বাগান, জান্নাতের নহর, জান্নাতের প্রাসাদ ইত্যাদির বর্ণনা আল্লাহ বারবার কুরআনে দিয়েছেন।
কেন দিয়েছেন? আমাদের জন্যই তো!
আল্লাহ বলছেন, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি সুসংবাদ প্রদান করুন যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে।’ [বাকারা-২৫]
‘তাতে রয়েছে দুর্গন্ধহীন পানির নহর, সুস্বাদু দুধের নহর, সুপেয় শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। সেখানে তাদের জন্য আরো রয়েছে, রকমারী ফল-মূল এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা।’ [মুহাম্মদ ১৫]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একজন ঘোষণাকারী তাদের আহ্বান করে বলবে, ‘তোমরা এখানে কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। তোমরা এখানে চির সুস্থ, কখনো অসুস্থ হবে না। তোমরা এখানে চির যুবক, কখনো বৃদ্ধ হবে না। তোমরা এখানে আনন্দ-ফূর্তি কর, কখনো দুঃখিত হবে না।[মুসলিম]
আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ মুমিন নর-নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের। যার নিম্ন দেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান সেথায় তারা চিরদিন থাকবে। এই চির সবুজ শ্যামল জান্নাতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র পরিচ্ছন্ন বসবাসের স্থান। আল্লাহর সন্তোষ লাভ করে তারা হবে সৌভাগ্যবান আর তা হবে তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ [তাওবা-৭২]
তো দেখুন, কত কত নেয়ামত! আর এখানে লক্ষ্য করুন, এত এত নেয়ামতরাজির মধ্যে আল্লাহ কোনটাকে সবচেয়ে বড় সাফল্য বলছেন? নিশ্চয়ই হুর পাওয়া নয়, বরং সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। তাহলে কেন আমরা চিন্তা করব হুর নিয়ে?
আর জান্নাতিদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার কী জানেন? হুর নয়, বরং আল্লাহর দর্শন লাভ করা। আর এই নেয়ামত সবার জন্য। যখন আপনি জান্নাতে যাবেন, তখন দেখবেন, এইসব হুর, জান্নাতি সুখ ইত্যাদি আল্লাহর দর্শন লাভের তুলনায় কত গৌণ! কত স্বাদ, কত শান্তি থাকবে রাব্বে কারীমের দর্শন লাভে! কী যে চাওয়া নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকব- কখন আমরা রবের দর্শন লাভে ধন্য হবো!
তৃতীয়ত :
জান্নাতে জান্নাতিরা যা চাইবে তা-ই পাবে। আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতে তোমাদের মন যা চাইবে তাই দেয়া হবে এবং তোমরা সেখানে যা চাইবে তাই পাবে।’ [হা-মীম সিজদা- ৩১]
এখন আপনি যদি চান, আপনার স্বামীর হুর না থাকুক, তবে হয়তো থাকবে না। সেক্ষেত্রে আপনার স্বামীর চাওয়ার কী হবে, এর উত্তরে আমরা বলতে পারি, হয়তো আপনাকে পুরুষ হুরের মাধ্যমে আপনার স্বামীর ডুপ্লিকেট তৈরি করে দেয়া হবে। যেমন, যেসব নারীর বিয়ে হয়নি, অথবা যাদের স্বামী চিরস্থায়ী জাহান্নামী তাহলে তাদের জন্য অনুমতি আছে, সে ইচ্ছে করলে জান্নাতি কোন অবিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে। আর না চাইলে পুরুষ হুর আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করে তার সাথে বিয়ে করিয়ে দিবেন। [মাজমাউল ফতোয়া ১৫/৩]
কিন্তু এই সকল প্রশ্নই অবান্তর। কেন জানেন? কারণ জান্নাতে আপনি কখনোই চাইবেন না, আপনার স্বামীর হুর না থাকুক। দুনিয়াতে যেমন মানুষের সামাজিক স্তর ও মর্যাদা আছে, জান্নাতেও জান্নাতিদের স্তর থাকবে। একজন শহীদ একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় হুর বেশি পাবে। কারণ শহীদের মর্যাদা থাকবে বেশি। শহীদ হবেন উচ্চ পর্যায়ের জান্নাতি। আপনি হবেন ওই উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন জান্নাতি ব্যক্তির প্রিয়তমা স্ত্রী। আপনি কখনোই চাইবেন না অন্যদের চেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন জান্নাতির স্ত্রী হতে। আপনি কখনোই চাইবেন না আপনার ও আপনার স্বামীর মর্যাদা অন্যদের চেয়ে কম থাকুক।
শেষ কথা হলো, আপনি জান্নাতি নারী হলে হুররা তো আপনার ঈর্ষার যোগ্যই নয়। তাদের সৌন্দর্যের বর্ণনা পড়লে আপনি হয়তো এই দুনিয়াতে চমকে উঠেন, কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার সৌন্দর্য আপনার মর্যাদা তাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে। আপনি কাকে ঈর্ষা করছেন? হুররা তো মানুষই নয়। আপনি মানুষ, আপনি ইবাদাত করে জান্নাত লাভ করেছেন, আর তাদেরকে আল্লাহ জাস্ট আপনার স্বামীর সেবা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আপনি তাদের রানী। যখন আপনি জান্নাতে যাবেন, আপনার প্রাসাদের সেবিকাদের সাথে কেন নিজের তুলনা করবেন?
মনে রাখবেন আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ নেককার স্ত্রী’। এখন চিন্তা করে দেখুন, একজন নেককার স্ত্রী যদি হয় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তার মর্যাদা জান্নাতে কত উচ্চ থাকবে। হুরের সাথে কি তার তুলনা চলে?
তারপরও যদি মন জেলাসি হয়, তবুও চিন্তার কিছু নেই। খুব খুব মন দিয়ে সঙ্গীসহ জান্নাতে যাওয়ার আমল করতে থাকুন। জান্নাতে যাওয়ার পর জেলাসির ‘জ’ টাও খুঁজে পাবেন না। তার কারণ মহান আল্লাহ বলছেন, ‘তাদের অন্তরে যে ব্যধি রয়েছে, আমি তা দূর করে দিব, তারা মুখোমুখি চেয়ারে উপবিষ্ট, সকলে ভাই-ভাই।’ [হিজর ৪৭]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তাদের মাঝে পরস্পর কোন বিদ্বেষ থাকবে না, তাদের সবার অন্তর একটি অন্তরের ন্যায় থাকবে।’ [বুখারী]
সুতরাং আপনার স্বামীকে বরং হুরদের বর্ণনা পড়ে শুনান। যাতে সে জান্নাতে যাওয়ার ব্যাপারে এত আগ্রহী হয় যে, আপনাকে, আপনার বাচ্চাদেরকে নিয়ে সারাক্ষণ ঈমান ও আমলের ফিকির করতে থাকে। এতে পরকালে যেমন পেয়ে যাবেন চিরসুখের জান্নাত, দুনিয়াতেও দাম্পত্য জীবনে আপনি লাভ করবেন জান্নাতি সুখ।
© মাজিদা রিফা