কিছু কিছু ‘আলেম’ (!!!) দাবি করেছেন কা’বা নাকি এক প্রকারের ভাস্কর্য। এনাদের আকিদা Orthodox ইহুদিদের থেকেও খারাপ। মুসলিমদের মতো ইহুদি ধর্মেও কিবলার ধারণা আছে। কিন্তু ইহুদিরাও তাদের কিবলা Temple Mount এর Holy of Holies [প্রাচীন বাইতুল মুকাদ্দাসের অন্তর্গত চার কোণা ইবাদতের ঘর] কে মূর্তি বা ভাস্কর্য বলে না।
.
কিছু “বিশেষ অজ্ঞ” ব্যক্তি কুরআনের আয়াতকেও অপব্যাখ্যা করেন। তারা সুরা সাবার আয়াত দেখিয়ে ভাস্কর্য বা মূর্তিকে জায়েজ বানানোর অপচেষ্টা করেন। সুরা সাবার ১৩ নং আয়াতে উল্লেখ আছে,
.
“তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য (تَمَاثِيلَ), হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ় ভাবে চুল্লির উপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত। (আমি বলেছিলাম) হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ।”
(আল কুরআন, সাবা ৩৪ : ১৩)
.
এখানে তামাসিল বা ভাস্কর্যের কথা দেখেই আত্মহারা হয়ে ঐসব “বিশেষ অজ্ঞ”রা বলেনঃ সুলাঈমান(আ.) এর সময়ে মূর্তি বানানো হয়েছে, কাজেই কুরআন অনুযায়ী এটা জায়েজ (!!!)।
.
তাফসির মা’আরিফুল কুরআনে এই আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করা হয়েছেঃ তামাসিল (تَمَاثِيلَ) শব্দটি تِمْثال এর বহুবচন। এর অর্থ চিত্র। ইবন আরাবী আহকামুল কুরআনে বলেনঃ চিত্র দুই প্রকারের হয়ে থাকে, প্রাণীদের চিত্র ও অপ্রাণীদের চিত্র। অপ্রাণীও দুই প্রকার। এক. জড় পদার্থ, যাতে হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। যেমনঃ পাথর, মৃত্তিকা ইত্যাদি।
দুই. হ্রাস-বৃদ্ধি হয় এমন পদার্থ। যেমনঃ বৃক্ষ, ফসল ইত্যাদি। [১]
.
কাজেই এই আয়াত থেকে নিশ্চিতভাবে এটা বলবার উপায় নেই যে সুলাঈমান(আ.) এর সময়ে জীবন্ত প্রাণীরই ভাস্কর্য বানানো হতো। এমন হবারও সম্ভাবনা আছে যে এমন ভাস্কর্য বানানো হতো যা প্রাণীর নয়। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির আহসানুল বায়ানে উল্লেখ করা হয়েছেঃ এ মূর্তি অপ্রাণীর হতো। সুলাঈমান(আ.)-এর শরীয়তে মূর্তি নির্মাণ বৈধ ছিল এ কথা সঠিক নয়। ইসলাম মূর্তি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। [২]
.
যেহেতু তামাসিল দ্বারা প্রাণী – অপ্রাণী সব রকমের চিত্র বা ভাস্কর্যকে বোঝায়, এবং ইস্রাঈলী রেওয়াতে পাওয়া যায় যে সুলাঈমান(আ.) এর সময়ে জীবন্ত প্রাণীর ভাস্কর্য বানানো হতো – কোনো কোনো মুফাসসির ইস্রাঈলিয়্যাহ এর আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন যে সুলাঈমান(আ.) এর আমলে হয়তো প্রাণীদের ভাস্কর্যও বানানো হতো। কিন্তু তাঁরা কখনোই এ থেকে দলিল নিয়ে এটা বলেননি যে এই যুগেও মূর্তি বানানো জায়েজ। তাঁরা বলেছেন যে এটা ছিলো সুলাঈমান(আ.) এর শরিয়ত। পূর্ববর্তী নবীর শরিয়ত এখন অনুসরণীয় নয়। বহু সংখ্যক সহীহ হাদিস দ্বারা এটা স্পষ্ট যে আমাদের জন্য নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর শরিয়তে সকল প্রকার জীবন্ত প্রাণীর ছবি ও মূর্তি তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [৩] ইস্রাঈলিয়্যাহ শরিয়তের কোনো দলিল নয়। কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে দলিল।
.
ইস্রাঈলিয়্যাহ বা ইহুদিদের কিতাবাদীতে পাওয়া যায় যে সুলাঈমান(আ.) বাইতুল মুকাদ্দাসে মূর্তি তৈরি করে রেখেছিলেন। [৪] কিন্তু আমরা যদি ইস্রাঈলিয়্যাহকেও ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখি, তাহলে বোঝা যাবে এখানে কিছু শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। ইহুদি ও খ্রিষ্টান সকলেই একমত যে সুলাঈমান(আ.) বনী ইস্রাঈলের একজন নবী ছিলেন এবং বনী ইস্রাঈলের অন্য নবীদের মতোই তিনিও তাওরাতের শরিয়তের অধীন ছিলেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে, তাতে বিভিন্ন স্থানে স্পষ্টভাবে সকল প্রকার প্রাণীর ছবি বা মূর্তি বানানো হারাম করা আছে। বাইবেলের ১ম ৫টি বইকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা মুসা(আ) এর ‘তাওরাত’ বলে বিশ্বাস করে। বাইবেলের ২য় বিবরণ বা Book of Deuteronomyতে উল্লেখ আছেঃ
.
16 সুতরাং খুব সাবধান! জীবিত কোনো কিছুর আকৃতিতে মূর্ত্তি অথবা খোদাই করা প্রতিমা তৈরী করে তোমরা পাপ করো না এবং নিজেদের ধ্বংস করো না| একজন পুরুষ অথবা একজন স্ত্রীলোকের মতো দেখতে কোনো প্রতিমূর্ত্তি তৈরী করো না|
17 পৃথিবীর কোনো পশুর মতো অথবা আকাশে ওড়ে এমন কোনো পাখির মতো দেখতে কোনো প্রতিমূর্ত্তি তৈরী করো না|
18 মাটির বুকে ভর দিয়ে চলে এমন কোনো কিছুর মতো অথবা সমুদ্রের কোনো মাছের মতো প্রতিমূর্ত্তি তৈরী করো না|
[বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ৪ : ১৬-১৮]
.
আরো বলা হয়েছে,
.
4 “তোমরা অবশ্যই অন্য কোন মূর্তি গড়বে না য়েগুলো আকাশের, ভূমির অথবা জলের নীচের কোন প্রাণীর মত দেখতে|
[বাইবেল, যাত্রাপুস্তক (Exodus) ২০ : ৪]
.
আরো বলা হয়েছে,
.
‘য়ে কেউ মূর্ত্তি তৈরী করে এবং সেগুলি গোপন জায়গায় রাখে, সেই অভিশপ্ত হয়| ঐ মূর্ত্তিগুলি শিল্পীর দ্বারা খোদিত বা ছাঁচে ঢালা মূর্ত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়| প্রভু এগুলিকে ঘৃণা করেন|’ তখন সমস্ত লোক উত্তরে বলবে, ‘আমেন!’
[বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২৭ : ১৫]
.
এ থেকে স্পষ্ট হলো যে বর্তমান বাইবেলের তাওরাত অংশেও মূর্তিপুজার সাথে সাথে এমনকি কোনো প্রকার প্রাণীর ছবি বা মূর্তি নির্মাণ করতেও নিষেধ করা আছে। বাইবেলের ঈশ্বর এগুলোকে ঘৃণা করেন এবং যারা এগুলো করে, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তাওরাত অনুযায়ী তারা অভিশপ্ত।
এই বাইবেলেই ১ রাজাবলী (বাদশাহনামা/Kings) ৬ : ২২-২৯ এ উল্লেখ আছে সুলাঈমান(আ.) নাকি বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে Cherubim বা ফেরেশতাদের মূর্তি তৈরি করেছিলেন! (নাউযুবিল্লাহ)
মূলত তাওরাতের শরিয়তে যেখানে সর্বপ্রকার মূর্তি নির্মাণ হারাম করা আছে, সেখানে তাওরাত অনুসারী একজন নবী খোদ বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে মূর্তি বানাবেন তা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কাজেই ইস্রাঈলী রেওয়ায়েতের এই তথ্যেও ভীষণ গড়মিল আছে। ইস্রাঈলী রেওয়াতের এই তথ্য আসলে সত্য নয়। আল্লাহর নবী সুলাঈমান(আ.) কখনো জীবন্ত প্রাণীর মূর্তি গড়তে পারেন না।
.
মূলত নবী সুলাঈমান(আ.) এর পরবর্তীকালে বনী ইস্রাঈলের লোকেরা মূর্তিপুজায় লিপ্ত হয় এমনকি বাইতুল মুকাদ্দাসকেও মূর্তি দিয়ে ভরে ফেলেছিলো। বাইবেল নিজেই এর সাক্ষ্য দেয়। দেখুনঃ বাইবেল, ২ রাজাবলী(2 Kings) ২১:৩-১১। [৫] বাইবেল নিজেই দাবি করে যে এই ভয়াবহ পাপের ফলে বনী ইস্রাঈলের উপর আল্লাহর আযাব নেমে আসে ও তারা ফিলিস্তিন থেকে বাইরে ব্যাবিলনে নির্বাসিত হয়। এমনটিও হতে পারে, বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে বসে মূর্তিপুজার ভয়াবহ গুনাহকে কম করে দেখানোর জন্য বাইবেলের কিছু লেখক নবী সুলাঈমান(আ.) এর নামে মিথ্যাচার করে তাঁর দ্বারা বাইতুল মুকাদ্দাসে মূর্তি নির্মাণের গল্প লিখেছে। যে কারণে ইস্রাঈলিয়্যাহর মধ্যে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য দেখা যায়। আল্লাহই উত্তম জানেন। ইহুদিদের কিতাব বিকৃতি ও নবীদের নামে মিথ্যাচারের বহু নিদর্শন বাইবেলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে।
.
যেখানে এমনকি ইস্রাঈলী রেওয়ায়েত দিয়েও সুলাঈমান(আ.) কর্তৃক মূর্তি বানানো প্রমাণিত নয়, সেখানে বঙ্গদেশীয় কিছু “বিশেষ অজ্ঞ” কুরআনের অপব্যাখ্যা করে মূর্তি বানানো সাবেত করতে চান। আমরা আল্লাহর নিকট তাদের মানসিক সুস্থতা ও হেদায়েতের জন্য দোয়া করি।
.
.
___ ___ __
[১] তাফসির মাআরিফুল কুরআন, সুরা সাবার ১৩ নং আয়াতের তাফসির; খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২৫৯
[২] https://www.hadithbd.com/quran/link/?id=3619
[৩] এ বিষয়ে এতো পরিমাণ দলিল আছে যে উল্লেখ করলে লেখার কলেবর বিশাল হয়ে যাবে। আগ্রহীরা এই বইটি দেখতে পারেন।
https://islamhouse.com/bn/articles/278880/
[৪] বাইবেল, ১ রাজাবলী (বাদশাহনামা/Kings) ৬ : ২২-২৯
☛https://www.wordproject.org/bibles/ben/11/6.htm#0
☛https://www.biblegateway.com/passage/?search=1%20kings%206%3A22-29&version=NIV
☛https://www.jibonerkotha.com/কিতাব-পড়ুন/?bk=11&cp=6
[৫] https://www.wordproject.org/bibles/ben/12/21.htm#0
মুশফিকুর রহমান মিনার হাফি.