গিনিপিগ- প্রথম পর্ব

#গিনিপিগ- প্রথম পর্ব
প্রথমে দেখলে মনে হবে মজার কোনো খেলা। সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। প্রত্যেকের বামে হাতে উল্কি। উল্কিতে বিশেষ একটা নম্বর লেখা। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। একটু দূরে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো হাসিমুখের এক লোক খাতা আর কলম নিয়ে একটা পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়েশি ভঙ্গি। লোকটার মুখে হাসি থাকলেও চোখ হাসছে না। সাপের মতো ঠান্ডা দুচোখ।
.
‘রেডি?’ সারিবেঁধে দাঁড়ানো মানুষদের প্রশ্ন করল হাসিমুখের লোকটা। ওরা নীরব থাকল। টেনশনে ভেঙে পড়ছে অনেকে। অনেকেই চুপচাপ স্থির হয়ে আছে। মনে কী চলছে বোঝা যাচ্ছে না। ঝড় আসার আগের পরিস্থিতির মতোই শান্ত ওরা।
.
‘আচ্ছা তাহলে আমরা শুরু করতে পারি।’ প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়েও মুখের হাসি সরলো না ঠান্ডা চোখওয়ালার। শুরু হলো খেলা।
.
এক একজন লোক, ‘ঠান্ডা চোখের’ সামনে দিয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেল। আর সে খাতাতে টুকে নিল কিছু তথ্য। কে কতটা জোরে দৌড়াতে পারল, কত কম সময় নিল ইত্যাদি।
.
তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই সারিবেঁধে দাঁড়ানো লোকদের দুভাগে ভাগ করা হবে। একদলকে বহাল রাখা হবে আগের কাজেই–ফ্যাক্টরির শ্রমদাস হিসেবে। অন্য দলকে পাঠানো হবে কয়েকটি জায়গায়। বুড়ো, অথর্ব, কাজ করতে অক্ষম লোকদের পাঠানো হবে গ্যাস চেম্বারে। এই ধরনের কাউকে কাউকে পাঠানো হবে ক্রিমোটোরিয়ামে–জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। আবার কাউকে কাউকে পাঠানো হবে বিভিন্ন টপ সিক্রেট ল্যাবে। নৃশংস মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট চালানো হবে ওদের ওপর!
.
পাঠক আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই ঠান্ডা চোখের লোকটার সঙ্গে। অত্যন্ত মেধাবী এই লোকটা জার্মান, নাম ড. জোসেফ ম্যাঙ্গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বইগুলোতে যাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ‘মৃত্যুর ফেরেশতা’ হিসেবে। ড. জোসেফ ম্যাঙ্গেল, ‘অ্যানজেল অফ ডেথ’!
.
নাৎসি জার্মানি গড়ে তুলেছিল অনেকগুলো টপ সিক্রেট মেডিকেল ল্যাব। এই ল্যাবগুলোতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের নিয়ে গা শিউরে ওঠা সব এক্সপেরিমেন্ট চালানো হতো! তখনকার সময়ের প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, যক্ষ্মার মতো রোগের জীবাণু বন্দীদের শরীরে প্রবেশ করানো হতো। তারপর পিল বা ইনজেকশন দিয়ে এসব রোগের পরীক্ষামূলক প্রতিষেধক দেয়া হতো বন্দীদের। কোনো কোনো বন্দীকে বিষ খেতে দেয়া হতো গোপনে। বন্দীর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা হতো। অথবা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হতো। তারপর লাশ কেটেকুটে দেখা হতো বিষ বন্দীর শরীরে কী প্রভাব ফেলল। কম সময়ে কম খরচে গণহারে বন্ধ্যাকরণের উপায় জানতে চালানো হতো একের পর এক রোমহর্ষক পরীক্ষা। এক্সরে রেডিয়েশনের সম্মুখীন করা হতো নারী-পুরুষ সবাইকে। কোনোপ্রকার অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই পুরুষদের লিংগ কেটে নেওয়া হতো। ক্রস সেকশন করে দেখা হতো রেডিয়েশনের ফলে লিংগে কেমন পরিবর্তন এল।
.
বুঝতেই পারছেন, এই অমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য বন্দীদের নির্বাচন করার কাজটা ছিল বেশ কষ্টকর। নির্দয় নাৎসি ডাক্তাররাও এই কাজটা করতে চাইত না। তাদের হয়ে এই কাজটা করে দিত ড. জোসেফ ম্যাঙ্গেল–অ্যানজেল অফ ডেথ।
.
সে নিজেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ল্যাব গড়ে তুলেছিল। আউশভিৎস ক্যাম্পে পুরো নরক গুলজার করে ছেড়েছিল। যমজ বাচ্চাদের নিয়ে তার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। এমন কিছু নেই যা যমজদের শরীরে ইনজেকশন দিয়ে ম্যাঙ্গেল ঢোকায়নি। ক্লোরোফরম থেকে শুরু করে পেট্রোল, বাদ দেয়নি কিছুই। খুব কষ্ট দিয়ে বাচ্চাদের হাতে বা পায়ে গ্যাংগ্রিনের সংক্রমণ ঘটাত সে। তারপর নিজের আবিষ্কৃত ওষুধ পরীক্ষা করত ওদের ওপর। চোখের মণির রং নিয়েও অনেক আগ্রহ ছিল ম্যাঙ্গেলের। বন্দীদের শরীর থেকে কেটে নিয়ে সংগ্রহ করেছিল হাজার হাজার চোখ। ছবি বা শোপিস সাজিয়ে রাখার মতো করে সাজিয়ে রেখেছিল দেয়ালে।
.
পাঠক নিশ্চয় এতক্ষণে ভাবতে শুরু করেছেন, উইঘুরদের কথা বলতে গিয়ে ম্যাঙ্গেল আর নাৎসিদের চালানো হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টের কথা কেন টানছি?
কারণ আছে। নাৎসিদের মতো করেই যে উইঘুরদের ওপর মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে হান চাইনিযরা!
.
ক্যাম্পফেরত বেশ কয়েকজনের মুখ থেকে শোনা যাক উইঘুরদের ওপর চালানো মেডিকেল এক্সপেরিমেন্টের কথা। সাইরাগুল সাউতাবাই বলছেন,
‘বন্দীদের অজান্তেই ক্যাম্পে তাদের ওপর খুব ঠান্ডা মাথায় নানা মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট চালাত চীনারা। বড় এক মাস্টারপ্ল্যানের অংশ এটা। আমার কাছে এমনটাই মনে হয়েছে। তা না হলে এত ঘনঘন কেন বন্দীদের ধরে নিয়ে মেডিকেল চেকআপ করানো হতো? বিভিন্ন টেস্ট করানো হতো? জোর করে ইনজেকশন দিত ওরা। পিল খেতে বাধ্য করত। বলত, ‘রোগব্যাধি থেকে এগুলো তোদের রক্ষা করবে।’ একদম মিথ্যে কথা; বরং এই ওষুধ খেয়েই অনেক বন্দী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। একজন নার্স আমাকে একবার চুপি চুপি জানিয়েছিল, ‘কক্ষনো ওসব ওষুধ খাবেন না। এগুলো খুবই ক্ষতিকর।’ পিল খাওয়ার পর বন্দীরা দুর্বল হয়ে যেত। মাসিক বন্ধ হয়ে যেত মহিলাদের। একদিকে সুস্থ বন্দীদের জোর করে পিল খাওয়ানো হতো, ইনজেকশন দেয়া হতো। আবার কারও যখন আসলেই ওষুধের দরকার পড়ত, তখন চিকিৎসা দেয়া হতো না।’
.
আরেকজন ক্যাম্পফেরত নারী মিহিরগুল তারসুন। তিনি শোনাচ্ছেন পাতেমহান নামের এক নারীর মর্মান্তিক কাহিনি। ‘পাতেমহানকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে আসে তখন তার বাচ্চারা বাড়ির পেছনের উঠোনে লুকিয়ে ছিল। বাচ্চাদের কথা মনে করে মাথানিচু করে কাঁদত সে। বুকখালি করা দীর্ঘশ্বাসে গুমোট হয়ে যেত ৪৩০ স্কয়ার ফিটের সেলটা। অচেনা একধরনের পিল খেতে বাধ্য করা হয়েছিল আমাদের। সেই সাথে সাদা রঙের কিছু তরল ওষুধ। পিল খাবার পরে মাথার ভেতর সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। আমরা মূর্ছা গেলাম। এরপর থেকে আমাদের চিন্তাশক্তি মাঝে মাঝেই এলোমেলো হয়ে যেত। সাদা লিকুইড খাবার পর একেকজনের শরীর একেক রকমভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল। অধিকাংশের মাসিক বন্ধ হয়ে গেল। আবার কয়েকজনের মারাত্মক ব্লিডিং হলো। পিলের প্রভাবেই পাতেমহানের ব্লিডিং শুরু হয় একদিন। এক মাস ধরে ব্লিডিং হতে থাকে তার। এই পুরো একটা মাস ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ওর কোনো ধরনের চিকিৎসা করেনি। আমাদের থাকার সেলগুলো ছিল খুব ছোট। সব বন্দী একসঙ্গে ঘুমুতে পারত না। পালাক্রমে ঘুমুতে হতো। একদল যখন ঘুমুত বাকিরা তখন দাঁড়িয়ে থাকত। একরাতে পালা করে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কাটা গাছের মতো ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল পাতেমহান। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ছুটে এল মাস্ক পরা বেশ কয়েকজন লোক। পা ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর থেকে পাতেমহানের আর কোনো খবর আমরা কেউ জানি না।’
.
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া গুলবাহার জালীলের ভাষ্যমতে ইনজেকশন দেয়া হতো প্রতি দশ দিন পরপর। আর আল্ট্রাসনোগ্রাফি হতো রুটিন করে।
.
বইঃ কাশগড়-কতো না অশ্রুজল
লেখকঃEnamul Hossain
সম্পাদকঃAsif Adnan
প্রকাশনীঃIlmhouse Publication
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৬৪
নির্ধারিত মূল্যঃ ২৬০ টাকা
বইয়ের প্রাপ্তিস্থানঃ https://tinyurl.com/yxjofwa4
=============
#উম্মাহ #উইঘুর #Uyghur #UyghurGenocide #UyghurHolocaust #কাশগড় #কতো_না_অশ্রুজল
.
রেফারেন্সঃ
[১] Night, Elie Wiesel. https://tinyurl.com/y79euleu
[২] How Josef Mengele Became The Angel Of Death, Richard Stockton. June 6th, 2016. https://tinyurl.com/y7sxb6x9
The twins of Auschwitz, Andy Walker. BBC News, January 28th, 2015. https://tinyurl.com/wkd8kvq
Lifton, Robert Jay, 1926- author. (16 May 2017). The Nazi Doctors: medical killing and the psychology of genocide. ISBN 978-0-465-09339-7. OCLC 1089625744
[৩]A Million People Are Jailed at China’s Gulags. I Managed to Escape. Here’s What Really Goes on Inside. David Stavrou. Hareetz, October 18th, 2019. https://tinyurl.com/y6m9kjl4
[৪]Video: In Full – Ex-Xinjiang detainee Mihrigul Tursun’s full testimony at the US congressional hearing. Hong Kong Foreign Press, December 8th, 2018. https://tinyurl.com/u4mwf7g
[৫]Bloody Harvest—How Everyone Ignored the Crime of the Century. Aaron Sarin. Quillette, January 3rd, 2020. https://tinyurl.com/te6lshr

আমাদের সাহায্য করুনঃ
➡️https://forms.gle/aVQEzjDY7MLJMQNGA

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *