ছবি-ভাস্কর্য নির্মাণের অবৈধতা : প্রামাণ্য একটি আলোচনা
ছবি-ভাস্কর্য তৈরির ঐতিহাসিক পটভূমি :
মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর শ্রেষ্ঠ মাখলুক মানুষকে বানিয়েছেন ‘খলিফাতুল আরজ’ তথা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি স্বরূপ। কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
‘আমি পৃথিবীতে (আমার) প্রতিনিধি বানাতে ইচ্ছুক।’ (সুরা আল-বাকারা : ৩০)
কিন্তু তিনি কেন তাঁর প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চান? এতে তাঁর উদ্দেশ্য কী? এর উত্তর আল্লাহ তাআলা নিজেই অন্য আয়াতে এভাবে দিয়েছেন :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘আমি জিন ও মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত, আমার একত্ববাদে বিশ্বাসের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আজ-জারিয়াত : ৫৬)
কিন্তু জান্নাত হতে বহিষ্কৃত মানবজাতির চিরশত্রু অভিশপ্ত ইবলিস বসে থাকবে কেন? দম্ভভরে সে ঘোষণা করল—কুরআনের ভাষায় :
قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ، إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
‘সে (শয়তান) বলল, আপনার ইজ্জত ও বুজুর্গির শপথ! আমি আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের ব্যতীত তাদের (মানবজাতির) সবাইকে অবশ্য অবশ্যই পথভ্রষ্ট করে ফেলব।’ (সুরা সদ : ৮২-৮৩)
আর এভাবে মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্নেই শুরু হয়ে যায় মানব ও ইবলিসের পারস্পরিক শত্রুতা। হক ও বাতিলের সুস্পষ্ট দ্বন্দ্ব। মানবজাতির ফিকির ও দায়িত্ব ছিল, কী করে মহান রবকে খুশি করা যায়, কীভাবে তাঁর একচ্ছত্র প্রভুত্ব ও একত্ববাদের বিশ্বাসে অটল থাকা যায়। আর ইবলিস শয়তানের চিন্তা হলো, কী করে মানব সম্প্রদায়কে প্রভুর অবাধ্য করা যায়, কীভাবে তাদেরকে আল্লাহ ইবাদত থেকে নিবৃত্ত রাখা যায়।
ইবলিস শয়তান ভাবল, মানবজাতির দ্বারা শুধু সাধারণ গুনাহ করানোই যথেষ্ট হবে না। কারণ, বান্দা গুনাহ করার পর অনুতপ্ত হয়ে তাওবা-ইসতিগফার করলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। খালিস দিলে তাওবা করলে উল্টো তার মর্যাদা আল্লাহর নিকট আরও বৃদ্ধি পায়। তাই এমন এক পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে তার মহামূল্যবান ইমান ও তাওহিদের দৌলত বিনষ্ট হয়ে যায়; আর এতে করে তার সকল আমল ও ইবাদত বরবাদ হয়ে যায়। এজন্য সে ফন্দি আঁটতে থাকে, কীভাবে এ পথে আগানো যায়। অর্থাৎ এমনভাবে মানবজাতিকে এ জালে আটকাতে হবে, যাতে সে ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে, সে ধ্বংস ও বরবাদির জালে আটকে গেছে। অতঃপর মানবজাতির দুনিয়া-আখিরাত সমূলে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে তার প্রথম ধাপ ছিল ছবি ও ভাস্কর্যের নির্মাণ। ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোনোরকমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের জন্য সে ভাস্কর্য নির্মাণ করে দিল। আর এভাবেই মানুষ তার ফাঁদে পড়ে নিজেদের মহামূল্যবান ইমান হারানোর প্রথম পথ খুঁজে পেল।
এ ব্যাপারে সুবিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মাহমুদ আলুসি রহ. তাঁর কালজয়ী তাফসিরগ্রন্থ ‘রুহুল মাআনি’-তে একটি হাসান (প্রমাণযোগ্য) রিওয়ায়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
وأخرج أبو الشيخ في العظمة عن محمد بن كعب القرظي أنه قال: كان لآدم عليه السلام خمسة بنين ود وسواع إلخ فكانوا عبادا فمات رجل منهم فحزنوا عليه حزنا شديدا فجاءهم الشيطان فقال: حزنتم على صاحبكم هذا؟ قالوا: نعم، قال: هل لكم أن أصور لكم مثله في قبلتكم إذا نظرتم إليه ذكرتموه؟ قالوا: نكره أن تجعل لنا في قبلتنا شيئا نصلي عليه قال: فأجعله في مؤخر المسجد، قالوا: نعم فصوره لهم حتى مات خمستهم فصور صورهم في مؤخر المسجد فنقصت الأشياء حتى تركوا عبادة الله تعالى وعبدوا هؤلاء فبعث الله تعالى نوحا عليه السلام فدعاهم إلى عبادة الله تعالى وحده وترك عبادتها فقالوا ما قالوا.
‘মুহাম্মাদ বিন কাব আল-কুরাজি রহ. বলেন, হজরত আদম আ.-এর পাঁচ সন্তান ছিল্। তাঁরা হলেন, উআদ, সুওয়া, ইয়াউক, ইয়াগুস ও নাসর। এরা সবাই ছিলেন আল্লাহর বান্দা। এদের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করলে বাকি সবাই খুব চিন্তিত ও ব্যথিত হলেন। তখন তাঁদের নিকট শয়তান এসে বলল, তোমরা কি তোমাদের এ সাথির জন্য চিন্তিত হচ্ছ? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। সে বলল, তোমরা কি চাও যে, (ইবাদতের সময়) তোমাদের সম্মুখভাগে আমি তাঁর একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দিই? যাতে তোমরা যখন তা দেখবে, তখন তাঁর কথা স্মরণ করবে। তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের সম্মুখভাগে এমন কিছু রাখাকে অপছন্দ করি, যেদিকে ফিরে আমরা সালাত আদায় করি। তখন সে বলল, তাহলে তা তোমাদের ইবাদতখানার পেছনে রাখি? তাঁরা বলল, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। অতঃপর সে তাঁদের জন্য তাঁর একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দিল। এরপর ধীরে ধীরে পাঁচজনের বাকি সবাইও মারা গেল। তখন ইবলিস তাঁদের সবার একটি করে প্রতিকৃতি বানিয়ে ইবাদতখানার পিছন দিকে রেখে দিল। এরপর সব জিনিসই (ইবাদত, সৎকর্ম) কমতে শুরু করল। একপর্যায়ে লোকেরা আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে এসব প্রতিকৃতির উপাসনা শুরু করল। তখন আল্লাহ তাআলা নুহ আ.-কে পাঠালেন। তিনি এসে তাদেরকে এসব ভাস্কর্য-প্রতিমার পূজা ছেড়ে এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার দাওয়াত দিলেন। প্রতিউত্তরে তারা যা বলার তা-ই বলল।’ (রুহুল মাআনি : ১৫/৮৬, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
হাফিজ ইবনু কাসির রহ. এ ঘটনাকেই অন্য একটি সূত্রে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘তাফসিরু ইবনি কাসির’-এ বলেন :
وَقَالَ ابْنُ أَبِي حَاتِمٍ: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مَنْصُورٍ، حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ مُوسَى، حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ عَنْ أَبِي الْمُطَهِّرِ قَالَ: ذَكَرُوا عِنْدَ أَبِي جَعْفَرٍ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي يَزِيدَ بْنَ الْمُهَلَّبِ، قَالَ: فَلَمَّا انْفَتَلَ مِنْ صِلَاتِهِ قَالَ: ذَكَرْتُمْ يَزِيدَ بْنَ الْمُهَلَّبِ أَمَا إِنَّهُ قُتِلَ فِي أَوَّلِ أَرْضٍ عُبِدَ فِيهَا غَيْرُ اللَّهِ، قال: ثم ذكروا رَجُلًا مُسْلِمًا وَكَانَ مُحَبَّبًا فِي قَوْمِهِ فَلَمَّا مات اعتكفوا حَوْلَ قَبْرِهِ فِي أَرْضِ بَابِلَ وَجَزِعُوا عَلَيْهِ، فَلَمَّا رَأَى إِبْلِيسُ جَزَعَهُمْ عَلَيْهِ تَشَبَّهَ فِي صُورَةِ إِنْسَانٍ، ثُمَّ قَالَ إِنِّي أَرَى جَزَعَكُمْ عَلَى هَذَا الرَّجُلِ فَهَلْ لَكَمَ أَنْ أُصَوِّرَ لَكُمْ مِثْلَهُ فَيَكُونَ فِي نَادِيكُمْ فَتَذْكُرُونَهُ؟ قَالُوا نَعَمْ، فَصُوِّرَ لَهُمْ مَثَلُهُ، قَالَ: وَوَضَعُوهُ فِي نَادِيهِمْ وَجَعَلُوا يَذْكُرُونَهُ، فَلَمَّا رَأَى مَا بِهِمْ مِنْ ذِكْرِهِ قَالَ: هَلْ لَكُمْ أَنْ أَجْعَلَ في منزل كل رجل مِنْكُمْ تِمْثَالًا مِثْلَهُ فَيَكُونَ لَهُ فِي بَيْتِهِ فَتَذْكُرُونَهُ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: فَمَثَّلَ لِكُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ تِمْثَالًا مِثْلَهُ، فَأَقْبَلُوا فَجَعَلُوا يَذْكُرُونَهُ بِهِ، قَالَ: وَأَدْرَكَ أَبْنَاؤُهُمْ فَجَعَلُوا يَرَوْنَ مَا يَصْنَعُونَ بِهِ، قَالَ: وَتَنَاسَلُوا وَدَرَسَ أَمْرُ ذِكْرِهِمْ إِيَّاهُ حَتَّى اتَّخَذُوهُ إِلَهًا يَعْبُدُونَهُ مَنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلَادُ أَوْلَادِهِمْ، فَكَانَ أَوَّلَ مَا عُبِدَ مِنْ دون الله: الصنم الذي سموه ودا.
‘আবুল মুতাহহির রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা ইমাম আবু জাফর রহ.-এর নিকট ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবের আলোচনা করছিল, যখন তিনি (ইমাম আবু জাফর রহ.) সালাত পড়ছিলেন। আবুল মুতাহহির রহ. বলেন, তিনি যখন সালাত থেকে ফারেগ হলেন তখন বললেন, তোমরা ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবের আলোচনা করছিলে। জেনে রাখো, সে এমন এক ভূমিতে নিহত হয়েছে, যেখানে প্রথম গাইরুল্লাহর উপাসনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এরপর লোকেরা এক ব্যক্তির আলোচনা করল, যিনি ছিলেন মুসলিম এবং স্বীয় গোত্রের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি মৃত্যুবরণ করলে লোকেরা বাবেল শহরে তাঁর কবরের পাশে অবস্থান করে আফসোস ও হা-হুতাশ করতে লাগল। ইবলিস যখন তাঁর ব্যাপারে লোকদের অস্থিরতা ও আফসোসের বিষয়টি লক্ষ করল, তখন সে (এটা মানুষকে গোমরাহ করার সুবর্ণ সুযোগ মনে করে) মানুষের আকৃতি ধারণ করে এসে বলল, আমি এ ব্যক্তির ব্যাপারে তোমাদের চিন্তান্বিত ও অস্থির হওয়ার বিষয়টি অবলোকন করেছি। তোমরা কি চাও যে, আমি তোমাদের জন্য তাঁর মতো হুবহু একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দিই, যা তোমাদের সমাবেশস্থল ও বৈঠকখানায় থাকবে আর এতে করে তোমরা তাঁর কথা স্মরণ করবে? তারা বলল, হ্যাঁ (বানিয়ে দাও)। তখন সে তাদেরকে হুবহু তাঁর (উআদের) মতো একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দিল। আবু জাফর রহ. বলেন, তারা তাঁর প্রতিকৃতি তাদের বৈঠকখানায় রেখে তাঁর কথা স্মরণ ও আলোচনা করত। ইবলিস যখন তার স্মরণের বিষয়ে লোকদের অবস্থা ও আগ্রহ পর্যবেক্ষণ করল, তখন সে বলল, তোমরা কি চাও যে, আমি তোমাদের প্রত্যেকের ঘরে তাঁর একটি করে প্রতিকৃতি বানিয়ে দিই, যা ঘরে থাকবে এবং তোমরা তার স্মরণ করবে? তারা বলল, হ্যাঁ (বানিয়ে দাও)। আবু জাফর রহ. বলেন, তখন ইবলিস প্রত্যেক গৃহকর্তার জন্য তাঁর প্রতিকৃতি বানিয়ে দিল। তারা তা অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনা সহিত গ্রহণ করে তা দেখে তার স্মরণ করতে লাগল। তিনি বলেন, এরপর তাদের সন্তানসন্ততি তাদের পিতাদের কার্যক্রম ও কর্মপন্থা অবলম্বন করতে লাগল। এভাবে বংশপরম্পরায় (কিছুকাল) চলতে লাগল এবং তাদের তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও স্মরণ করার বিষয়টি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে গেল। একপর্যায়ে (পরবর্তী) লোকেরা আল্লাহকে ছেড়ে তাঁকে (উআদের ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতিকে) মাবুদ মেনে উপাসনা করা শুরু করল। অর্থাৎ এদের অধীনস্থ সন্তানেরা। আর এভাবেই আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রথম যার উপাসনা করা হলো, তা হচ্ছে ওই প্রতিমা, যাকে তারা ‘ওয়াদ’ বলে ডাকে।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৮/২৪৯, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
উপরিউক্ত দুটি বর্ণনা হতে বোঝা যায়, মানবজাতির পরকাল ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইবলিস শয়তান প্রথম যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তা হলো, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যের ব্যাপক প্রসার। ইবলিস ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, এ পদ্ধতিতেই মানুষকে পথভ্রষ্ট করা সহজলভ্য ও ফলপ্রসূ হবে। আর বাস্তব ক্ষেত্রে হয়েছেও তা-ই্। এ থেকে খুব সহজেই অনুমেয় যে, ছবি-প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যের পরিণাম কত ভয়াবহ! কত মারাত্মক এর বিধ্বংসী কার্যক্রম! এটা শুধু আমলকেই শেষ করে না; বরং সকল আমল ও পূণ্যের মূলভিত্তি তাওহিদকে পর্যন্ত বিনষ্ট করে দেয়। আর এজন্যই শরিয়তে ছবি ও ভাস্কর্যের ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
হাদিসে রাসুলের আলোকে ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ ও তার ভয়াবহতা :
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছবি-প্রতিকৃতি বানানো তা রাখার ব্যাপারে ছিলেন খুবই কঠোর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও সময়ে তিনি কর্ম ও বাণী দ্বারা এর ভয়াবহতা বুঝিয়েছেন। কোনো কোনো হাদিসে ছবি-প্রতিকৃতি বানানোর অপরাধে তিনি কিয়ামতের দিন সর্বোচ্চ শাস্তির কথা বর্ণনা করেছেন। তাই এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, ইসলামে ছবি অঙ্কন ও ভাস্কর্য-মূর্তি বানানো সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। ছবির ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনোভাব ও তাঁর কঠোর বাণী কেমন ছিল, তা উপলব্ধি করার জন্য এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে হাদিসে রাসুল হতে কয়েকটি নির্বাচিত হাদিস উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
হাদিস নং ১
عَنْ مُسْلِمٍ، قَالَ: كُنَّا مَعَ مَسْرُوقٍ، فِي دَارِ يَسَارِ بْنِ نُمَيْرٍ، فَرَأَى فِي صُفَّتِهِ تَمَاثِيلَ، فَقَالَ: سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ المُصَوِّرُونَ
‘মুসলিম রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মাসরুক রহ.-এর সাথে ইয়াসার বিন নুমাইর রহ.-এর ঘরে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ তিনি (মাসরুক) তার ঘরের চত্বরে কিছু ছবি-প্রতিকৃতি দেখতে পেয়ে বললেন, আমি ইবনু মাসউদ রা. থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (কিয়ামতের দিন) সবচেয়ে বেশি সাজাপ্রাপ্ত হবে ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণকারীরা।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৬৭, হা. নং ৫৯৫০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ২
عَنْ عَبْدِ اللهِ , عَنْ نَبِيِّ اللهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالَ: ” إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَ نَبِيًّا , أَوْ قَتَلَهُ نَبِيٌّ , وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ , وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ
‘ইবনু মাসউদ রা. সূত্রে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত হবে ওই ব্যক্তি, যে কোনো নবিকে হত্যা করেছে বা কোনো নবি যাকে হত্যা করেছে এবং পথ ভ্রষ্ট ইমাম ও নেতা, যে নিজেও গোমরাহ এবং তাকে অনুসরণ করায় অন্যরাও হয় এবং ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণকারীগণ।’ (শারহু মুশকিলিল আসার : ১/১০, হা. ৬, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
হাদিস নং ৩
عَنْ نَافِعٍ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَخْبَرَهُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، يُقَالُ لَهُمْ: أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ
‘ইবনু উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যারা এ সকল প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ করে, কিয়ামত দিবসে তাদেরকে এ বলে শাস্তি দেওয়া হবে যে, তোমরা যা বানিয়েছ তাতে প্রাণ সঞ্চার করো।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৬৭, হা. নং ৫৯৫১, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, ছবি বানানোর নিষেধাজ্ঞা শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং যে সকল বস্তুর প্রাণ নেই, সে সকল জন্তু বা উদ্ভিদের ছবি আঁকতে অসুবিধা নেই। কারণ, হাদিসে এসেছে, ছবি নির্মাণকারীদের এ বলে শাস্তি দেওয়া হবে যে, তোমরা এতে প্রাণ দান করো। এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, যে সকল বস্তুর প্রাণ নেই, সে সকল জিনিসের ছবি বা ভাস্কর্য বানালে তাতে প্রাণ সঞ্চারের আদেশ দেওয়া বাস্তবতা-বিবর্জিত ও অযৌক্তিক। আর এ ধরনের অযৌক্তিক আদেশ মহান রব বান্দার ওপর চাপিয়ে দেন না; বরং তাঁর এ আদেশ কেবল ওই সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, যারা প্রাণী ও জীবজন্তুর ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ করে। অন্যান্য বিশুদ্ধ বর্ণনায় এর সপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
হাদিস নং ৪
عَنْ أَبِي زُرْعَةَ، قَالَ: دَخَلْتُ مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي دَارِ مَرْوَانَ فَرَأَى فِيهَا تَصَاوِيرَ، فَقَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ خَلْقًا كَخَلْقِي؟ فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً، أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوا شَعِيرَةً
‘আবু জুরআ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হুরাইরা রা.-এর সাথে মারওয়ানের ঘরে প্রবেশ করলাম। তিনি ঘরে কিছু ছবি-প্রতিকৃতি দেখতে পেয়ে বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেন, আর ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালিম কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মতো মাখলুক বানাতে শুরু করে? পারলে সে একটা পিঁপড়া বা একটা শস্যদানা বা একটি যব সৃষ্টি করুক দেখি!’ (সহিহু মুসলিম : ৩/১৬৭১, হা. নং ২১১১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
হাদিস নং ৫
قَتَادَةَ قَالَ: كُنْتُ عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ، وَهُمْ يَسْأَلُونَهُ، وَلاَ يَذْكُرُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى سُئِلَ، فَقَالَ: سَمِعْتُ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ صَوَّرَ صُورَةً فِي الدُّنْيَا كُلِّفَ يَوْمَ القِيَامَةِ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ.
‘কাতাদা রহ. বলেন, আমি ইবনু আব্বাস রা.-এর নিকট বসা ছিলাম; আর লোকেরা তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু তিনি নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম বা উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছিলেন না। এক পর্যায়ে (কোনো একটি বিষয়ে) তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে ছবি-প্রতিকৃতি তৈরি করবে, কিয়ামত দিবসে তাকে এ সকল ছবি প্রতিকৃতিতে প্রান সঞ্চারে বাধ্য করা হবে; কিন্তু তাতে সে জীবন দান করতে সক্ষম হবে না। (সহিহুল বুখারি : ৭/১৬৯, হা. নং ৫৯৬৩, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ৬
عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: ” وَعَدَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جِبْرِيلُ، فَرَاثَ عَلَيْهِ، حَتَّى اشْتَدَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَخَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَقِيَهُ، فَشَكَا إِلَيْهِ مَا وَجَدَ، فَقَالَ لَهُ: إِنَّا لاَ نَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ وَلاَ كَلْبٌ
‘ইবনু উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার জিবরাইল আ. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে (নির্দিষ্ট সময়ে সাক্ষাতের) ওয়াদা করলেন। এরপর তাঁর আসতে দেরি হলে তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জন্য বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াল। এরপর একদিন নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হলে জিবরাইল আ. তাঁর সাথে দেখা করলেন। তখন নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তাঁর আসতে দেরি হওয়ার এবং এতে তাঁর প্রচণ্ড মনক্ষুণ্ণ হওয়ার) অভিযোগ করলে তিনি বললেন, আমরা ওই ঘরে প্রবেশ করি না, যে ঘরে প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি বা কুকুর থাকে।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৬৮-১৬৯, হা. নং ৫৯৬০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ৭
عَنْ عَوْنِ بْنِ أَبِي جُحَيْفَةَ، عَنْ أَبِيهِ: أَنَّهُ اشْتَرَى غُلاَمًا حَجَّامًا، فَقَالَ: إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ ثَمَنِ الدَّمِ، وَثَمَنِ الكَلْبِ، وَكَسْبِ البَغِيِّ، وَلَعَنَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ، وَالوَاشِمَةَ وَالمُسْتَوْشِمَةَ وَالمُصَوِّرَ
‘আবু জুহাইফা রা. সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি একজন হাজ্জাম (শিঙা দিয়ে রক্ত বেরকারী) দাস ক্রয় করলেন। অতঃপর বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ত ও কুকুর বিক্রির মূল্য নিতে এবং ব্যভিচার করে উপার্জন করতে নিষেধ করেছেন। আর সুদখোর, সুদদাতা, উল্কিচিহ্নদাতা, উল্কিচিহ্নগ্রহীতা ও ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণকারীকে লানত দিয়েছেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৬৯, হা. নং ৫৯৬২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ৮
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلاَمٍ، قَالَ: أَخْبَرَنَا عَبْدَةُ، عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ أُمَّ سَلَمَةَ، ذَكَرَتْ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَنِيسَةً رَأَتْهَا بِأَرْضِ الحَبَشَةِ يُقَالُ لَهَا مَارِيَةُ، فَذَكَرَتْ لَهُ مَا رَأَتْ فِيهَا مِنَ الصُّوَرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أُولَئِكَ قَوْمٌ إِذَا مَاتَ فِيهِمُ العَبْدُ الصَّالِحُ، أَوِ الرَّجُلُ الصَّالِحُ، بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، أُولَئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ
‘আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, একবার উম্মে সালামা রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট একটি গির্জার কথা তুললেন, যাকে মারিয়া গির্জা বলা হতো। এতে তিনি যে সকল ছবি-প্রতিকৃতি দেখেছিলেন, তার আলোচনা করতে লাগলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরা তো ওই জাতি, যাদের মধ্যে কোনো নেক ও সৎলোক মারা গেলে তারা তাঁর কবরের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করত এবং তাতে ওই সকল লোকদের ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে স্থাপন করত। এরা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত মাখলুক।’ (সহিহুল বুখারি : ১/৯৪-৯৫, হা. নং ৪৩৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ৯
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الوَهَّابِ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ زُرَيْعٍ، أَخْبَرَنَا عَوْفٌ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي الحَسَنِ، قَالَ: كُنْتُ عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، إِذْ أَتَاهُ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا أَبَا عَبَّاسٍ، إِنِّي إِنْسَانٌ إِنَّمَا مَعِيشَتِي مِنْ صَنْعَةِ يَدِي، وَإِنِّي أَصْنَعُ هَذِهِ التَّصَاوِيرَ، فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: لاَ أُحَدِّثُكَ إِلَّا مَا سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: سَمِعْتُهُ يَقُولُ: «مَنْ صَوَّرَ صُورَةً، فَإِنَّ اللَّهَ مُعَذِّبُهُ حَتَّى يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ فِيهَا أَبَدًا» فَرَبَا الرَّجُلُ رَبْوَةً شَدِيدَةً، وَاصْفَرَّ وَجْهُهُ، فَقَالَ: وَيْحَكَ، إِنْ أَبَيْتَ إِلَّا أَنْ تَصْنَعَ، فَعَلَيْكَ بِهَذَا الشَّجَرِ، كُلِّ شَيْءٍ لَيْسَ فِيهِ رُوحٌ،
‘সাইদ বিন আবুল হাসান রহ. বলেন, আমি ইবনু আব্বাস রা.-এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে এক লোক তাঁর কাছে এসে বলল, হে আবু আব্বাস (এটা ইবনু আব্বাস রা.-এর উপনাম), আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম আমার হস্তশিল্প; আর আমি (এর মাধ্যমে) এ সকল (প্রাণীর) ছবি অঙ্কন করি। তখন ইবনু আব্বাস রা. বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যা বলতে শুনেছি তা-ই তোমার নিকট বর্ণনা করব। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোনো প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি বানাবে, (কিয়ামতের দিন) সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করা পর্যন্ত আল্লাহ তাকে শাস্তি প্রদান করতে থাকবেন; অথচ সে তাতে কখনো প্রাণ দিতে সক্ষম নয়। লোকটি এতে ভয় অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং তার চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করল। তখন ইবনু আব্বাস রা. বললেন, তোমার জন্য আফসোস! তোমার যদি ছবি অঙ্কনের কাজ করতেই হয়, তাহলে এ সকল গাছপালা এবং প্রত্যেক প্রাণহীন জড়বস্তুর ছবি আঁক।’ (সহিহুল বুখারি : ৩/৮২, হা. নং ২২২৫, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাদিস নং ১০
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى، وَأَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَزُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، – قَالَ يَحْيَى: أَخْبَرَنَا، وَقَالَ الْآخَرَانِ: – حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ حَبِيبِ بْنِ أَبِي ثَابِتٍ، عَنْ أَبِي وَائِلٍ، عَنْ أَبِي الْهَيَّاجِ الْأَسَدِيِّ، قَالَ: قَالَ لِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ: أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ «أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ
‘আবুল হাইয়াজ বলেন, একদিন আলি রা. আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এমন একটি কাজে পাঠাব না, যে কাজে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে একবার পাঠিয়ে ছিলেন? তা এই যে, তুমি কোনো ছবি বা প্রতিকৃতি নিশ্চিহ্ন করা ছাড়া এবং কোনো উঁচু কবর সমান্তরাল করা ব্যতিরেকে ছাড়বে না, অর্থাৎ ক্ষান্ত হবে না।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৬৬৬, হা. নং ৯৬৯, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
প্রাণীর সব ধরনের ছবি-প্রতিকৃতি হারাম হওয়া-সংক্রান্ত আরও অনেক বিশুদ্ধ ও প্রমাণযোগ্য মারফু হাদিস রয়েছে, কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে মাত্র দশটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদিস হতে কোনো রকম দ্বিধা-সংশয় ব্যতীত সহজেই প্রমাণিত হয়, যে পন্থাই হোক—হোক তা আধুনিক প্রযুক্তিতে বা হোক তা প্রাচীন পন্থায়—সর্বাবস্থায়ই প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম, রহমতবঞ্চিত ও লানতযোগ্য ঘৃণিত একটি কাজ।
এ পর্যায়ে আমরা এখন দেখব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তিরোধানের সত্য ও কল্যাণের সাক্ষ্যপ্রাপ্ত সোনালী যুগে ছবি-প্রতিকৃতি বানানোর ব্যাপারে সাহাবা ও তাবিয়িদের ফতোয়া-কর্মপন্থা কেমন ছিল। এটা এজন্য যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী ও কর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও মর্ম উদঘাটন তাঁদের ফতোয়া ও কর্মপন্থা থেকেই করা সম্ভব। তাই আমরা এখানে পৃথক একটি শিরোনাম তাঁদের বাণী ও আমল নিয়ে কতিপয় আসার (সাহাবি ও তাবিয়ির আমল বা ফতোয়া) উল্লেখ করছি।
ছবির ব্যাপারে সাহাবা ও তাবিয়িদের কর্মপন্থা ও ফতোয়া :
ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ বা তা ঘরে রাখার ব্যাপারে সাহাবা ও তাবিয়িন হতে অনেক আসার পাওয়া যায়, যা সন্দেহাতীতভাবে একথা প্রমাণ করে যে, তাঁরা প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ ও তা ঘরে রাখাকে কঠিন হারাম মনে করতেন। তন্মধ্য হতে এখানে আমরা কয়েকটি আসার উল্লেখ করছি।
আসার নং ১
وَرَأَى ابْنُ مَسْعُودٍ صُورَةً فِي البَيْتِ فَرَجَعَ
‘ইবনু মাসউদ রা. (একবার) ঘরে ছবি দেখতে পেয়ে (তাতে প্রবেশ না করেই) ফিরে গেলেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/২৫, হা. নং ৫১৮১ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
বুখারির কোনো কোনো নুসখায় এখানে ‘ইবনু মাসউদ রা.’-এর পরিবর্তে ‘আবু মাসউদ রা.’-এর নাম এসেছে। দুটি সম্ভাবনা আছে। এক. হতে পারে, এমন ঘটনা উভয় সাহাবির ক্ষেত্রেই ঘটেছে। যেমনটি বলেছেন শাইখ মুসতাফা আল-বাগা। (আত-তালিক আলা সহিহিল বুখারি : ৭/২৫, হা. নং ৫১৮১ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
দুই. এটা মূলত আবু মাসউদ রা.-এর ঘটনা, কিন্তু কোনো লিপিকার থেকে শব্দের পরিবর্তন ঘটে ‘আবু মাসউদ রা.’-এর পরিবর্তে ‘ইবনু মাসউদ রা.’ হয়ে গেছে। যেমনটি বলেছেন হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানি রহ.। (ফাতহুল বারি : ৯/২৪৯, হা. নং ৫১৮১ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)
আসার নং ২
أَخْبَرَنَا أَبُو عَلِيٍّ الرُّوذْبَارِيُّ، أنبأ أَبُو مُحَمَّدِ بْنُ شَوْذَبٍ الْوَاسِطِيُّ بِهَا، ثنا أَحْمَدُ بْنُ سِنَانٍ، ثنا وَهْبُ بْنُ جَرِيرٍ، ثنا شُعْبَةُ، عَنْ عَدِيِّ بْنِ ثَابِتٍ، عَنْ خَالِدِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ أَنَّ رَجُلًا صَنَعَ لَهُ طَعَامًا فَدَعَاهُ فَقَالَ: أَفِي الْبَيْتِ صُورَةٌ؟ قَالَ: نَعَمْ فَأَبَى أَنْ يَدْخُلَ حَتَّى كَسَرَ الصُّورَةَ ثُمَّ دَخَلَ
‘আবু মাসউদ আনসারি রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, একজন লোক তার জন্য খানা তৈরি করে তাঁকে দাওয়াত দিলেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ঘরে কি কোনো ছবি-প্রতিকৃতি আছে? সে (মেজবান লোকটি) বলল, হ্যাঁ আছে। তখন তিনি ঘরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। একপর্যায়ে ছবি ভাঙা হলে তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন।’ (আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি : ৭/৪৩৮, হা. নং ১৪৫৬৫, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানি রহ. বলেন, এর সনদ সহিহ। (ফাতহুল বারি : ৯/২৪৯, হা. নং ৫১৮১ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)
আসার নং ৩
وَقَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: إِنَّا لاَ نَدْخُلُ كَنَائِسَكُمْ مِنْ أَجْلِ التَّمَاثِيلِ الَّتِي فِيهَا الصُّوَرُ
‘উমর রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, তিনি (শাম দেশে গিয়ে) খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, (যখন তাঁকে তাদের গির্জায় প্রবেশের আহবান করা হয়) আমরা তোমাদের গির্জায় প্রবেশ করব না, এতে ছবি-সংবলিত ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি থাকায়।’ (সহিহুল বুখারি : ১/৯৪, হা. নং ৪৩৪ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত; মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক : ১/৪১১, হা. নং ১৬১০, প্রকাশনী : আল-মাজলিসুল ইলমি, হিন্দ)
আসার নং ৪
عَنْ قَتَادَةَ أَنَّ كَعْبًا قَالَ : وَأَمَّا مَنْ أَذَى اللهََ فَالَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ الصُّوَرَ فَيُقَالُ لَهُمْ : أَحْيُوْا مَا خَلَقْتُمْ.
‘কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত, কাব রহ. বলেন, আর যারা আল্লাহকে কষ্ট দিয়েছে, তারা হলো ওই সকল ব্যক্তি, যারা ছবি-প্রতিকৃতি বানানোর কাজ করে। সুতরাং (কিয়ামত দিবসে) তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যা সৃষ্টি করেছ তাতে প্রাণ সঞ্চার করো।’ (মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক : ১০/৪০০, হা. নং ১৯৪৯২, প্রকাশনী : আল-মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত; আজ-জুহদ, ইবনুল মুবারক : ২/১০১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আসার নং ৫
حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ عُمَرَ، حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، حَدَّثَنِي رَجُلٌ، مِنْ قُرَيْشٍ، عَنْ أَبِيهِ: أَنَّهُ كَانَ مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ، فَرَأَى أَبُو هُرَيْرَةَ، فَرَسًا مِنْ رِقَاعٍ فِي يَدِ جَارِيَةٍ، فَقَالَ: أَلَا تَرَى هَذَا؟ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّمَا يَعْمَلُ هَذَا مَنْ لَا خَلَاقَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةَ
‘আবু হুরাইরা রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত যে, তিনি একজন দাসের হাতে কাপড়ের টুকরা দিয়ে তৈরি একটি ঘোড়া দেখতে পেয়ে বললেন, তুমি কি এটা জানো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এটা (ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণের কাজ) তো একমাত্র সে-ই করতে পারে, কিয়ামত দিবসে যার (সফলতার) কোনো অংশ থাকবে না?’ (মুসনাদু আহমাদ : ১৩/২৬৩, হা. নং ৭৮৮০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
আসার নং ৬
أَخْبَرَنَا أَبُو زَكَرِيَّا بْنُ أَبِي إِسْحَاقَ الْمُزَكِّي، نا أَبُو الْعَبَّاسِ مُحَمَّدُ بْنُ يَعْقُوبَ، نا بَحْرُ بْنُ نَصْرٍ، نا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، عَنْ شُعْبَةَ مَوْلَى ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ الْمِسْوَرَ بْنَ مَخْرَمَةَ دَخَلَ عَلَى عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ يَعُودُهُ فَرَأَى عَلَيْهِ ثَوْبَ إِسْتَبْرَقٍ، فَقَالَ: يَا أَبَا عَبَّاسٍ مَا هَذَا الثَّوْبُ؟ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا: وَمَا هُوَ؟ قَالَ: الْإِسْتَبْرَقُ قَالَ: إِنَّمَا كُرِهَ ذَلِكَ لِمَنْ يَتَكَبَّرُ فِيهِ , قَالَ: مَا هَذِهِ التَّصَاوِيرُ فِي الْكَانُونِ؟ فَقَالَ: لَا جَرَمَ أَلَمْ تَرَ كَيْفَ أُحَرِّقُهَا بِالنَّارِ؟ فَلَمَّا خَرَجَ قَالَ: انْزِعُوا هَذَا الثَّوْبَ عَنِّي وَاقْطَعُوا رُءُوسَ هَذِهِ التَّصَاوِيرَ الَّتِي فِي الْكَانُونِ فَقَطَعَهَا
‘ইবনু আব্বাস রা.-এর আজাদকৃত দাস শুবা রহ. থেকে বর্ণিত যে, মিসওয়ার বিন মাখরামা রহ. ইবনু আব্বাস রা.-কে (তাঁর অসুস্থাবস্থায়) দেখতে গিয়ে তাঁর গায়ে পুরু পশমের বস্ত্র দেখতে পেলেন। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু আব্বাস, এটা কী কাপড়? ইবনু আব্বাস রা. বললেন, সেটা আবার কী? তিনি বললেন, (এই যে) পুরু রেশমের কাপড়। ইবনু আব্বাস রা. বললেন, যে ব্যক্তি তা অহংকারবশত পরিধান করে, শুধু তার জন্যই এটা অপছন্দনীয় এবং নাজায়িজ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, চুলার মধ্যে এসব ছবি-প্রতিকৃতি কেন? (সেখানে চুলার ভেতরাংশের দেয়ালে নকশাকৃত কিছু প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি ছিল।) তখন ইবনু আব্বাস রা. বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই (তা ছবি তবে) তুমি কি লক্ষ করছ না যে, আমি কীভাবে তা আগুনে জ্বালাচ্ছি? (অর্থাৎ ছবি-প্রতিকৃতিকে অপদস্তময় স্থানে রাখা হয়েছে।) এরপর তিনি (মিসওয়ার) যখন বের হয়ে গেলেন, তখন ইবনু আব্বাস রা. বললেন, আমার শরীর থেকে এ (রেশমের) কাপড় খুলে ফেলো এবং চুলার মধ্যে থাকা ছবিগুলোর মাথা কেটে দাও। এরপর তিনি ছবির মাথাগুলো কেটে দিলেন।’(আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি : ৭/৪৭১-৪৭২, হা. নং ১৪৫৮২, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আসার নং ৭
عَنْ قَتَادَةَ قَالَ : يَكْرَهُ مِنَ التَّمَاثِيْلِ مَا فِيْهِ الرُّوْحُ، فَأَمَّا الشَّجَرُ فَلَا بَأْسَ بِهِ.
‘কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কেবল প্রাণবিশিষ্ট জিনিস অর্থাৎ প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতিগুলোই নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। কিন্তু গাছপালার ছবি-প্রতিকৃতি অঙ্কন করতে বা বানাতে (শরিয়তে) কোনো অসুবিধা বা বাধা নেই।’(মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক : ১০/৪০০, হা. নং ১৯৪৯৩, প্রকাশনী : আল-মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত)
আসার নং ৮
أَخْبَرَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ قَالَ: حَدَّثَنَا عِمْرَانُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ قَالَ: حَدَّثَتْنِي غَنِيمَةُ جَارِيَةُ سَعِيدٍ قَالَتْ: كَانَ سَعِيدٌ لا يَأْذَنُ لابْنَتِهِ فِي اللَّعِبِ بِبَنَات الْعَاجِ. وَكَانَ يُرَخِّصُ لَهَا فِي الْكَبَرِ. يَعْنِي الطَّبْلَ.
‘সাইদ বিন মুসাইয়িব রহ.-এর দাসী গানিমা রহ. হতে বর্ণিত যে, সাইদ রহ. তাঁর মেয়েকে খেলনা পুতুল দ্বারা খেলাধুলার অনুমতি দিতেন না। তবে তবলার ব্যাপারে তাঁকে ছাড় দিতেন।’(আত-তাবাকাতুল কুবরা, ইবনু সাদ : ৫/১০২, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আর বেশি উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি না। তবে এসব আসার থেকে এতটুকু পরিষ্কার যে, ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ বা তা রাখার ব্যাপারে সাহাবা ও তাবিয়িনের অবস্থান ও কর্মপন্থা খুবই কঠোর ও দ্ব্যর্থহীন। সুতরাং এখন আর কোনো ধরনের অপব্যাখ্যারও সুযোগ থাকল না।
ছবির ব্যাপারে ফুকাহায়ে উম্মাহর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি :
উপরোল্লিখিত মারফু হাদিস ও আসারের ভিত্তিতে অধিকাংশ উলামা ও ফুকাহা ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ ও তা ঘরে রাখাকে হারাম বলেছেন; চাই তা দেহবিশিষ্ট ও ত্রিমাত্রিক হোক, যার ছায়া আছে অথবা তা অঙ্কিত ও নকশাকৃত হোক, যার কোনো ছায়া নেই। আমরা এ আলোচনায় ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মতামত ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু উল্লেখ করার প্রয়াস পাব।
হানাফি মাজহাব :
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি আল-হানাফি রহ. ‘তাওজিহ’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে বলেন :
قَالَ أَصْحَابنَا وَغَيرهم تَصْوِير صُورَة الْحَيَوَان حرَام أَشد التَّحْرِيم وَهُوَ من الْكَبَائِر وَسَوَاء صنعه لما يمتهن أَو لغيره فَحَرَام بِكُل حَال لِأَن فِيهِ مضاهاة لخلق الله وَسَوَاء كَانَ فِي ثوب أَو بِسَاط أَو دِينَار أَو دِرْهَم أَو فلس أَو إِنَاء أَو حَائِط وَأما مَا لَيْسَ فِيهِ صُورَة حَيَوَان كالشجر وَنَحْوه فَلَيْسَ بِحرَام وَسَوَاء كَانَ فِي هَذَا كُله مَا لَهُ ظلّ وَمَا لَا ظلّ لَهُ وَبِمَعْنَاهُ قَالَ جمَاعَة الْعلمَاء مَالك وَالثَّوْري وَأَبُو حنيفَة وَغَيرهم
‘আমাদের ফুকাহা ও অন্যান্য মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মত হলো, প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি বানানো অত্যন্ত কঠিন হারাম। এটা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত; চাই তা অপদস্ত ও অপমানজনক হয় এমনভাবে বানানো হোক বা সম্মানজনক হয় এমনভাবে বানানো হোক—সর্বাবস্থায়ই তা হারাম। কারণ, এতে আল্লাহর সৃষ্টি করার গুণের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। এ ছবি-প্রতিকৃতি কাপড়ে হোক বা বিছানায়, দিনার-দিরহাম হোক বা পয়সায়, পাত্রে হোক বা দেয়ালে—সবই হারাম। তবে প্রাণী ছাড়া অন্যান্য বস্তু যথা, গাছপালা ইত্যাদির ছবি-প্রতিকৃতি হারাম নয়। আর ছবি-প্রতিকৃতি হারাম হওয়ার ব্যাপারে ছায়াযুক্ত ছবি (অর্থাৎ মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি) এবং ছায়াহীন ছবি (অর্থাৎ কাগজ বা কাপড়ে অঙ্কিত ও ছাপা ছবি) উভয় প্রকারের বিধান বরাবর। (অর্থাৎ উভয়টি হারাম।) ইমাম মালিক রহ., ইমাম সাওরি রহ. ও ইমাম আবু হানিফা রহ.-সহ অন্যান্য ফুকাহা এরূপই বলেছেন।’(উমদাদুল কারি : ২২/৭০, অধ্যায় : কিয়ামত দিবসে ছবি অঙ্কনকারীদের শাস্তি, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
শাফিয়ি মাজহাব :
ইমাম নববি আশ-শাফিয়ি রহ. বলেন :
قَالَ أَصْحَابُنَا وَغَيْرُهُمْ مِنَ الْعُلَمَاءِ تَصْوِيرُ صُورَةِ الْحَيَوَانِ حَرَامٌ شَدِيدُ التَّحْرِيمِ وَهُوَ مِنَ الْكَبَائِرِ لِأَنَّهُ مُتَوَعَّدٌ عَلَيْهِ بِهَذَا الْوَعِيدِ الشَّدِيدِ الْمَذْكُورِ فِي الْأَحَادِيثِ وَسَوَاءٌ صَنَعَهُ بِمَا يُمْتَهَنُ أَوْ بِغَيْرِهِ فَصَنْعَتُهُ حَرَامٌ بِكُلِّ حَالٍ لِأَنَّ فِيهِ مُضَاهَاةً لِخَلْقِ اللَّهِ تَعَالَى وَسَوَاءٌ مَا كَانَ فى ثوب أو بساط أودرهم أَوْ دِينَارٍ أَوْ فَلْسٍ أَوْ إِنَاءٍ أَوْ حَائِطٍ أَوْ غَيْرِهَا وَأَمَّا تَصْوِيرُ صُورَةِ الشَّجَرِ وَرِحَالِ الْإِبِلِ وَغَيْرِ ذَلِكَ مِمَّا لَيْسَ فِيهِ صُورَةُ حَيَوَانٍ فَلَيْسَ بِحِرَامٍ هَذَا حُكْمُ نَفْسِ التَّصْوِيرِ وَأَمَّا اتِّخَاذُ الْمُصَوَّرِ فِيهِ صُورَةَ حَيَوَانٍ فَإِنْ كَانَ مُعَلَّقًا عَلَى حَائِطٍ أَوْ ثَوْبًا ملبوسا أو عمامة ونحوذلك مما لايعد مُمْتَهَنًا فَهُوَ حَرَامٌ وَإِنْ كَانَ فِي بِسَاطٍ يُدَاسُ وَمِخَدَّةٍ وَوِسَادَةٍ وَنَحْوِهَا مِمَّا يُمْتَهَنُ فَلَيْسَ بِحِرَامٍ وَلَكِنْ هَلْ يَمْنَعُ دُخُولَ مَلَائِكَةِ الرَّحْمَةِ ذَلِكَ الْبَيْتَ فِيهِ كَلَامٌ نَذْكُرُهُ قَرِيبًا إِنْ شاء الله ولافرق فى هذا كله بين ماله ظل ومالاظل لَهُ هَذَا تَلْخِيصُ مَذْهَبِنَا فِي الْمَسْأَلَةِ وَبِمَعْنَاهُ قَالَ جَمَاهِيرِ الْعُلَمَاءِ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ وَهُوَ مَذْهَبُ الثَّوْرِيِّ وَمَالِكٍ وَأَبِي حَنِيفَةَ وَغَيْرِهِمْ
‘আমাদের ফুকাহা ও অন্যান্য মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মত হলো, প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি বানানো অত্যন্ত কঠিন হারাম। এটা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, হাদিসসমূহে এ ব্যাপারে এমনই কঠোর ধমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। চাই তা অপদস্ত ও অপমানজনক হয় এমনভাবে বানানো হোক বা সম্মানজনক হয় এমনভাবে বানানো হোক—সর্বাবস্থায়ই তা হারাম। কারণ, এতে আল্লাহর সৃষ্টি করার গুণের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। অনুরূপ চাই এ ছবি-প্রতিকৃতি কাপড়ে আঁকা হোক বা বিছানায় বা দিনার-দিরহামে বা পয়সায় বা পাত্রে বা দেয়ালে বা অন্য কোথাও—সবই হারাম। তবে প্রাণী ছাড়া অন্যান্য বস্তু যথা- গাছপালা, উটের জিনপোশ ইত্যাদির ছবি-প্রতিকৃতি হারাম নয়। এটা হলো ছবি-প্রতিকৃতি অঙ্কনের বিধান। আর ছবিযুক্ত কোনো কিছু রাখা এবং তা ব্যবহার করার বিধান হলো, যদি তা দেয়ালে লটকানো থাকে বা পরিধেয় পোশাক কিংবা পাগড়ি অথবা এ জাতীয় এমন স্থানে থাকে, যা অসম্মানজনক হিসেবে গণ্য হয় না তাহলে তা হারাম হবে। আর যদি তা পা দিয়ে মাঁড়ানো হয় এমন স্থানে থাকে বা বালিশ, গদি ইত্যাদিতে থাকে, যাতে থাকলে সাধারণত ছবি-প্রতিকৃতির অসম্মান হয় তাহলে তা হারাম হবে না। তবে এটা (হারাম না হলেও তা) ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে কি না—এতে মতভেদ রয়েছে, যার আলোচনা কিছুক্ষণ পরে করব ইনশাআল্লাহ। আর এগুলোর মধ্যে এতে কোনো পার্থক্য নেই যে, তা ছায়াযুক্ত প্রতিকৃতি হোক কিংবা ছায়াহীন ছবি। ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে এটাই আমাদের (শাফিয়িদের) মাজহাবের সারকথা। অধিকাংশ সাহাবা, তাবিয়িন ও তৎপরবর্তীগণ এমনই বলেছেন। আর এটাই সুফইয়ান সাওরি রহ., মালিক রহ. ও ইমাম আবু হানিফার মত।’(শারহু মুসলিম, নববি : ১৪/৮১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
হাম্বলি মাজহাব :
আল্লামা মুরাদি আল-হাম্বলি রহ. বলেন :
يَحْرُمُ تَصْوِيرُ مَا فِيهِ رُوحٌ. وَلَا يَحْرُمُ تَصْوِيرُ الشَّجَرِ وَنَحْوِهِ. وَالتِّمْثَالِ مِمَّا لَا يُشَابِهُ مَا فِيهِ رُوحٌ، عَلَى الصَّحِيحِ مِنْ الْمَذْهَبِ.
‘প্রাণবিশিষ্ট বস্তুর ছবি-প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম। আর গাছগাছালি ও এ জাতীয় অন্যান্য বস্তু এবং প্রাণীর সাদৃশ্য হয় না, এমন বস্তুর ছবি-প্রতিকৃতি বানানো হারাম নয় (আমাদের হাম্বলি) মাজহাবের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী। …প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি সংবলিত কোনো কিছু (দেয়াল ইত্যাদিতে) লটকানো, তদ্দ্বারা দেয়ালের পর্দা বানানো ও তা আঁকা (সবকিছুই আমাদের হাম্বলি) মাজহাবের বিশুদ্ধতম মতানুযায়ী হারাম।’ (আল-ইনসাফ ফি মারিফাতির রাজিহি মিনাল খিলাফ : ১/৪৭৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
আল্লামা ইবনু কুদামা আল-হাম্বলি রহ. ‘আল-মুগনি’-তে প্রায় অনুরূপ কথাই উল্লেখ করেছেন। (আল-মুগনি : ৯/৫৬৯-৫৭০, অলিমা অধ্যায়, প্রকাশনী : দারুল হাদিস, কায়রো)
শাইখ তাকি উসমানি হাফি. আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ.-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করে বলেন :
وَبِهِ يَتَبَيَّنُ مَذْهَبُ الشَّافِعِيَّةِ وَالْحَنَفِيَّةِ وَهُوَ مَذْهَبُ الْحَنَابِلَةِ أَيْضًا.
‘এতে শাফিয়ি ও হানাফিদের মাজহাব স্পষ্ট হয়ে যায় (যে, সব ধরনের ছবি-প্রতিকৃতিই হারাম) আর এটা হাম্বলিদের মাজহাবও বটে।’(তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪/৯৪, প্রকাশনী : দারুল উলুম করাচি, পাকিস্তান)
পূর্বোক্ত আলোচনা হতে বুঝা গেল, হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী সব ধরনের প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি (বানানো ও রাখা) হারাম; চাই তা ত্রিমাত্রিক মূর্তি ও ভাস্কর্য হোক, যার ছায়া আছে অথবা কোনো স্থানে হাতে বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে অঙ্কিত হোক, যার কোনো ছায়া নেই।
মালিকি মাজহাব :
এ ব্যাপারে ইমাম মালিক রহ.-এর বর্ণনায় ইখতিলাফ রয়েছে। যার কারণে মালিকি মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরাম এ মাসআলায় কিছুটা মতানৈক্য করেছেন। তবে এ বিষয়ে তাঁদের কোনো মতভেদ নেই যে, ছায়াযুক্ত ত্রিমাত্রিক ছবি-প্রতিকিৃতি তথা মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি বানানো হারাম। তাদের মতানৈক্য কেবল ওই সকল ছবির ব্যাপারে, যা কাপড়, কাগজ বা দেয়াল ইত্যাকার স্থানে আঁকা হয়।
আল্লামা উবাই আল-মালিকি রহ. ‘শারহু মুসলিম’-এ বলেন :
وَاخْتُلِفَ فِيْ تَصْوِيْرِ مَا لَا ظِلَّ لَهُ، فَكَرِهَهُ ابْنُ شِهَابٍ فِيْ أَيِّ شَيْئٍ صُوِّرَ مِنْ حَائِطٍ أَوْ ثَوْبٍ أَوْ غَيْرِهِمَا، وَأَجَازَ ابْنُ الْقَاسِمِ تَصْوِيْرَهُ فِي الثِّيَابِ لِقَوْلِهِ فِي الْحَدِيْثِ الْأَتِيْ “إِلَّا رَقْمًا فِيْ ثَوْبٍ”.
‘ছায়াহীন (অঙ্কিত) ছবি-প্রতিকৃতি তৈরির ব্যাপারে (আমাদের মাজহাবে) ইখতিলাফ আছে। ইবনু শিহাব রহ. তা মাকরুহ মনে করেন, যার ওপরই আঁকা হোক না কেন; চাই তা দেয়াল হোক বা কাপড় কিংবা অন্য কিছু। আর ইবনু কাসিম রহ. কাপড়ে আঁকার অনুমতি দিয়েছেন। যেহেতু হাদিসে إِلَّا رَقْمًا فِيْ ثَوْبٍ বলে তা নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।’(ইকমালু ইকমালিল মুআল্লিম : ৫/৩৯৪, ছবি বানানো ও তা রাখা-সংক্রান্ত অধ্যায়, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
এভাবে আল্লামা মাওয়াক আল-মালিকি রহ. ইবনু আরাফা রগ.-এর উদ্ধৃতিতে বলেন :
إنْ أَرَادَ الصُّوَرَ الْمُجَسَّدَةَ فَصَوَابٌ وَإِلَّا فَلَا أَعْرِفُهُ عَنْ الْمَذْهَبِ
‘ছবি-প্রতিকৃতি (এর নিষেধাজ্ঞা) বলতে যদি ত্রিমাত্রিক শরীরি প্রতিকৃতি বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে ঠিক আছে। নতুবা (এ ভিন্ন অন্যান্য অঙ্কিত ছবি-প্রতিকৃতি উদ্দেশ্য হলে) তা মালিকি মাজহাব অনু্যায়ী (হবে কি না) আমি জানি না।’(আত-তাজ ওয়াল-ইকলিল লি-মুখতাসারি খলিল : ৫/২৪৪, অলিমা অধ্যায়, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আল্লামা দারদির আল-মালিকি রহ. বলেন :
وَالْحَاصِلُ أَنَّ تَصَاوِيرَ الْحَيَوَانَاتِ تَحْرُمُ إجْمَاعًا إنْ كَانَتْ كَامِلَةً لَهَا ظِلٌّ مِمَّا يَطُولُ اسْتِمْرَارُهُ، بِخِلَافِ نَاقِصِ عُضْوٍ لَا يَعِيشُ بِهِ لَوْ كَانَ حَيَوَانًا، وَبِخِلَافِ مَا لَا ظِلَّ لَهُ كَنَقْشٍ فِي وَرَقٍ أَوْ جِدَارٍ. وَفِيمَا لَا يَطُولُ اسْتِمْرَارُهُ خِلَافٌ، وَالصَّحِيحُ حُرْمَتُهُ
‘সারকথা হলো, প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি সবার ঐকমত্যে হারাম, যদি তা পরিপূর্ণ ও ছায়াযুক্ত ও দীর্ঘস্থায়িত্বসম্পন্ন হয়। তবে এমন অঙ্গবিহীন অসম্পূর্ণ প্রতিকৃতি, যা না থাকলে প্রাণী হলে বাঁচতে পারে না (যেমন, মাথাবিহীন ছবি), এবং যে সকল ছবির ছায়া নেই, যথা কাগজ বা দেয়ালে নকশাকৃত ছবি—এ দুপ্রকারের ছবিই জায়িজ। আর যে সকল ছায়াযুক্ত ত্রিমাত্রিক ছবি-প্রতিকৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, (যথা- তরমুজের খোলস জাতীয় কিছু দিয়ে বানানো ভাস্কর্য) তাতে বৈধ হওয়া, না হওয়ার ব্যাপারে ইখতিলাফ আছে। তবে বিশুদ্ধতম মতে, এটা বানানোও হারাম।’(হাশিয়াতুস সাবি আলাশ শারহিস সগির : ২/৫০১, অলিমা অধ্যায়, দারুল মাআরিফ, বৈরুত)
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ খারাশি আল-মালিকি রহ. ‘তাওজিহ’-এর উদ্ধৃতিতে বলেন :
التِّمْثَالُ إذَا كَانَ لِغَيْرِ حَيَوَانٍ كَالشَّجَرِ جَائِزٌ وَإِنْ كَانَ لِحَيَوَانٍ فَمَا لَهُ ظِلٌّ وَيُقِيمُ فَهُوَ حَرَامٌ بِإِجْمَاعٍ، وَكَذَا يَحْرُمُ إنْ لَمْ يُقِمْ كَالْعَجِينِ خِلَافًا لِأَصْبَغَ لِمَا ثَبَتَ أَنَّ «الْمُصَوِّرِينَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا كُنْتُمْ تُصَوِّرُونَ» وَمَا لَا ظِلَّ لَهُ إنْ كَانَ غَيْرَ مُمْتَهَنٍ فَهُوَ مَكْرُوهٌ وَإِنْ كَانَ مُمْتَهَنًا فَتَرْكُهُ أَوْلَى
‘ছবি-প্রতিকৃতি যদি প্রাণহীন বস্তু যথা, গাছ ইত্যাদির হয় তাহলে তা বৈধ। আর যদি তা প্রাণীর হয় তাহলে তা ছায়াযুক্ত ও স্থায়িত্বসম্পন্ন হলে সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। তদ্রুপ তা (ছায়াযুক্ত হয়ে) স্থায়িত্বসম্পন্ন না হলেও আসবাগ রহ. ব্যতীত অন্য সকলের নিকট হারাম। যেমন, আটার তৈরি মূর্তি। কেননা, (বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা) এটা সুসাব্যস্ত যে, “কিয়ামতের দিন ছবি-প্রতিকৃতি অঙ্কনকারীদের শাস্তি দেওয়া হবে আর তাদের বলা হবে, তোমরা যা অঙ্কন করেছিলে, তাতে প্রাণ দান করো।” আর তা ছায়াবিহীন হয়ে সম্মানজনক অবস্থায় থাকলে তা হবে মাকরুহ, আর অসম্মানজনক অবস্থায় থাকলে তা পরিত্যাগ করাই উত্তম ।’(শারহু মুখতাসারি খলিল : ১১/৪৭১-৪৭২, বিবাহের ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ঝগড়ার বিধান-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
এ সকল বর্ণনা হতে বুঝা যায়, মালিকি মাজহাবের ছায়াযুক্ত ত্রিমাত্রিক প্রতিকৃতি অর্থাৎ ভাস্কর্য, মূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। অবশ্য তা যদি ক্ষণস্থায়ী জাতীয় কোনো ভাস্কর্য হয়, যথা- আটা বা তরমুজের খোলস ইত্যাদি দ্বারা তৈরি প্রতিকৃতি, তাহলে তা দু’একজন বৈধ বললেও অধিকাংশের মতে তাও হারাম। আর ছায়াহীন অঙ্কিত বা নকশাকৃত ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে তাদের মাঝে বড় ইখতিলাফ রয়েছে। তাদের কিতাবগুলো ভালোভাবে অধ্যায়ন করলে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী এ সকল ছবি-প্রতিকৃতি সম্মানজনকভাবে, যেমন মেঝের কার্পেট, বিছানার চাদরে, জুতার নিচে, পেপার-পত্রিকায় ইত্যাদি পদদলিত ও অসম্মানজনক স্থানে থাকলে তা বৈধ হবে; যদিও তা না রাখাই উত্তম।
পূর্বের বিস্তারিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, ছায়াযুক্ত ত্রিমাত্রিক ছবি-প্রতিকৃতি তথা ভাস্কর্য বানানো ও তা সংরক্ষণ করা সর্বসম্মতভাবে চার মাজহাবেই হারাম ও নিষিদ্ধ। আর ছায়াহীন অঙ্কিত বা নকশাকৃত ছবি-প্রতিকৃতি সম্মানজনক অবস্থায় থাকলে, তাও হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী বানানো ও সংরক্ষণ করা হারাম। আর মালিকি মাজহাবের বিশুদ্ধতম মতানুযায়ী তা মাকরুহ। আর অসম্মানজনক অবস্থায় থাকলে তা হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাববের বিশুদ্ধতম মতানুযায়ী বানানো হারাম হলেও সংরক্ষণ করা হারাম হবে না। আর মালিকি মাজহাব অনুযায়ী তা বৈধ হলেও অনুত্তম। আর এ ব্যাপারে হাম্বলি মাজহাব হতে পরিস্কার কোনো বর্ণনা বা বক্তব্য পাওয়া যায় না। বিধায় (তাদের ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে অনমনীয়তা থেকে) বুঝা যায়, এ ধরনের অসম্মানজন ছবি-প্রতিকৃতিও সম্মানজনক ছবি-প্রতিকৃতির ন্যায় বানানো ও সংরক্ষণ করা হারাম হবে। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ১২/১০২, ১১১, মাদ্দা : تصوير, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)
কারণ, এ দু’প্রকারের বিধান ভিন্ন হলে অবশ্যই তা তাদের কিতাবসমূহে উল্লেখ থাকত। (আল্লাহু আ’লাম)
একটি ভ্রান্ত মত ও তার খণ্ডন :
আমাদের বর্তমান যুগে আধুনিকপন্থি একটি ক্ষুদ্র গবেষক দলের দাবি হলো, ছবি-প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নিষেধাজ্ঞার বিধানটি ইসলামের প্রথম যুগে ছিল। কারণ, তখন লোকেরা নতুন মুসলমান হওয়ায় মূর্খতাযুগের অন্ধকার ও মূর্তিপূজার প্রভাব পুরোপুরি দূর হয়নি এবং ইসলামের তাওহিদ ও একত্ববাদের শিক্ষা তাদের অন্তরে গেঁথে যায়নি, বিধায় তাদেরকে মূর্তিপূজা ও তা ঘরে বা নিজের সাথে রাখা নিষেধের পাশাপাশি প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি আঁকা ও তা রাখার ব্যাপারেও কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এরপর যখন মুসলমানদের অন্তরে তাওহিদ ও ইসলামের অমিয় বাণী ও শিক্ষা দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেল এবং মূর্তিপূজার প্রতি আগ্রহ ও ভক্তি শেষ হয়ে উল্টো সেখানে পরিপূর্ণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো, তখন ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে পূর্বের নিষেধাজ্ঞাও উঠে গেল।
এ ধরনের মনচাহি ও কুরআন-সুন্নাহর বহির্ভূত চিন্তাধারায় এরাই প্রথম নয়; বরং আজ থেকে প্রায় সাতশ বছর পূর্বেও এমন একটি দলের অস্তিত্ব ছিল। এদের বর্ণনা পাওয়া যায় আল্লামা ইবনু দাকিক আল-ইদ রহ.-এর বক্তব্যে। তিনি বলেন :
وَلَقَدْ أَبْعَدَ غَايَةَ الْبُعْدِ مَنْ قَالَ: إنَّ ذَلِكَ مَحْمُولٌ عَلَى الْكَرَاهَةِ، وَإِنَّ هَذَا التَّشْدِيدَ كَانَ فِي ذَلِكَ الزَّمَانِ، لِقُرْبِ عَهْدِ النَّاسِ بِعِبَادَةِ الْأَوْثَانِ. وَهَذَا الزَّمَانُ حَيْثُ انْتَشَرَ الْإِسْلَامُ وَتَمَهَّدَتْ قَوَاعِدُهُ – لَا يُسَاوِيهِ فِي هَذَا الْمَعْنَى. فَلَا يُسَاوِيهِ فِي هَذَا التَّشْدِيدِ – هَذَا أَوْ مَعْنَاهُ – وَهَذَا الْقَوْلُ عِنْدَنَا بَاطِلٌ قَطْعًا. لِأَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي الْأَحَادِيثِ: الْإِخْبَارُ عَنْ أَمْرِ الْآخِرَةِ بِعَذَابِ الْمُصَوِّرِينَ. وَأَنَّهُمْ يُقَالُ لَهُمْ ” أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ ” وَهَذِهِ عِلَّةٌ مُخَالِفَةٌ لِمَا قَالَهُ هَذَا الْقَائِلُ وَقَدْ صُرِّحَ بِذَلِكَ فِي قَوْلِهِ – عَلَيْهِ السَّلَامُ – «الْمُشَبِّهُونَ بِخَلْقِ اللَّهِ» وَهَذِهِ عِلَّةٌ عَامَّةٌ مُسْتَقِلَّةٌ مُنَاسِبَةٌ. لَا تَخُصُّ زَمَانًا دُونَ زَمَانٍ. وَلَيْسَ لَنَا أَنْ نَتَصَرَّفَ فِي النُّصُوصِ الْمُتَظَاهِرَةِ الْمُتَضَافِرَةِ بِمَعْنًى خَيَالِيٍّ.
‘কত বড় ভুলের মধ্যে আছে ওই সকল লোক, যারা এ কথা বলে যে, ছবি-প্রতিকৃতি নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি অনুত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মূর্তিপূজা ছেড়ে দেওয়ার সময় নিকট অতীত হওয়ায় ছবির ব্যাপারে কঠোরতা ছিল। আর এ যুগ, যখন ইসলাম প্রচার-প্রসার লাভ করেছে এবং নীতিমালা ও বিধান মানা (জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ায়) সহজ হয়ে পড়েছে তখন কঠোরতার বিষয়ে এ যুগ সে (ইসলামের প্রাথমিক) যুগের বরাবর হতে পারে না। (আল্লামা দাকিক আল-ইদ রহ. বলেন,) এ উক্তিটি আমাদের নিকট নিশ্চিতই ভ্রান্ত ও বাতিল। কেননা, হাদিস ও আসারসমূহে ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণকারীদের কিয়ামত দিবসে শাস্তি দেওয়ার কথা এসেছে। (শাস্তি দেওয়ার সময়) তাদেরকে বলা হবে, “তোমরা যা সৃষ্টি করেছ, তাতে প্রাণ সঞ্চার করো।” আর এটা এমন একটি ইল্লত বা কার্যকারণ, যা এ প্রবক্তার কথিত কার্যকারণের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী الْمُشَبِّهُونَ بِخَلْقِ اللَّهِ (আল্লাহর সৃষ্টি করার গুণের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনকারী)-তে এ (ইল্লতের) ব্যাপারে স্পষ্টাকারেই বলা হয়েছে। আর এটা (অর্থাৎ تَشْبِيْهٌ بِخَلْقِ اللهِ) উপযোগী, স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাপক একটি ইল্লত এবং তা কোনো যুগের সাথে বিশেষায়িত নয়। আর আমাদের এ অধিকার নেই যে, কেবল অলীক ও কল্পনাপ্রসূত যুক্তি দর্শিয়ে ছবি নিষেধের সুস্পষ্ট সকল নসসমূহে (অপব্যাখ্যা করে) অযাচিত হস্তক্ষেপ করব। (ইহকামুল আহকাম শারহু উমদাতিল আহকাম : ১/৩৭১-৩৭২, হা নং ১৬৬-সংশ্লিষ্ট আলোচনা, প্রকাশনী : মাতবাআতুস সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যা)
আল্লামা আহমাদ শাকির রহ. মুসনাদু আহমাদ-এর তালিকে ইবনু দাকিক রহ.-এর উপরিউক্ত বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন :
هذا ما قاله ابن دقيق العيد، منذ أكثرُ من 670 سنة، يرد على قوم تلاعبوا بهذه النصوص، في عصره أو قبل عصره. ثم يأتي هؤلاء المفتون المضللون، وأتباعهم المقلدون الجاهلون، أو الملحدون الهدموان، يعيدونها جذعة، ويلعبون بنصوص الأحاديث، كما لعب أولئك من قبل!!. ثم كان من أثر هذه الفتاوى الجاهلة، أن ملئت بلادنا بمظاهر الوثنية كاملة، فنصبت التماثيل وملئت بها البلاد، تكريمًا لذكرى من نسبت إليه وتعظيمًا!، ثم يقولون لنا إنها لم يقصد بها التعظيم!. ثم ازدادوا كفراً ووثنية، فصنعوا الأنصاب ورفعوها، تكريمًا لمن صنعت لذكراهم. وليست الأنصاب مما يدخل في التصوير، حتى يصلح لهم تأويلهم!، إنما هي وثنية كاملة صرف، نهى الله عنها في كتابه، بالنص الصريح الذي لا يحتمل التأويل.
وكان من أثر هذه الفتاوى الجاهلة أن صنعت الدولة، وهي تزعم أنها دولة إسلامية، في أمة إسلامية-: ما سمته “مدرسة الفنون الجميلة” أو “كلية الفنون الجميلة”!!، صنعت معهدًا للفجور الكامل الواضح!، ويكفي للدلالة على ذلك أن يدخله الشبان الماجنون، من الذكور والإناث، إباحيين مختلطين، لا يرد عهم دين ولا عفاف ولا غيرة، يصورون فيه الفواجر من الغانيات، اللائي لا يستحين أن يقفن عرايا، ويجلسن عرايا، ويضجعن عرايا، على كل وضع من الأوضاع الفاجرة، يظهرن مفاتن الجسد، وخفايا الأنوثة، لا يسترن شيئا، ولا يمنعن شيئاً!!، ثم يقولون لنا: هذا فن!!، لعنهم الله، ولعن من رضي هذا منهم أو سكت عليه. وإنا له وإنا إليه راجعون.
‘ইবনু দাকিক রহ. যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা (আজ হতে) ৬৭০ বছরেরও বেশি পূর্বের (ঘটনা)। তিনি ওই দলের দাবি খণ্ডন করেছেন, যারা তাঁর সময়ে বা তাঁর পূর্ব যুগে (ছবি-প্রতিকৃতিসংক্রান্ত) এ সকল নসসমূহকে খেলনার বস্তুতে রূপান্তরিত করেছিল। এরপর এ সকল (বর্তমান যুগের) পথভ্রষ্টকারী মুফতিগণ ও তাদের অন্ধভক্ত অজ্ঞ অনুসারীগণ বা (ইসলাম) ধ্বংসকারী অবিশ্বাসী নাস্তিকগণ এসে সে ফতোয়ার অবশিষ্টাংশের পুনরাবৃত্তি করছে এবং হাদিসের বাণীসমূহ নিয়ে খেলা করছে, যেমন খেলেছিল পূর্বের ওই সকল লোক। অতঃপর এ অজ্ঞতাপূর্ণ ফতোয়ার ফলাফল এ দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের দেশ মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার দৃশ্যে পুরোপুরি ভরে গেছে। এরপর (বিভিন্ন স্থানে) মূর্তি ও ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে এবং সারাদেশ তা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে ওই সকল (মহান) লোকের স্মৃতিচারণের মর্যাদা ও সম্মানার্থে, যাদের দিকে এসব ভাস্কর্য সম্বন্ধিত। অতঃপর তারা আবার আমাদের বলে বেড়ায় যে, এদ্বারা সম্মান প্রদর্শন উদ্দেশ্য নয়। এরপর তাদের কুফরি ও মূর্তিপুজা আরও বৃদ্ধি পেল এবং (স্থানে স্থানে) অনেক ভাস্কর্য প্রতিস্থাপিত করল। উদ্দেশ্য তাদের স্মরণে সম্মান প্রদর্শন করা। এসব ভাস্কর্য (মতভেদপূর্ণ) ছবির অন্তর্ভুক্ত নয় যে, এখানে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা চলতে পারে। বরং এগুলো তো পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্ট মূর্তি, যা নির্মাণের ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যেখানে কোনোরূপ ব্যাখ্যা প্রযোজ্য নয়। আর এ মূর্খতায় ভরা ফতোয়ার বিষফলে এটাও হয়েছে যে, নামসর্বস্ব ইসলামি রাষ্ট্রগুলো মুসলিম জাতির মাঝে চারুকলা বিদ্যালয় (Fine arts school) চারুকলা কলেজ (Fine arts College) ইত্যাদি নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। (এর দ্বারা) রাষ্ট্র (মূলত) সম্পূর্ণ প্রকাশ্য পাপাচার ও লাম্পট্যের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। এটা প্রমাণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এসব প্রতিষ্ঠানে বেহায়া ও নির্লজ্জ ধরনের যুবক-যুবতীরা ভর্তি হয়। ফলে তারা হয়ে ওঠে নৈরাজ্যবাদী ও বিশৃঙ্খল। তাদেরকে (খারাপ কাজ হতে) না দ্বীন, না সংযম, না আত্মমর্যাদাবোধ কোনো কিছুই নিবৃত্ত করতে পারে না। এসব প্রতিষ্ঠানে এরা পতিতা ও চরিত্রহীনা (নর্তকী ও) গায়িকাদের ছবি-প্রতিকৃতি অঙ্কন করে, যারা উঠতে-বসতে ও শয়নে-স্বপনে কোনো অবস্থাতেই বেহায়াপনা ও উলঙ্গ হতে লজ্জা বা দ্বিধাবোধ করে না। এরা প্রত্যেক অশ্লীল ও খারাপ স্থানে ও পরিস্থিতিতে দেহের আকর্ষণীয় অঙ্গগুলো ও নারীদের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ করে। কিছুই গোপন করে না এবং কোনো কিছুই হিফাজত করে না। এরপর আবার এরা আমাদের বলে, এটা একটা শিল্প ও বিদ্যা! আল্লাহ অভিশাপ দিক এবং অভিসম্পাত করুক ওই লোকদের প্রতি, যারা এদের এ সকল কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বা নীরব থাকে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।(আত-তা’লিক আলা মুসনাদি আহমাদ : ৭/১৯-২০, হা. নং ৭১৬৬ সংশ্লিষ্ট আলোচনা, প্রকাশনী : দারুল হাদিস, কায়রো)
কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যাকারীদের আলোচনার সারকথা হলো, ছবি-প্রতিকৃতি নিষেধ করা ইসলামের মৌলিক ও স্থায়ী কোনো বিধান নয়; বরং তা ছিল মূর্তিপূজার প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার জন্য সাময়িক নিষেধাজ্ঞা মাত্র। ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও মূর্তিপূজার প্রতি মুসলিমদের ব্যাপক ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়ার পর এ সাময়িক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। তাই বর্তমান সময়ে ছবি-প্রতিকৃতির ব্যাপারে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ছবি-প্রতিকৃতির নিষেধাজ্ঞা-সংবলিত হাদিসগুলো কার্যকর বলে বিবেচিত হবে না; বরং তা রহিত হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
আমরা বলব, তাদের এ ধরনের উক্তি ও যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কুরআন-সুন্নাহয় এর কোনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদি ছবি-প্রতিকৃতি নিষেধের বিধান রহিতই হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিস্কারভাবে বলে দিতেন বা স্বীয় কাজ-কর্মে তা বুঝিয়ে দিতেন। কমপক্ষে সাহাবা ও তাবিয়িদের ফতোয়া বা আমলে অবশ্যই তা বুঝা যেত। অথচ পূর্বে বর্ণিত সাহাবা ও তাবিয়িদের আসারসমূহে এবং আরও অন্যান্য রিওয়ায়াতে আমরা দেখতে পাই, যেসব বাড়িতে ছবি-প্রতিকৃতি থাকত সাহায়ে কিরাম রা. সেসব বাড়িতে প্রবেশ করতেন না এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছবিশিল্পের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মানুষকে সতর্ক করেছেন। তাবিয়িদের হতেও এ ধরনের ফতোয়া ও আমল পাওয়া যায়। এটি একটি সুস্পষ্ট দলিল যে, ছবি-প্রতিকৃতি নিষেধের বিধান রহিত হয়নি। কারণ, রহিত হলে তাঁরা তৎসম্পর্কে আমাদের চাইতে ভালো জানতেন। তদুপরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছবি নিষেধাজ্ঞার কারণ নিজেই হাদিসে تَشْبِيْهًا بِخَلْقِ اللهِ ‘আল্লাহর সৃষ্টি করার গুণের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন’ বলে বর্ণনা দিয়েছেন। আর এটা এমন ব্যাপক একটি ইল্লত বা কার্যকারণ, যা শুধু ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাথে বিশেষায়িত নয়; বরং তা সর্বক্ষেত্রে সর্বযুগেই বিদ্যমান। কারণ, এটা হতে পারে না যে, একটা যুগে ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ করলে তা আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যতার মতো ধৃষ্টতার শামিল হবে, আর অন্য যুগে করলে তা হবে না। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, তাদের এ ধরনের মত ও ব্যাখ্যা ভ্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আধুনিক চিন্তাধারায় বেড়ে ওটা আরেকটি দল আবার যুক্তি-জগৎ থেকে একটু অগ্রসর হয়ে কুরআন দ্বারা ছবি-প্রতিকৃতি বৈধকরণের বৃথাই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের দলিল হলো, কুরআনের এ আয়াত :
يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِنْ مَحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَاسِيَاتٍ
‘তারা (জিনেরা) সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী দূর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির ওপর স্থাপিত বিশাল ডেগ তৈরি করত।’(সুরা আস-সাবা : ১৩)
এ আয়াত হতে তারা ছবি-প্রতিকৃতি বৈধকরণের প্রমাণ এভাবে পেশ করে থাকে যে, আয়াতে বলা হয়েছে, সুলাইমান আ.-এর ইচ্ছায় জিনজাতি ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে দিত। আর এ বর্ণনাটি আল্লাহ তাআলা সুলাইমান আ.-এর প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ ও নিয়ামত দানের আলোচনায় এসেছেন। এতে বুঝা যায়, ছবি-প্রতিকৃতি বানানো নিষিদ্ধ কোনো কাজ নয়। নতুবা নবির ইচ্ছানুসারে তাঁর জন্য জিনদের ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে দেওয়া তাঁর প্রতি মহান রবের কোনো অনুগ্রহ বলে বিবেচিত হতো না। আর এটা অবৈধ হলে কোনো নবি কখনো তা করতে আদেশ দিতেন না। এতে এটাই প্রমাণিত হলো, ছবি-প্রতিকৃতি বানানো বৈধ একটি কাজ।
আমরা বলব, দুটি কারণে তাদের এ প্রমাণপদ্ধতি বাতিল ও ভ্রান্ত।
এক : উক্ত আয়াতটিতে تماثيل শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা تمثال এর বহুবচন। আমাদের এখন জানতে হবে, تمثال মানে কী? এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনু মানজুর রহ. লিসানুল আরবে লিখেন :
والتِّمْثَالُ: الصُّورةُ، وَالْجَمْعُ التَّمَاثِيل. ومَثَّلَ لَهُ الشيءَ: صوَّره حَتَّى كأَنه يَنْظُرُ إِليه. وامْتَثَلَه هُوَ: تصوَّره. والمِثَالُ: مَعْرُوفُ، وَالْجَمْعُ أَمْثِلَة ومُثُل. ومَثَّلْتُ لَهُ كَذَا تَمْثيلًا إِذا صوَّرت لَهُ مِثَالَهُ بِكِتَابَةٍ وَغَيْرِهَا. وَفِي الْحَدِيثِ: أَشدُّ النَّاسِ عَذَابًا مُمَثِّل مِنَ المُمَثِّلين أَي مصوِّر. يُقَالُ: مَثلْت، بِالتَّثْقِيلِ وَالتَّخْفِيفِ، إِذا صوَّرت مِثالًا. والتِّمْثَالُ: الِاسْمُ مِنْهُ، وظِلُّ كُلِّ شَيْءٍ تِمْثَالُه. ومَثَّلَ الشَّيْءَ بِالشَّيْءِ: سوَّاه وشبَّهه بِهِ وَجَعَلَهُ مِثْلَه وَعَلَى مِثالِه. وَمِنْهُ الْحَدِيثِ: رأَيت الجنةَ وَالنَّارَ مُمَثَّلَتين فِي قِبْلةِ الجِدار أَي مصوَّرتين أَو مثالُهما؛ وَمِنْهُ الْحَدِيثُ: لَا تَمَثِّلُوا بنَامِيَةِ اللَّهِ أَي لَا تُشَبِّهُوا بِخَلْقِهِ وتصوِّروا مِثْلَ تَصْوِيرِهِ، وَقِيلَ: هُوَ مِنَ المُثْلة. والتِّمْثَال: اسْمٌ لِلشَّيْءِ الْمَصْنُوعِ مشبَّهاً بِخَلْقٍ مِنْ خَلْقِ اللَّهِ، وَجَمْعُهُ التَّمَاثِيل، وأَصله مِنْ مَثَّلْت الشَّيْءَ بِالشَّيْءِ إِذا قدَّرته عَلَى قَدْرِهِ، وَيَكُونُ تَمْثيل الشَّيْءِ بِالشَّيْءِ تَشْبِيهًا بِهِ، وَاسْمُ ذَلِكَ الممثَّل تِمْثال.
‘আত-তিমসাল (التِّمْثَالُ) অর্থ আকৃতি। এর বহুবচন হলো التَّمَاثِيل। (বলা হয়) مَثَّلَ لَهُ الشَّيْئَ অর্থাৎ সে তার আকৃতি বানাল, যেন সে তাকে দেখছে। امْتَثَلَه هُوَ অর্থাৎ সে তাকে কল্পনা করল। المِثَالُ এর অর্থ প্রসিদ্ধ (অর্থাৎ উদাহরণ বা প্রতিচ্ছবি)। এর বহুবচন হলো, أَمْثِلَة ও مُثُل। বলা হয়, مَثَّلْتُ لَهُ كَذَا تَمْثيلًا অর্থাৎ আমি লেখা ইত্যাদির মাধ্যমে তার আকৃতি এঁকে দিলাম। হাদিসে এসেছে : أَشدُّ النَّاسِ عَذَابًا مُمَثِّل مِنَ المُمَثِّلين অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে আকৃতি নির্মাণকারী অর্থাৎ ছবি-প্রতিকৃতি অঙ্কনকারী। বলা হয়, مَثلْت (তাশদিদ সহকারে ও তাশদিদ ছাড়া) অর্থাৎ আমি প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করলাম। আর اَلتِّمْثَالُ হলো مَثَّلَ এর ক্রিয়ামূল বিশেষ। প্রত্যেক বস্তুর ছায়া বা প্রতিবিম্বকে تمثال বলা হয়। (বলা হয়) مَثَّلَ الشَّيْئَ بِالشَّيْئِ সে তার বস্তুকে অন্য বস্তুর সমান করল বা সে তাকে অন্যের সাথে তুলনা করল বা সে তাকে অন্যের সদৃশ্য ও প্রতিচ্ছবি বানাল। এ অর্থেই হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে যে, رأَيت الجنةَ وَالنَّارَ مُمَثَّلَتين فِي قِبْلةِ الجِدار ‘আমি দেয়ালের সামনের অংশে সদৃশ্যরূপে জান্নাত-জাহান্নাম দেখেছি, অর্থাৎ তাদের আকৃতি ও প্রতিচ্ছবি।’ …আর কারও মতে, এটা المُثْلة থেকে নির্গত। আর التِّمْثَالُ হলো, আল্লাহর কোনো সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য রেখে তৈরিকৃত বস্তু। এর বহুবচন হলো, التَّمَاثِيل। এটার মূল হলো, مَثَّلْت الشَّيْءَ بِالشَّيْءِ যখন তাকে তার অনুমান মতো পরিমাপ করলাম। বস্তুকে অন্য বস্তুর মতো বানানো অর্থ তাকে তার সদৃশ বানানো। আর ওই সদৃশ বস্তুকেই التِّمْثَالُ বলে।(লিসানুল আরব : ১১/৬১৩-৬১৪, শব্দ : مثل, প্রকাশনী : দারু সাদির, বৈরুত)
আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘আল-মুনজিদ-এ বলা হয়েছে :
التمثال، ج التماثيل : الصورة المصورة أو هو ما تصنعه وتصوره مشبها بخلق الله من ذوات الروح والصورة
‘আত-তিমসাল (التِّمْثَالُ) এর বহুবচন হলো التَّمَاثِيل। এর অর্থ হলো, চিত্রিত বা অঙ্কিত কোনো ছবি-প্রতিকৃতি। অথবা (এর আরেকটি অর্থ হলো) প্রাণ ও আকৃতিবিশিষ্ট কোনো সৃষ্টিজীবের সাথে মিল রেখে যে প্রতিচ্ছবি বানানো হয় (অর্থাৎ ভাস্কর্য ও ত্রিমাত্রিক মূর্তি)।’(আল-মুনজিদ ফিল-লুগাহ : পৃ. নং ৭৩৭, প্রকাশনী : দারুল মাশরিক, বৈরুত)
উপরিউক্ত উদ্ধৃতি হতে বুঝা যায়, التمثال আভিধানিকভাবে প্রত্যেক ওই আকৃতিকে বলে, যা অন্য কোনো বস্তুর আকৃতির অনুরূপ হয়। এতে কোনো পার্থক্য নেই যে, তা প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি হবে বা অন্য কোনো কিছুর। অর্থাৎ শব্দটি শুধু প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতির সাথেই বিশেষায়িত নয়। সুতরাং আমরা উক্ত আয়াতের জবাব এভাবে দিতে পারি যে, জিনেরা সুলাইমান আ.-এর ইচ্ছানুযায়ী যেসব ছবি-প্রতিকৃতি বানাত, তা প্রাণী ছাড়া অন্যান্য বস্তু যথা- গাছপালা, তরুলতা, নদী-নালা ইত্যাদির ছবি-প্রতিকৃতি ছিল। কোনো আয়াত বা হাদিসেই আসেনি যে, জিনেরা সুলাইমান আ.-এর জন্য প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করত। সুতরাং এ আয়াত দ্বারা প্রাণীর ছবি-ভাস্কর্য বানানো বৈধ হওয়ার দলিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে নন্দিত মুফাসসির আল্লামা জারুল্লাহ জমাখশারি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘কাশশাফ’-এ বলেন :
والتماثيل: صور الملائكة والنبيين والصالحين، كانت تعمل في المساجد من نحاس وصفر وزجاج ورخام ليراها الناس فيعبدوا نحو عبادتهم. فإن قلت: كيف استجاز سليمان عليه السلام عمل التصاوير؟ قلت: هذا مما يجوز أن تختلف فيه الشرائع، لأنه ليس من مقبحات العقل كالظلم والكذب، وعن أبى العالية: لم يكن اتخاذ الصور إذ ذاك محرّما. ويجوز أن يكون غير صور الحيوان كصور الأشجار وغيرها، لأنّ التمثال كل ما صوّر على مثل صورة غيره من حيوان وغير حيوان. أو تصوّر محذوفة الرؤوس.
‘আত-তামাসিল (التماثيل) হলো ফেরেশতা, নবি ও নেক লোকদের ছবিসমূহ। জিনেরা পিতল, স্বর্ণ, শিশা ও শ্বেতপাথর তা (তাদের ভাস্কর্য) মসজিদে বানিয়ে রাখত; যেন মানুষ তা দেখে তাদের মতো ইবাদত-উপাসনা করে। যদি তুমি প্রশ্ন করো, সুলাইমান আ. কীভাবে ছবিসমূহ বানানোর অনুমতি দিলেন? আমি বলব, এটা এ কারণে যে, হতে পারে ছবির ব্যাপারে বিভিন্ন শরিয়তের বিধান ভিন্ন ভিন্ন। কারণ, এটা (ছবি-প্রতিকৃতি বানানো) বিবেকবিবর্জিত কোনো কদর্য ও নিকৃষ্ট কাজ যথা- অত্যাচার করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদির অন্তর্ভুক্ত নয় (যে, তা সব শরিয়তেই নিষিদ্ধ ও অবৈধ হতে হবে)। আবুল আলিয়া রহ. হতে বর্ণিত, সে সময়ে (সুলাইমান আ.-এর যুগে) ছবি রাখা হারাম ছিল না। আর এটাও হতে পারে যে, তা প্রাণী ছাড়া অন্যান্য বস্তু যথা- গাছপালা ইত্যাদির ছবি-প্রতিকৃতি ছিল। কারণ, التمثال বলা হয় প্রত্যেক ওই ছবি-প্রতিকৃতিকে, যা অন্য কোনো জিনিসের আকৃতির ন্যায় বানানো হয়; হোক তা প্রাণী বা প্রাণী ব্যতীত অন্য কিছু। অথবা এটাও হতে পারে যে, মাথাকাটা অবস্থায় প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতি বানানো হতো।’ (আল-কাশশাফ আন হাকায়িকি গাওয়ামিজিত তানজিল : ৩/৫৭২, সুরা সাবা : ১৩, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
জিনেরা যে সুলাইমান আ.-এর জন্য প্রাণী ব্যতীত অন্য কিছুর ছবি-প্রতিকৃতি বানাত, তার পক্ষে শক্তিশালী একটি নিদর্শন হলো, তাঁর সময়ে শরয়ি বিধানের কিতাব ছিল তাওরাত। আর তাওরাতে ছবি-প্রতিকৃতি আঁকা হারাম বলা হয়েছে। এমনকি বর্তমানে বিদ্যমান বিকৃত তাওরাতে এখন পর্যন্ত সে বিধান লিখা আছে। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪/৯৬, প্রকাশনী : মাকতাবা দারুল উলুম, করাচি)
আর এটা প্রসিদ্ধ যে, সুলাইমান আ. তাওরাতের অনুসরণ করতেন। সুতরাং এটা হতে পারে না যে, তাওরাত যা হারাম করেছে, একজন নবি তা তৈরির আদেশ দেবেন। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, জিনেরা যে ছবি-প্রতিকৃতি বানাত, তা ছিল প্রাণহীন বস্তু যথা- গাছপালা, ফুল-ফল, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদির ছবি-প্রতিকৃতি। আবুল আলিয়া রহ. হতে সুলাইমান আ.-এর সময়ে ছবি-প্রতিকৃতি হারাম না হওয়ার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা ছবি রাখা সংক্রান্ত বর্ণনা, বানানো ও তৈরি করা সংক্রান্ত নয়। কারণ, বর্ণনায় اتخاذ الصور এসেছে, যার অর্থ ছবি-প্রতিকৃতি ব্যবহার করা বা রাখা। আর এটা সম্ভব যে, কোনো জিনিস বানানো হারাম হলেও ব্যবহার হারাম হবে না। যেমন অস্পষ্ট ছোট ছবি বানানো হারাম ঠিকই, কিন্তু তা রাখা হারাম নয়।
দুই : যদি একথা মেনে নেওয়া হয় যে, জিনেরা সুলাইমান আ.-এর নির্দেশে প্রাণীর ছবি-প্রতিকৃতিই বানাত তাহলে এর জবাব হলো, এটা আমাদের পূর্বের শরিয়ত। আর পূর্বেকার শরিয়ত দ্বারা প্রমাণ পেশ করা তখনই সহিহ হবে, যখন এর বিপরীতে আমাদের শরিয়তের কোনো বিধান না পাওয়া যাবে।
এ ব্যাপারে ড. আবদুল করিম জাইদান রহ. ‘আল-আজিজু ফি উসুলিল ফিকহ’-এ বলেন :
النوع الثاني: أحكام قصها الله في قرآنه، أو بينها الرسول صلى الله عليه وسلم في سنته وقام الدليل من شريعتنا على نسخها في حقنا أي أنها خاصة بالأمم السابقة، فهذا النوع لا خلاف في أنه غير مشروع في حقنا.
‘দ্বিতীয় প্রকার হলো, এমন বিধিবিধান, যা আল্লাহ তাআলা কুরআনে বা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে বর্ণনা করেছেন এবং আমাদের জন্য সে বিধান রহিত হওয়ার ব্যাপারে আমাদের শরিয়তে প্রমাণ রয়েছে যে, উক্ত বিধান শুধু পূর্বেকার উম্মাতদের জন্যই বিশেষিত ও নির্দিষ্ট। এ জাতীয় পূর্বেকার শরিয়তের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই যে, আমাদের জন্য তা (মানা) শরিয়তবহির্ভূত (অর্থাৎ তা মানা ও অনুসরণ করা আমাদের জন্য বৈধ নয়)।’(আল-অজিজ ফি উসুলিল ফিকহ : পৃ. নং ২৬৪, মূলনীতি নং ২৪৮, প্রকাশনী : মুআসসাসাতু কুরতুবা, কায়রো)
এ মূলনীতির আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ছবি-প্রতিকৃতি আঁকা ও বানানোর ব্যাপারে আমাদের শরিয়তে দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট ভাষ্য রয়েছে। সুতরাং আমাদের পূর্বেকার শরিয়তের ওপর ভিত্তি করে ছবি-প্রতিকৃতিকে বৈধ করার কোনো অবকাশ নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا
‘তোমাদের প্রত্যেক জাতির জন্যই আমি আলাদা শরিয়ত ও পথ বানিয়েছি।’(সুরা আল-মায়িদা : ৪৮)
এখানে জবাবটি এভাবেও দেওয়া যায় যে, জিনেরা সুলাইমান আ.-এর নির্দেশে ছবি-প্রতিকৃতি ঠিকই বানাত, কিন্তু তা ছিল মাথাকাটা। কারণ, ছবি-প্রতিকৃতি আঁকা বা বানানো নাজায়িজ হলেও মাথাবিহীন হলে তা সব শরিয়তেই জায়িজ; যেমনটি আল্লামা জারুল্লাহ জমাখশারি বলেছেন। সুতরাং এই জবাব অনুসারে সুলাইমান আ.-এর সময় ছবি-প্রতিকৃতি অবৈধ ছিল। কিন্তু তিনি এ ধরনের অবৈধ ছবি-প্রতিকৃতি বানানোর নির্দেশ দেননি; বরং তাঁর নির্দেশিত ছবি-প্রতিকৃতিগুলো ছিল মাথাকাটা, যা সব শরিয়তেই বৈধ।
পূর্বের সংক্ষিপ্ত আলোচন থেকে প্রমাণ হলো যে, ভাস্কর্য বানানো ইসলামে সুস্পষ্ট হারাম। এ ব্যাপারে উম্মাহর কারও কোনো মতভেদ নেই। অর্থাৎ এট একটি ইজমায়ি বা ঐকমত্য-সমর্থিত মাসআলা। এ মাসআলায় কেবল তারাই ভিন্নমত পোষণ করতে পারে, যাদের কুরআন-সুন্নাহর সাথে ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই, আর না আছে ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদ ও উসুলের ব্যাপারে সামান্য ধারণা। এরকম ইজমায়ি বিষয়ে মূলত দলিলের দরকার পড়ে না। তবুও দুর্বল মুসলিমরা যেন কোনো অপব্যাখ্যা দ্বারা প্রতারিত না হয়, সেজন্য আজকের এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এতকিছুর পরও যদি বিষয়টি কারও বুঝে না আসে, এরপরও যদি কেউ এটা নিয়ে মতভিন্নতা করে তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে হিদায়াতের দুআ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বস্তুত কারও অন্তরে যখন মোহর মারা হয় তখন দুনিয়ার তাবৎ দলিল সামনে এনে দিলেও তা তার হিদায়াতের জন্য যথেষ্ট হয় না। আমরা হিদায়ার পাওয়ার পর পুনরায় গোমরাহির পথে চলে যাওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
মুফতি তারেকুজ্জামান হাফি.
আল-আযহার, মিশর