ব্যভিচার, ধর্ষণ ও বাল্যবিবাহ বিষয় আইনের কিচ্ছা

ব্যভিচার, ধর্ষণ ও বাল্যবিবাহ বিষয় আইনের কিচ্ছা
————–
(কয়েকবছর আগের পোস্ট, যতই দিন যাচ্ছে আরও প্রাসঙ্গিক হচ্ছে। মূল গল্প এবং রেফারেন্সগুলোর লিংক থাকবে কমেন্টে।)
——————
[ক]
গত মঙ্গলবার রাতে একটা গল্প লিখেছিলাম ‘বাল্যবিবাহ’ নামে। সেখানে বলেছিলাম ‘বিবাহ বহির্ভুত মিউচুয়াল সেক্স ১৪ বছর থেকে বাংলাদেশের আইনে বৈধ’। এর ওপর কেউ কেউ আপত্তি করেছেন। কেউ ব্যখ্যা চেয়েছেন। নিজেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ুয়া দাবী করে একজন এটার বিরুদ্ধে গলা উঁচুও করেছেন। উনার মতে বাংলাদেশের সংবিধান ফুলের মতই পবিত্র। সাথে ডায়লগ ফ্রি ‘আপনার মত লোকদের জন্যই তো ইসলামের এত বদনাম…!’ তো উনারে ছাই দিয়ে ধরছিলাম। আমার পুরো ২ ঘণ্টা নষ্ট করার পর উনার আখেরি দলিল ছিল ‘নাহ! বাংলাদেশের আইনে এসব নিষিদ্ধ!! আমার পরিচিত দুজনরে পুলিশে ধরছে!!’ এই হচ্ছে দেশের নামকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ুয়ার অবস্থা! উনার নাকি আবার বাংলাদেশের সংবিধান পুরোটা মুখস্ত!!
সেই সুঁইওয়ালার গল্পের মত আরকি….
হাসবেন না প্লিজ… আপনি নিশ্চিত থাকুন এরচেয়েও অপদার্থ অনেক আছে, যারা দুদিন পর সেক্যুলারদের পূজনীয় “দেশের বিশিষ্ট নাগরিক” রূপে আবির্ভুত হবেন।
.
যাহোক, আমার লেখার ডিফেন্ড আমাকেই করতে হচ্ছে। যেহেতু আমি আইনের ছাত্র না। ইভেন স্কুল-কলেজ বা আলিয়া মাদরাসা পড়ুয়াও না। তো পরিভাষাগত কিছু কমবেশ হতেই পারে, যেমন আমি গল্পের মধ্যে বলেছিলাম “বাংলাদেশের সংবিধানে এটা বৈধ” সেখানে বলা উচিত ছিল “বাংলাদেশের আইনে এটা বৈধ!” বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছি তাই না?
তো যাহোক, আমি অজ্ঞ হলে কি হবে? আপত্তিকারিরা তো অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। তো আইনের কয়েকটা বাক্য বুঝতে তো উনাদের সমস্যা হওয়ার কথা না, তাই না? আমার দেয়া রেফারেন্স তারা কষ্ট করে যাচাই করে নিবেন, অকা?
.
[গ]
এবার আসা যাক মুল কথায়,
বৈধ এবং অবৈধ কী?
– যা অবৈধ নয় তাহাই বৈধ। আইনের গ্রন্থে বৈধ জিনিশের বিবরণ খুব কমই থাকে। সেখানে থাকে সাধারণত যা আবশ্যক এবং যা নিষিদ্ধ।
উদাহরণ স্বরূপ, আমি আপনাকে একটা গল্পের বই গিফট করলাম। বাংলাদেশের আইনে এটা বৈধ নাকি অবৈধ?
– বৈধ! কারণ, এব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই।
আরেকটি উদাহরণ, চুরি করা অবৈধ, কিন্তু “চুরি না করা”টা কি? বৈধ নাকি অবৈধ?
– বৈধ, কারণ এর বিপরীত কাজটা অবৈধ।
তাহলে আমরা বুঝলাম, আইন যেসব বিষয়কে অবৈধ বলে তা ব্যতীত বাকিসব বৈধ! অল্পকথায়, যা অবৈধ নয় তাহাই বৈধ!!
——–
এজ অফ কনসেন্ট (age of consent) কী?
– এজ অফ কনসেন্ট সেই বয়সকে বুঝায় যে পর্যায়ে গিয়ে একজন ব্যক্তি আইনানুগভাবে সেক্সুয়াল এক্টিভিটিতে জড়ানোর অনুমতি পায়। আইন ঘোষণার মাঝে যদিওবা সচরাচর এটা স্পষ্ট উল্লেখ থাকেনা, কিন্তু ‘সেক্সুয়াল এক্টিভিটি তে জড়ানোর সর্বনিম্ন বয়স সংক্রান্ত আইন’ থেকে এটা আহরণ করা হয়। কখনো এর দ্বারা বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স বুঝালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটাই উদ্দেশ্য হয় যা উপরে বলা হয়েছে। (wiki: Age_of_consent ) [১]

বাংলাদেশের এজ অফ কনসেন্ট কত?
– এজঅফকনসেন্ট.কম এবং উইকিপিডিয়া বলছে বাংলাদেশের এজ অফ কনসেন্ট (অর্থাৎ যে বয়সে সেক্সুয়াল এক্টিভিটিতে জড়ানো বৈধ) তা হচ্ছে ’১৪ বছর’ (wiki: Ages_of_consent_in_Asia#Bangladesh ) [২]
রেফারেন্স হিসেবে বলা হয়েছেঃ বাংলাদেশের আইনের পেনাল কোড ১৮৬০ [৩]
.
[ঘ]
কি আছে সেখানে?
নিয়মানুযায়ী এই পেনাক কোডে বিভিন্ন প্রকার দণ্ডনীয় অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রেপ সংক্রান্ত ধারাতে (৩৭৫, ৩৭৬) অবৈধ সেক্সুয়াল এক্টিভিটির সংজ্ঞা এবং এর শাস্তির বিবরণ রয়েছে। পরে ৪৯৭ ধারায় ব্যাভিচারের সংজ্ঞা এবং শাস্তির বিবরণ দেয়া আছে।
.
দণ্ডবিধি ৩৭৫নং ধারা খেয়াল করি, এখানে ধর্ষন (rape) সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে-
কোন পুরুষ অত:পর ব্যতিক্রম ভিন্ন অপর সকল ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পাঁচটি যে কোন অবস্থায় কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করলে সে ব্যক্তি নারী ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে-
প্রথমত, স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধেযৌন সঙ্গম করলে,
দ্বিতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করলে,
তৃতীয়ত, স্ত্রীলোকটিকে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে সম্মতি আদায করে যৌনসঙ্গম করলে,
চতুর্থত, যে ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি বিশ্বাস করে যে পুরুষ লোকটি তার স্বামী অথচ পুরুষটি জানে যে সে ঐ স্ত্রীলোকিটির স্বামী নহে এর পরও স্ত্রীলোকটির সাথে যৌন সঙ্গম করলে,
পঞ্চমত, স্ত্রী লোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যদি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বছরের কম হয়।
.
এখানে উল্লেখ্য যে, অনুপ্রবেশই নারী ধর্ষণের অপরাধ রূপে ‘গণ্য হবার যোগ্য যৌনসহবাস’ অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে।
ব্যতিক্রম: কোন পুরুষ কর্তৃক তার স্ত্রীর সহিত যৌন সহবাস, স্ত্রীর বয়স ১৩ বৎসরের কম না হলে নারী ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। [ref: chapter XVI, 375]
——-
কতটা জঘন্য আইন চিন্তা করেন, উপরের প্যারাগুলো ভালোভাবে খেয়াল করি.. সেখানে কি বুঝানো হচ্ছে-
প্রথম এবং দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধেযৌন বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করলে – অর্থাৎ সম্মতিক্রমে সঙ্গম করলে সেটা রেপ না! এজন্য শাস্তিও হবে না।
তৃতীয় শর্ত – স্ত্রীলোকটিকে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে সম্মতি আদায করে যৌনসঙ্গম করলে – অর্থাৎ যদি স্বেচ্ছায় সঙ্গম করে তবে রেপ না! এজন্য শাস্তিও হবে না।
চতুর্থ অদ্ভুত শর্ত হচ্ছে – স্ত্রীলোকটি বিশ্বাস করে যে পুরুষ লোকটি তার স্বামী অথচ পুরুষটি জানে যে সে ঐ স্ত্রীলোকিটির স্বামী নহে এর পরও স্ত্রীলোকটির সাথে যৌন সঙ্গম করলে!
.
পঞ্চম শর্ত খেয়াল করুন – স্ত্রী লোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যদি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বছরের কম হয় – অর্থাৎ চৌদ্দবছরের নিচে হলে সম্মতিক্রমে বা স্বেচ্ছায় সঙ্গম করলেও সেটা রেপ হবে, “কিন্তু যদি চৌদ্দ বছরের উপরে বয়স হয় হবে পুর্বোক্ত শর্ত অনুযায়ী কোনো মেয়েলোক (সে আপনার স্ত্রী হোক চাই না হোক) যদি স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় সেটা রেপ হবে না!! এবং এজন্য কোনো শাস্তিও ভোগ করতে হবে না!”
.
পরে একটি জঘন্য কুফরি এক্সেপশন দেয়া হয়েছে- ব্যতিক্রম: কোন পুরুষ কর্তৃক তার স্ত্রীর সহিত যৌন সহবাস, স্ত্রীর বয়স ১৩ বৎসরের কম না হলে নারী ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না – অর্থাৎ কোন লোক যদি তাঁর নিজের স্ত্রীর সাথে যৌনসঙ্গম করে, এবং স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছরের কম হয় তবে সেটা ধর্ষন বলে বিবেচিত হবে। এবং এজন্য স্বামীর ওপর ধর্ষকের অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদিওবা মেয়েটি তাঁর নিজের স্ত্রী!
.
[ঙ]
এবার বাংলাদেশের আইনের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচার (Adulatery) এর সংজ্ঞা দেখা যাকঃ
অনুযায়ি যদি কোন ব্যাক্তি অন্য কোন ব্যাক্তির স্ত্রীর সাথে বা যাকে সে অন্যের স্ত্রী বলে জানে অথবা অন্যের স্ত্রী বলে বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও সে “ঐ ব্যাক্তির সম্মতি ও সমর্থন ছাড়া” তার স্ত্রীর সাথে এমন যৌন সঙ্গম করে যা নারী ধর্ষনের সামিল নয়, তবে সে ব্যাক্তি ব্যভিচারের অপরাধের জন্য দোষী হবে এবং তাকে (৫) পাচ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অনুরুপ ক্ষেত্রে স্ত্রী লোকটি দুষ্কর্মের সহায়তাকারি হিসাবে দণ্ডিত হবে না। [ref: chapter XX, para 497]

এই আইন থেকে (বিশেষত কোটেশন দেয়া অংশ) থেকে বুঝা যাচ্ছে কোনো লোকের সম্মতিক্রমে যদি তাঁর সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় তবে সেটা ব্যাভিচার হবে না এবং কোনো শাস্তিও হবে না!! আর মেয়ে লোকটি যদি কারো স্ত্রী না হয়, তবে এদেশের আইন কোনোভাবেই এটাকে ব্যাভিচার বলবে না! চান্সই নাই!! আরো এপিক ব্যাপার হচ্ছে, যাই করেন শাস্তি শুধু পুরুষই পাবে, নারী নিষ্পাপ!
.
এই হচ্ছে পবিত্র সংবিধান শরিফের অবস্থা! আপনার স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে সেজন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে, কিন্তু ১৪ বছর+ অন্য মেয়ের সাথে করলে বা অন্য কারো অনুমতি নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করলে আপনাকে কিছুই বলা হবে না!
প্রশ্ন জাগতে পারে, ইসলাম কি বলে? এটা কি সুস্পষ্ট কুফর নয়?

References:
[1] https://en.wikipedia.org/wiki/Age_of_…
[2] https://en.wikipedia.org/wiki/Ages_of……
[3] http://bdlaws.minlaw.gov.bd/print_sec…

আরো দ্রষ্টব্যঃ
১. http://lawhelpbd.com/criminal-law/pen…
২. http://lawhelpbd.com/criminal-law/pen…

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ হাফি.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *