মাজহাব ও বাস্তবতাটা একটু বুঝার চেষ্টা করবেন কি?
(ধৈর্য ধরে পড়ুন, কারন সবার জন্য বিষয়টা জানা একান্ত দরকার)
লিখেছেন :শায়খ সুহাইব মাহমুদ সাকার হাফি, (লিবিয়া, বর্তমানে তুরস্কের অধিবাসী)
অনুবাদ : আবু বকর তাওহীদ
———————-
আহলুস সুন্নাহ এর প্রতিটি মাযহাবেরই ফিকহের সহজ সংক্ষিপ্ত কিতাবাদী রয়েছে যা অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় লিখিত এবং খুব ফলপ্রসূ। এ সমস্ত কিতাবাদীর মাধ্যমে আমাদের উলামায়ে কিরাম সকল মুসলমানের জন্য – এমনকি কেউ যদি একেবারে সাধারণ মানুষও হন – ইবাদত ও লেনদেন সঠিকভাবে পালন করার জ্ঞানলাভের রাস্তা সহজ করে দিয়েছেন। এটা দলীল অনুসন্ধান কিংবা ঐ শাস্ত্র যাকে তুলনামূলক ফিকহ তথা দলীল ভিত্তিক ফিকহ বলা হয় তাতে পারদর্শীতা ও পাণ্ডিত্য অর্জনের আগের ধাপের কথা।
লিবিয়ার অনেক সাধারণ মানুষ ইবনে আশিরের মতন তথা মূলপাঠ মুখস্থ করত।
সিরিয়ার অনেক মানুষ ফিকহে শাফেয়ীর জন্য আমরিতীর মতন এবং ফিকহে হানাফীর জন্য কুদুরীর মতন মুখস্থ করত এবং এখনও করে।
এই সংক্ষিপ্ত মতনগুলো সাধারন মানুষের মাঝে তর্ক বিতর্কের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তাদেরকে ইবাদত সঠিকভাবে পালনের কাজে ব্যস্ত রেখেছিল। এই সংক্ষিপ্ত মতনগুলো আহলে সুন্নাহর চিন্তা ও মতের একতাকে বজায় রেখেছিল।
আর এখন আমাদের মাঝে এমন একদল গজিয়ে উঠেছে যাদের শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতি খুব অবাক হওয়ার মত।
তারা প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শুরুতেই দলিল ভিত্তিক ফিকহ, ফকীহদের মতামতের মাঝে এবং প্রনিধানযোগ্য মত ও অগ্রহনযোগ্য মতের মাঝে তুলনামূলক পর্যালোচনা শিখাতে শুরু করে।
শেষ পর্যন্ত আপনি দেখবেন তারা কোন কাজেই লাগেনি।
তাদের অধিকাংশরাই তাহারাত তথা পবিত্রতার অধ্যায়গুলোই শেষ করতে পারে না,
আর যারা একটু যোগ্য তারা নামাজ কিংবা ইবাদতের আলোচনা হতে বের হতে পারে না।
তাদের চরম অজ্ঞতার সাথে দুঃসাহসিক স্পর্ধা সংমিশ্রিত হয়েছে,
অজ্ঞতার সহিত বাস্তব সত্যকে অস্বীকার, আহলুল ইলমের সম্মানহানি সবই তারা করেছে।
এই সবকিছু তারা ‘সালাফের বুঝ অনুযায়ী কুরআন সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা’ নামক ধোঁকাবাজিপূর্ণ শিরোনামের আড়ালে করছে।
বাস্তবে মূলত এটা সালাফের বিরোধীতাকারী (বর্তমান) খালাফদের বুঝ অনুযায়ী কুরআন সুন্নাহ হতে বেরিয়ে যাওয়ার নামান্তর।
———————-
আমি (অনুবাদক) অগোছালোভাবে সংক্ষেপে কিছু কথা পেশ করতে চাচ্ছি :
★ মূলকথা হল ফিকহের সংক্ষিপ্ত কিতাব রচনার মানে এই নয় যে এর লেখকগন দলীল জানেন না বরং প্রতিটি কিতাব তার পাঠক শ্রেণীর প্রতি খেয়াল রেখে লিখা হয়। যেটা সাধারন মানুষ বা প্রাথমিক ছাত্রদের জন্য লিখা সেটা দালিলিক জটিল আলোচনা পর্যালোচনার ক্ষেত্র নয়।সে কিতাবে কেন দলিল নেই এ আপত্তি তোলা নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক। সেজন্য চার মাযহাবের প্রতিটিরই ফিকহে মুদাল্লাল তথা দলিল ভিত্তিক ফিকহের স্বতন্ত্র কিতাব রয়েছে।
এক্ষেত্রে কিতাবগুলোর তিনটি ধাপ হয়ে থাকে :
প্রথমত ফিকহে মুজাররাদ তথা দলীল উল্লেখবিহীন ফিকহী মাসায়িল
দ্বিতীয়ত ফিকহে মুদাল্লাল তথা দলীল উল্লেখপূর্বক ফিকহী মাসায়িল
তৃতীয়ত ফিকহে মুকারান তথা তুলনামূলক ফিকহ যেখানে বিভিন্ন মাযহাব ও দলীলের মাঝে পর্যালোচনা হবে।
★ যারা দলীলের আলোকে তুলনামূলক ফিকহ চর্চায় আগ্রহী তাদের উচিত বাস্তবতার আলোকে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করা। এটা কত কঠিন কাজ তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। যেখানে আমরা কুরআনের একটি আয়াতের অনুবাদ সঠিকভাবে বুঝতে গেলে মাঝে মাঝে হিমশিম খেতে হয় সেক্ষেত্রে কিভাবে ফিকহের শতাধিক অধ্যায়ের হাজার হাজার নয় বরং লাখ লাখ মাসয়ালার মাঝে দলীলের মাধ্যমে উলামায়ে কিরামের মতামতের মাঝে প্রাধান্য দিব?
এর জন্য কুরআন হাদীস হতে মাসয়ালা উদ্ভাবনের নীতিমালা জানতে হবে, যে হাদীসের অনুবাদের বাইরে আমাদের মাথায় তেমন কিছু আসে না সে হাদীস হতেই উলামাগন শতাধিক মাসয়ালা বের করেছেন। কোথায় তাদের বুঝ আর কোথায় আমাদের বুঝ? কোথায় মাসয়ালা উদ্ভাবনের মূলনীতিসমূহ ও এর প্রয়োগ আর কোথায় আমাদের এ সম্পর্কে অনবগতি? তুলনামূলক ফিকহের জন্য অসংখ্য হাদীস জানতে হবে, শুধু হাদীস জানলেই হবে না বরং হাদীসের রাবীদের পর্যালোচনা করতে হবে। হাদীসটি সহীহ, হাসান, দয়ীফ, মাওজু কোন পর্যায়ের সেটি নির্ণয় করতে হবে। আমলযোগ্য কিনা দেখতে হবে। হাদীসের এক সনদ দেখেই হুকুম দেয়া যায় না বরং এ বিষয়ের সমস্ত হাদীস জমা করে এর বিশুদ্ধতা নির্ণয় করতে হবে। হাদীসের এ সূক্ষ্ণ পর্যালোচনাকে আজ মানুষ খুব সহজ মনে করছে অথচ ইলালুল হাদীস বিষয়ে যার প্রাথমিক ধারনাও আছে সেও টের পাবে দলীলের মাঝে তুলনামূলক আলোচনা ও প্রাধান্যদান আসলে কত জটিল কাজ। এভাবে প্রতিটি মাসয়ালায় এ বিষয়ক সমস্ত হাদীস ও উলামায়ে কিরামের মতামত পর্যালোচনা করতে গেলে কি পরিমান সময়ের দরকার একটু ভেবে দেখুন। সেক্ষেত্রে ফিকহের সব অধ্যায়ের লাখ লাখ মাসয়ালার দলীল ও মতামত পর্যালোচনা এক জীবনে কোনদিনই সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও এক গবেষকের পর্যালোচনা অপর জনের সাথে অনেকসময়ই মিলবে না। তৈরী হবে জগাখিচুড়ি মার্কা নতুন নতুন মাযহাব। এর চেয়ে দলীলভিত্তিক শৃংখলাপূর্ণ চার মাযহাবের কোনটি মানাই কি আমাদের জন্য অধিক নিরাপদ নয়?
★যারা তুলনামূলক ফিকহ চর্চা করে দলিলের মাঝে প্রাধান্য দিতে চান তারা কোন মূলনীতির আলোকে প্রাধান্য দিবেন? প্রতিটি মাযহাবের নিজস্ব কিছু নীতিমালা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তো নীতিমালার মাঝেও মুকারানা করে প্রাধান্য দিতে হবে!!!
★ যারা মাযহাবের গন্ডি ছেড়ে কোরআন সুন্নাহর পথে মানুষকে ফিরে আসার আহবান জানালেন তারা সকলে কি এক মতের উপর স্থির হতে পেরেছেন? তাদের নিজেদের মাঝেও অনেক মাসয়ালায় ব্যাপক মতভিন্নতা হয়ে গেছে যা নিয়ে আলাদা কিতাবও রচনা হয়েছে। তাহলে কেন তারা মাযহাব বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সংশয় সৃষ্টি করছেন?
★ আরেকটি দুঃখজনক বাস্তবতা উপরের লিখায় শায়খ সুহাইব বলেছেন যে এ লোকেরা ইবাদতের অধ্যায়গুলো হতে বের হতে পারে না। এটা নির্মম বাস্তবতা, তাদের জ্ঞানের দৌড় অধিকাংশ সময়ই নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতের মাসয়ালা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। তাদেরকে অর্থনৈতিক লেনদেন, হুদুদ, কিসাসসহ ফিকহের অন্যান্য মুয়ামালাত মুয়াশারাত বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায় না, শরীয়াহ আইনের বাস্তবায়ন বিষয়েও মুখ খুলতে দেখা যায় না। কোন কোন ক্ষেত্রে হারাম উপার্জন করেও আইম্মায়ে ফুকাহার উপর ইবাদতের বিষয়ে সহীহ দলীলের নামে জ্ঞান কপচাতে থাকে। আহ কি নির্লজ্জ আচরন!!! কি নিদারুণ নিরেট অজ্ঞতা!!!
আল্লাহ তায়ালা এরকম অবোধ লোকদের কবল হতে আমাদের রক্ষা করুন।
(প্রয়োজন মনে করে লিখাটি আবার দিলাম)