হেফাজতপন্থি আলিম মুফতি হারুন ইজহার হাফি. তার এক আলোচনায় বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে, জি হা দি বই উদ্ধার হয়েছে, সে কাফির হয়ে যাবে। কারণ, জি হা দকে সে ত্রাস ও আতঙ্কের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছে।’
মুহতারামের এ কথাটি ছিল একটি সরল ও সাধারণ মূলনীতি। এর যৌক্তিকতা ও তাৎপর্যও সুস্পষ্ট। যে ইল্লত (Cause) এর ভিত্তিতে তিনি এই মৌখিক ফাতওয়া প্রদান করেছেন, তাও যুক্তিযুক্ত ও সহজে বোধগম্য। শরিয়তে এ ধরনের অসংখ্য মূলনীতি বিবৃত হয়েছে। যেমন, ‘যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না, তারাই কাফির’। [আল-কুরআন] ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিলো, সে কাফির হয়ে গেল।’ [আল-হাদিস] ‘যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে কসম করবে, সে মুশরিক হয়ে যাবে।’ [আল-হাদিস] ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর শানে বসা শব্দ প্রয়োগ করবে, সে কাফির হয়ে যাবে।’ [হানাফি ফিকহ]
ফিকহের সাধারণ ছাত্রদেরও জানা থাকার কথা যে, তাকফিরের সাধারণ মূলনীতি ও ব্যক্তিবিশেষের ওপর সেই মূলনীতি প্রয়োগ করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ব্যক্তিবিশেষকে তাকফির করতে হলে এর জন্য অনেক শর্ত রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও। যার কারণে ‘ঈমান ভঙ্গের কারণ’ শীর্ষক আলোচনায় কোনো বিষয় উল্লেখ করার অর্থ এ নয় যে, তার ন্যূনতম অস্তিত্ব পাওয়া গেলেই পাইকারিভাবে নির্বিশেষে সবার ওপর কুফরের ফাতওয়া আরোপ করা হবে। ব্যক্তিবিশেষকে তাকফির করা শাস্ত্রজ্ঞ মুফতির কাজ; সাধারণ মূলনীতি জানা আম মানুষের কাজ নয়।
কিন্তু হেফাজতপন্থি আলিম মুফতি হারুন ইজহার সাহেবের উপরিউক্ত ফাতওয়া খণ্ডনার্থে চরমোনাইপন্থি আলিম মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ সাহেবের প্রতিষ্ঠান থেকে একটি ফাতওয়া প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমে আমরা সেই ফাতওয়াটির মৌলিক ভাষ্য দেখে নিই :
‘কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক কারও কাছে ইসলামি ও জঙ্গি বা জিহাদি বই পেলে এরই প্রেক্ষিতে যদি “জি হা দি বই উদ্ধার” বাক্য বলেন, তাকে কাফের বলার অবকাশ নেই। কারণ, এর দ্বারা সাধারণত শরিয়তের সুস্পষ্ট সিদ্ধ প্রমাণিত জি হা দকে অস্বীকার বা তাচ্ছিল্য করা উদ্দেশ্য হয় না; বরং তার উদ্দেশ্য হয় প্রান্তিকতার শিকার, বিপথগামী ও উস্কানিমূলক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী বোঝানো। হ্যাঁ, তবে যদি তার থেকে উক্ত বাক্যের মর্ম ও উদ্দেশ্য জানতে চাওয়া হলে প্রতি উত্তরে সে এর দ্বারা পবিত্র জি হা দে শরয়িকে অস্বীকার ও বিদ্রূপের কথাই স্বীকার করে এবং এমন বক্তব্য যে কুফরি তাও সে জানে ও বোঝে, তাহলে এমন বাক্য কুফরি বাক্যের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাকে কাফের বলার অবকাশ থাকবে। অতএব যেহেতু “জি হা দি বই উদ্ধার” বাক্যটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, তাই এর কারণে ওই মুফতি সাহেবের জন্য ব্যাপকভাবে কাফের বলা কোনোভাবেই বৈধ হয়নি। উল্লেখ্য, কাফের ফতোয়া প্রদান অত্যন্ত জটিল কঠিন শর্তসাপেক্ষ। কাফের হওয়ার সবগুলো শর্ত পাওয়া না গেলে কাফের বলা নিজেরই কুফরিকে টেনে আনার সমতুল্য।’
ফাতওয়ায় ব্যবহৃত বাংলাভাষার অসহায়ত্বের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখানে মোটাদাগে যে সমস্যাগুলো ঘটেছে, তা নিম্নরূপ :
১. সাধারণ মূলনীতি ও ব্যক্তিবিশেষের তাকফিরকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। মুফতি হারুন সাহেব বলেছিলেন সাধারণ মূলনীতি; কিন্তু চরমোনাইপন্থি মুফতি সাহেব এটাকে বানিয়ে দিলেন ব্যক্তিবিশেষের তাকফির। সাধারণ মূলনীতি বলার দ্বারাই যদি নিজের দিকে কুফরি টেনে আনা অপরিহার্য হয়, তাহলে তিনি উপরে উল্লেখিত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বর্ণিত সাধারণ মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে কী মন্তব্য করবেন? ফকিহগণের উল্লেখিত সাধারণ মূলনীতিগুলো দেখে তাদের ব্যাপারেও কি কুফরের আশঙ্কা করবেন?
২. কথকের কথার অবাস্তব ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বিগত সময়গুলোতে যেসব বইকে ‘উদ্ধারকৃত জি হা দি বই’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেগুলো কোন কিসিমের বই, তা সারাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। চার দেয়ালের ভেতরে বসবাসকারী মুফতি সাহেবের কাছে এগুলোকে বিভিন্ন বাতিল সংগঠনের বই মনে হলেও তাওহিদি জনতা ঠিকই দেখেছে, দু-চারটা বাদ দিলে বাকি শতসহস্র বই কোন বিষয়ের ছিল। দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট বিষয়কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা কতটুকু সমীচীন? ব্যাখ্যা তো সেখানে করা যায়, যেখানে তার সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে।
৩. //ইসলামি ও জঙ্গি বা জি হা দি বই পেলে এরই প্রেক্ষিতে যদি “জি হা দি বই উদ্ধার” বাক্য বলেন, তাকে কাফের বলার অবকাশ নেই। কারণ, এর দ্বারা সাধারণত শরিয়তের সুস্পষ্ট সিদ্ধ প্রমাণিত জি হা দকে অস্বীকার বা তাচ্ছিল্য করা উদ্দেশ্য হয় না; বরং তার উদ্দেশ্য হয় প্রান্তিকতার শিকার, বিপথগামী ও উস্কানিমূলক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী বোঝানো।//
এখানে চরমোনাইপন্থি মুফতি সাহেবের প্রথম বাক্য এবং পরবর্তী বাক্যগুলোই তো সুস্পষ্ট বিরোধপূর্ণ। প্রথমে তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, ইসলামি ও জঙ্গি বা জি হা দি বই পেয়ে এর প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছে। এরপর ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে বললেন, এর দ্বারা ব্যক্তিকে কোনো সংগঠনের কর্মী বোঝানো উদ্দেশ্য। আচ্ছা, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি যদি কোনো সংগঠনের কর্মীও হয়, এর দ্বারা তার ইবাদতগুলো কি অপরাধ বলে পরিগণিত হবে? তাহলে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতবিষয়ক বইগুলোও কেন সামনে হাজির করা হয় না? (যদিও আজকাল নিরেট হাদিসের কিতাবকেও জি হা দি বই বলে চালিয়ে দিতে দেখা যায়) সেই ব্যক্তি যদি অপরাধীও হয়, তাই বলে কি জি হা দকে ত্রাস ও আতঙ্কের বিষয় হিসেবে দেখানো বৈধ হয়ে যাবে? আজকাল সর্বত্র তো জি হা দ বিষয়ক বই থাকাই পাপ। হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করলে হিন্দুও তো জি হা দ অস্বীকারের কথা বলে না। কিন্তু তারা এর যে ব্যাখ্যা দেয়, তা তো সুন্নাহসম্মত ব্যাখ্যা নয়; বরং বিকৃত ব্যাখ্যা। বিকৃত ব্যাখ্যার দ্বারা পাড় পাওয়া গেলে বেচারা কাদিয়ানিদের কী দোষ ছিল? হেযবুত তাওহীদেরই বা কী দোষ? তারাও তো সরাসরি অস্বীকার করে না; বরং বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে।
৪. সাধারণ মূলনীতি বলার সময় ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে কেন? রাসুলুল্লাহ সা. কয়জন বেনামাজি বা গাইরুল্লাহর নামে কসমকারীকে জিজ্ঞেস করে সেই মূলনীতি বলেছিলেন? আপনারাও যে রাফেজি ও কাদিয়ানিদের পাইকারিভাবে তাকফির করেন, তাদের কয়জনকে ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করে নেন? আর একটা বাক্যকে কুফরি বাক্যের তালিকায় উল্লেখ করার জন্য যদি জিজ্ঞেস করে নিতে হয়, তাহলে আপনাদের ‘মালাবুদ্দা মিনহু’ থেকে শুরু করে বড় বড় ফিকহ-ফাতওয়ার গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ থাকা কুফরি বাক্যগুলোর ব্যাপারে কী বলবেন? আরেকটি ব্যাপার হলো, ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে তাওয়িল (ব্যাখ্যা) নামক প্রতিবন্ধক থাকার কারণে কি একটা বাক্যকে কুফরি বাক্য শিরোনামেই উল্লেখ করা যাবে না, নাকি বাক্যটি কুফরি হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর তাকফির প্রয়োগ করা হবে না? দুটো কিন্তু এক বিষয় নয়।
৫. একটি ফরজ বিধানকে আতঙ্ক ও ত্রাস হিসেবে উপস্থাপন করার পরও তাদের ওপর কুফরের ফাতওয়া প্রয়োগ করা যাবে না, কিন্তু কোনো ব্যক্তিবিশেষকে তাকফির না করে স্রেফ এ বিষয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা করার কারণে একজন বিদগ্ধ আলিমের ব্যাপারে আপনারা কুফরের আশঙ্কা করেন! সুবহানাল্লাহ, এ কেমন মূলনীতি আপনাদের? চরমোনাইপন্থি মুফতি সাহেব, আপনিই তো সেই ব্যক্তি, যিনি বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র নামক কুফরি মতবাদকে কুফর বলতে রাজি নন; কিন্তু শাইখুনা বাবুনগরি হাফি.-এর কাছে গিয়ে মাহমুদ গুনবি ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন যে, //গুনবি তো মুরতাদ হয়ে গেছে। কারণ, সে আকাবিরদের তাকফির করে। আর কাউকে কাফির বললে সে যদি কাফির না হয়, তাহলে তা তাকফিরকারীর দিকে ফেরে।//
গুনবি সারাজীবনে একটা তাকফিরের ফাতওয়াও দেয়নি। বেচারা শুধু কিছু ইহুদি-খ্রিষ্টানরচিত বাতিল মতবাদকে কুফরি মতবাদ বলে উল্লেখ করে। এর দ্বারা আপনি নিজের থেকে চেইন সাজিয়েছেন, //যেহেতু সে এগুলোকে কুফর বলে, তাহলে যারা এতে লিপ্ত হবে, তার দৃষ্টিতে নির্বিশেষে তারা সকলে কাফির। আর যেহেতু আদতে তারা সকলে কাফির নয়, এ কারণে গুনবি মুরতাদ।// হায় ফিকহ! হায় ফাতওয়া! স্বার্থান্বেষী ফাতওয়ার সামনে কমনসেন্সও যেন বিরল আনকা পাখি।
উপরের ফাতওয়া নিয়ে বললে আরও অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু আপাতত এর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। হসপিটালের বারান্দায় বসে সংক্ষেপে উপরের কথাগুলো লিখলাম। বস্তুত কারও ইলম হয় দীনের উপকারের জন্য আর কারও ইলম হয় বাতিলের মদদের জন্য। এসব ফাতওয়ার অসারতা সাধারণ তাওহিদি জনতার সামনেও দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট থাকার কথা। চরমোনাইপন্থি মুফতিগণ এই ফাতওয়ার পক্ষে যে তিনটা রেফারেন্স এনেছেন, তা যে কতটা কিম্ভূতকিমাকার, এটা নিয়ে না হয় আরেকদিন আলাপ করা যাবে।
শাইখ আলি হাসান উসামা হাফি.
শাইখ হাসপাতালে কারণ শাইখের ২য় সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে আজ। আলহামদুলিল্লাহ্।