আমাদের চিন্তার বর্তমান ধরণ-প্রকৃতি তৈরি করে দেয়া তিনটি বড় ঘটনা
মূলঃ ড. আসাদ জামান; ভাইস চ্যান্সেলর, পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স -PIDE।
(এই লেখাটি অনুবাদ করা হয়েছে ড. আসাদ জামানের ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত একটি সিরিজ লেখা Becoming a Great Teacher এর একটা পর্ব থেকে, যেটার মূল শিরোনাম হচ্ছে Three Mega-events which Shaped Our Thoughts. মূল লেখার লিংক নিচে দেয়া হয়েছে।)
এটা আমাদের খুব ভালোভাবেই জানা আছে যে, আমরা যেসব চিন্তা-চেতনা লালন করি তা গঠিত হয়েছে ইতিহাসের কাল-পরিক্রমায়। স্বেচ্ছাসম্মতি ছাড়া লাখ লাখ লোক হাজারখানেক লোক দ্বারা শাসিত হতে পারেনা। একজন মহান শিক্ষক হতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই প্রথমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা সৃষ্ট সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদেরকে অবশ্যই তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে হবে যেগুলো আমাদের বর্তমান পৃথিবীর মানুষদের চিন্তার ধরণ তৈরি করে দিয়েছে।
১. ইউরোপিয়ান বৈশ্বিক উপনিবেশিকরণ
এ্যাডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’এ বলেছেন-
বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই পৃথিবীর প্রায় ৮৫% সম্পদ ইউরোপিয়ানদের দখলে ছিলো। এর ফলে পাশ্চাত্য (বিজেতা এবং ঔপনিবেশিক), প্রাতীচ্য (পরাজিত এবং উপনিবেশ) এবং তাদের নিজেদের প্রতি অনুগত ধ্যানধারণা তৈরি হয়েছে।
২. ইউরোপিয়ানদের ধর্মহীন আধুনিকতায় রুপান্তর
ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারকদেরকে উস্কে দিয়েছিলো যার ফলে ধর্মীয় গোলযোগের সৃস্টি হয়েছিলো। এই আন্দোলনের মাধ্যমে চার্চের পতনের ফলে শাসন কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা জন-পরিসর থেকে ধর্মকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছে এবং ধর্মহীন, আধুনিক চিন্তাধারার সুচনা করেছে যা বর্তমান পৃথিবীতে রাজত্ব করছে।
৩. বাজার-ব্যবস্থার মহা-পরিবর্তন
শিল্পবিপ্লব বিশাল এক উদবৃত্ত-উতপাদনের সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। এই উদ্বৃত্ত ব্যবহার করার জন্য পুরাতন সমাজকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ পরিপূর্ণরুপে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হয়েছিলো। এই বাজার ব্যবস্থা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক-ক্ষমতা এবং মানুষের মন-মানসকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
মানুষের চিন্তা-চেতনার উপর এই তিনটি জিনিসের সবকটির বিশেষ প্রভাব আছে এবং সর্বাবস্থায় এগুলো ইসলামিক মুল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রথমত আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের নিজস্ব চিন্তাধারার উপর এই তিনটি ঘটনার প্রভাব স্বীকার করতে হবে এবং আমাদের মনে এদের দ্বারা সৃষ্ট দন্ধগুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ইউরোপিয়ানদের বিজয় এবং উপনিবেশিকরণের ফলাফল
এই বিজয় ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকদের মধ্যে একমাত্র নিজেদেরকেই শ্রেষ্ঠ মনে করার (White Supremacy) একটা প্রবণতা সৃষ্টি করেছে এবং উপনিবেশ প্রাতীচ্যে হীনমন্যতার (Inferiority Complex) ধারনা গভীরভাবে গেথে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য জাতির গণহত্যা, বিভিন্ন সভ্যতার পরিপূর্ণরুপে বিনাশ, লাখ লাখ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধকরণ এবং সারা দুনিয়ায় মানবজাতির সম্পদ চুরি ও শোষণসহ তাদের এই অমানবিক ও পাশবিক দখলদারিত্বের বৈধতা দেয়ার জন্য কিছু গালগল্প এবং ইউরোপ-কেন্দৃক ইতিহাস তৈরির প্রয়োজন হয়েছিলো।
আমাদের নিজেদের ভিতরে তৈরি হওয়া এই হীনমন্যতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রথমে আমাদের ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির (Islamic Worldview) পূনর্পাঠ প্রয়োজন। (দেখা দরকার, ইসলাম দুনিয়াকে কিভাবে দেখে। আমাদের ইসলামী শাসনকাল আর বর্তমান পুজিবাদী শাসনের মধে একটা তুলনামূলক পাঠ দরকার।) এই কাজের জন্য একটা প্রাথমিক জায়গা হচ্ছে সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভীর গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ‘ইসলামি সভ্যতার পতনে বিশ্ব কী হারালো’। এছাড়াও পরাজয় এবং অন্যদের শোষণের দ্বারা আমাদের হারানো আত্মবিশ্বাসের পুনরুদ্ধার এবং অন্যান্য দিকে প্রচুর কাজ করা প্রয়োজন। এর একটা হচ্ছে- ‘ইউরোপিয়ানদের ইতিহাসের চুরি’ সম্পর্কে জানা; কিভাবে ইউরোপিয়ানরা অন্যান্য সভ্যতার আবিষ্কারগুলো চুরি করে তাদের নিজের বলে চালিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে কোপার্নিকাসের কথা- যিনি কেবলই একজন অনুবাদক ছিলেন, আবিষ্কারক নয়।
ইউরোপিয়ানদের ধর্মহীন আধুনিকতায় রুপান্তর
এটা সম্পর্কে যে সুন্দর গল্পটা বলা হয় সেটা হচ্ছে; মানবেতিহাসে ইউরোপিয়ানরাই সর্বপ্রথম বিচারশক্তি (Rationality) প্রয়োগ করা শিখেছে। যার ফলে তারা তাদের উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যমে খ্রিস্টান ধর্মের কুসংস্কারগুলো প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে এবং সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনে বড় বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। গত তিন শতাব্দীকাল ধরে তাদের চিন্তা-চেতনা, কাজ এবং আবিস্কারের কারণ ছিলো তাদের অসাধারণ শক্তিক্ষমতা এবং গৌরব ।
এই গল্পটা আমাদের ইসলামী শিক্ষার সাথে শক্তিশালীভাবে সাংঘর্ষিক কিন্তু বর্তমান মুসলমানদের মাঝে এটা খুবই ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, কারণ পশ্চিমা যে শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সেটা এই গল্পে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।
ইসলামী শিক্ষার পূনর্পাঠের জন্য আমাদের এমন কিছু শব্দ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার যেগুলো প্রায়শয়ই ব্যবহার হয়ে থাকে এবং এই শব্দগুলোর যে অর্থ আমাদেরকে শেখানো হয়েছে সেটা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। যেমন, উন্নতির অর্থ হচ্ছে ‘বেশি বেশি সম্পদ উপার্জন করা’, এটা সঠিক শুধু তাদের জন্য যারা মনে করে নির্বিচারে পৃথিবীজুড়ে সম্পদ হরণ করাটাই উন্নতি। অন্যপক্ষে ইসলাম উন্নতি কে সংজ্ঞায়িত করে মানবিক চরিত্র এবং সক্ষমতার উন্নতি হিসেবে।
একইভাবে জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন হয় যেটা আমাদেরকে সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনে সাহায্য করে আর দখলদার ও উপনিবেশিক সভ্যতার প্রতি অনুগত মন-মানসিকতা তৈয়ার করে। ইসলামী জ্ঞান আমাদেরকে শেখায়- কিভাবে মানবজাতি সৃষ্টির সেরা হওয়ার জন্য তাদের সুপ্ত মেধাকে কাজে লাগানো শিখতে পারে।
পাশ্চাত্য সমৃদ্ধিকে সংজ্ঞায়ন করে সম্পদ এবং ক্ষমতার মালিক হওয়া হিসেবে, অন্যদিকে ইসলাম এটাকে সংজ্ঞায়িত করে মানুষের আচার-আচরণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা হিসেবে।
এই পশ্চিমা শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করা এবং ইসলামী শিক্ষার পূনর্পাঠের জন্য আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে- সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করা।
বাজার ব্যবস্থার মহা-পরিবর্তন
আমরা এখন একটা পিরামিডের চুড়ায় আছি। আমাদের চিন্তাচেতনা সেভাবেই গঠিত হয়, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে সেটা গঠন করে দেয়। পাশ্চাত্য থেকে আগত শিক্ষা আমরা বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নিই। ঈগলের মতো স্বাধীনভাবে উড়তে শিখতে আমাদের প্রথমে দেখা প্রয়োজন কোথা থেকে এই জ্ঞান আসছে। ঐ সমস্ত উপাদানগুলো কী কী যেগুলা ইউরোপিয়ানদের মন-মানসিকতা গঠন করে দিয়েছে এবং তাদেরকে এই ধরণের জ্ঞান সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করেছে যা আমরা আমাদের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি? কেন আমাদের মুসলিম পূর্বসুরীরা এই ধরণের জ্ঞান সৃষ্টি করেননি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য আমাদের বৈশ্বিক ইতিহাসের বড় বড় স্রোতগুলোর দিকে তাকাতে হবে যেগুলো মানবজাতির জীবন এবং চিন্তা-চেতনা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মূলে আছে ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লব, যেটা অতিরিক্ত এবং বিশাল এক উৎপাদন-সক্ষমতা তৈরি করেছে। ভিন্ন একটি সংস্কৃতির দ্বারা, ভিন্ন একটি সময়ে এবং ভিন্ন একটি জায়গায় এই সক্ষমতা তৈরি হয়েছে যার বিশেষ কোনো ফলাফল নেই- কারণ, এটা একটা আত্ম-সমৃদ্ধ সমাজে অনর্থক; আমরা এতো অতিরিক্ত জিনিসপত্র দিয়ে কি করবো যেগুলো আরেকটা অভাবী সমাজের প্রয়োজন? ইংল্যান্ডের এই অদ্ভুত ঘটনাবলীর ফলাফল হিসেবে উদীয়মান বাজার-ব্যবস্থা এমন একটা আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে যেটা পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে একটা আধুনিক বিশ্ব সৃষ্টি করেছে।
মূল লেখার লিংকঃ http://bit.ly/2MYG1Es