শাতিমে রাসূল এবং ফিকহে হানাফী – কিছু সরল কথা!!

খেলাফত ধ্বংস হওয়ার পর থেকে শাতেম ইস্যুতে মুসলমানদের রক্তক্ষরণের অধ্যায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘই হচ্ছে। কতক মর্দে মুজাহিদের জীবন উৎসর্গ করা কিছু আক্রমণ ছাড়া উম্মাহের শান্তনা খুঁজার আর কিছুই নেই।
(আল্লাহ রক্তক্ষরণের এই দীর্ঘ অধ্যায় দ্রুত শেষ করে মুসলিম উম্মাহকে দ্রুত তার পূর্বের অবস্থানে যাওয়ার তাওফিক দান করুক। আমীন। )

যখন শাতেম ইস্যু আসে তখনই কিছু ভাই বুঝে হোক, বা না বুঝে হোক, ফিকহে হানাফিকে ক্রিটিসাইস করেন। কেউ কেউ তো মূল মাযহাব না বুঝে পুরো মাযহাব নিয়ে হাসি-তামাশাও করে।
শাতেম ইস্যুতে অনৈক্য ভরা এই উম্মাহ কিছুটা হলেও ঐক্যের স্বাদ পায়। তাই সে সময়ে অন্তত কোনো পোষ্টে এইসব বিষয় নিয়ে কমেন্ট চালাচালিতে মন সায় দেয়না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কিছু বাড়াবাড়ি দেখার পর এই বিষয়ে ওলামায়ে আহনাফের অবস্থান নিয়ে লেখাটা জরুরি মনে হচ্ছে। তাই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা এখানে বলে রাখি।

১. শাতেম নিয়ে হানাফি মাজহাবের অবস্থান।

ক.
ইমাম কাজি আবু ইউসুফ রহ. বলেন,
قالَ أبُو يُوسُف: وأيُّما رَجُلٍ مُسْلِمٍ سَبَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ أوْ كَذَّبَهُ أوْ عابَهُ أوْ تَنْقُصُهُ؛ فَقَدْ كَفَرَ بِاللَّهِ وبانَتْ مِنهُ زَوْجَتُهُ؛ فَإنْ تابَ وإلا قُتِلَ. وكَذَلِكَ المَرْأةُ؛
কোনো মুসলমান যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয় বা তাঁর দোষ বর্ণনা করে অথবা তার সম্মানকে খাঁটো করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। এবার যদি সে তাওবা করে তাহলে তা কবুল হবে অন্যথায় তাকে হত্যা করে ফেলা হবে। এই বিধান নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে।- কিতাবুল খারাজ ১৯৯পৃ.।

খ.
ইমাম তাহাবী রহ. বলেন- যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিবে অথবা তাকে খাঁটো করে পেশ করবে এর দ্বারা সে মুরতাদ হয়ে যাবে। ……
ইমাম জাসসাস রহ. বলেন, এই কথা থেকে প্রমানিত হলো—রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিলে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়। -অর্থাৎ শাতেম আর মুরতাদের বিধান একই -।-শরহে মুখতাসারুত তাহাবী ৬/১৪১-১৪২, শায়খ সায়েদ বাকদাশ তাহকিককৃত নুসখা।

ফিকহে হানাফির অনেক নির্ভরযোগ্য কিছু কিতাবে যেমন ফাতওয়ায়ে বাজ্জাজিয়া, ফাতহুল কাদিরসহ অনেক কিতাবে আছে যে, শাতেমের তাওবা কবুল হবেনা। তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে। তবে এটা মুহাক্কীক ওলামায়ে আহনাফের মত নয়। এবং এই কথার উপর ফতোয়াও নয়।

২. শাতেমে রাসুলের দুইটি পয়েন্টে চারো মাজহাব একমত।
১- শাতেমে রাসুল ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
২- শাতেমের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

কিন্তু ইখতেলাফের জায়গা হলো—শাতেমে রাসুলকে হত্যার পূর্বে তার থেকে তাওবা চাওয়া হবে কি না? বা সে যদি নিজ থেকে তাওবা করে তাহলে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে যে, তার হত্যা বাতিল বলে গন্য হবে?

আয়িম্মায়ে আহনাফের ফতোয়া হলো—তার নিকট তাওবা তলব করা হবে অথবা সে যদি তাওবা করে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

ফিকহে মালেকী ও হাম্বলি মতনুযায়ী শাতেমের তাওবা কবুল হবেনা। তার থেকে তাওবা চাওয়াও হবেনা এবং সে নিজে তাওবা করলেও তা কবুল হবেনা। তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, তাকে হত্যা করতে হবে।
শাফেয়ী মাজহাবের ইমামদেরর থেকে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেলেও মাজহাবের ফতোয়া হলো— শাতেমের তাওবা গ্রহণযোগ্য হবে। সুতরাং তার থেকে তাওবা চেয়ে ইসলামে ফিরে আসতেও বলা হবে। এবং সে নিজে তাওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।

ইখতেলাফের মূল কারন কী?

আয়িম্মায়ে আহনাফ আর অন্যান্য ইমামদের মাঝে এই পয়েন্টে ইখিতেলাফের মূল কারণ হলো—‘হানাফি ওয়ালামায়ে কেরামের নিকট শাতেমের কোনো আলাদা বিধান নেই। এটা মূলত ইরতিদাদেরই একটি প্রকার। তাই মুরতাদের যে হুকুম,শাতেমেরও একই হুকুম। আর অন্য মাজহবের নিকট শাতেম হলো ‘হদ’র অন্তর্ভুক্ত তথা শরীয়ত শাতেমের জন্যে নির্দিষ্ট শাস্তি রেখেছে। আর যে বিষয়টি ‘হদ’-র অন্তর্ভুক্ত সেখানে তাওবা বা নতুন করে ইসলাম অথবা ইমামের পক্ষ থেকে কোনোরকম ক্ষমা করার অনুমতি নেই৷ যেমন যিনার শাস্তি। কোনো বিবাহিত নারী-পুরুষ থেকে যদি যিনা প্রমানিত হয় তাহলে শরীয়তের নির্দিষ্ট যে শাস্তি রয়েছে সেটাই দিতে হবে। তা কোনোভাবেই মাফ হবেনা। খলিফারও এখানে মাফ করার কোনো সুযোগ নেই বা উক্ত ব্যক্তি দিল থেকে যতই তাওবা করুক। এই হলো মূল বিষয়।

৩. হানাফি মাজহাবে কি শাতেম কে ছোট করে দেখা হয়েছে?

ক.
আপনি যদি হানাফি মাজহাবের ইরতিদাদের শাস্তি একটু গভির থেকে উপলব্ধি করেন; তাহলে ধরতে পারবেন যে, হানাফিদের নিকট ইরতিদাদটা মূলত ইসলামের সাথে একটি বিদ্রোহ সমতুল্য। আর বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড এটা ঠিক থাকলেও— এর প্রকার কি হবে তা ইসলাম মূলত খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধানের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু যে বিধানগুলোকে ইসলাম হদ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, সেখানে ইসলাম প্রদত্ত হত্যার যে নির্দিষ্ট প্রদ্ধতি তার বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর রিদ্দাহের ক্ষেত্রে আমির মৃত্যুদন্ডের কার্যকর যেভাবে করতে চায় সেভাবেই করতে পারবে। সুতরাং শাতেমদের হুকুমকে রিদ্দাহ সাব্যস্ত করাতে তাদের শাস্তিকে লঘু করা উদ্দেশ্য নয় বরং এখানে শাস্তিকে

ক্ষেত্র বিশেষ বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে, যাতে এই ধরনের অন্যায়ের শাস্তি এত বেশি করে দেওয়া যায় যে— কোনো মানুষ যেনো এই ধরনের অন্যায় করার কল্পনাও না করতে পারে।

খ.
মুতায়াখখিরিন ওলামায়ে আহনাফের অন্যতম হলেন ইবনে আবেদিন আশশামী রহ. (মৃত্যু ১২৫২)। তিনি শাতেম নিয়ে ‘তাম্বিহুল উলাতি ওয়াল হুক্কাম আলা আহকামি শাতিমি খাইরিল আনাম’ নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচানা করেন। রচনার মূল উদ্দেশ্য হলো— শাতেমের তাওবা কবুল হবে এবং তার থেকে তাওবা চাওয়া হবে এই মর্মে ওলামায়ে আহনাফের অবস্থা উল্লেখ করা। তিনি জোরালোভাবে তা উল্লেখ করে সর্বশেষ নিজের অবস্থান বর্ণনা করেন এভাবে,
قلت: المسلم ظاهر حاله أن السب إنما صدر منه غيط وحمق، وسبق لسان لا عن اعتقاد جازم، فإذا تاب وأناب وأسلم، بخلاف الكافر؛ فإن ظاهر حاله يدل على اعتقاد ما يقول، وأنه أراد الطعن في الدين، ولذلك قلنا فيما مر: إن المسلم أيضا إذا تكرر منه ذلك، وصار معروفا بهذا الاعتقاد داعيا إليه يقتل، ولا تقبل توبته وإسلامه، کالزنديق، فلا فرق ح بین المسلم والذمي، لأن كلا منهما إذا تكرر منه ذلك، وصار معروفا به دل ذلك على أنه يعتقد ما يقول، وعلى خبث باطته وظاهره وسعيه في الأرض بالفساد، وأن توبته إنما كانت تقية ليدفع بها عن نفسه القتل،

অর্থাৎ, একজন মুসলমের বাহ্যিক অবস্থা তো এটাই যে, তার থেকে যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে কোনো অযাচিত বক্তব্য প্রকাশ পাবে তা হয়তো তার ভুলে বা নির্বুদ্ধিতা অথবা মুখ ফসকে বের হয়েছে। সে দৃঢ়ভাবে সেগুলো বিশ্বাস করে এমন নয়।
তবে যদি কোনো মুসলিম থেকে তা বারবার প্রকাশ পায় এবং সেটা তার বিশ্বাসের অংশ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় যে, সে এইগুলোর দাওয়াত দিয়ে বেড়ায় তাহলে তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে। তার ইসলাম এবং তাওবা কোনোটাই কবুল করা হবেনা। যদি সে তাওবা করে তাহলে তার তাওবাকে মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্যে তাকিয়া ধরা হবে।-রাসায়েলে ইবনে আবেদিন ১/৫৪৪। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ ২০১৪।

৪. মুরতাদের শাস্তি কে দিবে?

এক.

‘মুরতাদ হয়ে যাওয়ার পর নিয়ম হলো— খলিফা বা তার নায়েব মুরতাদ ব্যক্তির নিকট ইসলাম দ্বিতীয়বার পেশ করবেন। যদি ইসলাম নিয়ে তার কোনো সংশয়ের কারণে সে ধর্ম ত্যাগ করে থাকে তাহলে তা দূর করা হবে৷ অথবা মুরতাদ ব্যাক্তি নিজে যদি সময় চায় বা খলিফা অথবা আমির তার ইসলাম কবুলের ব্যাপারে আশাবাদী হয় তাহলে তাকে তিনদিন সময় দেওয়া হবে। আর যদি মুরতাদ ব্যক্তির নিকট ইসলাম পেশ করার পরও সে তা কবুল না করে তাহলে তাকে সেখানেই সাথে সাথে হত্যা করে ফেলা হবে।’

ফিকহে হানাফির কিতাবে এটাই হলো মোটামুটি মুরাতাদের সাথে করনীয়। এবং ইসলামী রাষ্ট্রে মুরতাদের বিধিবিধান বাস্তবায়নের দায়িত্বও খলিফা এবং তার নায়েবেরই৷

কিন্তু এখানে একটি হলো— মুরতাদকে খলিফা বা কাজির দরবারে পেশ করার আগেই যদি কেউ হত্যা করে ফেলে , তাহলে সে অনুমতি আছে কি না? বা কেউ এই কাজ করে ফেললে ঐব্যক্তিকে ইসলাম কি শাস্তি দিবে?

এই দুটো প্রশ্ন সমকালীন বিভিন্ন ঘটনার সাথে খুব বেশি আলোচিত হচ্ছে। তাই নিজেদের রাষ্ট্র চিন্তা আর বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা পেশ করার আগে ফুকাহায়ে কেরামের নিকট নিজেকে অর্পন করাই বেশি যুক্তিযুক্ত এবং নিজেকে ফুকাহাদের কাছে সোপর্দ করাটাই বেশী নিরাপদ। সে হিসেবে এই বিষয়ে ফুকাহায়ে আহনাফ ও ওলামায়ে আহনাফের কিছু বক্তব্য আমরা এখানে পেশ করবো।

১. ইমাম তাহাবী রহ. (মৃত্যু৩২১ হি.) বলেন–
قال أصحابنا: لا يقتل المرتد حتى يستتاب، ومن قتله قبل أن يستتاب فقد أساء،
আমাদের ওলামায়ে আহনাফ বলেন- পূনরায় ইসলামের দিকে আহবান করা ছাড়া মুরতাদকে হত্যা করা হবেনা। তবে কেউ হত্যা করে ফেললে সে ভুল করেছে। কিন্তু তার উপর কোনো জরিমানা আসবেনা। (মুখতাছারু ইখতিলাফিল উলামা ৩/৫০১)

২. ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ আল-মাউসিলি রহ. (মৃত্যু ৬৮৩ হি.) বলেন-
فإن قتله أحد قبل العرض لا شيء عليه،
কেউ যদি মুরতাদকে ইসলাম পেশ করার পূর্বেই হত্যা করে ফেলে তাহলে তার উপর কোনো জরিমানা আসবেনা।

৩. এই কথার টিকায় সায়েদ বাকদাশ হাফিজাহুল্লাহ বলেন-
لأن عرض الإسلام عليه مستحب، وليس بواجب، ويكره ذلك،
“হত্যা করলে কোনো জরিমানা আসবেনা” এর কারণ হলো- মুরতাদকে দ্বিতীয়বার ইসলাম পেশ করা মুস্তাহাব। আবশ্যকিয় কোনো বিষয় নয়।তবে এই কাজটি মাকরুহ হবে।-আলমুখতার লিল ফাতাওয়া পৃ.৪৫৯। দারুল বাশায়ের , দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৫, সায়েদ বাকদশ তাহকিককৃত নুসখা

৪. ইমাম কুদুরী রহ .(মৃত্যু৪২৮হি.) বলেন—
فإن قتله قبل عرض الإسلام عليه كره له، ولاشيء على القاتل،
মুরাতদের নিকট দ্বিতীয়বার ইসলাম পেশ করার পূর্বেই তাকে হত্যা করে ফেলে কেউ তাহলে তা মাকরূহ হবে । তবে হত্যাকারীর উপর কোনো জরিমানা আসবেনা।

৫. এই কথার ঠিকায় শায়খ সলাহ আবুল হাজ্জ হাফিজাহুল্লাহ লেখেন- মাকরূহ হওয়ার কারণ হলো—সে একটি মুসতাহাব আমল ছেড়ে দিয়েছে।
‘হত্যাকারীর উপর কোনো জরিমানা আসবেনা’ তার কারণ হলো-কুফরের সাথে যখন বিদ্রোহো বিশেষণ যুক্ত হয় তখন ঐ ব্যক্তির রক্ত বৈধ হয়ে যায়।-বুগইয়াতুস সায়েল আলা খুলাসাতিত দালায়িল ৪/৩১৩, দারুল ফাতহ ,দ্বিতীয় মূদ্রণ ১৪৪০হি.

৬. ওবাইদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রহ.(মৃত্যু ৭৪৭ হি.) তার ‘শরহে বেকায়াহ’ গ্রন্থে লেখেন-
(قتله قبل العرض ترك ندب بلا ضمان) لأنه استحق القتل بالارتداد،
‘কেউ যদি মুরতাদকে দ্বিতীয়বার ইসলাম পেশ করার পূর্বে হত্যা করে ফেলে তাহলে সে একটি মুসতাহাব আমল ছেড়ে দিলো। তার উপর কোনো জরিমানা আসবেনা।’

৭. ইমাম আব্দুল হাই লাখনাবী রহ. (মৃত্যু) এই কথাটি ব্যাখ্যা করে বলেন-
(قتله) يعني لو قتل المرتد قبل عرض الاسلام عليه كان تاركا للامر المستحب مرتكبا المكروه تنزيها، لأن العرض مستحب، لا واجب،
(بلا ضمان) يعني لا يجب على القتال ضمان دية ولا كفارة، لأنه قتل من هو مستحق بالقتل، فكان قتله مباحا، ولا شيء في ارتكاب المباح، غاية الأمر أنه ترك الأمر المندوب،
‘অর্থাৎ, মুরতাদকে ইসলাম পেশ করার পূর্বে হত্যা করে ফেললে একটি মুসতাহাব কাজ ছেড়ে দেওয়ার কারনে মাকরূহে তানজিহির গুনাহগার হবে। কারণ, মুরাতদাকে দ্বিতীয়বার ইসলাম পেশ করাটা মুসতাহাব। ওয়াজিব নয়।।………..
‘হত্যাকারীর উপর কোনো জরিমানা আসবেনা’ অর্থাৎ এই হত্যার কারনে হত্যাকারীকে কোনো রকম দিয়াত বা কাফফারা কিছুই দিতে হবেনা। কারণ সে এমন ব্যাক্তিকে হত্যা করেছে যে হত্যার উপযুক্ত ছিল। সেনুযায়ী সে একটি বৈধ কাজ করেছে। আর বৈধ কাজে কোনো জরিমানা আসেনা । সর্বোচ্চ এতটুকু বলা হবে সে সে একটি মুস্তাহাব আমল ছেড়ে দিয়েছে।-উমদাতুর রিয়ায়াহ ৪/৪৮০,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম মূদ্রণ ২০০৯

দুই.

এই ছিলো হানাফি ফকিহদের সংক্ষিপ্ত কিছু বক্তব্য। আমার অল্প জানা-শোনায় উপরের কথার ব্যক্তিক্রম কোনো হানাফি আলেম বলেননি। আর যদি বিপরীত বক্তব্য থাকেও তাহলে সেটা মাজহাবের গ্রহণযোগ্য কথা নয়।

এখন প্রশ্ন আসবে, তাহলে ইরতিদাদ প্রমানিত হলেই তাকে মেরে ফেলবে জনগন? ইসলামে কি রাষ্ট্রীয় কোনো বিচার নেই ? আর সে যদি সন্দেহ বশত মেরে ফেলে সেটার দায় কিভাবে হবে ?

প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো- এই কাজটা রাষ্ট্রই করবে। জনগন এতে কোনো দখল দিবেনা। এটাই ইসলামের বিধান । এবং মানুষকে ইসলাম এটাই শিক্ষা দেয়। আর রাষ্ট্রপক্ষ এই কাজ করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধ্য।
কিন্তু কোনো ব্যক্তি থেকে যদি স্পষ্ট ইরতিদাদ প্রমানিত হয় আর অপর কোনো মুসলিম দ্বীনী গাইরাত বা ইমানি চেতনা থেকে উক্ত মুরতাদকে হত্যা করে ফেলে তাহলে তাকে নিন্দা করা বা রাষ্টীয়ভাবে কোনো জরিমানা আরোপ করা হবেনা ।

তবে হাঁ, যদি উক্ত ব্যক্তিকে হত্যার পর তার ইরতেদাদ প্রমানিত না হয়, তাহলে ইসলাম হত্যার শাস্তির যে প্রকারগুলো রেখেছে কাজি সাহেব সেগুলোর মধ্যে যেটা প্রমানিত হবে সে অনুযায়ী হত্যাকারীর ব্যাপারে ফায়সালা দিয়ে দিবে।

জি, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য , মানুষকে ইমানি গাইরাত শিক্ষা দিবে। আবার পাশাপাশি এটাও সতর্ক করে দিবে যে, যদি জযবা সঠিকবভাবে প্রয়োগ না করো তাহলে ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জাহানেই তোমার জন্য রয়েছে শাস্তি।

তিন.

উপরের কথাগুলো থেকে আশা করি স্পষ্ট হয়েছে মুরতাদকে কি ধরনের শাস্তি দিতে হবে। কে শাস্তি দিবে ?

এখন কোথাও কোনো মুরতাদকে পেলেই হত্যা করে ফেলতে হবে কিনা,এভাবে চলতে দিলে তো সমাজে বিশ্রিংখলা সৃষ্টি হবে বা অনেকে এই সুযোগে অহেতুক হত্যা ফাসাদে লিপ্ত হবে। এই বিষয়ে রোধের জন্যে সর্বোচ্চ এটা করা যেতে পারে, যে এইধরনের কাজ এখন এই পরিবেশে না করাই উচিত। বা ইত্যাদি যেকোনো হিকমতনুযায়ী কথা বলে মানুষকে বুঝিয়ে বিরত রাখা যেতে পারে। কিন্তু কোনো মুসলিম ভাই ইমানি জযবা, গাইরাত বা আবেগ যেটাই বলা হোক কোনো মুরতাদকে হত্যা করে ফেললে, সেটাকে উগ্রবাদ বলা বা এই ধরনের কাজ ইসলাম সমর্থন করেনা, উক্ত ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা অথবা তার কাজকে অনৈসলামিক বলা এগুলোতো বক্তার অজ্ঞতা বা বিতরের ‘ছুপা মডারেট’ প্রকাশ পায়।আল্লাহ আমাদেরকে পূর্ণভাবে ফুকাহা কেরামের কাছে ইসলামকে সোপর্দ করার তাওফিক দান করুক। আমীন।

তথ্যসূত্র
১] কিতাবুল খিরাজ- ইমাম কাজি আবু ইউসুফ রহ.।

২] মুখতাছারু ইখতিলাফিল উলামা ৩/৫০১, দারুল বাশায়ের আল-ইসলামইয়া।

৩] শরহে মুখতাসারুত তাহাবী ৬/১৪১-১৪২, শায়খ সায়েদ বাকদাশ তাহকিককৃত নুসখা।

৪] আলমুখতার লিল ফাতাওয়া পৃ.৪৫৯। দারুল বাশায়ের , দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৫, সায়েদ বাকদশ তাহকিককৃত নুসখা।

৫] বুগইয়াতুস সায়েল আলা খুলাসাতিত দালায়িল ৪/৩১৩, দারুল ফাতহ ,দ্বিতীয় মূদ্রণ ১৪৪০হি.।

৬] রাসায়েলে ইবনে আবেদিন ১/৫৪৪। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ ২০১৪।

৭]উমদাতুর রিয়ায়াহ ৪/৪৮০,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম মূদ্রণ ২০০৯

শাতিমেরাসূলের শাস্তিকিছু সরল কথা!!

ইদানিং এবং দীর্ঘদিন যাবত শাতিমে রাসুলের শাস্তি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গালিদাতার শাস্তি) ইস্যু নিয়ে অনেক লেখালেখি সামনে এসেছে। অনেকেই সুন্দর কিছু লেখা আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন।এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে শাইখ Abdullah Bin Bashir হাফিজাহুল্লাহর আজকের লেখাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।হযরতের লেখাটি এক্ষেত্রে ফিকহে হানাফীর অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
তবে প্রায় সবগুলো লেখার ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে, মৌলিক কিছু বিষয় সবাই এড়িয়ে গিয়েছেন বা তাদের অজান্তেই বাদ পড়ে গেছে কিংবা এত অস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন যা বোঝা আমাদের মত সাতহিয়্যাতের অধিকারী (স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন) ব্যক্তিদের জন্য কঠিনই বটে!
এজন্য আমি অতি সংক্ষেপে এলোমেলোভাবে কিছু মৌলিক পয়েন্ট উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।আল্লাহ তা’আলা সবাইকে বোঝার তাওফিক দান করুন আমিন।

১। শাতিমে রাসুলের ক্ষেত্রে আমাদের ফুক্বাহায়ে কেরাম যে সকল বক্তব্য উল্লেখ করেছেন বিশেষ করে হানাফী এবং শাফেয়ীগণ,তাদের বক্তব্য মূলত তাদের সময়ের বিশেষ প্রেক্ষাপট ও অবস্থার ভিত্তিতে বলা হয়েছে। তাদের সময় ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো।ইসলামী খেলাফতের অধীনে তারা এই মাসআলাগুলো বর্ণনা করেছেন।তাই সেই যুগের সাথে -বর্তমান যুগ যখন কিনা খেলাফত ব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে বিদায় নিয়েছে, খেলাফতের স্থলে কুফরি গণতন্ত্র সারা বিশ্বকে গ্রাস করে রেখেছে,-এই যুগের সাথে মিলানো ও খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা ফিকহের ক্ষেত্রে খুব একটা দূরদর্শিতা বলে মনে হয় না।এমনকি খেলাফত ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও খলিফাগণ যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিধি-বিধান বাস্তবায়নে সামান্য কোতাহী বা দুর্বলতা প্রকাশ করতেন তবে সেক্ষেত্রেও সমকালীন ফকীহগণ অনেক বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীহগণের মতকে গ্রহণ না করে তা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।যেমন ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের মাসাআলায় সাহিবাইনের (ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মূহাম্মাদের) মতকে প্রাধান্য দিয়ে ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লার মতকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ যে সময়ে (দারুল হরব হওয়ার জন্য) এই শর্তগুলো আরোপ করেছিলেন তখন ইসলামী খলিফাগণ পরিপূর্ণরূপে জি’হা’দে মশগুল থাকতেন। কিন্তু বর্তমান যুগের (ইমাম জাসসাসের সময়ের) খলিফাগণ জি’হা’দকে মৃত বানিয়ে ছেড়েছে। এজন্য বর্তমান যুগে (৩৫০ হিজরীর দিকে) আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ জীবিত থাকলে এই শর্তগুলো আরোপ না করে কারামিতাদের (এক যিন্দিক ফিরকা) রাষ্ট্রগুলোকে দারুল হরব ঘোষণা করতেন!! সুতরাং ফিকহের মাসআলার সাথে সাথে উভয় যুগের পার্থক্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

২।ফুক্বাহায়ে কিরাম শাতিমে রাসুলের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রপ্রধানের কথা বলেছেন তা খেলাফত ব্যবস্থায় হদ আকারে (صبرا) প্রয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে কোথাও হদ প্রয়োগের ব্যবস্থা নেই। তাই সেই মাসআলার সাথে বর্তমান যুগে শাতিমদেরকে হ’ত্যা করার বিষয়টি মিলানো সঠিক নয়। বরং বর্তমানে যে শাতিমদেরকে ক’তল করা হচ্ছে তা কি’তা’লের ভিত্তিতে।আর কি’তা’লের ক্ষেত্রে হদের শর্তগুলো প্রয়োগ করা বা উল্লেখ করা বাস্তবসম্মত নয়!

৩। দারুল ইসলাম এবং দারুল হরবের মাসআলাগত এবং প্রয়োগগত পার্থক্যের কথাও অনেকে অস্পষ্ট রেখেছেন বা উল্লেখ করেননি!অথচ দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ!!দারুল হারবে যদি কোন মুরতাদ অবস্থান করে তাহলে সে মুরতাদ হওয়ার সাথে সাথে হারবী-তেও(হারবী কাফির হলো যার রক্তের কোন মূল্য নেই) পরিণত হয়ে যায়।আর হারবী ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য কোন খেলাফত রাষ্ট্র বা খলীফার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সেক্ষেত্রে কি’তালকারী (যোদ্ধা) একদল মুসলিমদের জামাতই যথেষ্ট!আর হত্যার পূর্বে তাওবা করানোর তো প্রশ্নই আসে না!

৪। হানাফি ফিকহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামকে গালিদাতা শাতিমকে হত্যা করার পূর্বে যে তওবা করানোর কথা বলা হয়েছে তা ব্যক্তিগতভাবে কোন ব্যক্তি যদি তাঁকে গালি দেয় এবং তা যদি মাত্র দুই একবার হয় এবং তা তার আদত বা অভ্যাসে পরিণত না হয় সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,যেমনটি ইবনে আবেদীন শামী রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে আমরা যে সকল শাতিমদেরকে চিনি তারা একক কোন ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং তারা একটা পুরো জামায়াত এবং গোষ্ঠী হিসেবে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়।সুতরাং তাদের এই কাজ শুধু ইরতিদাদ নয় বরং সুনিশ্চিতভাবে কোন সন্দেহ ব্যতীত ইফসাদ ফিল আরদ্ব তথা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং মুহারাবা লিদদীন তথা দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এখানে তাদেরকে হত্যা করার পূর্বে তাওবা করানোর কোন প্রশ্নই আসে না!

৫। সর্বোপরি বর্তমানে ‘শাতিমে রাসুল’রা নিঃসন্দেহে মুরতাদ হওয়ার পাশাপাশি দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত মুহারিব কাফির। তাদেরকে হত্যার জন্য কোনোরূপ শর্তারোপ করা সঠিক নয়।

এলোমেলো বিক্ষিপ্তভাবে সামান্য কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা হলো।আশা করি এতে বিষয়টি স্পষ্ট হবার কথা।আল্লাহু আ’লাম।

Related Post

One Reply to “শাতিমে রাসূল এবং ফিকহে হানাফী – কিছু সরল কথা!!”

  1. কুড়ানো মুক্তা (৮)
    [শাতিমে রাসূল ও ফকীহগণেরর হৃদয়ের আকুতি]
    ১. আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. (মৃত্যু ৮৫৫)
    মিশরে হাফেজ ইবনে হাজার আর আইনী রহ.- ইলমী মুকারানা ছিলো বেশ প্রসিদ্ধ। প্রত্যেকেই নিজ মাযহাবের মাসায়েলগুলোকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রমান করতেন।এই ব্যাপারে উভয়ে থাকতেন আপন আপন দলিলে মজবুত।
    কোনো জিম্মি যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি করে এবং মুসলমানদের কৃত চুক্তি ভঙ্গ হয় এমন কোনো অপরাধ তার থেকে প্রকাশ না পায় তাহলে ইমাম আবু হানিফার মত হলো—তাকে হত্যা করা হবেনা। কারণ সে এর থেকেও বড় কুফরিতে লিপ্ত। আল্লামা আইনী রহ. ইমাম আবু হানিফার এই বক্তব্যের যুক্তি এবং বিভিন্ন দলিল পেশ এবং অন্যদের দলিল এক স্থানে খণ্ডন করে আরেক স্থানে নিজের রাসুলের ইশক ইজহার করেন এভাবে,
    أقُول: هَذا بحثا، ولَكِن أنا مَعَه فِي جَواز قتل الساب مُطلقًا،(عمدة القاري ١٣: ٧١ باب رهن السلاح)
    এইখানে আরো আলোচনার জায়গা আছে। কিন্তু আমার মত হলো, শাতেম চাই মুসলিম হোক বা জিম্মী তাকে হত্যা কতে ফেলতে হবে। (উমদাতুল কারী ১৩/৭১)
    নোট.
    জিম্মী যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয় বা কটুক্তি করে এবং তার থেকে এটা বারবার না হয় এবং মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ হয় এমন কোনো কাজও তার থেকে প্রকাশ না পায় তাহলে হানাফি মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলো তাকে হত্যা করা হবেনা। কিন্তু রাষ্ট্র প্রধান চাইলে তাকে রাজনৈতিক কারণে হত্যা করতে পারেন।
    অথবা তাকে এই কারণে কট্টর শাস্তি দেওয়া হবে। আর এই শাস্তি দিতে গিয়ে যদি সে মারাও যায় তাহলে তার রক্তের কোনো মুল্য নেই। (দেখুন, তাম্বিহুল উলাত ওয়াল হুক্কাম-রাসায়েকে ইবনে আবেদিন।
    শাতেম জিম্মীর হত্যার বিষয়ে হানাফি মাযহাব নিয়ে আরো বিস্তারিত কথা আছে। ‘ফিকহি হানাফির আলোকে জিম্মী শাতেমের হত্যা’ শিরোনামে লেখবো ইনশাআল্লাহ)
    ২. আল্লামা ইবনে আবেদিন শামী রহ. (মৃত্যু ১২৫২হি.)
    হানাফীদের নিকট যদি তাওবা করে ফেলে ইসলাম গ্রহণ করে নেই তাহলে তার তাওবা কবুল হবে এই মর্মে এক দালালিক পুস্তিকা রচনা করেন ইবনে আবেদিন শামী রহ.। কিন্তু উনি পুস্তিকার শুরুটা করেন এভাবে—
    ولكن على حسب ما ظهر لي من النقول، والأدلة القوية أظهرت الانقياد، وتركت العصبية ، وملت إلى قبول توبته، وعدم قتله إن رجع إلى الإسلام، وإن كان لا يشفى صدري منه إلا إحراقه وقتله بالحسام، ولكن لا مجال للعقل بعد اتضاح النقل،
    সমস্ত আসাবিয়্যাত মুক্ত হয়ে শক্তিশালী দলিলের আলোকে আমার মত এটাই যে, শাতেম যদি তাওবা করে নেয় তাহলে তার তাওবা কবুল হবে এবং তাকে হত্যা করা হবেনা। তবে আমার অন্তরের আকুতি হলো—রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কটুক্তিকারীকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হোক বা ধারালো ছুড়ি দিয়ে কতলা করা হোক। কিন্তু দলিলের কাছে আকলের কোনো স্থান নেই।- রাসায়েলে ইবনে আবেদিন ১/৪৮২
    ৩. ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু ৭২৮হি.)
    أن تطهير الأرض من إظهار سب رسول الله ﷺ واجب حسب الإمكان لأنه من تمام ظهور دين الله وعلو كلمة الله وكون الدين كله لله فحيث ما ظهر سبه ولم ينتقم ممن فعل ذلك لم يكن الدين ظاهرا ولا كلمة الله عالية.
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে গালি দেওয়ার মত ঘৃণ্য কাজ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখা সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব। কেননা এটা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং তাঁর কালেমা সমুন্নত হওয়ার অংশ। সুতরাং যেখানে তাঁকে প্রকাশ্যে গালি দেয়া সত্ত্বেও গালিদাতাকে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয়া হলো না সেখানে আল্লাহর দীন বিজয়ী হলো না এবং তার কালিমা বুলন্দ ও সমুন্নত হলো না।-আসসারিমুলল মাসলূল, পৃ. ২৯৮।
    ৪. ইমাম সুবকী রহ. (মৃত্যু ৭৫৬হি.)
    ক.
    সুবকি রহ. বলেন,
    وليس لي قدرة أن أنتقم بيدي من هذا الساب المعلون، والله يعلم أن قلبي كاره/منكر، ولكن لا يكفي الإنكار بالقلب هاهنا، فأجاهد بما أقدر عليه من اللسان والقلم، وأسأل الله عدم المؤاخذة بما تقصر يدي عنه.
    ‘আমার এই সামর্থ্য নেই যে, আমি হাত দিয়ে এই অভিশপ্ত গালিদাতা থেকে প্রতিশোধ নিব। তবে আল্লাহ তো জানেন- আমার মনের অবস্থা কী! তবে এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে শুধু অন্তরের প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। (মুসলিম হিসেবে) আমার কর্তব্য হল, আমি সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের যবান ও কলম দ্বারা তার বিরুদ্ধে জিহাদ করব। আর আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করবো- তিনি যেন আমার এ অক্ষমতাকে ক্ষমা করে দেন।’ -আসসাইফুল মাসলূল, পৃ. ১১৪।
    খ.
    শাতেম খাটি মনে তাওবা করলে তাওবা কবুল হবে’ এই মর্মে বিভিন্ন দলিল পেশ করার পর সুবকী রহ. নিজের আশংকা পেশ করেন এভাবে—
    وإن اخترنا أن من أسلم وحسن إسلامه تقبل توبته ويسقط قتله فذلك على سبيل الفرض إن وجد، وهو أمر ممكن فيما يظهر، فمن وجد ذلك وعلم الله منه هذا، فهذا حكمه، وهو ناج في الآخرة، ولكنا نخاف على من يصدر ذلك منه خاتمة السوء، نسأل الله العافية، فإن التعرض لجناب النبي ﷺ عظيم، وغيرة الله له شديدة، وحمايته بالغة، فنخاف على من يقع فيه بسب أو عيب أو تنقيص أو أمر ما أن يخذله الله تعالى فلا يرجع له إيمانه ولا يوفقه لهداية. ولهذا جرت العادة في الحصون والقلاع أنهم متى تعرضوا لذلك هلكوا، وكثير ممن رأيناه وسمعنا به تعرض لشيء من ذلك – وإن نجا من القتل في الدنيا – بلغنا عنهم خاتمة ردية نسأل الله السلامة،
    ‘যদি আমি এই মতটি গ্রহণ করেছি যে, শাতেম যদি সঠিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তার তাওবা কবুল হবে এবং তাকে হত্যা করা হবেনা। কিন্তু আমার আশংকা হয়, যে সমস্ত মানুষ থেকে এইধরনের কিছু প্রকাশ পায় তাদের মৃত্যু ইমানের সাথে হয়না। কেননা রাসূলুল্লাহর শানে গোস্তাখির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর!
    আর রাসুলুল্লাহর মর্যাদার ব্যাপারে আল্লাহর প্রতিশোধ প্রবণতা অত্যন্ত কঠোর এবং এক্ষেত্রে তার সংরক্ষণ ব্যবস্থাও অতিসুসংহত!
    সুতরাং আমার তীব্র আশংকা হলো, যে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে গালি দিবে অথবা তার কোনো দোষ ত্রুটি বের করবে অথবা কোনোভাবে তাকে খাটো করার চেষ্টা করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঞ্চিত করে ছাড়বেন। তার ইমান গ্রহণ করবেননা এবং তাকে সঠিক পথও দেখাবেননা। এই জন্যেই দেখা যায় কোনো রাষ্ট্র বা কোনো দুর্গে যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি করা হয় তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
    আমার এমন অনেক দেখেছি এবং শুনেছি কেউ রাসুলের শানে কোনো কটুক্তি করার পর তাওবা করেছে এবং দুনিয়ায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে কিন্তু তার মৃত্যু খুব ভালোভাবে হয়নি। হয়তো ইমান হারা হয়ে মরেছে বা লাঞ্চিত হয়ে দুনিয়া থেকে গিয়েছে’। -আসসাইফুল মাসলুল আলা মান সাব্বার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃ.২১৩।
    বি.দ্র.
    শাতেম ইস্যুতে হানাফি মাযহাবের অবস্থান এবং কেউ যদি দায়িত্ববোধ বা ইমানি জযবায় কোনো শাতেমকে হত্যা করে ফেলে তাহলে তার কী বিধান, সেই সম্পর্কে জানতে লিংকের লেখাটি পড়তে পারেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *