শায়খ শরীফ হাতেম আল আউনী হাফি. এর সালাফিয়াত থেকে ফিরে আসার রহস্য কথা

শায়খ শরীফ হাতেম আল আউনী হাফি. এর সালাফিয়াত থেকে ফিরে আসার রহস্য কথা‌‌=
অমুক শায়খ বা অমুক ব্যক্তি সালাফিয়াত থেকে ফিরে এসেছেন কথাটা প্রায়ই চাউর হয়। কিন্তু সালাফিয়াত থেকে ফিরে আসার মর্মটা কী? এটা ক্লিয়ার হওয়া ছাড়া ফিরে আসার ব্যাপারটা একটা ভেগ ওয়ার্ড ছাড়া কিছু না৷
সালাফিয়াতের ‘কী পয়েন্ট’ কী যার ভিত্তিতে এই চিন্তাটি গড়ে উঠেছে?
এই বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা দরকার। সালাফিয়াত শব্দটার ব্যবহার বলা হয় প্রথম করেছেন, শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু। যিনি আমাদের হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. এর সমকালীন ছিলেন।
ইনফ্যাক্ট সালাফিয়াতকে তার ‘কী পয়েন্ট’ দিয়ে ডিফাইন করতে গেলে বলতে হবে, সালাফিয়াত হলো, সালাফ বা অনেক পূর্বে বিগত পূর্বসূরীদের অনুসরণের শ্লোগান সামনে রেখে ট্র্যাডিশনকে ছুড়ে ফেলা। এই পন্থার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সালাফকে ইন্টারপ্রেট করতে গিয়ে আপনি স্বাধীনতা ভোগ করবেন। মাযহাবী, মাসলাকী সীমাবদ্ধতা আপনাকে আটকে রাখতে পারবে না। (যদিও ট্র্যাডিশনে আটকে না থাকার সুখানুভুতিটাও কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ইন্টারপ্রেটেশনে গিয়ে আবার আবার আটকে যায়। সেটা ভিন্ন টপিক। ট্র্যাডিশন থেকে মুক্তি মেলে এটাই মূল কথা।)
এই ডেফিনিশন এতটাই ধ্রুব সত্য যে, যে কেউ সালাফিয়াত মন্থন করলে এই সমাধানে পৌঁছতে বাধ্য হবে। যার ফলে পরিস্কার দেখবেন যে, শায়খ নজদী রহ. থেকে শুরু করে নিকটতমকালের শায়খ বিন বায, বিন উসাইমিন রহ. নিজেদের হাম্বলী সম্বন্ধ ধরে রাখলেও মাসআলা গবেষণায় হাম্বলী ফিকহের ট্র্যাডিশনে একেবারেই দায়বদ্ধ ছিলেন না। সম্পূর্ণ নতুন ও নিজস্ব আঙ্গিকেই তারা মাসআলা গবেষণা করতেন৷ ফলে অসংখ্য মাসআলায় তাঁরা ব্যক্তিগত মত রাখতেন৷ তাকলীদ বিষয়টাকে তারা একটু ভিন্ন নজরে দেখতেন। অনেকটা ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. এর তাকলীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের পরম্পরা বলা যায়। (বাস্তবে ইবনু তাইমিয়া রহ.ও হাম্বলী ফিকহের দায়বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন)
সুতরাং সালাফিয়াতের সাথে মাযহাব, পরম্পরা ও চলে আসা বিষয়গুলোর উপরে উঠে পাখির চোখে নতুন করে দলীলগুলো বিবেচনায় নেওয়ার সম্পর্ক একেবারে গোড়ার ও মৌলিক।
শায়খ শরীফ হাতিম এক কালে তাঁর কিতাব ইজমাউল মুহাদ্দিসীনে লিখেছিলেন, সালাফী মানহাজে লেখা হয়েছে এই কিতাব। পূর্ণাঙ্গ সালাফী ছাড়া কেউ যেন এই কিতাব না পড়ে৷ মুকাল্লিদদের এই কিতাব পড়ার অধিকার নেই।
উলুমুল হাদীস নিয়ে যা লিখেছেন আর যে সকল মত প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে তাঁর এই সালাফিয়াত পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছিল। ফলে তিনি উলুমুল হাদীসের প্রথম যুগের মুহাদ্দিসীনদের অনুসরণের দাবী তুলে মাঝখানের দীর্ঘ কালের পরম্পরাগত মত থেকে সাঁৎ করে বেরিয়ে যেতে কার্পন্য করেননি। ফলে তিনি ইজমাউল মুহাদ্দিসীন নামে কিতাব লিখে হাদীসে মুআনআন নিয়ে প্রসিদ্ধ ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. এর মতবিরোধকেই অস্বীকার করে বসলেন। বললেন, ইমাম মুসলিমের মাযহাবের উপর রয়েছে ইজমা।
হাদীসে মুরসালের ক্ষেত্রে পরম্পরাগত মত যে, হাদীসে মুরসাল নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে এই মতটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি দাবী করলেন, হাদীসে মুরসাল সর্বসম্মতিক্রমে জয়ীফ। এখানে ইজমার দাবী করলেন।
এদিকে ইরসালে খফী এবং তাদলীস দুটোর মধ্যে পরম্পরাগত মতগুলোর বাইরে গিয়ে তারাদুফ ও সমার্থকতার দাবী করলেন। আল মানহাজুল মুকতারাহ কিতাবে তাঁর অভ্যন্তরে বয়ে চলা সালাফিয়াতের তীব্র ঝড় উন্মত্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই কিতাব পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মধ্যে প্রথম যুগের মুহাদ্দিসীনদের মানহাজ অনুসরণের শ্লোগানের ভেতর দিয়ে পরবর্তীতে দীর্ঘকালীন পরম্পরাগত মতগুলোকে উপেক্ষা করার একটি তীব্র সাহস তৈরি হয়ে যায়।
বস্তুত শায়খ শরীফের উলুমুল হাদীস চর্চার দীর্ঘ সময় জুড়ে ছেয়ে আছে শায়খ আলবানীর ক্যাসেট। যেগুলো তিনি নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুনতেন। সেগুলোর প্রভাব তার ভিতরে হাদীস শাস্ত্রের ভেতরে পরম্পরা ও তাকালিদকে ছুড়ে ফেলার অদম্য তাড়না জাগিয়ে তুলেছিল।
সালাফিয়াতকে এই অদম্য ও প্রবলভাবে লালনকারী শায়খ শরীফ সালাফিয়াতকে ছেড়ে উদার হয়ে গেছেন বলে চাউর করা হলো। আসলে কি তিনি সালাফিয়াত ছেড়েছেন? আসলে কি তিনি সালাফিয়াতে ‘কী পয়েন্ট’ মূল চিন্তাপদ্ধতি থেকে বিন্দুমাত্র সরেছেন?
এক বিন্দুও না। তিনি মূলত ভার্সন পাল্টেছেন। তিনি চিন্তাপদ্ধিতির ক্ষেত্রে ঠিক সেই জায়গাটিতেই আছে। সালাফে কদীমকে অনুসরণের শ্লোগান সামনে রেখে মাঝখানের সিলসিলাগত পরম্পরা ও ফাহমে মুতাওয়ারাসকে উপেক্ষা করার মূল কী পয়েন্টে বিন্দুমাত্র বদল আনেননি। বদলটা শুধু এসেছে, আগের সালাফিয়াত ছিল সালাফে কদীমের নুসুসের যাহেরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সালাফিয়ত। সেখানেও ফাহমে মুতাওয়ারাসের জায়গাটা উপেক্ষিতই ছিল। আর এখন হলো, সেই নুসুসগুলোর মাকাসিদ অনুযায়ী গবেষণার সালাফিয়াত। এই মাকাসিদ বোঝার ক্ষেত্রেও ফাহমে মুতাওয়ারাস ও পরস্পরাগত অবস্থান উপেক্ষিতই থাকে। আগেরটা জাহেরে নসে থাকার অান্দোলন। এখনের টা মাকাসিদুন নস অনুযায়ী গবেষণার আন্দোলন। মূল চিন্তাপদ্ধতির প্রধান মশলা ঠিকই থাকছে। যেমনটি শায়খ আবদুহুর পরিবর্তের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। শুরুতে প্রথম অর্থের সালাফিয়াত। পরে দ্বিতীয় অর্থের সালাফিয়াত।
চলমান যুগে প্রথমটিকে মানুষ সালাফিয়াত হিসেবে চেনে। দ্বিতীয়টিকে ওয়াসাতিয়্যাহ হিসেবে চেনে। এই সালাফিয়াত এবং ওয়াসাতিয়্যাহ উভয়টিরই প্রধান শর্ত হলো, চিন্তাকে তোমার শায়খ, তোমার সিলসিলা থেকে অবমুক্ত করতে হবে। এরপর তুমি স্বাধীনভাবে উড়তে পারবে। দুটোই মাযহাব থেকে মুক্ত। যদিও কেউ কেউ নামের মাযহাব ধরে রাখে। কাজে কিছুই থাকে না।
ওয়াসাতিয়্যাহর ধারার শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন শায়খ ত্বাহির ইবনে আশুর। যিনি তাঁর মাকাসিদুশ শরীয়াহ কিতাবে ট্র্যাডিশনাল উসুল থেকে বের হয়ে নুসুসের মাকাসিদ বের করে নিজস্ব চিন্তাপদ্ধতি অনুসরণের দাওয়াত দিয়েছিলেন। দাওয়াত দিয়েছিলেন, নিজের উস্তাদ ও সিলসিলার বাঁধন থেকে মুক্ত হবার। এই দাওয়াতের মাধ্যমে তিনি শাতেবী, গাজালী, জুয়াওনীর মাকাসেদ থেকে শতক্রোশ দুরে চলে গিয়েছেন।
এই বাঁধনমুক্তির ফলাফলই হলো, শায়খ শরীফ হাতিমের ফিকহী মতামতগুলো। যে মতামতগুলো ইন ফ্যাক্ট চারো মাযহাবের কোনো একটারও চিন্তা পদ্ধতি অনুসরণ করে না। ফলে তিনি এইকনক্লুশানগুলোতে বাই ডিফল্ট পৌঁছে গিয়েছেন,
-নারীদের চেহারা পর্দা নয়
-দাড়ি এক মুষ্টি রাখা জরুরী নয়
-মিউজিক বৈধ
-দারুল হরব দারুল ইসলাম টার্ম এখন কোনো প্রয়োজন নেই
এরকম আরো বহু মত। এই মতগুলো বাস্তবে তাঁর পূর্বের চিন্তাপদ্ধতির থেকে ভার্সনের ভিন্নতা ছাড়া অন্য কোনো ভিন্নতা রাখে না। ওয়াসাতী আলেমরা ঠিক শায়খ শরীফ হাতিমের কনক্লুশনগুলোতেই পৌঁছেছেন। যার গোড়াতেই বিদআত নিয়ে কঠোরতা থাকবে না। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে কঠোরতা থাকবে না। দাড়ি, টুপি, হিজাব, লেবাস নিয়ে কঠোরতা থাকবে না। এই সব মতামতগুলো আগে মাকাসিদ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে অতঃপর প্রত্যেকটাকে ‘খিলাফে মু’তাবার’ নামের একটা চমৎকার শিরোনামের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে।
অর্থাৎ এই ‘খিলাফে মু’তাবার’ শিরোনামটা ইজমাকে প্র্যক্টিক্যালী মূল্যহীন করার কাজে ব্যবহার হয়েছে। কারণ পৃথিবীতে এমন ইজমা দেখানো দুস্কর যার সাথে দুয়েকজনের ইখতিলাফ দেখানো যাবে না।
বাস্তব কথা হলো তা, যা থানভী রহ. চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, ইজমা সংগঠিত হওয়ার সময় কারো ভুল বোঝাবুঝি, কারো গ্রহণযোগ্য দলীলহীন বিচ্ছিন্ন অবস্থান ইজমার মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে না। বরং ইজমার মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে এমন মতবিরোধ যার পিছনে দলীল আছে। অন্য পক্ষ দলীলকে দুর্বল বললেও সঠিক হবার সম্ভাবনা আছে স্বীকার করেন। এমন ইখতিলাফকেই খিলাফে মু’তাবার বলা যায়। কিন্তু এই খিলাফে মু’তাবার শব্দটাকে দেদারসে ভুল ব্যবহার করে মাকাসেদি আলেমরা ইজমাকে অকার্যকর করে ফেলেছেন। যেমন মিউজিকের অবৈধতা নিয়ে কোনো খিলাফে মু’তাবার নেই। হ্যাঁ, কিছু জিনিস আছে যেমন, দফ বা এরকম সাউন্ড৷ সেগুলো ব্যবহার করে সামা’র নজীর আছে। সেখান থেকে সুফীদের মধ্যে একটি মত দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু সেই মত প্রচলিত সাধারণ মিউজিকের ক্ষেত্রে মোটেই নয়। বিস্তারিত কেউ দেখতে চাইলে মুফতী শফী রহ. এর ইসলাম আওর মুসীকী দ্রষ্টব্য। ওটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে এই সব অবান্তর দলীল ও চিন্তা বাতাসে ভেসে যাবে। স্পষ্ট হয়ে যাবে, শায়খ শরীফ হাতিম মোটেই সালাফিয়াত ত্যাগ করেননি। করেননি ইয়াসির কাজীও। যেমন করেননি শায়খ আবদুহু। শুধু ভার্সন পাল্টেছেন। যে ভার্সনের চেয়ে প্রথম ভার্সনটা দ্বীনী দিক থেকে তুলনামূলক নিরাপদ ছিল। সুতরাং কেউ এই দ্বিতীয় ভার্সনটাকে খুশিতে গদগদ হয়ে গ্রহণ করলে ভুল করেছেন। এর উপর থাকা যায় না। এলোমেলো বহু কথা বলে ফেললাম। আল্লাহ উপকারী করুন। সবাইকে সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটল রাখুন। আমীন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *