ফিতনা শব্দের যাচ্ছেতাই ব্যাখ্যা এই যুগের অন্যতম ভয়াবহ ফিতনা। কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বাণীতে বিবৃত হয়েছে ফিতনা শব্দটি। কোন জায়গায় এই শব্দের তাফসির-ব্যাখ্যা কী হবে, তা নির্ণীত হবে শাস্ত্রীয় নীতি অনুসারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যার যেভাবে ইচ্ছা, ফিতনা শব্দের ব্যাখ্যা করছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করছে।
সুরা বাকারাহ্র ২১৭ নম্বর আয়াতের সঙ্গে সবাই পরিচিত—
وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ
ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।
উক্ত আয়াতে ফিতনা দ্বারা কোন ফিতনা উদ্দেশ্য? মাদরাসার অভ্যন্তরীণ ফিতনা? সাদপন্থী বনাম শুরাপন্থীর মধ্যকার ফিতনা? দেওবন্দি ও জামাআতিদের মধ্যে চলমান ফিতনা? মাজহাবি ও লা মাজহাবিদের অন্তর্দ্বন্দীয় ফিতনা? মূলধারা ও মানহাজিদের ফিতনা? নাকি এর দ্বারা উদ্দেশ্য সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ? মাদক ও চোরাচালান? দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় আইনের লঙ্ঘন? এই যুগে মালউন কুফফারের বিরুদ্ধে কেউ আল-বারা’র প্রকাশ ঘটালেও একশ্রেণির মানুষ চেঁচিয়ে এই আয়াত শুনিয়ে দেয়। কিন্তু আসলে এর ব্যাখ্যা কী?
উক্ত আয়াতে ফিতনা শব্দ দ্বারা এর সবচে গুরুতর প্রকার ‘কুফর’ উদ্দেশ্য। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ, আবদুল্লাহ বিন আব্বাস ও মুজা-হিদসহ তাফসিরশাস্ত্রের অনেক ইমাম থেকে এই ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি এই ব্যাখ্যা গ্রহণের ব্যাপারে কোনো একজন ইমামও আপত্তি করেননি।
সুরা বাকারাহ্র ১৯৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ
তোমরা কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যাবত্ না ফিতনা নির্মূল হয়।
অধিকাংশ মানুষের নিকট যুদ্ধই হচ্ছে ফিতনা। তাহলে ফিতনা নির্মূল হওয়া অবধি যুদ্ধ অব্যাহত রাখার নির্দেশ কেন দেওয়া হলো? সহিহ বুখারিতে (হাদিস : ৪৬৫১) এসেছে, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ বিন উমর রা.-কে প্রশ্ন করল,
كَيْفَ تَرَى فِيْ قِتَالِ الْفِتْنَةِ
ফিতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তো ফিতনা নির্মূল হওয়া অবধি যুদ্ধ করতে বললেন। যুদ্ধ নিজেই তো ফিতনা। তাহলে এর দ্বারা কীভাবে ফিতনা নির্মূল হবে? তাদের এই প্রশ্নকে একেবারে অযৌক্তিক ভাবারও কারণ নেই। কারণ, সহিহ বুখারির হাদিসে (১০৩৬) কিয়ামতপূর্ব সময়ের ফিতনার বিবরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কতল (হত্যা) বৃদ্ধি পাবে। একজন আরেকজনকে হত্যা করলে সেটাকে বলা হয় কতল; আর দুই বাহিনী পরস্পর হত্যাযজ্ঞ ও খুনোখুনিতে মেতে উঠলে সেটাকে বলা হয় কিতাল (যুদ্ধ)। কতলই যদি ফিতনা হয়, তাহলে স্বভাবতই কিতাল তারচেও বড় ফিতনা হওয়া যুক্তির দাবি। আবদুল্লাহ বিন উমর রা. জবাবে বললেন,
وَهَلْ تَدْرِيْ مَا الْفِتْنَةُ كَانَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم يُقَاتِلُ الْمُشْرِكِيْنَ وَكَانَ الدُّخُوْلُ عَلَيْهِمْ فِتْنَةً وَلَيْسَ كَقِتَالِكُمْ عَلَى الْمُلْكِ.
তুমি কি জানো, ফিতনা কী জিনিস? রাসুলুল্লাহ ﷺ মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। মুশরিকদের ধর্ম গ্রহণই হচ্ছে ফিতনা। ফিতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ তোমাদের রাজত্বকে কেন্দ্র করে সংঘটিত যুদ্ধের মতো নয়।
অর্থাৎ, কুফর ও শিরক হচ্ছে ফিতনা। কুফর ও শিরকের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে মুমিনদের আমরণ যুদ্ধ চলবে, যাবত্ না ভূপৃষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণরূপে কুফর ও শিরক নিশ্চিহ্ন হবে। যেহেতু দাজ্জালকে হত্যা করা অবধি কুফর ও শিরক নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হবে না, তাই সে পর্যন্ত যুদ্ধও কখনো সমাপ্ত হবে না।
উপরিউক্ত আলোচনার দ্বারা প্রতিভাত হলো, কুফর হচ্ছে সবচে বড় ফিতনা। কুফর নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া কোনো ফিতনা নয়; বরং তা তো খোদায়ি নির্দেশ এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহ।
ফিতনার দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, ইসলামি বিধিবিধান এবং কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও নির্দেশনার হাকিকত (স্বরূপ) ও মর্মার্থ পালটে দেওয়া। পরিভাষা বিকৃত করা, তত্ত্ব ও মর্ম পরিবর্তন করা, এবং হক ও বাতিলকে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। এই ফিতনার ব্যাপারেও আল্লাহ কুরআনে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
لَقَدِ ابْتَغَوُا الْفِتْنَةَ مِنْ قَبْلُ وَقَلَّبُوا لَكَ الْأُمُورَ
ওরা তো ইতিপূর্বেও ফিতনা করতে চেয়েছে এবং তোমার জন্য বহু বিষয় পালটে দিয়েছে। [সুরা তাওবা : ৪৮]
নামধারী ধর্মীয় স্কলারদের হাত ধরেই এই ফিতনার অনুপ্রবেশ ঘটে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘আমি আমার উম্মাহর ব্যাপারে সবচে বেশি ভয় করছি বাকপটু মুনাফিকের’। এই ফিতনা যখন ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ তখন হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, শত্রু ও বন্ধুকে আলাদা করে চিনতে পারে না। সাহাবি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেছেন,
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ، وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ، وَيَتَّخِذُهَا النَّاسُ سُنَّةً، فَإِذَا غُيِّرَتْ قَالُوا: غُيِّرَتِ السُّنَّةُ “. قَالُوا: وَمَتَى ذَلِكَ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ؟ قَالَ: «إِذَا كَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ، وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ، وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ، وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ، وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الْآخِرَةِ، وَتُفُقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ»
সে সময় তোমাদের কেমন অবস্থা হবে, যখন বস্ত্রের মতো ফিতনা তোমাদের সঙ্গে মিশে যাবে; যে ফিতনার প্রভাবে বয়স্ক ব্যক্তি বুড়িয়ে যাবে, নবীনরাও দ্রুত বেড়ে উঠবে আর মানুষ ফিতনাকেই সুন্নাহ হিসেবে গ্রহণ করে বসবে। যখন সেই ফিতনার পরিবর্তন ঘটানো হবে, তখন লোকেরা বলবে, সুন্নাহকে পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। লোকেরা বলল, হে আবু আবদির রহমান, কখন এমনটা হবে? তিনি বললেন, যখন তোমাদের কারী বাড়বে আর ফকিহ কমবে; নেতা বাড়বে আর আমানতদার কমবে এবং আখিরাতের আমল করে দুনিয়া সন্ধান করা হবে আর দীন ব্যতিরেকে অন্য উদ্দেশ্যে ফিকহ (ধর্মীয় জ্ঞান) অর্জন করা হবে। [সুনানুদ দারিমি : ১৯১, ১৯২। হাদিসটি সহিহ।]
এই যুগে বিভিন্ন সময়ে উগ্রবাদী মুশরিকদের মুখেও জি হা দ শব্দ শুনতে পাবেন। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ শব্দটিকে যেই অর্থে ব্যবহার করেছে, তারা এর দ্বারা সেই অর্থ উদ্দেশ্য নেয় না। বরং তারা এই শব্দটিকে ভিন্ন অর্থে পরিচিত ও প্রচলিত করতে চায় আর এক্ষেত্রে একশ্রেণির ভণ্ড আলিমও পার্থিব লোভে পড়ে তাদের সঙ্গ দেয়। আমরা যদি ফিরআউনের জীবনীর দিকে তাকাই, তাহলে একই আদর্শ দেখতে পাই। ফিরআউন তার কুফরি দাওয়াত প্রচারের জন্য ঠিক সেই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছিল, যা দীনের দাওয়াত প্রচারের জন্য সকল নবি ব্যবহার করেন। কুরআনে এসেছে,
قَالَ فِرْعَوْنُ مَا أُرِيكُمْ إِلَّا مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلَّا سَبِيلَ الرَّشَادِ
ফিরআউন বলল, আমি যা সঠিক মনে করি, তোমাদেরকে তা-ই দেখাই। আর আমি তোমাদেরকে ‘সঠিক পথই প্রদর্শন করি’।
মুনাফিকরা সর্বদাই কুরআন-সুন্নাহর অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ও বাক্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে চায়। এর সাহায্যে শরিয়াহর বিধিবিধানের তত্ত্ব ও মর্ম বিকৃত করার অপচেষ্টা করে। তারা শাশ্বত ও অকাট্য আয়াত ও হাদিসগুলো সযত্নে এড়িয়ে যায়। মডারেট, মডার্নিস্ট, লিবারেল এবং র্যান্ড ও ইন্টারফেইথের চেতনা লালনকারী স্কলারদের এটা একটা কমন বৈশিষ্ট্য। অথচ আল্লাহ কুরআনে বলেন,
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ
তিনি সেই সত্তা, যিনি আপনার ওপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে অনেক দ্ব্যর্থহীন আয়াত। আর এগুলোই কিতাবের মূল অংশ। আর কিছু রয়েছে দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা কিতাবের দ্ব্যর্থবোধক অস্পষ্ট আয়াতগুলোর পেছনে পড়ে ফিতনা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এবং এর ব্যাখ্যা অনুসন্ধানে। [সুরা আলে ইমরান : ৭]
তবে এই ফিতনা সৃষ্টি করতে তারা তখনই সফল হয়, যখন মানুষের থেকে সহিহ ইলম হারিয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে অজ্ঞতার মহামারি বিস্তার লাভ করে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقْبَضَ الْعِلْمُ، وَتَكْثُرَ الزَّلاَزِلُ، وَيَتَقَارَبَ الزَّمَانُ، وَتَظْهَرَ الْفِتَنُ، وَيَكْثُرَ الْهَرْجُ ـ وَهْوَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ ـ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمُ الْمَالُ فَيَفِيضُ
কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। আর হারজ হলো হত্যা ও খুন। তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, তা উপচে পড়বে। [সহিহ বুখারি : ১০৩৬; সহিহ মুসলিম : ১৫৭]
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ ﷺ ফিতনা প্রকাশ হওয়াকে ইলম উঠিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে উল্লেখ করলেন। অর্থাৎ, যখন সহিহ ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, তখনই ফিতনা প্রকাশিত হতে শুরু করবে। ইলম উঠিয়ে নেওয়া কথাটা প্রকৃত অর্থেও হতে পারে; আবার এর রূপক অর্থ এটাও হতে পারে, ইলম থাকবে গ্রন্থের পাতায় এবং আলিমদের সিনায়। কিন্তু তা সমাজে প্রকাশিত থাকবে না। পেট, পিঠ বা পকেট যেকোনো দিকে তাকিয়ে আলিমরা তা জনসমক্ষে উপস্থাপন করবে না। ফলে ইলম থেকেও যেন নেই। একদলের কিতমান (গোপন করা) এবং আরেক দলের তাহরিফ (অপব্যাখ্যা)-এর প্রভাবে মানুষ সে সময় হককে মনে করবে বাতিল আর বাতিলকে মনে করবে হক। সহিহকে মনে করবে গলদ আর গলদকে মনে করবে সহিহ। সুন্নাহকে মনে করবে বিদআত আর বিদআতকে মনে করবে সুন্নাহ। যেমনটা আমরা বর্তমান সময়ে খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি।
- আলি হাসান উসামা